রূপালি স্বপ্ন

আমাদের প্রাচীন সংস্কৃতির ইতিহাস ধরে যদি দেখা হয়, মানুষের ন্যূনতম প্রয়োজনের তালিকায় রাখা হয়েছিল মাত্র চারটি শব্দ—‘আহার-নিদ্রা-ক্রীড়া- মৈথুন’; ভাবলে অবাক লাগে যে পাশাপাশি কত আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত এই ধারণা। জৈবিক প্রক্রিয়া বজায় রাখতে আহার, বিশ্রাম এবং বংশবৃদ্ধির সাথে বিনোদনটিও যে কত প্রয়োজন তা এই ছোট কটি কথার সমাহারেই বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। ক্রীড়া মানে শরীরচর্চা বা প্রদর্শনী অর্থে সীমাবদ্ধ নয়, বিনোদন অর্থেও ব্যবহৃত ক্রীড়া যা মনকে দেবে আনন্দ ও তৃপ্তি। তাই আমরা দেখি সেই মহাভারত, রামায়ণের যুগ থেকেই নৃত্য-গীতের উল্লেখ এবং তার সাথে থিয়েটার এর ইতিহাসও প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ বছরের পুরোনো। ভারতবর্ষসহ আরও বহুদেশের প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাসেই দেখা যায় নাচ গান ও থিয়েটারের উল্লেখ যার প্রত্যেকটির জন্য সঠিক সুর, ছন্দ ও অভিব্যক্তি প্রকাশই সেই সব শিল্পকলাকে জনগ্রাহী ও জনপ্রিয় করে তুলেছিল। ওলিম্পিয়ার পাহাড়ে প্রায় হাজার খ্রিস্টপূর্বে আয়োজিত হতো অলিম্পিক; গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী যা ছিল দেবতা জিউস-এর ক্রীড়া বিনোদন। তারপরে আবার দেখি খ্রিস্টোত্তর প্রথম শতকে রোমের কলোসিয়াম, যা তৈরি হয়েছিল প্রধানতঃ খেলাধুলা ভিত্তিক আমোদ প্রমোদের জন্য, কিন্তু সেখানেও অভিনীত হতো থিয়েটার। প্রায় ৮০,০০০ মতো দর্শকের আসন ছিল; এখনো পর্যন্ত পৃথিবীর সব থেকে বড়ো মুক্তাঙ্গন বলতে এই কলোসিয়ামকেই বোঝায়।

কাজেই ইতিহাসে চোখ বোলালে দেখা যায় বহু হাজার বছর ধরে আনন্দ আস্বাদনের মাধ্যম ছিল সাংস্কৃতিক চর্চা গান-বাজনা-নৃত্য-কথকতা-অভিনয়। অনেক পরে এসেছে মোশন পিকচার বা চিত্রে চলমানতা বা যাকে বলা হয় রূপালি পর্দায় আধুনিক চলচ্চিত্র বা ছায়াছবি। ইতিহাসের কথাই যখন হচ্ছে একটু দেখে নেওয়া যাক চলমান চিত্রের উৎসটা কখন এবং কিভাবে। চিত্রে (ফটোগ্রাফি) ও চলচ্চিত্রের অগ্রগতিতে রসায়নবিদ্যা, পরীক্ষা ও টেকনোলজি বা যন্ত্রের উদ্ভাবনের দীর্ঘদিনের ইতিহাসে লিখিত আছে বহু আবিষ্কারকের নাম। চতুর্থ ও পঞ্চম শতকে একদিকে চীনে ও অন্যদিকে অ্যারিস্টটল-এর লেখায় পিন-হোল ক্যামেরার উল্লেখ পাওয়া যায়। তারপর ছিন্ন ছিন্ন ভাবে বহু সময়েই ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলা হয়েছে জানা গেলেও সেসব ছবি সংরক্ষিত করার কোনো উপায় জানা ছিল না। ১৮০০ শতকের গোড়ার দিকে যৌগ পদার্থের কেমিস্ট্রি থেকে প্রথম জানতে পারা গেলো যে সিলভার-নাইট্রেট সূর্যের আলোতে এক কালো ছাপ ফেলে যায় ধাতু বা কাগজের ওপর। কিন্তু ঘটনাটা লক্ষ্য করেছিলেন একজন এনাটমি ও ফিজিক্সের প্রফেসর John Heinrich Schulze । সাদা কালোয় ছবি ফুটে উঠতে লাগলো আয়নায়  দেখার মতো। সেই শুরু হলো রূপালি স্বপ্ন দেখা কিভাবে ছবিকে ফুটিয়ে তোলা যায় ও টিকিয়ে রাখা যায় অনেক দিন। তারপর একে একে সিলভার-নাইট্রেট, সিলভার-ক্লোরাইড, সিলভার-আয়োডাইড ও অন্যান্য রৌপ্য-যৌগিক পদার্থের ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন জনে কাগজে বা ধাতুর পাতে বিভিন্ন ভাবে আরো পরিষ্কার ছবি বানানোর চেষ্টা চালিয়ে গেছেন।

