মামুন হুসাইনের গল্প নিয়ে সামান্য কথন

সোসিও ডাক্তার ফারাহার নিকট থেকে প্রাপ্ত হাসপাতাল বিষয়ক যে বঙ্গানুবাদ টেবিলে স্তূপের মতো জমে ওঠে তা ঘেঁটে শেষ করতে না পারলেও বুঝে নেয়া যায় গল্পকার মামুন হুসাইন (জ.১৯৬২) নিজেও একজন সুচিকিৎসক হিসেবে আমাদের (সাধারণ মানুষের) একমাত্র সরকারি ‘হাসপাতাল বঙ্গানুবাদ’ (২০১২) করার মাধ্যমে যে কোডিং উন্মোচন করে দিয়েছেন সেসব রিপোর্ট নিঃসন্দেহে ঔষধ পথ্যহীন মৃত্যুর দিকে ইশারা করে। রিপোর্ট তৈরির আগে : ‘ড. ফারাহ দেখছিল, জুতো পালিস হচ্ছে। করিডোরে বাদাম, কাপড়-জামা ও চাদর বেচাবিক্রি চলছে। রোগী হাসপাতাল থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার জন্য ভালোমানুষের মুখ করে বিচ্ছিষ্ট ব্যক্তিবর্গ শাহজাদী জর্দার সুঘ্রাণ ছড়িয়ে চলেছে জায়গায়। আর রোগী নামক গরিব মানুষটি ঘরের সমস্ত সম্পদ বন্ধক রেখে সংগৃহীত টাকা-পয়সা ভালো-মানুষ-চতুর ব্যক্তিটির হাতে তুলে দিতে দিতে তেলাপোকা উড়ে বেড়ানো, ড্রেন উপচে যাওয়া জল¯্রােতে নিমগ্ন ক্লিনিকের গভীর আঁধারে হারিয়ে যাচ্ছে শহরের ডাক্তারের লোভে।’ -(হাসপাতাল বঙ্গানুবাদ, পৃ.৩৩) ‘মর্নিং শোজ দ্য ডে’-হাসপাতালের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও ডাক্তারদের প্রথানুগ যে জীবনপ্রণালী এবং হাসপাতাল সম্পর্কিত যে অভিজ্ঞতা হয়, তা আমাদেরকে অনুৎসাহিত করে সরকারি হাসপাতাল অভিমুখি হওয়ার ব্যাপারে। তারপরও আঠারো কোটি মানুষের ক্ষুদ্র দেশের অসংখ্য দরিদ্র-অভুক্ত মানুষ ছুটে আসে বাঁচার আসা নিয়ে। কেউ বাঁচে আর কেউবা ফিরে যেতে পারে না পৈত্রিক জীন নিয়ে খড়-বিচালির পর্ণকুটিরে।

ড. ফারাহ হাসপাতালের আদ্যোন্ত জানার পর যেমন সে রিপোর্ট প্রকাশের মধ্য দিয়ে পৈত্রিক জীবন সংকটাপন্ন করতে চায় নি, অনুরূপ আমাদের চিকিৎসা নেয়ার খুঁটিনাটি অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে মেডিকেলের সামনের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে গিয়ে এক ধরনের ভয়ের ভূতে আক্রান্ত হয় কতিপয় মানুষ কিন্তু অধিকাংশ মানুষের উপায় থাকে না ভূতজনিত ভয়ের নিকট পরাজয় স্বীকার করে নিয়ে হাসপাতালের পথ এড়িয়ে যাওয়া। গল্পকার মামুন হুসাইন হাসপাতাল সিজার করার আগেই জনগণ এসব দুর্বহ-দুঃসহ ঘটনার মুখোমুখি হলেও নিরুপায় থাকে বঙ্গানুবাদ প্রকাশের ব্যাপারে। কেননা হাসপাতালের অনুবাদ হলে যে মানুষগুলো নিরুপায় হয়ে সেখানেই উপচে পড়ে তাদের বসবাস শান্ত সন্ত্রাসের কোনো গ্রামীণ জনপদে। যেখানে ‘যুদ্ধাপরাধ ও ভূমিব্যবস্থার অস্পষ্ট বিজ্ঞাপন’ (১৯৯৫) ঝুলে থাকলে জবরদখলের অনিবার্য লালসা আর ঈর্ষার অনলে তাদের অস্থিমজ্জা ডিমসিদ্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলে তারা বাধ্য হয়-হাসপাতালের ভয়ানক রিপোর্ট উপেক্ষা করেও ছুটির দিনে ওয়ার্ড পর্যন্ত গড়িয়ে বারান্দা ও সিঁড়ি অবধি পৌঁছে যাওয়ার  প্রতিযোগিতায়।

এসব প্রতিযোগিতা ছাড়াও চলে ডিভি লটারি আয়ত্ত করবার প্রবল দৌড়ঝাঁপ। আমেরিকাই জীবনের এন্ড গেম হয়ে ফিরে আসে আমাদের জীবনে। অথবা আমাদের সঞ্চিত অভিজ্ঞতায় যেমন ছিল আমবাড়িয়ার কৈলাশবাবুর ‘মৃতদের জন্য সমবেত প্রার্থনা’ করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কারণ, তখন কৈলাশ বাবু আমবাড়িয়া কিংবা দৌলতপুর জুড়ে চলে ‘কিলিং মিশন সেভেন এইট সিক্স’। এই অদ্ভুত হত্যা পরিকল্পনার অংশ যেমন সাধারণ মানুষ তেমনি দেশনন্দিত সেলিব্রেটি গল্পকার হাসান আজিজুল হকের মতো মুক্তবুদ্ধির মানুষও। ‘অতঃপর আমরা মৃত্যুস্রোত টপকে উদ্দেশ্যহীন হাঁটতে থাকি, নাকি আবার গোপন মৃত্যু মানুষ এসে পা ভাড়ি করে দেয়।’ -(নিক্রপলিস, পৃ.৯১) মৃত্যুর অপরিহার্য অনিবার্যতা অস্বীকার করবার উপায় নেই। নিক্রপলিসের ভেতর মৃত্যু সহজতর হবে ভাবলেও ‘কর্নেল এবং কিলিং বিষয়ক এন্ড গেম’ নামক শান্ত সন্ত্রাসের হাতে ভয়াবহ হয়ে উঠলে মানুষেরা পালাতে চায়। তারা কি দৌলতপুর, আমবাড়িয়া, আড়–য়া পাড়া ছেড়ে ডিভি লটারি জোগাড় করে আমেরিকা পাড়ি জমাবে? তাহলে কি মৃত্যু হবে না? আমাদের জীবনে ‘আমিরিগো দি এন্ড গেম’ হলেও মানুষের পিছনে ‘সেভেন এইট সিক্স কিলিং মিশন’ পিছু ছাড়ে না।

