স্টিফেন হকিং : থিওরি অফ এভরিথিং

আমরা কে? কেন আমরা এই মহাবিশ্বে এলাম? এই মহাবিশ্বের উৎপত্তি কীভাবে? এই মহাবিশ্ব তৈরিতে আদৌ সৃষ্টিকর্তার কোনো অবদান আছে কি? কিংবা সৃষ্টিকর্তার মন কীভাবে কাজ করে? জটিল এসকল প্রশ্নের সমাধান করতে চেয়েছিলেন যে মানুষটি তিনি হলেন, বর্তমান সময়ের শ্রেষ্ঠ তাত্ত্বিক পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং। ১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি গ্যালিলিওর ৩০০তম মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে জন্মগ্রহণ করেন স্টিফেন উইলিয়াম হকিং। আলবার্ট আইনস্টানের পর তাকেই শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী ধরা হয়।

দর্শনবিদ্যাকে তোয়াক্কা না করে বিজ্ঞানের সমীকরণের মাধ্যমে, ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন এই সৃষ্টিজগতকে যেমন করে বিজ্ঞানের শুরুর দিকে পিথাগোরাস চেয়েছিলেন--সৃষ্টিজগত তথা মানুষের মনকে সমীকরণের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করতে। পরীক্ষামূলক ও গাণিতিক পদার্থবিদ্যায় দক্ষ মহান বিজ্ঞানী নিউটন--যে দৈত্যের কাঁধের ওপর ভর করে দেখেছেন মহাবিশ্বকে, সেই গ্যালিলিও তার জীবন অবিবাহিত করেন কারাগারে। তবুও গ্যালিলিও হার মানেননি-ধর্মীয় কুসংস্কার ও এরিস্টটলের প্রভাবের; ঠিক সেই ধারাবাহিকতা ছিল আলবার্ট আইনস্টাইনের। যিনি তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যাকে আরও দূরে নিয়ে গেছেন ম্যাক্সওয়েল ও নিউটনের হাত ধরে। অবশেষে আইনস্টানের চিন্তাকে আরও সুদৃঢ় করেন স্টিফেন হকিং। ব্যাক্লহোল ও কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি তার গবেষণার মূল বিষয়। এই দুই তত্ত্বের সমন্বয় করে তিনি প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন গ্র্যান্ড ইউনিফিকেশন থিওরি বা থিওরি অব এভরিথিং।

যে তত্ত্বের মাধ্যমে সমস্ত সৃষ্টিজগত তথা স্রষ্টাকে প্রকাশ সম্ভব। যে তত্ত্ব সম্পন্ন করতে চেয়েছেন আলবার্ট আইনস্টাইন। যিনি ৩৫ বছর বয়সে সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব প্রকাশ করার পর বাকি জীবন কাটান গ্র্যান্ড ইউনিফিকেশন তত্ত্বের পিছনে। তৎকালীন সময়ে প্রযুক্তি এতটা উন্নত ছিল না। তথ্য-উপাত্ত অপর্যাপ্ত ছিল । ফলে আইনস্টাইনের স্বপ্ন পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। আশির দশকে রিচার্ড ফেইনম্যানের আপেক্ষিক তত্ত্বের সমাধান ব্ল্যাকহোলের ধারণাকে বিকশিত করলেও Grand Unification  অধরাই রয়ে যায়। সেই অধরা স্বপ্নকে আবারো মুক্তভাবে আকরে ধরেন স্টিফেন হকিং।

স্টিফেন হকিংয়ের এই প্রচেষ্টাকে বুঝতে হলে আমাদেরকে পিছনে ফিরে তাকাতে হবে। প্রাচীনযুগে বিজ্ঞান কিছু নীতিবিন্দু ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। অধম পৃথিবী ছিল হাতির শুড়ের উপর আর হাতি দাঁড়িয়ে ছিল বিশাল কচ্ছপের উপর। তাহলে কচ্ছপ কিসের উপর দাঁড়িয়েছিল। ছিল না কোনো সঠিক উত্তর। পৃথিবীকে তখন কল্পনা করা হতো থালার ন্যায় চ্যাপ্টা। কোপারনিকাস ও কেপলারের হাত ধরে পৃথিবী কেন্দ্রিক, মহাবিশ্ব থেকে আমরা বেরিয়ে আসি সূর্যকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের দিকে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞানীদের সাহস ছিল না, এরিস্টটলের ধারণার বাইরে কথা বলার। এরিস্টটল-দর্শন, অর্থনীতি, জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সফল অবদান রাখলেও পদার্থবিদ্যার তাঁর তত্ত্ব নির্ভুল ছিল না।

