সাহিত্যে বব ডিলানের নোবেল প্রাপ্তি

 

বব ডিলান। মার্কিন রক-ফোক সংগীতের কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী ও প্রথাবিরোধী গীতিকবি, সুরকার, ডিস্ক জকি এবং একই সঙ্গে কবি, লেখক ও চিত্রকর। বব ডিলানের প্রকৃত নাম রবার্ট অ্যালেন জিমারম্যান। জন্ম মে ২৪, ১৯৪১। যিনি ১৯৬০-এর দশক থেকে পাঁচ দশকেরও অধিক সময়ধরে জনপ্রিয়ধারার মার্কিন সংগীতের অন্যতম প্রধান পুরুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। বব ডিলানের শ্রেষ্ঠ কাজের মধ্যে অনেক কাজ ১৯৬০ দশকে রচিত হয়েছে। সে সময় তিনি আমেরিকান অস্থিরতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হন। তার কিছু গান, যেমন 'Blowin in the wind' এবং 'The Times They Are A-Changing' যুদ্ধবিরোধী জাতীয় সংগীত হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে এবং ১৯৫৫-১৯৬৮ সালের আমেরিকান নাগরিক অধিকার আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। ২০১৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন কিংবদন্তি এই কবি ও শিল্পী।

বব ডিলান পুরস্কার পাওয়ার পর বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে কিছুটা বিতর্কের সৃষ্টি হয়। এটা হতেই পারে। সকলেরই মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে। ড. মুহাম্মদ ইউনুস যখন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেলেন, তখন বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে বিতর্কের ঝড় বয়ে গেছে। কেউ কেউ বলতে চেয়েছেন, তিনি শান্তিতে কী করে পুরস্কার পান। ড. মুহম্মদ ইউনুসের গ্রামীণ ব্যাংক গরিবদের মাঝে সুদে টাকা লোন দেন।

সে প্রসঙ্গে যাওয়া সমীচীন হবে না। বলছিলাম বব ডিলানের নোবেল পুরস্কার পাওয়া নিয়ে বিতর্কের কথা। পত্রপত্রিকাসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বব ডিলানের  নোবেল পুরস্কার পাওয়া নিয়ে নানান মন্তব্য দেখলাম। কারো কারো মনে বব ডিলানের নোবেল পাওয়া নিয়ে সে কী দুঃখ! লেখকদের কেউ আবার নিজের পছন্দের লেখক নোবেল না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ভাবখানা এমন, যেন তার পছন্দ অনুযায়ী নোবেল দিতে হবে। কেউ আবার বলছে, সবই আমেরিকার ক্ষমতা আর টাকার জোর। এরা ভুলে যায় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের পুরস্কার নিয়ে ব্রিটিশদের দালালি থেকে, সুইডিশ রাজপুত্রের মেহমানদারি, কী না দায়ী করা হয়েছিল।

অন্যদিকে এক দল শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সমর্থনের জন্যে তাঁর পুরস্কার যথার্থ ভাবছেন। আরেক দল আবার এই একই কারণে বব ডিলানের পুরস্কার প্রাপ্তিকে মেনে নিতে পারছেন না। কিন্তু আমরা কী ইচ্ছে করলেই ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সহায়তায় জর্জ হ্যারিসনের উদ্যোগে আয়োজন করা হয়েছিল যে কনসার্ট, ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’, তা ভুলে যেতে পারি? ভুলে যেতে পারব পণ্ডিত রবিশঙ্কর, জর্জ হ্যারিসন ও বব ডিলানের কথা? তাঁদের মহান অবদানের কথা? বব ডিলান ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠানে পাঁচটি গান গেয়েছিলেন। যার মধ্যে আগের থেকে জনপ্রিয় ‘Blowin In The Wind' গানটি আরও জনপ্রিয় হয়েছিল। বব ডিলানের গানটি অনুবাদ করে গেয়েছিলেন শিল্পী কবীর সুমন। আবার এই বব ডিলানই ভিয়েতনামের জন্য গান করেছেন ১৯৬০ সালে তখন ভিয়েতনামে যুদ্ধে চলছিল। সেসময় বব ডিলানের গান ভিয়েতনামে শান্তির প্রচারণা জোরদার করেছিল। শুধু ভিয়েতনাম নয়। বব ডিলানের গান শুনে আমেরিকা, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশে শান্তির আন্দোলন চাঙ্গা হয়েছিল।