শহীদুল জহির কাহিনীর বয়ানে যেভাবে পেছনের ঘটনাকে পুনরাবৃত্তির মধ্য দিয়ে খেই হারিয়ে ফেলা পাঠককে চাঙা রাখেন গল্পের শেষছত্র পাঠ না করা অবধি, সেদিন থেকে মামুনের বয়ানরীতি ভিন্ন; বলা ভালো সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। মামুন হুসাইন গল্পের ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে শহীদুল জহিরের ন্যায় পুনরাবর্তন ত্যাগ করে টানা সামনে এগিয়ে যান এবং প্রতি বাক্যেই নবতর কাহিনীর কিংবা ঘটনার ইঙ্গিত দেন। ফলে তাঁর অনেক পাঠকই কাহিনীর সূচনা অথবা ঘটনাসূত্র হারিয়ে ফেলেন। তবে মামুনের গল্প পাঠের সময় যদি পাঠক সম্মুখ অগ্রসরমান ঘটনাক্রমের ভাষাকে গদ্যকবিতার পঙ্ক্তি হিসেবে করে তাহলে ভিন্নতর এক উপলব্ধি তৈরি হয়। কেননা মামুন হুসাইন প্রায় বিচ্ছিন্ন ঘটনারাশি ক্রমাগত জোড়া দিয়ে ক্রমাগত ঘটনাকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। পরিণামে সেই ঘটনাক্রমের সংশ্লেষণ ও তথ্য সমন্বয় বন্ধ করে দিলেই তাঁর গল্পের সমাপ্তি ঘটে। গল্পকার ঘটনাদির বর্ণনা থামিয়ে দিলেও পাঠক পরবর্তীতে সৃজনশীল প্রক্রিয়ায় গল্পের প্রত্যাশিত সুখকর পরিণাম দিতে পারেন অথবা নিজের মতো করে উপসংহারে পৌঁছে যেতে পারেন।

বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের ইতিহাসে মামুন হুসাইন যাত্রা শুরু করেন আশির দশকে; সেই হিসেবে ইতোমধ্যে তিনি প্রায় চার দশকব্যাপী কথাশিল্পের জগৎ ভ্রমণ করেছেন। একক ব্যক্তির চার দশক ধরে শিল্পের সঙ্গে নিরন্তর বসবাস কম কথা নয়; প্রায় চল্লিশ বছরে তাঁর রচনার তালিকা দীর্ঘ না হলেও একেবারে নগণ্যও নয়। প্রায় চার দশকে মামুন হুসাইনের গল্পগ্রন্থ ১৩টি এবং সাকুল্যে গল্পের সংখ্যা ৪৫টি। মামুন হুসাইনের গল্পের অর্ন্তগত পাঠসূত্র বয়ানের দীর্ঘ প্রস্তুতি নিয়ে তাঁর গল্পের গভীর চোরাস্রোতে নেমে অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয় : পুরোপুরি মামুন হুসাইন পাঠ-একজীবনে হয়তো আদৌ সম্ভব হয়ে উঠবে না। এদিক-সেদিক ঘুরতেই জীবনকাল অতিক্রান্ত হবে! আশার কথা এই যে, মামুন হুসাইনকে পাঠের বাল্যশিক্ষা জাতীয় এ পাঠসূত্র নির্মাণ-প্রকল্প অব্যাহত থাকবে ভবিষ্যতেও।

‘শান্ত সন্ত্রাসের চাঁদমারি’ মামুন হুসাইনের প্রথম গল্পগ্রন্থ; এতে সংকলিত হয়েছে ছয়টি গল্প। এ গল্পগ্রন্থের মাধ্যমে মামুন যে শিল্পযাত্রা শুরু করেছিলেন নব্বইয়ের মাঝামাঝি, তা ক্রমাগত সম্মুখগামী হয়েছে, উত্তরণ ঘটেছে রচনাশৈলীর। তাঁর গল্পের বয়ন-রীতি ও ভাষা-বিন্যাসের কৌশলে যে দুরূহ রহস্যের আবরণ তৈরি কিংবা বিচ্ছিন্ন ঘটনারাশির সংযোজন প্রক্রিয়ায় যে ধরনের দুর্বোধ্য ভাব তৈরি হয়েছিল প্রথম পর্যায়, তা ক্রমোত্তরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বর্তমানে আকর্ষণীয় একটি পেলব রূপ লাভ করেছে। অর্থাৎ মামুনের গল্পের একাধিক বিচ্ছিন্ন ঘটনা ও তথ্য কিভাবে সংযুক্ত করে গল্পের অবয়ব নির্মাণ করে নিতে হয়, তাঁর পাঠকবৃন্দ সে কাজটি এখন করতে পারে কিংবা কাহিনীর বিনির্মাণ সূত্র পেয়ে যায়।

মামুনের পাঠক একথা নিশ্চয় জানে যে, তিনি গল্পের দেহাবয়ব কিংবা কাহিনী নির্মাণের প্রচলরীতি এড়িয়ে প্রথম থেকেই বাংলা গল্পধারায় একটি ভিন্নমাত্রা ও ধারা সৃষ্টির লক্ষ্য স্থির করেই শুরু করেছিলেন। আর সে কারণেই মামুনের গল্প-উপন্যাসের গদ্যে সংবেদী-আত্মার বিস্ময়কর অথচ মৃদু-কুহকাচ্ছন্ন আলোক রেখা স্বীয় দীপ্তিতে বিসর্পিল ঢঙে অন্তর্বয়নের দিকে যাত্রা করে। মামুন হুসাইন গল্পের বৃহৎ কলেবরকে ভেঙে ভেঙে সেখানে উপন্যাস নির্মাণের বিস্তৃত পরিসরে মামুন নিজেকে মেলে ধরেছেন সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র গদ্যঢঙে এবং নিজস্ব ভাষায়। ইতোমধ্যে মামুনের ভাষাকৌশল এবং বাক্য-শব্দ নির্মাণের টেকনিক নিজস্বরীতিতে গড়ে উঠেছে। তাঁর গদ্যশৈলী কারো মতো নয় কিংবা অন্য কেউ তাঁর মতো নন। প্রথম গল্পগ্রন্থের পর ‘আমাদের জানা ছিল কিছু’ প্রকাশের মধ্যে সময়ের পার্থক্য চার বছর। গল্পকারের নিজেকে সংযত রাখার মধ্য দিয়ে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, শুধুমাত্র নন্দিত কিংবা প্রশংসিত হতে অথবা জনপ্রিয় লেখক হওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি সাহিত্যের দরজায় পা রাখেন নি। প্রথমাবধিই তিনি বাংলা গল্পের প্রচলরীতির কাহিনী নির্ভর সরল গল্পধারা এড়িয়ে গিয়ে বিসর্পিল বন্ধুর পথে হেঁটেছেন; নির্মাণ করতে চেয়েছেন-ভিন্ন আঙ্গিক, ভাষাকৌশল ও শিল্পরীতি।

