আমরা করবো জয়
করোনা আক্রান্ত এই ভয়ঙ্কর সময়ে খানিক স্মৃতিচারণ করা যাক
আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগের কথা। ১৯১৬ সালের জুলাই মাসে নিউইয়র্কে সরকারিভাবে পোলিও রোগকে মহামারি হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। ওই বছর সারা দেশে প্রায় সাতাশ হাজার লোক পোলিও আক্রান্ত হয় আর প্রায় ছয় হাজার লোকের মৃত্যু হয়। শুধু নিউইয়র্ক শহরেই মারা যায় আড়াই হাজার এর ওপরে, পঙ্গু হয় এক হাজারের মতো। এই রোগের তখন কোনো ওষুধ কিংবা প্রতিষেধক ছিল না, রোগের বিস্তার রোধই ছিল একমাত্র ভরসা। তাই স্বাস্থ্য দফতর মরিয়া হয়ে এ বিষয়ে নানাবিধ ব্যবস্থা নিতে থাকে। রোগাক্রান্ত লোকদের নাম ঠিকানা নিয়মিতভাবে পত্রিকায় প্রকাশ করা হতো, যাতে অন্যরা এই রোগীদের এড়িয়ে চলতে পারে। কুকুর বা বিড়াল এই রোগ ছড়াচ্ছে অনুমান করে নিউইয়র্ক শহরে এক নিদারুণ নিধনযজ্ঞ শুরু হয়। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, তখন বাহাত্তর হাজার বিড়াল আর আট হাজার কুকুরকে মেরে ফেলা হয় নিউইয়র্ক শহরে। মশা মারার জন্য শহরময় বিষাক্ত ডিডিটি বারবার ছড়ানো হয়। বাজার ঘাট, মুভি থিয়েটার, সভা সমাবেশ বন্ধ করে দেয়া হয়। আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ দলে দলে শহর ছাড়তে শুরু করলে শহরব্যাপী কোয়ারেন্টাইন ঘোষণা করা হয়। চিত্রটা যেন ঠিক এখনকার করোনা-আক্রান্ত নিউইয়র্ক শহরের মতোই।
কিন্তু মানুষ ঘুরে দাঁড়ায় ঠিকই। পোলিওর চিকিৎসার প্রয়োজনেই হার্ভার্ডের গবেষকরা আবিষ্কার করেন ‘আয়রন লাং’ নামের কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র যার পরিবর্তিত রূপ হচ্ছে জীবন রক্ষাকারী আধুনিক ভেন্টিলেটর। পোলিও আক্রান্ত রোগীদের অবশ হাত পা প্লাস্টার করে রাখা হতো দীর্ঘদিন, বেঁচে উঠলেও এতে রোগীদের দুর্দশা বেড়ে যেত অনেক গুণ। এই কষ্টের নিরাময়ে অষ্ট্রেলিয়ার সিস্টার কেনি প্লাস্টারের বদলে শুরু করেন মালিশ ও গরম পানির সেক—এভাবেই আধুনিক ফিজিও থেরাপির যাত্রা শুরু। এর পরের গবেষণায় আসে পোলিওর প্রতিষেধক টিকা। ফলশ্রুতিতে এখন দেখি—পোলিও প্রায় নির্মূল। ২০১৭ সালে সারা বিশ্বে মাত্র ২২ টি পোলিও রোগী চিহ্নিত হয় (তুলনা : ১৯৮৭ সালে ৩৫০,০০০ পোলিও রোগী)।
মানবজাতির সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পোলিওর মতো আরও বেশ কয়েকটি রোগের উচ্ছেদ সম্পন্ন হয়েছে উদাহরণ স্বরূপ বলা চলে আমেরিকা ও রাশিয়ার দুটি ল্যাবরেটরির হিমঘর ছাড়া—দুনিয়ার আর কোথাও জলবসন্তের ভাইরাসের অস্তিত্ব নেই। আমরা এখন স্বপ্ন দেখি, একসময় আরও অনেক ভাইরাসবাহী রোগের একই দশা হবে।
মানবজাতি যুগে যুগে মহামারির দুর্যোগ দেখেছে। প্লেগের মহামারিতে বিশ্বব্যাপী মৃত্যু হয় প্রায় আড়াই কোটি লোকের, ১৬৬৫-৬৬ সালে শুধু লন্ডন শহরেই সত্তর হাজার লোক মারা যায়। উনিশ শতকের তিনটি কলেরা মহামারিতে শুধু ভারতেই মারা যায়—প্রায় দেড় কোটি লোক। বিশ শতকের বসন্তের মহামারিতে বিশ্বব্যাপী মৃত্যু হয় প্রায় তিন কোটি মানুষের। স্প্যানিশ ফ্লুর মহামারিতে (১৯১৮) পৃথিবী জুড়ে মৃত্যু ঘটে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের।