কবীর সুমন বব ডিলানের নোবেল প্রাপ্তিতে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছেন, ‘সুরে নয় আমি বাঁধা পড়েছিলাম ডিলানের গানের কথায়। ওঁর গানের প্রতিটি কথা জীবনমুখী।’ ডিলানকে নোবেল সম্মান দেওয়ার কথা শুনে উচ্ছ্বসিত তিনি। বলেন, “আমার এক বন্ধুর বাড়িতে ডিলানের গান প্রথম শুনেছিলাম ‘দ্য হার্ড রেইন গোনা ফল’। আজও মনে আছে গানটি শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।” তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের পর আমার প্রিয় কোনো গায়ক নোবেল সম্মান পাচ্ছেন। আমি খুব খুশি। আমার জীবনে বব ডিলানের প্রভাব অপরিসীম। যদিও আমার গুরু তিনি নন। কিন্তু আমার গানে-জীবনে ডিলানের প্রভাব রয়েছে।’

তাই তো কবীর সুমন বব ডিলানের ব্লোইন ইন দ্য উইন্ড অনুবাদ করে গেয়েছেন, 

কতটা পথ পেরোলে পাখি জিরোবে তার ডানায়?
কতটা অপচয়ের পর মানুষ চেনা যায়?
প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও তো জানা।
কত বছর পাহাড় বাঁচে ভেঙে যাবার আগে?
কত বছর মানুষ বাঁচে পায়ে শেকল পরে?
ক’বার তুমি অন্ধ সেজে থাকার অনুরাগে?
বলবে তুমি দেখছিলে না তেমন ভালো করে।
কত হাজারবারের পর আকাশ দেখা যাবে?
কতটা কান পাতলে তবে কান্না শোনা যাবে?
কত হাজার মরলে তবে মানবে তুমি শেষে?
বড্ড বেশি মানুষ গেছে বানের জলে ভেসে।

কবীর সুমনের মতো পশ্চিমবঙ্গের আরেক জনপ্রিয় শিল্পী ও চলচ্চিত্র পরিচালক অঞ্জন দত্তের গানেও উঠে এসেছে বব ডিলানের কথা। অঞ্জন দত্তের জনপ্রিয় গান পুরোনো গিটারের সেই লাইনটির কথা অনেকেরই মনে থাকবে। জন লেননের সোচ্চার ভালোবাসা, বব ডিলানের অভিমান!

মোদ্দাকথা বব ডিলানকে বাংলাদেশের লালন সাঁই ও হাসন রাজার সাথে তুলনা করা যায়। মানবতার বাণী জোরালোভাবে উচ্চারিত হয়েছে কিংবদন্তি মার্কিন গীতিকবি ও কণ্ঠশিল্পী বব ডিলানের প্রতিটি গানে। হাতের গিটার বা হারমোনিকা। কখনো যুদ্ধের বিরোধিতা। কখনো যুব প্রজন্মের চাওয়া পাওয়া নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভ। চারপাশের অস্থিরতার কথা, আশা-আকাঙ্ক্ষা উঠে এসেছে বব ডিলানের গানে। শুধু আমেরিকা নয় গোটা বিশ্ব মুগ্ধ তাঁর সংগীতের কাব্যিক ব্যঞ্জনায়। তারই স্বীকৃতি দিল নোবেল কমিটি।

আসলে আমরা অনেকেই প্রশংসা ও সমালোচনা গুলিয়ে ফেলি। সমালোচনা করি, কীর্তিমানের পুরোটা না জেনেই। পুরস্কারের প্রশংসাপত্রে নোবেল কমিটি বলেছে, ডিলানকে এ পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে আমেরিকার মহান সংগীত-ঐতিহ্যে নতুন কাব্যিক অভিব্যক্তি সৃষ্টির জন্য। 'The Nobel Prize in Literature 2016 was awarded to Bob Dylan  for having created new poetic expressions within the great American song tradition.'