প্রথম সার্থক ফটোগ্রাফি আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেওয়া হয় ফরাসী চিত্রশিল্পী Jacques Mande Daguerre- কে (১৮৩৯); তারপর সেই একই সালে ইংল্যান্ডের বৈজ্ঞানিক Henry Fox Talbot স্বীকৃত হলেন বিশেষ ধরনের কাগজের নেগেটিভ বানানোয় যার থেকে ইচ্ছেমতো ছবি ছাপানো বা প্রিন্ট করা যাবে।

চলচ্চিত্রের শুরুটা আসে একই রকমভাবে এবং আজও বেশিটাই নির্ভর আধুনিক ও উন্নতপ্রযুক্তি বা টেকনোলজির ওপর। ১৮০০-র গোড়ার দিকে ড্রামের মধ্যে আঁকা ছবিকে জোরে ঘুরিয়ে স্থিরচিত্রের মাঝে গতিময়তা আনা হতো, তারপর কাচের স্লাইডে এঁকে নানা রকম কায়দায় লণ্ঠনের আলো দিয়ে বিভিন্ন গল্প ফুটিয়ে  তোলা হতো যার পেছনে পাপেট শো বা পুতুলনাচের প্রভাব আছে বলে ধরা হয়। কিন্তু এগুলোর কোনোটাকেই মৌলিক চলচ্চিত্র বলা চলে না। মজার ঘটনা হলো,  যে দুজনকে পথিকৃৎ ধরা হয় তারা কেউই ব্যবসায়িক বা বিনোদনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে চলমান চিত্র ব্যবহারের কথা ভাবেননি, দুই ক্ষেত্রেই বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রমাণের জন্য নির্মিত হয়েছিল ক্রম ধারাবাহিক স্থির চিত্র যা ড্রামে ঘুরিয়ে আঁকা ছবির মতো ঘূর্ণমান বা চলমান দেখাবে। প্রথম ব্যক্তি আমেরিকান ফটোগ্রাফার  Eadweard Muybridge ক্যালিফোর্নিয়ায় ঘোড় দৌড়ের ঘোড়াদের মালিকের সাথে কাজ করার সময় লক্ষ্য করেছিলেন যে ছুটন্ত ঘোড়ার চারটে পা-ই এক এক সময় ছোটার গতিতে টগবগিয়ে লাফিয়ে ওঠার সময় শূন্যে উঠে যায়।

তার সে কথা কাউকে মানাতে না পারায় প্রমাণের উপায় বার করলেন এক অদ্ভুত পরিকল্পনা নিয়ে। ১২-টা ক্যামেরা সারা রেসট্র্যাকে তার দিয়ে জুড়ে নির্দিষ্ট দূরত্বে সাজিয়ে রেখেছিলেন; দুরন্ত ঘোড়ার খুরে সেই তারে টান পরে সাটার চালু হয়ে পরপর সাজানো ছবি তোলার ব্যবস্থা করেছিলেন এবং সফলও হয়েছিলেন। তারপর মুইব্রীজ সেগুলোকে গ্লাসপ্লেটে ডেভেলপ করে দুরন্ত গতিতে চালিয়ে প্রমাণ  দেখান (১৮৭৭) যে ঘোড়া যখন দৌড়োয় তখন লাফিয়ে ওঠে আর সত্যি তখন কিছু মুহূর্তের জন্য চারটে পা-ই থাকে শূন্যে, মাটিতে নয়।