এইভাবে একের পর এক মানবজাতির ওপর সঙ্কট এসেছে—বিসুভিয়াসের আতঙ্ক নিয়ে। কিন্তু ইতিহাসের শিক্ষা হলো, মানুষ নতজানু হয়নি, বরং বারবারই উঠে দাঁড়িয়েছে। আমার ক্ষণিক কর্মজীবনেই আমি এহেন সঙ্কট দেখেছি, আবার উত্তরণও দেখেছি। প্রতিটি সঙ্কটই মানুষকে শেখায়, উদ্দীপ্ত করে। এইডস-এর মহামারি আমার কাছে নিকট অতীতের উদাহরণ। উপাত্ত ঘাটলে বেরিয়ে আসে, শুধু আমেরিকাতেই প্রায় সাত লক্ষ লোক এইডস-এ মারা যায়। এইডস মহামারির উত্তুঙ্গু সময়ে আমি নিউইয়র্ক শহরের একটি বড় হাসপাতালে ক্রিটিকাল কেয়ার-এর ফেলোশিপ ট্রেনিং নিচ্ছিলাম। তখনো এইচআইভি ভাইরাসের যুতসই কার্যকরী ওষুধ বের হয়নি, একটি মাত্র ওষুধ ছিল—যা দাবানলে সামান্য জল ফেলার মতো। আমি দেখেছি ওয়ার্ড ভর্তি এইডসের রোগী, অপেক্ষাকৃত কম বয়সের রোগী, যাদের বেশির ভাগই হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরতো না। ডেথ-সার্টিফিকেট লিখতে লিখতে ক্লান্ত হয়ে পড়তাম। সারা দেশ জুড়ে হাহাকার, মনে হচ্ছিল—এই পাতালপুরী থেকে উদ্ধার পাওয়ার হয়তো কোনো সম্ভাবনা নেই। কিন্তু মানুষের অধ্যবসায়ের কল্যাণে এই সঙ্কটই আবার নতুন দিক নির্দেশনা নিয়ে আসে। সারা দেশের বিখ্যাত রিসার্চ সেন্টারগুলোতে গবেষণা শুরু হয়ে গেল—সরকারি-বেসরকারি প্রণোদনায়। আমার নিজের গবেষণার হাতেখড়িও ওই সময়। বৈরী সময়ের তীব্র-তীক্ষ্ণ প্রশিক্ষণই আমাকে পোক্ত করেছে আজকের নিবিড় চিকিৎসক হিসেবে। আমার ট্রেনিং শেষ হওয়ার বছর কয়েকের ভেতরেই দেখলাম নতুন নতুন ওষুধ আবিষ্কৃত হলো, ওষুধের ক্রিয়া পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার বিশদ বর্ণণা বেরিয়ে এলো এবং অবশেষে মোক্ষম কয়েকটি ওষুধের মিলিত প্রয়োগে রোগটিকে আয়ত্তে নিয়ে আসার কৌশল শেখা হয়ে গেলো। ফলস্বরূপ এইডস এখন আর মহামারি নয়। আমরা যা শিখলাম তা হলো, যতদিন না রোগের ওষুধ বের হয় ততদিন রোগ বিস্তারের পথটি বন্ধ করতে পারলেই মহামারি ঠেকানো সম্ভব, আর পরে যুতসই ওষুধ কিংবা ভেকসিন আবিষ্কার হলে রোগটিকে উচ্ছেদ করাও সম্ভব। আমার ধারণা, করোনার ক্ষেত্রেও এটাই ঘটবে।
সন্দেহ নেই, আমরা এখন এক মহাদুর্যোগ পার করছি। কিন্তু নিশ্চিত জানি, এই অমানিশার সমাপ্তি হবে। আমরা ঘুরে দাঁড়াবো, আগের চেয়ে আরও শক্তিমান হয়ে। মানুষের অনবদ্য এক গুণ তার বিশ্বাস না হারোনোর তাড়না। ভবিষ্যত প্রজন্ম এই নিয়ে বেঁচে থাকুক। আমরা যেমন পেছনে তাকিয়ে দেখি, তারাও এক সময় পেছন ফিরে দেখুক হতাশার বৈরী স্রোত ডিঙিয়ে—আমরা কীভাবে অবশেষে বেঁচে থাকার মন্ত্রটি রপ্ত করেছিলাম। শুধু রোগ বালাই থেকে রক্ষা পাওয়ার কৌশল নয়, তারা শিখুক মৃত্যুর মিছিলে ঠেলে দেয় এমন সব আচার-অনাচার থেকে মুক্ত হওয়ার কৌশল। আমাদের ভুলগুলো চিহ্নিত করুক। হিংসা, দ্বেষ ও যুদ্ধহীন পৃথিবীতে বেঁচে থাকুক স্বাস্থ্যবান বিশ্বনাগরিক হয়ে।