২০১৩ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর বিখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক বিল উইম্যান নিউইয়র্ক টাইমস-এ 'Knock, Knock, Knockin' on Nobel's Door' নামে একটি কলাম লিখেছিলেন। যেখানে বিল উইম্যান গোটা বিশ্বের খ্যাতিমান সাহিত্যিকদের সঙ্গে বব ডিলানের গানকে তুলনা করে বব ডিলানকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য সুপারিশ করেছিলেন। ১৩ অক্টোবর বৃহস্পতিবার স্টকহোমে নোবেল পুরস্কার ঘোষণার পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ১৮ সদস্যের সুইডিশ একাডেমি’র স্থায়ী সেক্রেটারি ও লিটারারি স্কলার সারা দানিউস বলেছেন, 'Mr. Dylan a great poet in the English-speaking tradition and compared him to Homer and Sappho, whose work was delivered orally'. 

যাঁকে গোটা বিশ্ব জনপ্রিয় গায়ক হিসেবে চেনে, তাঁর হাতে সাহিত্যে নোবেল তুলে দিলে অনেকেরই যে ভ্রু কুঁচকে যাবে, সেটা পুরস্কারের আয়োজকেরা আগাম অনুমান করেছেন। সেজন্য স্টকহোমে পুরস্কার ঘোষণার সময় সুইডিশ একাডেমির স্থায়ী সচিব সারা ড্যানিয়ুস বলেছেন, তিনি আশা করছেন, এই সিদ্ধান্তের জন্য একাডেমিকে সমালোচনা করা হবে না। ড্যানিয়ুস আরো বলেছেন, ডিলানকে বেছে নেওয়া বিস্ময়কর মনে হতে পারে, তবে ‘পেছন ফিরে তাকালে আপনারা (গ্রিক কবি) হোমার ও সাফোকে দেখতে পাবেন। তাঁরা কাব্যিক লেখা লিখেছেন, যেগুলো লেখা হয়েছে কেবল গান গেয়ে শোনানোর জন্য, পরিবেশন করার জন্য, বব ডিলানের ক্ষেত্রে একই কথা খাটে। তাঁকে পড়াও যায় এবং পড়াই উচিত। ইংলিশ ঐতিহ্যমাফিক তিনি এক মহান কবি।’

পুরস্কারের প্রবর্তক আলফ্রেড নোবেলের উইলে বলা আছে, সাহিত্যে নোবেল পাবেন সেই লোক, যিনি ‘সাহিত্যের ক্ষেত্রে একটি আদর্শ অভিমুখে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখেছেন।’ ডিলান যে এই শর্ত পূরণ করেন, সেটা বোঝানোর জন্য ১৮ সদস্যের বাছাই কমিটিকে এই তথ্যটুকুও যোগ করতে হয়েছে যে, ডিলানের গানের লিরিকস বই আকারে বের হয় এবং সেগুলোর একাধিক সংস্করণ প্রকাশ করতে হয়। তাছাড়া ডিলান টারানটুলা নামে একটি গদ্যকবিতার বইসহ নানারকম নিরীক্ষাধর্মী সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি করেছেন। এর বাইরে তিনি যে একজন সক্রিয় পেইন্টার, নোবেল ঘোষণায় সে কথাও বলা হয়েছে। 

বব ডিলানের ‘ব্লোয়িন ইন দ্য উইন্ড’ আর ‘টাইমস দে আর-চেঞ্জিং’ গান ষাটের দশকে আমেরিকায় সিভিল রাইটস আন্দোলনে জাতীয় সংগীতে পরিণত হয়েছিল। শুরুতে ফোক মিউজিকের ঘরানায় থাকলেও সেই ধারা ভেঙে বেরিয়ে আসেন ডিলান। এরপর কেবলই প্রথা ভেঙেছেন। ‘রোলিং স্টোন’ গানের গড়িয়ে পড়া পাথরখণ্ডের মতোই নিরন্তর এক বিদ্রোহী মেজাজে গড়িয়ে গেছেন, কোনো শেওলা জমতে দেননি গায়ে। ২০০৪ সালে বেরিয়েছে তাঁর তিন পর্বের আত্মজীবনীর প্রথম পর্ব ক্রনিকলস : ভলিউম ওয়ান, যার শেষ অধ্যায়ে তিনি বর্ণনা করেছেন, মার্কিন ব্লুজ গায়ক রবার্ট লেরয় জনসনের গান শুনে তিনি নিজে গান লেখার অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। মার্কিন কবি এন্ড্রু মোশন তাঁর গানের কথাকে কবিতা হিসেবেই পড়তে বলেছেন।