দ্বিতীয় জন ছিলেন ফরাসি শরীর বিজ্ঞানী Etienne Jules Marey; ওড়ার সময় পাখিদের ডানা ও পেশিগুলো কিভাবে কাজ করে সেই বিষয় খুঁটিয়ে দেখার জন্য মুইব্রীজের মতো একই পন্থায় উড়ন্ত পাখির ছবি তুলে পরে খুঁটিয়ে দেখে বিশ্লেষণ করেছিলেন তাদের বাতাস কেটে আকাশে ওড়ার কার্যপ্রণালী (১৮৮২)। ইতিমধ্যে ক্যামেরা ও ফোটোগ্রাফির জগতে আরো নতুন উদ্ভাবন এসেছে, রঙিন ছবি ও এসে গেছে বাজারে। এসে গেছে আর এক রাসায়নিক গবেষণার ফসল বিশেষ কাগজ বা প্লাস্টিক—সেলুলয়েড ফিল্ম। কাজেই চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহ বাড়তে থাকলো।

প্রথম নির্মিত চলচ্চিত্রটি (১৮৮৮) ছিল ২-সেকেন্ডের, নাম “Roundhay Garden Scene”; বাগানের দৃশ্যগ্রহণ করা হয় ইংল্যান্ডের লীডসে, সাথে ছিল আবহ সংগীতও। বাগানে ঘোরা ফেরা বা গতিশীলতা তুলে ধরতে পেরেছিলেন ক্যামেরা দিয়ে। তিনটি চরিত্র নিয়ে ছায়াছবিটি তৈরি করেছিলেন ফরাসি আবিষ্কারক Louis Le Prince. দুটো বড় ঘটনা এই ২-সেকেন্ডের প্রোডাকশন এর সঙ্গে জড়িত। প্রথম ঘটনা-রহস্যজনকভাবে এই ছবি তৈরির কিছুদিনের মধ্যেই ছবির পরিচালক, অভিনেত্রী ও অভিনেতা সবার জীবনাবসান ঘটে। দ্বিতীয় ঘটনা-প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে Louis Le Prince-এর নাম অস্বীকার করার চেষ্টা করে Thomas Alva Edison, যার নাম বেশি শোনা যায় চলচ্চিত্রের  অগ্রগামী ও কিংবদন্তি পুরুষ হিসেবে। লে প্রিন্স-এর ছেলে অনেক যুদ্ধ করে বাবার নাম আবিষ্কারক হিসেবে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করেন এবং তার প্রমাণ  পাওয়া যায় গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে। এডিসন-এর উদ্ভাবিত ক্যামেরায় উন্নতমানের ও বেশিক্ষণ সময়ের চলমান ছবি বাজারে চলে এসেছিলো একই সালে ১৮৮৮-তে।

এডিসন ১৪ মিনিটের পূর্ণাঙ্গ ছবি তৈরি করেছিলেন সুবিখ্যাত গল্প আঙ্কেল টমস কেবিন নিয়ে। এর পরেই ফিল্ম এর সেলুলয়েড বানানোর ফ্যাক্টরি তৈরি করে ব্যবসায়িক সাফল্য আনেন Eastman Kodak। এই সময়ের পর আরো ২০/২৫ বছর ধরে ক্যামেরা, ফটোগ্রাফি, এডিটিং, লাইটিং, প্রজেকশন, সাউন্ড সব কিছু নিয়েই বিভিন্ন প্রযুক্তি উদ্ভাবিত ও ব্যবহৃত হয়েছে চলচ্চিত্র নির্মাণে; সব থেকে উল্লেখযোগ্য, চলচ্চিত্র নির্বাক থেকে সবাক হয়েছে ১৯২০-র মাঝামাঝি। ইতিমধ্যে ভারতবর্ষে মারাঠিতে প্রথম চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে “রাজা হরিশ্চন্দ্র”(১৯১৩), পরিচালনায় দাদাসাহেব ফালকে। আর এর পরে পরেই ১৯৩১-এ কলকাতায় স্যার বীরেন সরকার তৈরি করেন নিউ থিয়েটার্স স্টুডিও। প্রায় পঁচিশ বছর পর্যন্ত বাংলা ও হিন্দি দুই ভাষাতেই ছায়াছবি তৈরি হয়েছে নিউ থিয়েটার্সে খুবই সাফল্যের সাথে। 

