লেখক এবং লেখার বৃত্তান্ত

লেখক মারা গেছেন। নন্দিত লেখক পরপারে গেছেন। ইচ্ছে হলো স্বর্গ এবং নরক দু’টিই একটু ঘুরে দেখবেন। ইচ্ছেটা মঞ্জুর হলো। প্রথমে নিয়ে যাওয়া হলো নরকে। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করেই লেখকের মাথা খারাপ। শেকল বাঁধা লোকজন! ধরাধামের সামান্য ভুলভ্রান্তির জন্য লোকজনের এমন শেকলবন্দি অবস্থা। দেখে নরকের গভীরে যাওয়ার আর সাহসই হলো না লেখকের। 

এবার লেখককে নিয়ে যাওয়া হলো স্বর্গ দেখবেন বলে। লেখক দেখলেন, সারিসারি লোক মাথা ঝুঁকিয়ে বসে আছে। এই লোকগুলোর শেকল দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে এরাও চেয়ারের সঙ্গে বাঁধা। চোখেমুখে তীব্র যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। 

লেখক অস্ফুটে উচ্চারণ করলেন, এতো দেখছি নরকের অবস্থার মতোই। এখানে এমন হচ্ছে কেন? 

এবারে অদৃশ্য কণ্ঠের উত্তর, এখানে আপনাদের লেখাগুলো সম্পাদনা করা হচ্ছে! 

—লেখা সম্পাদনা নিয়ে এ কৌতুকটি বেশ পুরনো। 

এর পরের কৌতুকটি হচ্ছে, জঙ্গি সন্ত্রাসী আর সম্পাদকদের মধ্যে পার্থক্য কী? উত্তর, জঙ্গিদের সঙ্গে সমঝোতার আলাপ করা যায়। সম্পাদকদের সঙ্গে কোনো সমঝোতা করা যায় না! 

আমি জানি, আমার এ লেখার ভাগ্যও কোন সম্পাদকের হাতে নির্ধারিত হবে।

এ সপ্তাহেই দু’জন লেখকের সঙ্গে বেশ দীর্ঘ আলাপ করতে হলো পেশাগত কারণে। এরমধ্যে একজন আমেরিকান শ্বেতাঙ্গ লেখক। এন ফেরার নামের এ লেখক এক সময় নিউইয়র্ক টাইমস সহ নানা জায়গায় কলাম লিখতেন। বই প্রকাশ করেছেন। এখন প্রায় অবসরে থাকা এ নারী লেখক সময় পেলে আমার সঙ্গে কথা বলেন। আড্ডা দিতে পছন্দ করেন। স্টারবাক্স নামের কফিশপে বসে আড্ডা তাঁর খুব প্রিয়। এন ফেরারের সঙ্গে আড্ডা আমি এড়িয়ে চলি সময়ের কারণে। কিন্তু বসলে উঠতে পারি না। কেমন আছ, কী লিখছ-এসব নিয়ে কথা শুরু হয়। তিনি শুরু করবেন গুছিয়ে।

প্রথমে বর্ণনা দেবেন গত সপ্তাহান্তে আবহাওয়া কেমন ছিল। সূর্য ওঠা থেকে পড়া পর্যন্ত দিনের বর্ণনা দেবেন। এরমধ্যে পোষা কুকুরটি তাঁর সঙ্গে কেমন মান অভিমান করে, তা নিয়ে বলবেন কিছুক্ষণ। তারপর শুরু করবেন লেখালিখির গল্প। জানাবেন, পত্রিকায় লেখার জন্য তিনি আউটলাইন জমা দিয়ে অপেক্ষা করছেন। সম্পাদকীয় বিভাগ থেকে তাঁকে জানানো হবে লেখাটি চূড়ান্ত করার জন্য।
কোন কোন লেখা নিয়ে আগামী একবছর ব্যস্ত থাকবেন, এ কথাটি জানাতে তাঁর কমপক্ষে দুই ঘণ্টা সময় লাগে। এরমধ্যে আমি কখনো ফোড়ন কাটছি, কখনো প্রশ্ন করে জেনে নিচ্ছি কোন বিষয়। অনেকক্ষণ তিনি এক নাগাড়ে কথা বলে আমাকে জিজ্ঞেস করেন প্রায় একই প্রশ্ন, কী নিয়ে কাজ করছি? কোন সামাজিক বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে আজকাল লিখছি?-এসব প্রশ্ন। আমি মোটামুটি পাঁচ মিনিটেই আমার আদ্যোপান্ত বলে এন ফেরারের দিকে তাকিয়ে থাকি। হো হো করে হেসে ওঠেন এন ফেরার। 

: হাসছ কেন? 