১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যে নোবেল পেয়েছিলেন, তখন সুইডিশ নোবেল কমিটি রবীন্দ্রনাথের গীতি-কবিতায় প্রকৃতির মধুর সুর মূর্চ্ছনায় আত্মায় শান্তি বর্ষণ করে বলে বর্ণনা করেছিলেন। ঠিক ১০৩ বছর পর এবার আবার গীতি-কবিতার জন্য সাহিত্যে নোবেল পেলেন বিশ্বের অন্যতম ইনফ্লুয়েনসিয়াল মিউজিশিয়ান ও গীতিকার বব ডিলান।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন গীতাঞ্জলিতে। আসলে বলতে গেলে ঠিক গীতাঞ্জলিতে নয়,  তিনি নোবেল পেয়েছিলেন Song Offerings-এ এটি ইংরেজিতে অনুবাদ করা রবীন্দ্রনাথের একটি গ্রন্থ যেখানে সবচেয়ে বেশি অনূদিত হয়েছিল গীতাঞ্জলি থেকে--৫৩টি। এছাড়া নৈবেদ্যর ১৫, শিশুর ৩, খেয়ার ১১, গীতিমাল্যের ১৬, চৈতালীর ১, স্মরণের ১, কল্পনার ১, উৎসর্গের ১ ও অচলায়তনের ১ টিসহ মোট ১০৩ টি ‘গান’ রয়েছে এই Song Offerings-এ।

বব ডিলান সাধারণত গিটার, হারমোনিকা এবং কীবোর্ড বাজিয়ে গান করেন। ১৯৮০ দশক থেকে কয়েকজন সংগীতজ্ঞকে নিয়ে নিয়মিত সংগীত ভ্রমণ করেন। ডিলানের ভাষায় ‘নেভার এন্ডিং টুর’। তিনি বিশিষ্ট অনেক শিল্পীর সাথে কাজ করেছেন। যেমন : দ্য ব্যান্ড, টম পেটি, জোয়ান বায়েজ, জর্জ হ্যারিসন,  দ্য গ্রেটফুল ডেড, জনি ক্যাশ, উইলি নেলসন, পল সিমন, এরিক ক্ল্যাপটন, প্যাটি স্মিথ, দ্য রোলিং স্টোনস, জনি মিচেল, জ্যাক হোয়াইট, নেইল ইয়ং, ভয়ান মরিসন, রিঙ্গো স্টার এবং স্টিভি নিকস। যদিও তার ক্যারিয়ারে গায়ক হিসেবেই তিনি বেশি পরিচিত এবং সফল হয়েছেন, তবে গীতিকার হিসেবেই তার অবদানকে বেশি মূল্য দেওয়া হয়।

সংগীতে অসামান্য অবদানের জন্য নোবেল প্রাপ্তির আগে বব ডিলান গ্রামি এ্যাডওয়ার্ড, গোল্ডেন গ্লোব এবং অস্কার পুরস্কার জিতেছেন এবং রক অ্যান্ড রোল হল অব ফেম, ন্যাশভিল সংরাইটার্স হল অব ফেম, ও সংরাইটার্স হল অব ফেম এ তাঁর নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। টাইম ম্যাগাজিনের প্রকাশিত বিংশ শতকের শ্রেষ্ঠ ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় তাঁর নাম রয়েছে। ২০০৪ সালে রোলিং স্টোন ম্যাগাজিন প্রকাশিত সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ১০০ গায়ক তালিকায় ‘দ্য বিটলসের’ পর বব ডিলান দ্বিতীয় অবস্থান দখল করেছেন। ১৯৯০ সালের জানুয়ারিতে ডিলানকে ফরাসি সংস্কৃতি মন্ত্রী জ্যাক ল্যাং কর্তৃক কমান্ডার দেস আর্টস এট দেস লেটার্স উপাধিতে ভূষিত করেছেন; ২০০০ সালে রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব মিউজিক তাকে পোলার মিউজিক পুরস্কার প্রদান করেন এবং ২০০৭ সালে ডিলানকে সংস্কৃতিতে প্রিন্স অব অস্ট্রিয়াস পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে।