নিউ থিয়েটার্স স্টুডিও ভারতবর্ষের প্রথম স্টুডিও যেখানে প্রথম প্লেব্যাক হয়। ১৯৫০এর মাঝামাঝি নিউ থিয়েটার্স যখন একেবারেই বিদায় পথে, বাঙালির দুঃখকে সামাল দিলো বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগের রোমান্টিক জুটি উত্তম-সুচিত্রা। পঞ্চাশের শেষের থেকে ষাটের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাঙালি মোহমুগ্ধ ছিল এদের অভিনয়ে। আগেকার সময়ে বা প্রথম আমলে বিশেষ করে ভারতীয় সিনেমায় রূপালি পর্দায় জ্যোৎস্নার মতো ঝকঝকে সুন্দর নাহলে নায়ক বা নায়িকা কারোরই  সেরকম স্থান ও কদর হতো না। উত্তম কুমারের জনপ্রিয়তায় ঈর্ষাকাতর হয়ে তাকে ‘ম্যাটিনি-আইডল’ বলে নস্যাৎ করার চেষ্টা করলেও শোনা যায় উত্তমকুমার-এর চলচ্চিত্র অভিনয়ের প্রথাগত শিক্ষা না থাকলেও ক্যামেরা এবং সঠিক অভিব্যক্তির অসাধারণ জ্ঞান ছিল। এই দক্ষতার উল্লেখ স্বনামধন্য সত্যজিৎ রায় থেকে শুরু করে বহু অভিনেতা ও পরিচালকদের কাছেই জানা গেছে।

বিংশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত যা দেখা যায় বাংলা সিনেমায় ছোটদের জন্য সিনেমা কম তৈরি হত। আশ্চর্য লাগতো যে একে তো ছোটদের জন্য সিনেমাই কম আবার তাও যা তৈরি হতো সেগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে হৈ-চৈ হুল্লোড়ের না হয়ে হতো কি রকম একটা বুকের ভেতর যন্ত্রণা বা চোখ ঠেলে কান্না আসার ধরনের। ষাটের দশকে মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলায় ছোটদের সিনেমা বলতে ছিল তপন সিনহার কাবুলিওয়ালা (কাবুলিওয়ালা বাংলায় করেছিলেন ছবি বিশ্বাস আর হিন্দিতে বলরাজ সাহানী) লালু-ভুলু ও বাদশা সিনেমা, যেগুলো সবই বেশ দুঃখের। ছোটবেলায় খুব নাম শুনতাম ‘Bicycle Thief’ সিনেমার। শোনা যায় বাই সাইকেল থিফ-এর পরিচালক Vittorio Desica থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ছিলেন সত্যজিৎ রায়। ছোটদের বই হিসেবে পরিচিত না হলেও বাই সাইকেল থিফ কিংবা পথের পাঁচালী কিংবা পোস্টমাস্টার সব গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে কিন্তু রয়েছে শিশুচরিত্র এবং সেই শিশুদের বড়ো বেদনা দায়ক পরিস্থিতি। এই ষাটের দশকের ইংরেজি সিনেমা  যেগুলো মনে পড়ে The Sound of  Music, সিংহ শাবক এলসার বেড়ে ওঠা নিয়ে Born Free, Living Free, Forever Free, Hatari ইত্যাদি। বাংলায় ছোটদের জন্য সিনেমার মোড় ঘুরলো সত্যজিৎ রায়ের তৈরি গুপী গাইন বাঘা বাইন মুক্তি পাবার পর (১৯৬৯)। তারপরে এই জনপ্রিয় তার জের ধরেই বেশ কয়েক বছরের মধ্যে তৈরি হয় সত্যজিৎ রায়ের সোনারকেল্লা (১৯৭১), জয় বাবা ফেলুনাথ (১৯৭৯), থিরুমুঘমের হাতি মেরে সাথী (১৯৭১), অরুন্ধতী দেবীর পদি-পিসির বর্মি বাক্স (১৯৭২), তপন সিনহার সফেদ হাতি (১৯৭৮) ও সবুজ দ্বীপের রাজা (১৯৭৯)। অন্যদেশের কথা ঠিক জানা নেই, তবে মার্কিন দেশে সারা বছরই রূপালি পর্দায় নানা উপলক্ষে প্রকাশিত হয় ছোটদের জন্য অনেক মুভি; বিশেষ করে গরমের ছুটি ও ক্রিসমাসের সময়।

