করোনাভাইরাস ও রিফিউজির ভাগ্য
আমরা সবাই ভয় পাচ্ছি, সাবধান হচ্ছি, আত্মীয়স্বজনকে ও দেশের জনগণকে সাবধান করছি এবং সর্বোপরি নিজের নিজের দেশের সরকারকে ধুয়ে দিচ্ছি যে, করোনাভাইরাস থেকে আমাদের রক্ষা করতে তেমন ব্যবস্থা তারা কেন নেয়নি? যেন আমরা একটা পরিবারের ছেলেমেয়ে, যারা বাপ মায়ের কাছে অনুযোগ করেই চলেছি। কিন্তু ভাবুন তো, যাদের ঐ বাপ মা বলে কেউ নেই? তারা কোথায় কার কাছে মুখ তুলে তাকাবে? জ্বি হ্যাঁ, আমি রিফিউজিদের কথা বলছি, যারা লোভী সাম্রাজ্যবাদিতার বলি হয়ে নিজের দেশে বা দেশ ছাড়া হয়ে ছিন্নমূলের মতো অন্যের দেশে ঘুরে ঘুরে ফিরছে বা ঢোকার চেষ্টা করছে। যারা রিফিউজি ক্যাম্পে বছরের পর বছর একটা ছোট্ট ঘিঞ্জি তাঁবুর মধ্যে কাচ্চা বাচ্চা নিয়ে ৭-৮ জন মাথা গুঁজে আছে। কিংবা যারা অহেতুক যুদ্ধের গোলাগুলিতে তাড়া খেয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে, অন্য দেশে আশ্রয় নেবার জন্য। কিন্তু দেশগুলি তাদের বর্ডার বন্ধ করে দিয়েছে যাতে নতুন রিফিউজি ঢুকে তাদের ঝামেলা আর বাড়াতে না পারে।
এখন যখন সব কিছুই অচল, মানুষের যাতায়াত, চলাফেরাও প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ বললেই চলে, দেশের ও বিশ্ব অর্থনীতি ধস নামা থেকে এখন প্রায় তলানিতে ঠেকতে বসেছে। কদিন পরে কে এসব মানুষদের খাওয়াবে, পরাবে এবং ঔষধপত্র ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে? এর মধ্যে পৃথিবীর কয়েকটি দেশের শক্তিশালী নেতারা বলেই দিয়েছে, বিশ্বমানবতা শব্দটি দ্রুত শূন্যের দিকে ধাইছে। আর রিফিউজিগুলো এখন কেবল বিরাট একটা সমস্যা ছাড়া আর কিছুই নয়। নিজেদের সমস্যা নিয়ে আমরা নিজেরাই এখন নাজেহাল। রিফিউজিদের এখন কে দেখবে? কিন্তু কথা হলো রিফিউজি বানালো কারা? সেখানকার মানুষদের সুখে থাকতে কি ভূতে কিলাচ্ছিল? তারা কি নাচতে নাচতে আবদার করে বলেছিল, আমাদের রিফিউজি করো গো?
এখন করোনাভাইরাসের জন্য সবাই যখন ত্রাহি মধুসূদন ডাক ছাড়া শুরু করেছে, তখন সবারই কেয়ামতের দিনের সেই পরিচিত ‘ইয়া নফসি, ইয়া নফসি’ মানে আমার কি হবে, আমার কি হবে অবস্থা, তখন স্বাভাবিকভাবেই, ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’ তিয়োরিটাই জাস্টিফায়েড মনে হবে। অর্থাৎ দেশগুলো তাদের নিজেদের নাগরিকদের বাঁচানোটা দায়িত্ব মনে করবে ও শরণার্থীদের দেখার ইচ্ছা, উদ্যোগ বা উপায় তেমন থাকবে না। এগুলি আবার বিশ্বের জনবহুল কিন্তু ধনী-নয় দেশগুলিতে বেশি পরিলক্ষিত হবে। আবার যারা যুদ্ধে বিধ্বস্ত বা আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে গেছে, সেই সব দেশের জন্যও পর্বত প্রমাণবাধা। কয়েকটা দেশের নাম করা যায় যাদের ঘনবসতিতে এই করোনাভাইরাস যদি আক্রমণ করে, তাহলে তাদের সামলানো প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে। যেমন ইরান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, গ্রীস। আরও খারাপ অবস্থা যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া, ইয়েমেন, ভেনেজুয়েলা যেখানে হাসপাতালগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং স্বাস্থ্য বিভাগেরও জীর্ণ-শীর্ণ অবস্থা। এদের মধ্যে প্রাদুর্ভাব হিসেবে মাত্র কয়েকটি কেস রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ও গ্রীসের ছোট দ্বীপে দেখা গিয়েছে। তার মানে যে আরও গাদা গাদা দেখা যাবে না, এই মিথ্যা সান্ত্বনা নিয়ে আদৌ বসে থাকা যায় না।