এরিস্টটলের ধারণা ছিল তীর্যকভাবে নিক্ষিপ্ত বস্তশক্তি হারিয়ে হঠাৎ করে মাটিতে পরে যাবে, ভারী বস্তু হালকা বস্তুুর আগে মাটিতে পড়বে, অথবা সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘূর্ণায়মান। এই তত্ত্ব তৎকালীন সময়ে বাইবেল বিরোধী ছিল। কিন্তু গ্যালিলিও সরল দোলকের পর্যায়কাল পর্যবেক্ষণ করে--সৃষ্টির তিন রহস্য প্রকাশ করেন। ভারী ও হালকা বস্তুুর সমসময়ে পতন, সৌরকেন্দ্রিক পৃথিবী তাকে তখন দাঁড় করায় তৎকালীন পোপের কাঠগড়ায়। কিন্তু, তার  বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফল থেকে--তিনি সরে দাঁড়াননি। তখন থেকেই ব্যাপ্ত হতে থাকে পদার্থবিজ্ঞানের শক্তির সমন্বয়ের বীজ। পরবর্তীতে মহান তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী নিউটন এসে সফলভাবে ব্যাখ্যা করেন--মহাকর্ষ সূত্র ও গ্রহগুলোর সঠিক আবর্তন।

নিউটনের মৃত্যুর পরও তড়িৎশক্তি ও চুম্বকশক্তি থেকে যায় দুটি আলাদা শক্তি হিসাবে। এই দুই শক্তিকে একত্র করেন আরেক তাত্ত্বিক পদার্থবিদ জেমস ক্লার্ক-ম্যাক্সওয়েল। তার তড়িৎচৌম্বক তত্ত¡ ছিল পদার্থ বিজ্ঞানের একটি সফল সমন্বয়।

১৯০৫ সালে আলবার্ট আইনস্টাইন আপেক্ষিক তত্ত্বের মাধ্যমে পালটে দেয় বিশ্ব সম্পর্ক সকল ধারণা। নিউটনের ধ্রুব স্থান ও সময় তখন হয়ে গেল আপেক্ষিক, ত্রিমাত্রিক মহাবিশ্ব তখন ধারণ করল চারমাত্রা। যোগ হলো আরেকটি স্থানাঙ্ক সময়। ম্যাক্স প্ল্যাংকের কৃঞ্চবস্তুর বিকিরণে ব্যবহার হয় কোয়ান্টাম বল বিজ্ঞান। শুরু হয় আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞানের যাত্রা। ১৯১৬ সালে আইনস্টাইন তার যুগান্তকারী ‘সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব’ প্রকাশ করলে ও কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানকে সঠিকভাবে মেনে নিতে পারেননি। কিন্তু সকল পরীক্ষায় কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান সফল ব্যাখ্যা করে।

এবার আসা যাক সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব ও কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানের পার্থক্য কোথায়? সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের স্কেলে সকল গ্রহ, নক্ষত্র ও মহাকর্ষকে সফলভাবে ব্যাখ্যা করে, অপর দিকে কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান ক্ষুদ্র  স্কেলে পরমাণুর অভ্যন্তরের ঘটনা ব্যাখ্যা করে। কিন্তু এ দুটি তত্ত্ব একটি অপরটির বিপরীতমুখী ও একে অপরকে সঠিক ব্যাখ্যা করতে পারে না। ল্যামেটার সৃষ্টিজগত সৃষ্টি সম্পর্কে বিগব্যাংক তত্ত্ব, প্যানরোজের সিংগুলারিটি, সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব ও কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানের একাত্মতাকে একীভূত করার ইঙ্গিত প্রকাশ করে। এই দুই তত্ত্বকে এক করেন কোয়ান্টাম গ্রাভিটির কাজে এগিয়ে আসেন বর্তমান সময়ের আলোচিত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং।