All I have in my life is imagination বলেছিলেন সুবিখ্যাত পরিচালক Woody Allen; যে কথাটি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করা যায় তার সিনেমায়। কল্পনার  জোরে মিলনের আগে মস্তিষ্কের কোষে উত্তেজনা থেকে শুক্রাণুর মানসিকতা নিয়ে যে কেউ এতো সুন্দর একটি গল্প তৈরি করে রূপালি পর্দায় তুলে ধরতে পারেন তা না  দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত। থিয়েটার আর সিনেমার সঙ্গে এই একটা বড় পার্থক্য চিত্র কাহিনির এবং তাকে তুলে রূপালি পর্দায় রূপ দেওয়া। অন্যদিকে ব্যবসায়িক সাফল্য ও জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও অনেক সময়েই পাঠকদের থেকে আপত্তি শোনা গেছে যে বইয়ের গল্পের অনেক পরিবর্তন ঘটনা হয়েছে রূপালি পর্দায় তুলে ধরার জন্য যেমন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের রহস্য গল্প ‘পাতালঘর’ উপেন্দ্রকিশোরের ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ জে কে রাউলিং এর ‘হ্যারি পটার’ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর ‘চাঁদের পাহাড়’ ইত্যাদি। সৃজনশীলতা আর কল্পনার কথা বলতে গেলে উল্লেখ করতেই হবে চার্লি চ্যাপলিনের নাম। তিনি ছিলেন একাধারে লেখক, গায়ক, নায়ক, নাট্যনির্মাতা, পরিচালক ও প্রযোজক। হাস্যরসের আড়ালে বিদ্রƒপ করে গেছেন আমাদের সমাজকে আর মানুষের বিচিত্র মনকে। চলচ্চিত্র সবাক হবার পরেও ওঁর সিনেমার কোনো পরিবর্তন করেননি, অভিব্যক্তি ও কাহিনি ছিল তাঁর সিনেমার অভিনবত্ব।