আশির দশকে সামরিক শাসনাধীন বাংলাদেশ যে প্রকারন্তরে ‘শান্ত সন্ত্রাসের’ অধীন ছিল, তা সম্ভবত মামুনের মতো করে সমকালের অন্য কোনো গল্পকার তুলে ধরতে পারেন নি। সমগ্র বাংলাদেশকেই তিনি এ গল্পগ্রন্থে শান্তসন্ত্রাসের (শান্ত সন্ত্রাসের চাঁদমারি) জনপদ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এই সন্ত্রাস কবলিত জনপদে ‘যুদ্ধাপরাধ’ ঘটেছে একাত্তরে এবং পরে ‘ভূমিব্যবস্থার’ যে বণ্টন সরকারিভাবে করা হয়েছে, তা ‘অস্পষ্ট বিজ্ঞাপন’-এর সমান্তরাল। কিংবা জরবদখলের অনিবার্য লালসা আর ঈর্ষার অনলে দাউ দাউ জ্বলছে রারণের চিতার মতো অদ্যাবধি। সন্ত্রাস কবলিত জনপদ ছেড়ে লোকসকল প্রতিযোগিতা করে ডিভি লটারি আয়ত্তের; কেননা সাধারণ জনগণের সামনে আধিপত্য বিস্তারী দারিদ্র্য অতিক্রমের একমাত্রা উপায় বা এন্ড গেম হচ্ছে আমেরিকার গ্রিনকার্ড। সন্ত্রাস কবলিত বাংলাদেশ একাত্তরে স্বাধীনতা অর্জন করলেও সন্ত্রাসের শান্ত অথচ তীব্র উত্তাপ সাধারণ মানুষের জীবন থেকে অপসারিত হয় না।

মামুনের গল্পে তাই গোটা বাংলাদেশ নামক জনপদ হয়ে ওঠে ‘শান্ত সন্ত্রাসের চাঁদমারি’। সেই জনপদে বসেই মামুন স্বাধীনতার রক্ষাকবচ খুঁজেছেন এবং দেখেছেন স্বাধীনতার পর তা রক্ষার কৌশল স্বরূপ ‘আমাদের জানা ছিল কিছু’ অথবা ছিল না; বাংলাদেশ জুড়ে সাম্প্রদায়িকতার ভয়াবহ বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়লে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রে উদ্বাস্তু হয়েছে এদেশের মাইনর সম্প্রদায়। হিংসা-বিদ্বেষ অথবা সাম্প্রদায়িক মন নিয়ে দেশকে ভালোবাসা যায় না, আর দেশপ্রেম ছাড়া স্বাধীনতা রক্ষা করা যে সম্ভব নয় তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। দেশপ্রেম শিখে-জেনে সুনাগরিক হওয়ার পরিবর্তে আমাদের রাজনীতিকদের রাশিফলের ওপর অথবা জ্যেতিষীর নিকট ভবিষ্যৎ জেনে নিতে অধিক পছন্দ করলে ‘এ বছর কেমন যাবে’ তা জ্যোতিষী বাবা মুহূর্তে গুনেপড়ে বলে দেন। পরিণামে দেখা যায়, সমাগত বছর গত বছরের তুলনায় কঠিনতর সমস্যা-সংকুল হয়ে ওঠে। তখন সবকিছুই অন্ধকারে ডুবে যায়, ‘আঁধার সকলই দেখি’; কিন্তু তারপর জীবনের দায় টেনে বেড়াতে বেড়াতে ক্লান্ত হয়ে মামুন হুসাইনের নিকট ফিরলে তিনি ঢুলুঢুলু চোখ তুলে বলেন ‘ঘুমায়ে পড়িব আমি’।

অতঃপর আমরা ক্লান্ত হলে এবং গল্পকার তাঁর গল্পের ঝাঁপি বন্ধ করে দিলে, আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ শহিদের জন্য অথবা ‘মৃতদের আত্মার জন্য সমবেত প্রার্থনা’ করি। তখন আমাদের অনেকেই হয়তো জীবনের দায়ভার নির্বাহ করেত না পেরে চিরতরে ঘুমিয়ে গেছে আমাদেরই চোখের সামনে। এসব হয়তো আমাদের জানাই ছিল, তারপরও আমাদের অর্জিত বিদ্যাবুদ্ধি দিয়ে সংকটের-সমস্যার কোনো সমাধান অথবা প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে সক্ষম হই না। ‘মানুষের মৃত্যু হলে’ শিশু অথবা কিশোর বোঝে না তার স্বজন আর কখনো তাকে আদর করবে না, স্নেহ-ভালোবাসায় কোলে তুলে নেবে না। তারপরও অসংখ্য ‘মৃত্যু পুরাণ’ আমাদের জনপদে রাষ্ট্রযন্ত্রের নাকের ডগায় অপ্রতিরোধ্য হয় র‌্যাব অথবা মিলিটারি বাহিনীর ক্লিনহার্ট অপারেশনে। সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্র তার প্রজাদের ওপর এভাবে নির্দয় হলে কিংবা উদাসীন হলে, দরিদ্র প্রজারা মৃত্যুকেই স্বাগত জানায়; তখন মামুন গল্প লেখেন ‘স্বাগত মৃত্যুর পটভূমি’। তখন দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আমরা বিক্ষিপ্ত ঘোরাঘুরি শেষে ‘দুঃখের মধ্যে বিশ্রাম’ নেয়ার চেষ্টায় নিয়োজিত দেখে সাধারণ মানুষের ‘আলো অন্ধকার আয়ু’। অতঃপর বস্তিবাসী অসংখ্য মানুষ ছাড়াও স্কাইস্ক্র্যাপারের নিচেই ‘নিরাশ্রয় মানবের সমুদ্র দর্শন’ ঘটলে পাঠক বিভ্রান্ত হয়, মতিভ্রম ঘটে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন দৃষ্টে। চোখের সামনে প্রার্থনার ঘর ‘মসজিদের ছবি ছবির মসজিদ’ হয়ে ঝুলে থাকে, হিন্দুস্তানের ঐতিহ্যবাহী বাবরি মসজিদ উগ্রবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি ভেঙে ফেলার পরও। মামুনের গল্পের চাবুকে পাঠক অথবা জনগণ করণীয় ভুলে গেলে, তখন বিভ্রান্তিকর বিস্ময় নিয়ে পুনরায় ‘বালকবেলার কৌশল’ রপ্ত করার চেষ্টায় নিয়োজিত হয় এবং বারবার ভুল হলে বুঝতে পারে চিন্তাশক্তি হ্রাস পেয়েছে। অথবা মস্তিষ্কের নিউরোনে চিন্তার ধারা পরম্পরা ছিন্ন হয়ে গেলে, সামনে ‘দুটি নষ্ট ছেলের বাল্যকাল’ ছায়াছবির মতো ভেসে থাকে। এরপর সবকিছু ছুঁড়ে ফেলে ‘কালো সাবান হাতে জয় একদিন’ সমাজ ও রাষ্ট্রের জঞ্জাল কিংবা দুষ্টক্ষত সারাতে চায়; সব চাওয়ার কী পরিণাম হয়? হয় না। অতঃপর বাধ্য হয়ে যখন এইরকম সিদ্ধান্ত হয় যে, জয় ফিরে আসবে না, তখন সমবেত হয়ে আরো একবার প্রার্থনায় নষ্ট দুজন বালকের প্রতীক ভেবে ‘নীল কমল লাল কমল’-এর জন্য মাগফেরাত কামনা করা ছাড়া গত্যান্তর থাকে না জনপদবাসীর!