বব ডিলানের শৈশব কেটেছে ডুলুথ ও হিবিং এলাকায় লেক সুপিরিয়রের পার্শ্ববর্তী মেসাবি আয়রন রেঞ্জ এলাকায়। ডিলানের জীবনী লেখকেরা গবেষণা করে দেখেছেন তার দাদা-দাদি জিগম্যান ও আনা জিমারম্যান ইউক্রেনের ওডেসা থেকে অভিবাসিত হয়ে ১৯০৫ সালের দিকে আমেরিকায় বসতি স্থাপন করেছিলেন। তার পিতা অ্যাব্রাম জিমারম্যান ও মাতা বেয়াট্রিস। ডিলনের মা ছিলেন কোমল ও বন্ধুত্বপূর্ণ স্বভাবের।

জিমারম্যান যৌবনের অনেকটা সময় রেডিও শুনে কাটিয়েছেন। প্রথমত তিনি শুনতেন ব্লুজ ও কান্ট্রি গান যা প্রচারিত হতো শ্রেভেপোর্ট থেকে। পরবর্তীকালে তিনি প্রথম দিককার রক অ্যান্ড রোল সংগীতের দিকে ঝুঁকে পড়েন। উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াকালীন তিনি কয়েকটি ব্যান্ড গঠন করেছিলেন। প্রথম ব্যান্ড ‘দ্য শ্যাডো ব্লাস্টার্স’ নিয়ে খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। পরে প্রতিষ্ঠা করেন ব্যান্ড ‘দ্য গোল্ডেন কর্ডস।’

১৯৫৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জিমারম্যান ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটা তে ভর্তি হন এবং মিনিয়াপোলিসে বসবাস শুরু করেন। রক অ্যান্ড রোলে তার প্রথম দিককার উৎসাহ থেকে তিনি আমেরিকান ফোক সংগীতে, বিশেষত যেসব সংগীতে অ্যাকুস্টিক গিটার ব্যবহৃত হয় তার প্রতি আকৃষ্ট হন। এক সাক্ষাৎকারে বব ডিলান বলেন, “যে প্রথম বিষয় আমাকে ফোক সংগীতে আকৃষ্ট করেছে তা হচ্ছে en:Odetta। আমি একটি দোকানে তার রেকর্ড শুনি। এরপর সেখান থেকেই আমি আমার ইলেকট্রিক গিটার ও অ্যাম্পলিফায়ার বদলে অ্যাকুস্টিক গিটার আনি একটি ফ্লাট-টপ গিবসন।”

ডিঙ্কিটাউনে থাকাকালীন জিমারম্যান নিজেকে বব ডিলান নামে পরিচয় দিতে শুরু করেন। তার আত্মজীবনী ক্রনিকলস (২০০৪) তিনি লিখেছেন : বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর আমি নিজেকে রবার্ট অ্যালেন নামে ডাকতে শুরু করলাম... এটা শুনলে মনে হতো কোনো স্কটিশ রাজার নাম এবং এটা আমি পছন্দ করতাম। তবে ডাউনবিট ম্যাগাজিন পড়ে তিনি জানতে পারেন ডেভিড অ্যালিন নামে বাস্তবে একজন স্যাক্সোফোন বাদকের অস্তিত্ব রয়েছে। এসময় ডিলান থমাসের কবিতার সাথে তার পরিচয় ঘটে। রবার্ট জিমারম্যান অনুভব করছিলেন রবার্ট অ্যালিন ও রবার্ট ডিলান থেকে তাকে একটাকে বেছে নিতে হবে। শেষ পর্যন্ত ডিলানকেই তার পছন্দ হয়। তিনি নামের আগে বব যোগ করার সিদ্ধান্ত নেন, কেননা তখন জনপ্রিয়ধারার অনেক শিল্পীর নামেই বব ছিল।