কিছু কিছু জিনিস চিহ্নিত হয়ে যায় সর্বকালীন হিসেবে; যেমন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে ‘দেবদাস’। একই গল্প নিয়ে ষোলোটি সিনেমা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। বাংলা ও হিন্দি ছাড়া  ভারতবর্ষেই তেলেগু, মালয়ালম, অহমিয়াতে তৈরি হয়েছে এই ফিল্ম আবার বাংলাদেশে ও পাকিস্থানে উর্দুতেও তৈরি হয়েছে এই ফিল্ম। নির্বাক ছবির সময় থেকে এই গল্প রূপালি পর্দায় উঠে এসেছে তার রোমান্টিকতার ছোঁয়ায়। নিউ থিয়েটার্সে একই সঙ্গে তৈরি হয় বাংলায় ও  হিন্দিতে প্রমথেশ বড়ুয়ার ছবি সেই তিরিশের দশকে। তারপরে পরেই সায়গল বানান দেবদাস, প্রমথেশ বড়ুয়ার জনপ্রিয়তা ও সাফল্যকে ছাড়িয়ে যায় সেই  দেবদাস। আরো লম্বা তালিকায় আর যাচ্ছি না, কিন্তু ২০০২-এ সঞ্জয় লীলা বানশালির নির্মিত দেবদাস  ধামাকা ও জাঁক জমকে ছাড়িয়ে গেছে সবাইকে তার সঙ্গে মূল গল্পের থেকেও অনেক দূরে। এই আলোচনা প্রসঙ্গে মনে পড়লো সম্পূর্ণ অন্য ধাঁচের দুটি সিনেমার কথা—Alfred Hitchcock এর ‘Psycho’ (১৯৬০) IMerian Cooper and Ernest Schoedshack এর ‘Kingkong’  (১৯৩৩)। কিংকং-এ দু’জন মানুষ মিলে তৈরি করা হয়েছিল ওই মহাকীর্তিমান গরিলা কিংকং- কে। আতঙ্কের চূড়ান্ত হলেও সাইকো এতো জনপ্রিয় হয়েছিল যে হলিউডে এই ছবি নিয়েই একটা প্রদর্শনীর অংশই আছে। পৃথিবীর সর্বকালীন সর্ববৃহৎ যানের নির্মম পরিণতির মাঝেও রোমান্টিক গল্প অবলম্বনে সিনেমা তৈরি হলো ‘Titanic’ একেবারে বিংশ শতাব্দীর শেষে। টাইটানিক প্রায় তিন ঘণ্টার ছবি। এই রকমই দীর্ঘ তিন ঘণ্টার ছবি হয়েছিল হিন্দিতে রমেশ সিপ্পির ‘শোলে’ একই রকম জনপ্রিয় তথা ভারতের সিনেমায় এক উল্লেখযোগ্য স্থান গ্রহণ করে রয়েছে আজও। প্রথম মুভি তৈরি হয় ২-সেকেন্ডের; এক শতকের মধ্যে শোলে ও টাইটানিক এই দুটো সিনেমাই প্রায় তিন ঘণ্টার ছবি। বাণিজ্যিক সাফল্য দুটোরই ছিল সাংঘাতিক; একটি ভারতীয় মুদ্রায় ১৫ মিলিয়ন আর অন্যটি আমেরিকা মুদ্রায় প্রায় দুই বিলিয়ন। অবশ্য বাণিজ্যিক সাফল্য দেখতে গেলে বহুদিন পর্যন্ত রেকর্ড ছিল ‘Star Wars’-এর (১৯৭৭), আন্তর্জাতিক বাজারে ৭৭৫ মিলিয়ন উঠেছিল এই মুভি থেকে। চলচ্চিত্র প্রসঙ্গে কিন্তু একটা কথা উল্লেখ করতেই হয় যে ভারতীয় চলচ্চিত্র গিনিস ওয়াল্ড রেকর্ডে চোদ্দটা আসন নিয়ে বসে আছে।

ভয়ের ও ভূতের গল্পের বিভাগে বা ‘genre’-তে বাংলা ছায়াছবির দিক খুবই দুর্বল। হাতে গোনা অল্প কিছু ভয়ের সিনেমা বাংলায় তৈরি হয়েছে মাঝে মধ্যে  যেমন: মণিহারা, কুহেলী, নিশিতৃষ্ণা, লাল-কুঠি। আমেরিকাতে হ্যালোউইনের সময় বাজারে আসতে থাকে ভয়ের ছবি লাইন দিয়ে। হ্যালোউইনের সময় অর্থাৎ অক্টোবর থেকেই শুরু হয় সিনেমা হলে ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-রাক্ষস-খোক্ষসের আনাগোনা ওই ঠাকুমার ঝুলির লাল কমল-নীল কমলের মতো। ইদানীং মনস্তত্ব সমীক্ষণ হচ্ছে ছেলেরা বেশি ভয়ের সিনেমা দেখে কেন এই নিয়ে। বেশ কিছু অধ্যাপক ও মনস্তত্ববিদের মতে ছেলেরা তাদের পুরুষত্বকে আবার আবিষ্কার করে এইসব ফিল্ম দেখে। তবে কয়েক বছর আগে বাংলা সিনেমা ভূতের ভবিষ্যৎ দেখে কেউ পুরুষত্বকে আবিষ্কার করেছে কিনা না বলতে পারলেও পরিচালক অনিক দত্ত  যে অনেকদিন পরে একটি পরিচ্ছন্ন ও বিনোদনের মুভি উপহার দিয়েছেন ভূতের গল্পের আড়ালে তা অনঃস্বীকার্য। বাংলা সিনেমায় সাম্প্রতিককালে অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ যে আগের ভালো ভূতের বই না থাকার আফসোস তলিয়ে গেছে।