স্বাধীনতার পর তা রক্ষার কৌশল স্বরূপ ‘আমাদের জানা ছিল কিছু’ (২০০০) অথবা ছিল না; তবে দেশপ্রেম ছাড়া স্বাধীনতা রক্ষা করা যে সম্ভব নয় সে বিষয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। দেশপ্রেমের পরিবর্তে আমরা রাশিফল অথবা জ্যোতিষীদের নিকট থেকে জেনে নিতে অধিক পছন্দ করলে ‘এ বছর কেমন যাবে’ তা বাবা (জ্যোতিষী) মুহূর্তে গনেপড়ে বলে দেন। পরিণামে দেখা যায়, সমাগত বছর গত বছরের তুলনায় কঠিনতর সমস্যা-সংকুল হয়েছে। এমতাবস্থায় আমরা ‘আঁধার সকলই দেখি’; কিন্তু তারপর জীবনের দায় টেনে বেড়াতে গিয়ে ক্লান্ত হলে মামুন হুসাইন ঢুলুঢুলু চোখ তুলে বলে দেন ‘ঘুমায়ে পড়িব আমি’। অতঃপর আমরাও ক্লান্ত হলে এবং গল্পকার তাঁর গল্পের ঝাঁপি বন্ধ করে দিলে আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ শহিদের জন্য অথবা ‘মৃতদের আত্মার জন্য সমবেত প্রার্থনা’ করি। হয়তো তখন আমাদের অনেকেই জীবনের দায়ভার নির্বাহ করেত না পেরে চিরতরেই হয়তো ঘুমিয়ে গেছে আমাদেরই চোখের সামনে। এসব কিছুই হয়তো আমাদের জানা ছিল, তারপরও আমরা আমাদের অর্জিত বিদ্যাবুদ্ধি দিয়ে এসব সমস্যার কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে সক্ষম হই না। ‘মানুষের মৃত্যু হলে’  (২০০০) শিশু অথবা কিশোর বোঝে না তার স্বজন আর কখনো তাকে আদর করবে না, স্নেহ-ভালোবাসায় কোলে তুলে নেবে না। তারপরও অসংখ্য ‘মৃত্যু পুরাণ’ আমাদের জনপদে রাষ্ট্রযন্ত্রের নাকের ডগায় অপ্রতিরোধ্য হয় র‌্যাব অথবা মিলিটারি বাহিনীর ক্লিন হার্ট অপারেশনে। সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্র তার প্রজাদের ওপর এভাবে নির্দয় হলে কিংবা উদাসীন হলে প্রজারা বলে ‘স্বাগত মৃত্যুর পটভূমি’। আমরা তখন দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বিক্ষিপ্ত ঘোরাঘুরি শেষে ‘দুঃখের মধ্যে বিশ্রাম’ নেয়ার চেষ্টায় নিয়োজিত দেখে জনমানুষের ‘আলো অন্ধকার আয়ু’।

অতঃপর বস্তিবাসী অসংখ্য মানুষ ছাড়াও স্কাইস্ক্রাপারের নিচেই ‘নিরাশ্রয় মানবের সমুদ্র দর্শন’ ঘটলে আমরা বিভ্রান্ত হই। আমাদের চোখের সামনে প্রার্থনার ঘর ‘মসজিদের ছবি ছবির মসজিদ’ হয়ে ঝুলে থাকে বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার পর। করণীয় ভুলে গেলে অথবা বিভ্রান্তিকর বিস্ময় নিয়ে পুনরায় ‘বালকবেলার কৌশল’ (২০০২) রপ্ত করতে গিয়ে ভুল হলে বুঝতে পারি আমাদের চিন্তাশক্তি হ্রাস পেয়েছে অথবা চিন্তার ধারা পরম্পরা ছিন্ন হয়ে গেলে আমাদের সামনে ‘দুটি নষ্ট ছেলের বাল্যকাল’ ছায়াছবির মতো ভেসে থাকে। এরপর সবকিছু ছুঁড়ে ফেলে ‘কালো সাবান হাতে জয় একদিন’ সমাজ ও রাষ্ট্রের জঞ্জাল অথবা দুষ্টক্ষত সারাতে চায়। অতঃপর জয় ফিরে না আসলে আমরা সমবেত হয়ে এক প্রার্থনায় নষ্ট দুজন বালকের প্রতীক ভেবে ‘নীল কমল লাল কমল’-এর জন্য মাগফেরাত কামনা করি।

প্রিন্ট-মিডিয়া, ভিউ-মিডিয়াসহ শ্রুতি-মিডিয়ার সর্বত্রই ‘গন্ধহীন পচা সংবাদ’ পরিবেশিত হতে থাকলে মামুন হুসাইন তাঁর ‘নিরুদ্দেশ প্রকল্পের প্রতিভা’ গুছিয়ে নিয়ে টেবিল চেয়ারে বসেন ‘সর্পরাজ’ বিষয়ক গল্প রচনা করবেন ভেবে। রোগী দেখার চেম্বারে না বসে, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার লেখার সরঞ্জাম টেনে নিলে তাঁর অন্তর জুড়ে ‘কয়েকজন সামান্য মানুষ’ স্থান করে নেয় এবং তিনি বাধ্য হন ‘মানুষ টিয়ার গল্প’ রচনার খসড়া প্রস্তুত করতে। তিনি ‘শহর ঢাকার বিগতকাল’ সম্পর্কিত যেসব জ্ঞান অর্জন করেছিলেন তা ভুলে যাওয়ার বৃথা চেষ্টায় ‘দারুচিনি দ্বীপের ভেতর’ আশ্রয় নিয়েও স্বস্তি লাভ করতে পারেন না এবং এই ব্যর্থতার ঘটনায় তাঁর মনে পড়ে ‘বাঁচাতে পারি নি আমি বন্ধু বংশীর জীবন’।