: হাসছি, কারণ আমরা একই জগতের মানুষ। একই বিষয় নিয়ে আমরা দু’জনই পরস্পরকে প্রশ্ন করলাম। তুমি উত্তর দিলে পাঁচ মিনিটে। আমি দিলাম দীর্ঘ সময় নিয়ে। পার্থক্যটা কোথায় জানো? পার্থক্য হচ্ছে, তুমি জাত সাংবাদিক-রিপোর্টার। শব্দের সংখ্যায় তুমি বন্দি হয়ে পড়েছ। তোমাকে সময় ও শব্দ সংখ্যার বন্দিত্বে থেকে নিজেকে প্রকাশ করতে হয়। আমার এ দায় নেই। সময় আর শব্দের গ-ির মধ্যে আমি আমার যা বলার, তা বলতে পারব না। আমাকে আমার মতোই বলতে হবে। দ্রুত বলতে গিয়ে তুমি অনেক কিছুই এড়িয়ে গেলে। যন্ত্রের মতো আমাকে তথ্য দিয়ে দিলে। আমি সাহিত্যের মানুষ। শুধু তথ্য দিয়ে আমার বলা বা লেখা কিছুই হবে না।

এন ফেরার থামলেন। আমি নিরুত্তর থাকি। 

আসলেই চল্লিশ শব্দের ইন্ট্রো আর তিন থেকে চারশ শব্দের মধ্যে আমাকে লিখতে হচ্ছে বছরের পর বছর। আমাকে প্রতিষ্ঠান বলে দিচ্ছে, আমার যা বলার তা যেন নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট শব্দ সমষ্টিতে বলে ফেলি! এ দাসত্বের লেখা আর এন ফেরারের লেখা ভিন্ন! 

এন ফেরার একটি বই লিখছেন গত তিন বছর থেকে, জানালেন। জানালেন বইয়ের কিছু কিছু অংশ স্থানীয় এক সাহিত্য ব্লগে প্রকাশ করছেন। 

আমি আবার ফোড়ন কাটি, তাহলে তো অর্থকড়ি চলে আসতে শুরু করেছে? 

এন ফেরার জানালেন, তিনি এ ধরনের লেখার জন্য ছোট পত্রিকা বা ওয়েব প্রকাশনা থেকে কোন অর্থ নেন না। তাঁর বর্তমান অর্থকষ্টের কথা জানি। জানি বলেই খুচরা অর্থ না নেয়ার কারণটি জানতে চাইলাম। এন জানালেন, তার লেখাটির বিনিময়ে ছোট বড় কোন অর্থ বা উপহার তিনি নিচ্ছেন না। এর যুক্তিসংগত কারণ আছে। ক’টি ডলার হয়তো ধরিয়ে দেবে। কিন্তু লেখার ওপর লেখকের আর কোনো মেধাস্বত্ব থাকবে না। লেখাটির মেধাস্বত্ব তখন যে প্রতিষ্ঠান  অর্থ দিয়েছে তার হয়ে যাবে। বিনিময়টা যত সামান্যই হোক লেখার ওপর প্রতিষ্ঠানটির মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। পরে এ লেখা নিয়ে, অদল বদল করেও বই প্রকাশ করা হবে অনৈতিক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেআইনিও। নিজের লেখা সম্পাদনা হচ্ছে, আংশিক প্রকাশের ফলে এক ধরনের পাঠ প্রতিক্রিয়াও পাওয়া যাচ্ছে—এটাকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন এন ফেরার। প্রাথমিক সম্পাদনা এবং সীমিতভাবে হলেও প্রকাশের পর লেখাটি কেমন যাচ্ছে তা দেখার অবকাশ পাচ্ছেন। বড় কাজের জন্য এমন দেখাটা জরুরি বলেই তিনি বলছিলেন। এন ফেরারের এ কথা আমাকে ভাবনায় ফেলে দিল। 