হকিংয়ের এই তত্ত্ব বোঝার আগে এবারে ঘুরে আসি ব্ল্যাকহোল থেকে। আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বকে সমাধান করলে ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। সূর্যের চেয়ে প্রায় ১.৫ গুণ ভারী নক্ষত্র যখন জ্বালানী  শেষ করে আকারে ছোট হতে থাকে তখন তার মহাকর্ষ শক্তি বৃদ্ধি পায়। তারকার কেন্দ্রে শক্তি এত বিশাল হয় কোনো আলোকরশ্মি, সেখান থেকে বের হতে পারে না। আলো না আসার কারণে নক্ষত্রটি আর দৃষ্টিগোচর হয় না বলে তাকে ব্ল্যাকহোল বলে। আলবার্ট আইনস্টানের ভবিষ্যৎবাণী ও স্টিফেন হকিং-এর রেডিয়েশন তত্ত্ব প্রমাণ করে যে ব্ল্যাকহোল থেকেও বিকিরণ হয়। ২০১৭ সালে তা প্রমাণিত হয়। তাহলে ব্ল্যাকহোলের সঙ্গে বিগ ব্যাংয়ের তত্ত্বের কী সম্পর্ক?

স্টিফেন হকিং বিগব্যাং তত্ত্বের যে জোড়ালো সমর্থন করেন তা আসলে কী ? আসলে বিগ ব্যাং মানে হলো মহাবিস্ফোরণ। যে বিস্ফোরণের মাধ্যমে সৃষ্টি হয় মহাবিশ্ব। বিগব্যাংয়ের পূর্ববর্তী সময়ে মহাবিশ্বের সকল শক্তি ও পদার্থ একটি পরমাণুর আকারে রক্ষিত ছিল। প্যানরোজেরসিং গুলারিটি বলতে ওই ক্ষুদ্র পরমাণুটার আকারকে  বোঝানো হয়। তাহলে ওই সময় নিশ্চয়ই সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব ও কোয়ান্টাম তত্ত্ব একীভূত ছিল। আর এই তত্বকে গাণিতিক রূপ দিতে কাজ করেন হকিং। বিগ ব্যাংতত্ত্বকে যদি সফল ভাবে ব্যাখ্যা করা যায় তাহলে আমরা পেয়ে ∆ut আর জেনে যাব সৃষ্টির সম্পূর্ণ রহস্য। সফল হবে স্টিফেন হকিংয়ের স্বপ্ন।

২১ বছর বয়সে মোটরনিউরন ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েও থেমে থাকেনি হকিংয়ের স্বপ্ন। সমাধান করেন সৃষ্টির রহস্য। রচনা করেন  A Brief Histort of Time  যা পৃথিবীর সর্বাধিক বিক্রিত একটি বই। কোনো গাণিতিক সমীকরণ ছাড়া বিজ্ঞানকে অসাধারণভাবে সহজ ভাষায় সবার কাছে উপস্থাপন করেন। বুঝাতে চেয়েছেন সৃষ্টির রহস্য। এই বইতে সৃষ্টিকর্তাকে তিনি  ইলুশন হিসাবে প্রকাশ করলেও পরবর্তীতে তার স্যান্ড ডিজাইনে সৃষ্টিকর্তাকে একেবারেই আড়াল করে দেন। স্টিফেন হকিং বিজ্ঞান ও মানবতাকে একসূত্রে বেঁধেছেন।

তিনি বলেছেন, এক সময় আমি মনে করতাম--পদার্থ বিজ্ঞানের যুগ শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু প্রকৃত পক্ষে আমার মৃত্যুর পরও তা চলমান থাকবে। যদিও তার Theory of Everything -এর কাজ সমাপ্ত হয়নি, হয়তো কোনো একদিন অন্য কারো হাত ধরে সমাধান হবে এই সৃষ্টির রহস্য।

menu
menu