এসব সমস্যার অন্তর্গত যন্ত্রণায় গল্পকারের হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হলে ‘ড. আজিজ স্মারকগ্রন্থ’ প্রণেতা সম্পাদকের দপ্তর থেকে দ্রুত লেখা শেষ করবার তাগাদা এলে তিনি ‘কবির রক্তমোক্ষণ অথবা জীবনপ্রণালী’ লেখার স্ক্রিপ্ট গোছানোর চেষ্টা করেন এবং পুনরায় ব্যর্থ হয়ে বিকেল বেলা হাসপাতাল রোডে দৃশ্যমান হন; তখন উ™£ান্তের মতো চোখেমুখে চিন্তার বলিরেখ নিয়ে গল্পকার মামুনকে মেডিপ্যাথের নিজস্ব চেম্বারে ঢুকতে দেখা যায়। তথাপি তিনি মনে মনে হয়তো অংক কষতেই থাকেন ‘একটি স্মারকগ্রন্থের জীবনপ্রণালী’ কেমন হওয়া উচিত অথবা তিনি ভাবেন, কোন জায়গা থেকে শুরু করবেন কিংবা আদৌ তিনি ভাবার কোনো প্রয়োজন মনে করেন না। কেননা, তখন তাঁর চেম্বারে মনোরোগীদের মানসিক থেরাপি দিতে গিয়ে সঠিক ঔষধের নাম স্মরণ করাটাই জরুরি মনে হয় এবং মামুনের স্মৃতিতে ভেসে ওঠে বাল্যশিক্ষার কথা ‘মানব সেবাই বড় ধর্ম’। জীবন নিজের হলে তা, নিজের জন্য নয়, বরং উজাড় করে দিতে হবে পরের জন্য। প্রায় লুপ্ত হয়ে যাওয়া বাল্যশিক্ষার এই স্মৃতিরাশির সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে গল্পকার ও মনোরোগবিদ মামুন রোগী-রোগিনীদের সঙ্গে কথা বলেন, তাদের করণীয় এবং ঔষধপত্র লিখে দেন দ্রুত হাতে।

মামুন হুসাইন সবসময় গল্প লেখেন-নিজের কাল নিয়ে, বিগত কাল নিয়ে  এবং আগামী কাল নিয়ে। কালের পরম্পরায় যে সমাজ-রাজনীতির প্রচ্ছায়া প্রতিফলিত হয়, তা প্রভাবিত করে তাঁকে, গল্পের শব্দে-বাক্যে তিনি রাজনীতির জটিল-কুটিল ফাঁদ, ফাঁক-ফোকর আবিষ্কার করতে করতে দেখেন ‘রাষ্ট্রযন্ত্রের খেলাধুলা’ নামক স্ক্রিপ্ট তৈরি হয়ে গেছে। রাজনীতির লেন্স দিয়ে মামুন দেখেন, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় যে ধর্মীয় উন্মাদনা প্রসার লাভ করায়, এখানে ‘পিতা-পুত্র ও পবিত্র আত্মার নামে’ হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ ঘটছে হরদম। হত্যার মতো গুরুতর অপরাধ করেও হত্যাকারী দ্বিধান্বিত হয় না, বিবেকের দংশনে দগ্ধ হয় না, অন্যদিকে স্বার্থ উদ্ধারের প্রয়াসে পিছ-পা হয় না, ধর্মাচ্ছান্ন মানুষও। স্বাধীনতার পর দেশে মৌলবাদী অপশক্তি ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকলে এবং পঁচাত্তরের মধ্য-আগস্টের রক্তপাতের ভয়াবহ রাত্রির পর বাংলা জনপদের সাধারণ মানুষের জন্য মামুন হুসাইন ‘একটি উদ্বাস্তু জীবনপ্রণালী’ তৈরির প্রয়াস গ্রহণ করেন। সেটাও পরিণামে যে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ, মামুনের গল্পগুলো তখনো আমাদের গল্প হয়ে ওঠে না। এবং আমরা দেখি, উদ্বাস্তু লোকসকল এখনো খোলা আকাশের নিচে রাত্রি যাপন করে, করতে বাধ্য হয়, তাদের দ্বিতীয় কোনো অপশন নেই বিধায়। অথবা এরা আজন্ম-আমৃত্যু উদ্বাস্তু।

অতঃপর গল্পকারের সঙ্গী হয়ে বেশ মজা করে, রসিয়ে রসিয়ে ‘নিছক ভ্রমণ বৃত্তান্ত অথবা হলোকাস্ট বর্ণনা’ দেয় আমাদেরই বন্ধু-বান্ধবদের কেউ, নয়তো ইতিহাসপ্রণেতাগণ। এবং আমরা মনে মনে ভাবি, বিগত কালের ইতিহাস কিংবা কল্পিত কাহিনীর ভিতরেই হয়তো তিনি গল্পের কাঁচা রসদ পেয়ে যাবেন। পরিণামে আমাদের সকল ভাবনা-পরিকল্পনা ভুল প্রমাণিত হয় ‘রাষ্ট্রযন্ত্রের খেলাধুলা’ গল্পগ্রন্থের বিবিধ তথ্যরাশির ভিতরে প্রবেশের পর। অথচ পাঠকের অভিজ্ঞতায় সঞ্চিত ছিল, আমবাড়িয়ার কৈলাশবাবুর পক্ষে ‘মৃতদের জন্য সমবেত প্রার্থনা’ করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কারণ, তখন কৈলাশবাবুর আমবাড়িয়া কিংবা দৌলতপুর জুড়ে চলে ‘কিলিং মিশন সেভেন এইট সিক্স’। ঈশ্বরের নাম হত্যাকে জায়েজ করার অদ্ভুত এক পরিকল্পনা দেখে সাধারণ মানুষ ভীত হয়, সন্ত্রস্ত হয়, আত্মগোপনে থাকার উপায় খোঁজে।