ইদানীং অ্যানিমেশন দিয়ে তৈরি ফিল্মের সংখ্যা ও বাজারে অনেক বেড়েছে, কম্পিউটারের অবদান এক্ষেত্রে অনস্বীকার্য। এই অ্যানিমেশনের প্রসঙ্গে আবার ফিরে যেতে হচ্ছে ইতিহাসের পাতায় ও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা তত্ত্বে। প্রত্যেকটা অঙ্গ-প্রতঙ্গ নড়াচড়ার ছবি একটার পর একটা সারি দিয়ে এঁকে গতি বা  কোনো কাজ বোঝানো দেখতে পাওয়া গিয়েছিল ইজিপ্টে (খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০) আর ইরানে (খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০)। তারপর বিখ্যাত চিত্র শিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির কাছে আমাদের মতো শরীর বিজ্ঞান চর্চা যাদের পেশা তারা চিরকালের জন্য ঋণী ও কৃতজ্ঞ। মানুষের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ছবি এঁকে গেছেন কি নিখুঁত নৈপুণ্যে! আবার তাঁর আঁকা ক্রম বিস্তারিত ছবির ধারাই পথ দেখিয়েছে অ্যানিমেশন সৃষ্টিতে। প্রথম দিকে ১৯০০-র শুরু থেকে মাঝ পর্যন্ত প্রত্যেকটি ছবিই ওই ভাবে হাতে আঁকা হতো তারপর আস্তে আস্তে সেই জায়গা সহজ করে দিয়েছে কম্পিউটার প্রযুক্তি। ১৯৩৭-এ ডিজনির বানানো স্নো-হোয়াইট পূর্ণদৈর্ঘ্যরে অ্যানিমেশন মুভি ধরা হলেও তার আগে আমেরিকাতে Winsor McCaye বানিয়েছিলেন  ‘Gertie the Dinosaur’  বলে একটা ছবি (১৯১৪), নিজে হাতে ১০,০০০ ছবি এঁকে ছিলেন এই মুভি বানানোর জন্য। চীনে প্রথম অ্যানিমেশন হয় ১৯২২-এ, জাপানে হয় ১৯১৫-তে। অ্যানিমেটেড মুভি বানানোয় ইন্ডিয়ান সিনেমার মধ্যে অগ্রগণ্য ছিল নিউ থিয়েটার্স; ‘P.Brothers’ ‘On a Moonlight’ (১৯৩৪) আর ‘মিচকেপটাশ’ (১৯৫০) তৈরি হয়েছিল এই স্টুডিওতে। অ্যানিমেশন প্রসঙ্গে একটি আশ্চর্য যোগাযোগের কথা বলতেই হচ্ছে। চলচ্চিত্র জগতে আকিরা কুরোসায়া-র নাম শুধু জাপানি চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক হিসেবেই  নয়, চলচ্চিত্র নির্মাণের নানা আধুনিক টেকনিকও তার উদ্ভাবিত। পঞ্চাশ শতকে তার নির্মিত সাড়ে তিন ঘণ্টার ছবি সেভেন সামুরাই এক উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল গল্প ও চিত্ররূপায়ণে। তার পঞ্চাশ বছর পরে পিক্সারের ‘আ বাগ’স লাইফ’ (A BugÕs Life) দেখামাত্র বোঝা গেলো সেভেন সামুরাইকে কিভাবে অ্যানিমেশনে সুন্দরভাবে রূপ দেওয়া হয়েছে (যদিও সে কথাটি সন্তর্পণে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে)।

সিনেমা শুধু বিনোদন নয়, অনেক ছবি আবার বিতর্কিত হয়ে ওঠে রাজনৈতিক ঘটনা বা চরিত্রকে কেন্দ্র করে। অনেক সময় দেখা যায় সেগুলোর প্রচারও বন্ধ করে দেওয়া হয়। মনে পড়ে সুচিত্রা সেন ও সঞ্জীভ কুমার অভিনীত ছবি আঁধি বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্দিরা গান্ধীর জীবনের প্রতিচ্ছবি থাকাতে। আর সাম্প্রতিককালে অনীক ধার-এর বাংলা সিনেমা ভবিষ্যতের ভূত থেকে কিছু লোক ভূত দেখার মতো আঁতকে ওঠায় রাতারাতি তার প্রচারও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।