আমি একটি পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত। এখানে অনেকেই লেখেন। সপ্তাহে পাওয়া প্রচুর লেখা আমাদের সম্পাদনা করতে হয়। বেশ খাটুনির কাজ। লেখার বিনিময়ে যেহেতু আমরা লেখককে কোন অর্থ দিতে পারি না। কেউ হয়তো এন ফেরারের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজটা করিয়ে নিচ্ছেন সামনের বড় কোন কাজের জন্য। কেউ হয়তো অনুযোগও করেন। এ নিয়ে আমি নিজেই বেশ বিব্রত থাকি মাঝে মধ্যে। 
এন ফেরার জানিয়ে দিলেন, কোনো বিনিময় না দিয়ে ভালোই করছি। লেখার মেধাস্বত্বটি অন্তত লেখকের থাকছে। প্রতিষ্ঠানের নয়। এসব প্রকাশিত লেখা নিয়ে লেখক বই প্রকাশে যেতে পারেন। ফেলেও রাখতে পারেন। ছাপা হওয়ার বিনিময়ে অর্থ বা উপহার গ্রহণ করলেই লেখাটির মালিকানা আর লেখক এককভাবে দাবি করতে পারেন না।

এন ফেরার এবারে লেখালিখি নিয়ে দার্শনিক কথায় চলে যান। এন ফেরার আর্নেস্ট হেমিংওয়ে’র ভক্ত। মার্কিন সাহিত্যে হেমিংওয়ের অবদান হল তাঁর লেখনীর ভিন্নতা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমা সাহিত্যে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে’র প্রভাব ব্যাপক। হেমিংওয়ের কাজের জনপ্রিয়তা এর বিষয়বস্তু। প্রেম, যুদ্ধ, বন্যতা ও বিনাশের চিত্র পাওয়া যায় তাঁর সাহিত্য কর্মে । এসব মার্কিন সাহিত্যে বহুল ব্যবহৃত বিষয়বস্তু এবং হেমিংওয়ের কাজের প্রধানতম উপাদান ছিল। হেমিংওয়ের কাজ স্পেন, সুইজারল্যান্ড ও আফ্রিকার পর্বতমালা থেকে শুরু করে মিশিগানের ছোট নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আধুনিক মার্কিন লেখকরা কোন-না-কোন ভাবে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে কর্তৃক প্রভাবান্বিত। সাহিত্যিক ও সাংবাদিক হেমিংওয়ের কথাসাহিত্যের ভাষাশৈলীতে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছিলেন। তাঁর নির্মোহ ও নিরাবেগ ভাষার প্রভাব বহু মার্কিন লেখককে আজো প্রভাবান্বিত করে থাকে। হেমিংওয়ে’র রোমাঞ্চপ্রিয় জীবন ও ভাবমূর্তি তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের ওপর ব্যাপক প্রভাব নিয়ে বিরাজ করছে।  

এন ফেরারের সঙ্গে প্রতিটি আড্ডায় বিংশ শতাব্দীর এ লেখকের কথা থাকে নানা ভাবে। এন ফেরার আমাকে বলতে ভালোবাসেন, কিভাবে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে বিশ্বসাহিত্যকে প্রভাবিত করে গেছেন। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের কথা ধার করে এন ফেরার আমাকে উপদেশ দেন, তোমার নতুন লেখকদের বলো তারা যেন সাতপাঁচ না ভেবে লিখতে বসে পড়েন। যা মনে আসে, তাই লিখবেন। মনোভাবনার একটি মাত্র সত্যকথন দিয়ে লেখা শুরু করতে বলো। এর পর ভাবনা ও লেখা এমনিতেই এগিয়ে যাবে। এক সঙ্গে তো সব লিখতে পারবে না। লেখা ভালো চলছে বলেই এক সঙ্গে সব না লিখে, ভালো চলছে এমন সময়ে লেখা বন্ধ করে দাও। অন্য কাজে ফিরে যাও। পরের যখন লেখাটি শেষ করতে বসবে, তখন ভালো জায়গা থেকে শুরু করতে পারবে। যে কোন বিষয়ে প্রথম লেখাটিই ভালো লেখা নয়। প্রথম লেখাটি ছুড়ে ফেলে, আবার লেখো—নিজেই নিজের লেখা সম্পাদনা করো অন্যজন দেখার আগে। অবচেতন মনকে কাজ করতে দাও। লেখা নিয়ে সব সময় মাথা জ্যাম করে রেখো না। একজন লেখকের অবচেতন মনেই লেখা তৈরি হয়ে যায়। মনকে সে সুযোগটা দিতে হবে। দ্রুত কিছু শেষ করার চেষ্টা করো না। শেষটাই বিচার করা হয়। ফলে ভালো সমাপ্তির জন্য সময় নিয়ে লেখা শেষ করো। 