দেশে ক্রমাগত শক্তি সঞ্চয়কারী মৌলবাদীদের অদ্ভুত এসব হত্যা পরিকল্পনার অংশ যেমন সাধারণ মানুষ, তেমনি সেলিব্রেটি, লেখক-সাহিত্যিক, এমনকি পরিচিত গল্পকার হাসান আজিজুল হকের মতো মুক্তবুদ্ধির মানুষও। মৃত্যুর অপরিহার্য অনিবার্যতা অস্বীকার করবার উপায় নেই। নিক্রপলিসের ভেতর মৃত্যু সহজতর হবে ভাবলেও ‘কর্নেল এবং কিলিং বিষয়ক এন্ড গেমে’র কল্যাণে যখন আমাদের শান্ত বঙ্গজনপদ সন্ত্রাসের উপদ্রুত উপকূলে পরিণত হয়ে ভয়াবহ রূপ নিলে মানুষেরা পালাতে চায়। তারা কোথায় যাবে? তারা কী দৌলতপুর, আমবাড়িয়া, আড়–য়া পাড়া ছেড়ে ডিভি লটারি জোগাড় করে আমেরিকা পাড়ি জমাবে? তাহলে কী মৃত্যু হবে না, তাদের! আমাদের জীবন ‘আমিরিগো দি এন্ড গেম’ দিকে ধাবিত হওয়ার পরও ‘সেভেন এইট সিক্স কিলিং মিশনে’র ত্রাস পিছু ছাড়ে না। এভাবে সমকালীন বাস্তবতার নিরিখে মামুন হুসাইন সম্পর্কিত আমাদের অর্জিত জ্ঞান কিছুটা সমৃদ্ধ হলে রিডিং টেবিল জুড়ে তাঁর তিন দশকের গল্পসমগ্র মোটাসোটা শরীর এলিয়ে পড়ে থাকে এবং বাংলা কথাসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ লেখক হিসেবে তাঁর তিন দশকের পরিশ্রমের দিকে ফিরে তাকিয়ে যেমন ক্লান্ত হই তেমনি ঔসৎসুক্য অনুভব করি, গল্পগুলো পাঠ্য-টেবিলে নিয়ে ছুরিচিকিৎকার কথা ভাবি। ঠিক তখন মনে হয়, তাঁর গল্পের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার আগেই একথা জানা দরকার যে, মামুনের গল্পের গদ্য কিংবা ভাষা এ্যাট্রাকটিভ না; অবশ্যই কষ্ট করে ভিতরে প্রবেশ করতে হবে। যতটা মনোযোগ দাবি করে তাঁর লেখা, সেটা দিতে হবে; ফাঁকি দিয়ে অথবা দায়সারা গোছের পাঠে কিছুই বোঝা যাবে না।

গল্পকার মামুন ঠিক নির্দিষ্ট কোনো বক্তব্য তুলে ধরতে চান, অথবা তাঁর কথার প্রতীক-রূপক চিত্রকল্প কী, তা ধীরেসুস্থে সরিয়ে অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে হয়। তাঁর অভিনব উপস্থাপন কৌশলের বিন্যাসে পাঠক মনোযোগী হতে বাধ্য হন, যা তাকে অনিবার্যভাবে নিয়ে যায় গল্পের অন্তর্বয়নের সুগভীরতায়। যেমন ‘আমিরিগো দি এন্ড গেম’ পড়তে পড়তে পাঠক হারিয়ে ফেলে : আমবাড়িয়ার হামিদুর ও হাসিবুর রহমানের ডিভি লটারি পাওয়ার কথা, অথবা কৈলাশ কবিরাজের চা খেতে খেতে বলা তার অর্জিত অভিজ্ঞতার বয়ান প্রাসঙ্গিক কিনা; উভয় ঘটনার সাথে কোনো গোপন লিংক আছে কিনা! অথবা চৌধুরী বাড়ি, বিষ পুকুর, ছোট চৌধুরী, তাদের পিতার জমি দখল সংক্রান্ত দুঃসাহসী গল্প শুনতে শুনতে চায়ের দোকানে বসা চাষাদের ‘চায়ের কাপ ভেদ করে কোথাও যেন খানিকটা রক্তের গন্ধ লেগে থাকে।’ চায়ের দোকান থেকে পাঠকের টেবিলে উঠে আসে বিষপুকুর; যেখানে রক্তাক্ত চৌধুরীর শরীর প্রক্ষালন করা হয়েছিল। এসব অভিজ্ঞতা নিয়ে পাঠক দিকভ্রান্ত হলে গল্পকার মামুন তখন বেশ প্রশান্ত গলায়, পৃথিবীব্যাপী আমেরিকার ঘৃণ্যকর্মের একটি খসড়া ফর্দ চা-চক্রের আমজনতাকে শোনান।

মামুনের গল্পের অবিরাম টার্নিং আসলে পাঠককে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট করে না কিংবা বিশেষ কোনো বিষয়ের প্রতি ঝুঁকে পড়তে দেয় না; ফলে তাঁর গল্পদেহে সুবিন্যস্ত কোনো কাহিনি গড়ে ওঠার সুযোগ থাকে না। অথচ মামুন ঠিকই তাঁর পাঠককে জানিয়ে দেন ‘এভরি ওয়ান রাইটস্ টু কর্নেল’। কর্নেলকে লেখার আগে সবকিছু গুছিয়ে মনে মনে সরলরৈখিক কাহিনি নির্মাণ করতে গিয়ে পাঠক হতোদ্যোম হয় এবং কর্নেলের সামনে-পাঠক তার হতদরিদ্র, হতশ্রী  যাপিত নিকৃষ্ট জীবনকথা বলার অথবা লেখার সাহস সঞ্চয় করতে পারে না। আকাশ পাতাল অনেক ভেবেচিন্তে অবশেষে কর্নেল সাহেবকে হতদরিদ্র জনগণ তাদের চূড়ান্ত দৈন্যের কথা লেখে :

প্রীতি নিবেন। অনেক বছর আগে একটি যুদ্ধে আমিও আপনার মতো কর্নেল হই অথবা জনগণ কর্নেল উপাধি দিয়ে আমার অবসর নিশ্চিত করে। আমার স্ত্রীর শ্বাসকষ্ট। সপ্তাহের একটি দিনে লঞ্চে আমাদের চিঠিপত্র এলে, পাড়ে অপেক্ষা করি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আমরা আসলে গত চল্লিশ বছর অপেক্ষা করছি একটি পেনশনের জন্য। আমার নম্বর ১৮৮৩। কোনো কর্নেল কখনও দরিদ্র হয় বলে, আপনার ধারণা আছে কি? অভাবে, দেয়াল ঘড়ি, সাইকেল এবং যে মোরগটি দিয়ে আমি লড়াই খেলবো ভেবেছিলাম-সব বিক্রি করে, এখন কেবল অপেক্ষা।
 (কর্নেল এবং কিলিং বিষয়ক এন্ড গেম, পৃ.১০৮)