প্রথমে দেবদাস ও পরে ব্যোমকেশের সিনেমার সাড়া জাগানো সার্থকতার সঙ্গে বাঙালি জড়িয়ে থাকলেও বাংলা সিনেমায় স্টার ওয়ার্স ধরনের সিনেমার মতো টেকনোলজির ব্যবহারে সেরকম উল্লেখযোগ্য কিছু আছে বলে আমার সেরকম  জানা নেই। তবে সাম্প্রতিককালে সিনেমা প্রাক্তন-এর এক দৃশ্যতে হেলিকপ্টারে   (ড্রোন ক্যামেরা) তোলা কলকাতার ছবি যেমন মন কেড়েছে তেমন আবার মনে করিয়েছে জুলি এনড্রুজ-এর দ্য সাউন্ড অফ মিউজিক এর বিখ্যাত ‘দ্য হিলস আর এলাইভ উইথ সাউন্ড অফ মিউজিক (The hills are alive with sound of music) গানের দৃশ্য যা তোলা হয়েছিল হেলিকপ্টার থেকে। কোলকাতাপ্রেমী হিসেবে শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের কল্পিত ওই দৃশ্য বাঙালি হিসেবে বড় মন চুমিয়ে গেছে আর বাংলা সিনেমার উত্তরণও নজর কেড়েছে। ড্রোন ক্যামেরার ব্যবহার মিলিটারিতে বহু বছর ধরে; তারপর হঠাৎ করে সিনেমার দৃশ্য গ্রহণে নিয়ে আসে হলিউডসহ বহু বিদেশি চলচ্চিত্র নির্মাতা। ইদানীংকালে বাংলা সিনেমায় বহুক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে ড্রোনের ব্যবহার অর্থাৎ কিছু আধুনিক টেকনোলজির সার্থক ব্যবহার।

বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে সিনেমার হলে দেখা ‘রূপালি পর্দা’ ছোট হয়ে ঘরে চলে এলো ‘টেলিভিশন’ রূপে এবং কিছুদিনের মধ্যে চলে এলো ভিডিও, নিজের বাড়িতে ইচ্ছে মতো সিনেমা দেখার সুবিধের জন্য। অনেকেই তখন হাহাকার করে উঠলো যে এই বোকা বাক্স মানুষের সব ভালো কাজের পথ আটকে দেবে, তারা নেশাচ্ছন্ন থাকবে এর আকর্ষণে। তারপর গত একযুগ ধরে ুড়ঁ-ঃঁনব কমার্শিয়াল সিনেমার বাজারের হালচাল বদলে দিল। আবার সেই টেকনোলজির মহিমা! আর এখন আরো সহজে শুধু ইউটিউব নয়, নেটফ্লিক্স, হুলু ও অন্যান্য আরো সংস্থা নিজের ঘরে বসে সিনেমা এবং আরো অন্য বহু শো দেখার সুবিধে করে দিয়েছে। তার ওপরে টিভিও আরো ছোট হয়ে চলে এসেছে হাতের মুঠোয় স্মার্টফোনে। সেই টেকনোলজি ঘুরে ফিরে নবরূপে!

যুগে যুগে টেকনোলজির অগ্রগতির সঙ্গে রূপালি পর্দার মাপ ছোট হতে হতে হাতের তালুর মধ্যে চলে এলেও জ্যোৎস্নার রূপালি স্বপ্ন আজও মোহমুগ্ধ করে দর্শককে, আর তাই বাংলার চাঁদের পাহাড়ই হোক, বা হিন্দিতে দেবদাসই হোক কিংবা ইংরেজিতে স্টার-ওয়ার্স বা ব্ল্যাক প্যান্থার-ই হোক প্রিমিয়ার শো-তে মাঝরাতে দেখা যায় সব বয়েসের সিনেমামোদী উৎসাহী হাজার হাজার যুবক-যুবতীর ভীড় আই ম্যাক্স-এর হলে মস্ত বড় রূপালি পর্দার সামনে।

menu
menu