বুঝতে পারছিলাম, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে দিয়ে আমার দ্রুততার ওপর হামলা চালাতে চাচ্ছেন এন ফেরার।

: লেখালিখির জন্য আর কী গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে? 

: অন্যকে শোনো। যখন অন্যজন কথা বলছে, পরে নিজে কী বলবো তা নিয়ে আমরা ভাবতে শুরু করি। অবচেতনভাবেই তা মাথার মধ্যে কাজ করতে থাকে। ফলে প্রকৃত অর্থে অন্যের কথা শোনা হয় না। অন্যকে পূর্ণভাবে শোনার কাজটি করতে হবে। একজন ভালো লেখকের জন্য এ গুণের কোনো বিকল্প নেই! 
এন ফেরার জানালেন, আসছে ডিসেম্বরের আগে আর আড্ডা হবে কি না এ নিয়ে তিনি নিশ্চিত নন। এরমধ্যে তাঁর কিছু লেখা আমাকে ইমেইল করবেন। যেন দেখে মতামত দেই।

এবারে আসি অন্য লেখক প্রসঙ্গে। কয়েক দফা চেষ্টা করে আমাকে যোগাযোগ করতে হয় বাংলা সাহিত্যের চলমান সময়ের এক দাপুটে লেখকের সঙ্গে। ভিন্ন বিষয় আর ভিন্ন ধাঁচের এ লেখক এখনই তাঁর প্রকল্পের জানান দিতে অনিচ্ছুক। ফলে নাম প্রকাশ করা যাচ্ছে না। তো এ লেখকের কাছ থেকে জানা গেল, আমেরিকার পাশের এক দেশের প্রেক্ষাপট নিয়ে নিয়ে তিনি বই লিখবেন। এর প্রস্তুতি হিসেবে সেই দেশটিতে ভিসা নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। জানতে চাচ্ছিলাম, কতদিন ওই দেশটিতে থাকতে হবে। জানালেন প্রাথমিকভাবে বছর খানেক থাকতে হবে। প্রথমে কোন লেখালেখি নেই। ওখানে যেতে হবে। লেখার জন্য যাচ্ছেন, সে কারণে দেশটির অনুমতি নিতে হবে। ওখানে যাওয়ার পর অর্থ দিয়ে গাইড ভাড়া করতে হবে। দেশটির সমাজ, জনমানস-এসব ধাতস্থ করার জন্যই অনেক সময় লাগবে বলে জানালেন। সাহিত্য সৃষ্টির জন্য প্রায় অসুস্থ শরীর নিয়ে আমাদের এ লেখক আমেরিকার বাইরে সময় কাটাবেন এক বছরের বেশি সময়। তারপরও কতটা লেখা যাবে বা আদৌ যাবে কি না-এখনো বলা যাচ্ছে না বলে বিড়বিড় করলেন।

আমি অবাক হওয়ার ভান করি। বলি, আমার বন্ধু বিমানযাত্রার বিরতিতে মধ্যপ্রাচ্যের এক দেশে দুই দিন আটকা পড়েছিল। এ দুই দিনে দেশটির ওপর একখানা বই লিখে ফেলেছে আমার প্রতিভাবান বন্ধুটি।

ফোনের অপর প্রান্ত থেকে আমার স্বজন এ লেখক হাসলেন, না বিদ্রৃপ করলেন-তা প্রথমে টের পাওয়া গেল না। 

শুধু বললেন, তোমার প্রতিভাবান বন্ধুদের সাহিত্যের উত্তাপ আমিও দূর থেকে পাই! 

বিদ্রৃপ যে করছেন, তখনই তা টের পেলাম!     

menu
menu