কর্নেলের কী সময় হয়, শ্রীবিহীন দরিদ্র জনগণের এসব দুঃখকথা কিংবা দুর্ভোগের কথা পড়ার, অথবা জানার? সাধারণ, নাগরিকবৃন্দের দুঃখকথা সংবলিত চিঠিপত্রের কোনো কোনোটি হয়তো কর্নেলের রিডিং ডেস্ক পর্যন্ত অতি কষ্টে পৌঁছায়, অথবা পৌঁছায় না, কিংবা অনেক ব্যস্ততার ভিড়ে তা পড়ার সময় হবে কিনা কর্নেলের তা নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারা মুশকিল; কেননা সামরিক ব্যারাকের খবরা-খবর সাধারণ্যে কোনোদিনই প্রকাশিতব্য নয়। উপরন্তু প্রজাতন্ত্রের কর্ণধর হিসেবে কর্নেলকে দেশ ও জনগণের কল্যাণভাবনায় দিনরাত পরিশ্রম করতে হয়। জাতিসংঘে মিটিং শেষ করে ন্যাম সম্মেলনে যোগ দিতে কুয়ালালামপুর ছুটতে হয়। মালয়েশিয়া থেকে দেশের বিমান বন্দরে অবতরণ করার পরদিনই দেশ-জনগণের মঙ্গল কামনার্থে ওমরাহ পালনের নির্ধারিত তারিখে সৌদি আরবের মক্কা নগরীতে যেতে হয়।

কর্নেল যখন জনগণের কল্যাণে দিনরাত ব্যস্ত তখন ‘যুদ্ধাপরাধ ও ভূমিব্যবস্থার অস্পষ্ট বিজ্ঞাপনে’ সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দেয়, মেজরিটির হাতে মাইনর সম্প্রদায় নির্যাতিত হয়। একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যারা জন্মভূমি ছেড়ে ইন্ডিয়ায় আশ্রয় নিয়েছিল, স্বাধীনতার পর তারা অনেকেই ফিরে এসেছে হিন্দুস্তানের শরণার্থী শিবির ছেড়ে, আবার কেউ কেউ ধর্মীয় এবং অন্যান্য নানাবিধ সংশয়ে ফেরার সাহস পায় না, কিংবা দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও সাম্প্রদায়িক নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে অনেকে পৈত্রিক ভিটামাটি ছেড়ে ইন্ডিয়ায় চলে যায়, যেতে বাধ্য হয়। যারা ফিরে আসে নি অথবা যারা পরে ইন্ডিয়ায় চলে গেছে, তারা কেউই যুদ্ধাপরাধী নয়; বরং ভিটেমাটি ও স্বজনহারা অসহায় মানুষ। অথচ প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীরা স্বাধীনতার পরপরই দেশপ্রেমিকের মুখোশ নিয়ে আম-জনতার কাতারে মিশে যায়; এই বর্ণচোরাদের ভয়ে স্বাধীনতার পরও সাধারণ মানুষের ঘরবাড়ি, জমি-জিরাত ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। অথবা তারা জবরদখল করে এবং সরকার তা ‘শত্রু সম্পত্তি’ ঘোষণা করে ভোগ-দখলকারীদের লিজ দিয়ে দেয়। অন্ধ বাবা তখন বধ্যভূমি থেকে পাঠানো ছেলের শেষ চিঠিখানা খুঁজে যেসব কাগজপত্র পায়, তা প্রকৃতপক্ষে দুগ্ধধবল সাদা কাগজ মাত্র।

কেননা মেয়েটি চাকরির সন্ধানে গেলে এবং সময় মতো ফিরতে না পারায় বাবার বাক্সের কাগজপত্র বদলে ফেলা হয় গোপনে। অথচ অন্ধ বাবা কাগজের স্পর্শ নিয়েই মনে মনে ছেলের লেখা চিঠির কথাগুলো ভাবতে বসে তার মনে পড়ে মেয়েটির কথা : ‘মেয়ে নিশ্চয় চাকরির পরীক্ষায় শহরে ফুফুর কাছে গেছে।’ অক্ষম বাবার অর্থহীন ভাবনা নিষ্ফল ও ব্যর্থতার অসামান্য এক দলিল গল্পকার মামুন তুলে দেন পাঠকের হাতে। অন্ধ বাবা যখন শহিদ ছেলে এবং জীবিত মেয়ের কথা ভাবে, চারদিন আগেই ত্রিশোত্তীর্ণ সুকন্যা টেলিভিশন ও খবরের কাগজের সংবাদ হয়ে গেছে। মৃত সুকন্যার লাশেরও সৎকার করা যাচ্ছে নাÑ আইনী জটিলতার ট্র্যাফিকে আটকে। স্বাধীনতা যুদ্ধে পুত্র হারিয়ে যে অন্ধবাবা কন্যাকেই জীবনের একমাত্র অবলম্বন মনে করেছিলেন, তার ‘সাম্প্রতিক পরিস্থিতি অথবা আগাম ফলাফল’ মামুন হুসাইন পরিবেশন করলে আমরা শুধু ভূমি ব্যবস্থার বিজ্ঞাপনে অস্পষ্টতা পাই না, তখন যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক সংজ্ঞারও দ্বিবাচনিক প্রতিক্রিয়ায় স্বাধীনতা শব্দটিও বাঙালির নিকট অস্পষ্ট হতে থাকে।

আমরা বিবিধ জটিলতা কিংবা সংকটের-সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে যখন ‘রাজযাত্রা অথবা সহজ বেহুলাপাঠ’ কিংবা ‘সনকার কালাবুড়ি ও আমাদের দিনযাপন’ বিষয়ে কিঞ্চিৎ গল্পের স্বাদ গ্রহণের নিমিত্তে মামুন হুসাইনের প্রথমগ্রন্থ ‘শান্ত সন্ত্রাসের চাঁদমারি’ খুলে বসলে জীবনের বিচিত্র অন্ধিসন্ধি ও গলিতে ঢুকতে ঢুকতে জিললুর রহমানের উত্তর আধুনিকতা বিষয়ক তত্ত্বাক্রান্ত না হয়ে পারি না। কারণ, তিরিশের কলোনিয়াল আদর্শে উজ্জীবিত সাহিত্য যে আমাদের নিজস্ব দেখার চোখ প্রায় অন্ধ করে দিয়েছিল-মামুন হুসাইন সচেতনভাবে সেই কলোনিয়াল আদর্শ  অতিক্রম করে তাকিয়েছেন নিজের ঘরে, নিজের দিকে, একেবারেই নিজস্ব চোখে। নিজের ভূগোলের দৃশ্যমান বাস্তবতাকে তাই মামুন অনায়াসে ১৯৮৮-এর বন্যাপীড়িত সখিনার দ্বিতীয় স্বামী রাজাকে বাঁচিয়ে তোলার প্রাণান্ত প্রয়াসে চাঁদ সদাগর-বেহুলাকে মিথ হিসেবে ব্যবহারে মধ্য দিয়ে প্রতীয়মান হয়।