সারা পৃথিবী জুড়ে এখন প্রায় ৭ কোটি শরণার্থী আছে। এর মধ্যে নিজের দেশের মধ্যে বা যারা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়ে এক প্রকার অসহায় অবস্থায় বাস করছে তাদের মধ্যে পড়ে যায় বাংলাদেশের রোহিঙ্গারা, ইয়েমেনের অপুষ্টিতে ভোগা, একই তাঁবুর মধ্যে এক শিফটে এক পরিবার, অন্য শিফটে আর একটা পরিবার নিয়ে বাস করা ৪০ লক্ষ মানুষ, দেশি ও শরণার্থীদের মধ্যে নিত্য গৃহযুদ্ধে লিপ্ত লিবিয়া নিবাসী, ইসলামিক স্টেটের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে বাস্তুচ্যুত ১৫ লাখ ইরাকি। এর মধ্যে সবচেয়ে নাজুক অবস্থা হলো যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে একত্র হওয়া প্রায় ৪০ লাখ শরণার্থী, যারা তুরস্কের সীমায় অপেক্ষা করছে। এখানকার জনসংখ্যার ঘনত্ব এখন মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে জনবহুল এলাকা ‘গাজা’কে ছাড়িয়ে গিয়েছে। এ সম্বন্ধে সবচেয়ে ভয়ের কথা বলেছে ৬৫ বছর বয়স্ক গাজারই এক নাগরিক। তার কথায়, “করোনা যদি একবার এখানে আসে, তাহলে আমরা শুধু যে ঐ ভাইরাসেই মারা পড়ব তাই নয়, পৃথিবীর সাহায্য সংস্থাগুলো তাদের হাত আমাদের থেকে গুটিয়ে নেবে এবং আমাদের এক রকম নিরুপায় অবস্থায় পড়ে মরে যেতে বাধ্য করবে”। ইউরোপের বর্ডারের ভিতরের অবস্থাও তেমন সঙ্গিন, বরং বলা যায় অবর্ণনীয়। অকুলান বাসস্থান, কনকনে ঠান্ডা, আদ্রতা, তীব্র মানসিক চাপ, ক্লান্তি, পাতলা তাঁবুর মধ্যে ঠাসাঠাসি করে কোনো রকমে টিকে থাকা, প্রতিদিন ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়ার যন্ত্রণা ও অপমান, মলমূত্রের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও দুর্গন্ধের পাশে বাস করা—সব মিলিয়ে বাসের অযোগ্য অবস্থা।
দুর্ভাগ্যবশত, ইউরোপ ও আমেরিকায় কিছু লোক ও নেতাদের কাছে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার জন্য এই শরণার্থী বা আশ্রয় প্রার্থীদেরকেই দায়ী করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যদিও সেই অনুমানটা সত্যি কি না তার কোনো প্রমাণ নেই। উদাহরণ স্বরূপ, ধরা যাক আমেরিকা যদি সে কারণে তাদেরকে আসতে না দিয়ে মেক্সিকোতেই থেকে যেতে বাধ্য করে, তাহলে তাদের ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া ও চিকিৎসার ব্যবস্থা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ঠ কারণ থেকে যাবার সম্ভাবনা। তার ফলে রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা বরং আরও বেড়েই যাবে। এ ব্যাপারে ত্রাণদাতা সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা ও “ডকটরস উইদাউট বর্ডারস”-এর মুখপাত্রের পক্ষ থেকে কয়েকটি প্রশ্ন তোলা হয়েছে। যেমন, তোমার সামনে যদি কোনো পানি বা সাবান কেনার পয়সা না থাকে, তাহলে তুমি হাতটা নিয়মিত ধোবে কি করে? তুমি যদি কোন বস্তি বা রিফিউজি ক্যাম্পে ঠাসাঠাসি করে বাস করো, তাহলে একজন থেকে আর একজনের দূরত্ব কী করে বজায় রাখবে? নিজের দেশের ভয়াবহ যুদ্ধক্ষেত্র থেকে যখন তুমি জান বাঁচানোর জন্য পালিয়ে আসছ, তখন পাশের দেশের বর্ডার পেরুনো ছাড়া তোমার জন্য আর কি পথ খোলা আছে?”