১৯৬৫ সালের ২২ নভেম্বর বব ডিলান বিয়ে করেন সারা লাউন্ডসকে। ডিলান ও সারা’র চার সন্তান। জেসে বায়রন ডিলান (জন্ম ৬ জানুয়ারি ১৯৬৬), আন্না লিও (জন্ম ১১ জুলাই ১৯৬৭), স্যামুয়েল আইজাক আব্রাম (জন্ম ৩০ জুলাই ১৯৬৮) ও জ্যাকব ডিলান (জন্ম ৯ ডিসেম্বর ১৯৬৯)। এছাড়া ডিলানের অ্যাডাবটেড সন্তান মারিয়া লাউন্ডস (সারা’র আগের পরিবারের সন্তান, জন্ম ২১ অক্টোবর ১৯৬১) পরে যিনি মারিয়া ডিলান নামে পরিচিতি পান। বব ও সারা’র মধ্যে ১৯৭৭ সালের ২৯ জুন ডিভোর্স হয়। ১৯৮৮ সালে মারিয়া ডিলান বিয়ে করেন বিখ্যাত সংগীতশিল্পী পিটার হিমেলম্যানকে। ‘দ্য ওয়ালপ্লাওয়ার্স’ ব্যান্ডদলের লিড সিঙ্গার বব ডিলানের ছেলে জ্যাকব ডিলান। বড় ছেলে জেসে ডিলান একজন ফিল্ম ডিরেক্টর ও সফল বিজনেসম্যান।

১৯৮৬ সালের ৪ জুন বব ডিলান তাঁর ব্যাকআপ সিঙ্গার ক্যারোল ডেনিসকে বিয়ে করেন। তাঁদের সন্তান ক্যারোলিন ডেনিসের জন্ম তাঁদের বিয়ের আগে ১৯৮৬ সালের ৩১ জানুয়ারি। ১৯৯২ সালে ক্যারোল ও ডিলানের মধ্যে ডিভোর্স হয়। তাঁদের এই সন্তানের কথা অবশ্য ২০০১ সাল পর্যন্ত গোপন ছিল। ২০০১ সালে বব ডিলানের আত্মজীবনীমূলক বই ‘ডাউন দ্য হাইওয়ে : দ্য লাইফ অব বব ডিলান’ প্রকাশিত হলে সেখানে ক্যারোলিন ডেনিসের বিষয়টি জানা যায়।

বব ডিলানের বিখ্যাত অ্যালবামগুলো হলো--বব ডিলান (১৯৬২), ব্রিংগিং ইট অল ব্যাক হোম (১৯৬৫), হাইওয়ে ৬১ রিভিজিটেড (১৯৬৫), ব্লন্ডে অন ব্লন্ডে (১৯৬৬), ব্ল্যাড অন দ্য ট্রাকস (১৯৭৫), ও মার্সি (১৯৮৯), টাইম আউট অব মাইন্ড (১৯৯৭), লাভ অ্যান্ড থেফট (২০০১), মডার্ন টাইমস (২০০৬)। চলচ্চিত্র নির্মাতা ডিএ পেনেবাকের বব ডিলানের ওপর নির্মাণ করেন প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘ডোন্ট লুক ব্যাক (১৯৬৭)। বব ডিলানের লেখা বইগুলো হলো-তারানতুলা (১৯৭১), রাইটিংস অ্যান্ড ড্রয়িংস (১৯৭৩), ডাউন দ্য হাইওয়ে : দ্য লাইফ অব বব ডিলান (২০০১), ক্রনিকেলস (২০০৪) এবং নেভার এন্ডিং ট্যুর। 

অতীত ও বর্তমানের মতো আগামী দিনেও নতুন ছন্দ আর সুরে গোটা বিশ্বকে মুগ্ধ করে রাখবেন ভুবন জয়ী সুরস্রষ্টা বব ডিলান। বব ডিলান যেমন বলেন, 'The Times They Are a-Changin' : 'This was definitely a song with a purpose. I wanted to write a big song, some kind of theme song, with short concise verses that piled up on each other in a hypnotic way. The civil rights movement and the folk music movement were pretty close and allied together at that time.'

সুইডিশ একাডেমি সাহিত্যে একজন কীর্তিমান বব ডিলানকে পুরস্কার প্রদান করে পুরস্কার প্রদানে যথার্থতা প্রমাণ করেছেন। ডিলানকে পুরস্কৃত করে নিজেরাই ধন্য হয়েছেন। পুরস্কার প্রদানের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে বব ডিলানকে নিয়ে তাঁদের যে বিশ্লেষণ তাও যথার্থ নিঃসন্দেহে।

menu
menu