সখিনা তার দ্বিতীয় স্বামী রাজা প্রতিবেশীদের দ্বারা মাথায় বল্লম নিয়ে বাড়িতে এসে পড়ে গেলে তাকে বাঁচিয়ে তোলার আশায় বন্যার থৈথৈ পানি অতিক্রম করে বেহুলার মতোই স্বামীকে নিয়ে ভেলায় চড়ে সদর হাসপাতালে পৌঁছালে দেখে-সেখানে গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগি আর বন্যাপীড়িত অসংখ্য মানুষে একাকার অবস্থা; ডাক্তার কোথায় সেখানে? সখিনা ঔষধ-চিকিৎসা পাবে কোথায়? অথচ সামরিক রাষ্ট্রপ্রধান তাঁর মোসাহেবদের নিয়ে জল¯্রােত ভেঙে কত কষ্ট করে ত্রাণ বিতরণ করছেন, সেসব দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি হয়ে হাসপাতাল করিডোরে স্থাপিত দূরদর্শন যন্ত্রে প্রদর্শিত হচ্ছে। সখিনা ঔষধবিহীন অবস্থায় বিশ শতকের শেষপাদে মনসার কোনো সহায়তা না পেয়ে বল্লম গেঁথে যাওয়া মাথাসমেত রাজার দেহ ক্রমেই স্থির হয়ে পড়ার দৃশ্য দেখে। সখিনা স্পষ্ট দেখতে পায় রাজার মাথার ডানচোখের পাশ বরাবর গেঁথে যাওয়া বল্লমের ক্ষতস্থানে জমে যাওয়া রক্তের উপর গোটাকতক মাছির সম্প্রীতি নিবিড় হচ্ছে। বেহুলার মতো স্বামীকে ভেলায় নিয়ে যাত্রা করেও সখিনা তাকে বাঁচাতে পারে না।

কালাবুড়ি-আকালী-সখিনা এবং শহুরে জীবন অভ্যস্ত গ্রামীণ তরুণ প্রজন্মের সংমিশ্রণে যে ঘোর তৈরি করেন পরিণামে তা বাংলার গ্রামীণ জনপদের বিচিত্র জীবনযাপন, বিশ্বাস, সংস্কার বহুবিধ তথ্যের ভারে ন্যূব্জ হয়ে উঠলে বিষণ্নতা বোধে ভোগে পাঠক। গ্রামীণ মানুষের বিশ্বাস ও কালাবুড়ি সংক্রান্ত ঘটনাদির মধ্যেই মামুন তাঁর গল্প নিয়ে যে পোস্ট-কলোনিয়াল আদর্শে অথবা উত্তর-আধুনিকতার চর্চায় মগ্ন হয়েছেন, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। যারা উত্তর আধুনিকতার তত্ত্ব নিয়ে বোঝা না-বোঝার সংশয় কিংবা দোদুল্যমানতায় আছে, তাদের জন্য উত্তরাধুনিক তত্ত্বের প্রকৃত স্বরূপ উদাহরণসহ বুঝে নেয়ার সহজ প্রকল্প হতে পারে, মামুনের টেক্সটসমূহ। বলাবাহুল্য, মামুন সচেতনভাবেই কলোনিত্তোর বা উত্তর-আধুনিক গল্পকার। কেননা তিনি কলোনিত্তের বাংলা জনপদ, এখানকার পরিবেশ, বাস্তবতা সম্পূর্ণ নিজের মতো করে সমকালের দৃষ্টিতে নিজের স্বরে (ভাষায়) উপস্থাপন করেছেন। উত্তর-আধুনিকতার তাত্ত্বিক বিচারেও মামুন হুসাইন যে সফল গল্পকার, সেকথা তাঁর টেক্সেটের পরতে পরতে বিদ্যমান।

মামুন হুসাইনের ‘শব্দান্ধ আত্মার সাধন-বাসনা’ (২০১৮) গল্পগ্রন্থে সাকুল্যে তিনটি গল্প আছে : ‘শব্দান্ধের প্রাসাদজীবন’, ‘নবীবখশের আত্মা ও সম্পত্তি’ এবং    ‘গোলাম মওলার হৃদয় ও সাধন-বাসনা’। এ গল্পসংকলনের তিনটি গল্পেই বাংলাদেশের সমসাময়িক রাজনীতি, আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা, মৌলবাদের উত্থান এবং সরকারি পদক্ষেপ, সুশীল সমাজের ভূমিকা প্রভৃতি বিষয়াদি সরাসরি আর কখনো রূপক-প্রতীকের শিল্পিত সৌকর্যে প্রতিভাত হয়েছে। মামুনের পাঠক এ গ্রন্থের গল্পে তাঁকে আরও একবার নতুনভাবে আবিষ্কার করবেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

মামুন হুসাইন গল্পের ভাষা দ্বারা শব্দ ও বাক্য নির্মাণের ক্ষেত্রে ভীষণ রকমের ব্যতিক্রমী-প্রতিভা; একইসঙ্গে অত্যন্ত সচেতন এবং দক্ষও। ভাষা ব্যবহারের এ জাতীয় প্রণোদনা তিনি জেমস জয়েস, উইলিয়াম ফকনার, ফুয়েন্তেস অথবা মার্কেজ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে করেছেন কিনা, সেকথা জোর দিয়ে অথবা আগ বাড়িয়ে বলারও খুব একটা সুযোগ নেই। গল্পের সমকালীন সংলগ্নতা এবং ব্যক্তি সমাজ জাতি রাষ্ট্রের নাগরিকদের যাপিত জীবনের রাজনীতি সংশ্লিষ্টতাই মামুন হুসাইনের গল্পে মুখ্য উপাদান বা কাঁচারসদ। মামুন বরাবরই সাহসী গল্পকার; তিনি তাঁর সময় থেকে কখনোই স্কেপ করেন না, কিংবা ঘাস লতাপাতা ফুল পাখি নিয়ে অথবা মৃত বা কাল্পনিক কোনো আখ্যান তৈরি করেন না পাঠকের জন্য। এ যাবৎ প্রকাশিত তাঁর সবগুলো গল্প সম্বন্ধেই একথা প্রযোজ্য। সমকালে জীবনের যে দিকটি সাধারণের চোখ দিয়ে দৃশ্যমান হয় না, অথবা এড়িয়ে যায়, মামুনের সাহসী কলম সেই অদৃশ্যমান অন্তরালের দৃশ্য শব্দভাষ্যে গল্পের মাধ্যমে তুলে আনেন। চরম বাস্তবতাই যে পরিণামে কথাশিল্পীর সৎ থাকার চূড়ান্ত পরীক্ষা, তা মামুন হুসাইন তাঁর প্রতিটি গল্পেই প্রমাণ করেছেন। আষাঢ়ে কাহিনি ফাঁদা গল্পকারের কাজ নয়, যাপিত জীবনের অন্তরালে যেসব ঘটনাসমূহ অদৃশ্য থাকে তা দৃশ্যমান করা কিংবা প্রকাশ করাই কথাশিল্পী মামুনের দায় এবং লেখার প্রেরণা।

menu
menu