রবীন্দ্রনাথের পরিবেশভাবনা    

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন উনিশ ও বিশ শতকে ভারতবর্ষ তথা বিশ্বের সেরা চিন্তানায়কদের একজন। তার চিন্তা-চেতনার জগত নিজের সমাজ ও রাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিকতায় স্থিত হয়েছিল। ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস, রাজনীতি তথা মানবজীবনের চিন্তা-চেতনার প্রায় সকল দরজাতেই তিনি আঘাত করেছিলেন। একজন বিজ্ঞানমনস্ক ও প্রকৃতিপ্রেমিক মানুষ হিসেবে রবীন্দ্রনাথ পরিবেশভাবনা থেকেও দূরে ছিলেন না। 

ইংরেজি  environment শব্দটির আভিধানিক অর্থ চতুর্পার্শ্ব বা পরিবেশ বুঝালেও বর্তমান ইন্টারনেট-প্রযুক্তির যুগে শব্দটি ভূমি-পরিকল্পনা, শিল্প-নির্মাণ, যাতায়াত, জনসম্পদ, দূষণ ইত্যাদি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। আবার রবীন্দ্রমানসেও ‘পরিবেশ’ শব্দটির ব্যাপক তাৎপর্য আছে। আমরা এখানে রবীন্দ্রনাথের পরিবেশভাবনার কথা বলতে গিয়ে বিশেষ করে তার প্রাকৃতিক পরিবেশভাবনার কথাই বলব। প্রখর বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,

‘অন্ন চাই, প্রাণ চাই, আলো চাই, চাই মুক্ত বায়ু,
চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ উজ্জ্বল পরমায়ু,’

তার এই ‘চাওয়া-পাওয়ায়’ পরিবেশের ভূমিকাই মুখ্য। ‘পরিবেশ’ অনুকুল না হলে তার এই চাওয়া যে কখনো পাওয়ায় রূপ নেবে না তা তিনি ভালোভাবেই বুঝেছিলেন। তাই রবীন্দ্রনাথ বিশ শতকের শুরুতে (১৯০১ খ্রি.) কলকাতা থেকে প্রায় ১০০ মাইল দূরে বীরভূম ( ‘বির’ মানে জঙ্গল। বীরভূম>জঙ্গলভূমি) জেলার বোলপুরের ভুবনডাঙা নামক স্থানে পিতৃদেব দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত আশ্রমে একটি ব্রহ্মবিদ্যালয় স্থাপন করেন প্রাচীন ভারতের আশ্রম বা তপোবনের ধারণাকে সামনে রেখে। পরবর্তীকালে যার নাম হয় ‘শান্তিনিকেতন’। যেখানে বাড়িগুলো হবে মাটির তৈরি, পাঠদান হবে গাছতলায়। পরিবেশ হবে গাছগাছালি সমৃদ্ধ ‘ছায়া-সুনিবিড়’। রবীন্দ্রনাথ এভাবে মণ্ডিত করতে চেয়েছিলেন তার ‘শান্তিনিকেতন’। সেই মণ্ডনের মধ্যেই তার পরিবেশ চিন্তা সাকার হয়ে উঠেছিল। ঘটনাটা এমন একটা সময়ে ঘটেছিল যখন পরিবেশচিন্তা বলে কোনো বিষয় আধুনিক জগতের আর কোথাও সেভাবে আত্মপ্রকাশ করেনি।

আজ যাকে আমরা পরিবেশ (environment) বলছি, যার বিষয়ে আজ সারা পৃথিবীর মানুষ মুখর হয়ে উঠেছেন, মহাকবি কালিদাস বর্ণিত (কালিদাস-এর ‘রঘুবংশ’ দ্রষ্টব্য। যার অনবদ্য অনুবাদ করেছেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং) প্রাচীন ভারতের তপোবনগুলোতে সেই পরিবেশের ব্যাপারটা ছিল মানুষের জীবনের সাথে অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়ানো। প্রকৃতির কথা তখন কেউ আলাদা করে ভাবতেন না। প্রকৃতির মধ্যেই তারা বাস করতেন। গাছপালা-পশুপাখিকে বাদ দিয়ে তাদের স্বতন্ত্র কোনো জীবন ছিল না। রবীন্দ্রনাথ এমনই একটি পরিবেশ রচনা করলেন তার শান্তিনিকেতন-এ। 

রবীন্দ্রনাথ যেখানে মানুষ হয়েছিলেন, সেই চিৎপুর-জোড়াসাঁকো অঞ্চলে কলকাতার নগরায়নের কুফলগুলো আজ থেকে শতাধিক বছর আগেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। এর মধ্যে সংবেদনশীল কবি যে নির্বাসিত বোধ করবেন তাতে আর আশ্চরয কী ?

‘সবার মাঝে আমি ফিরি একেলা। 
কেমন করে কাটে সারাটা বেলা!
ইঁটের ’পরে ইঁট, মাঝে মানুষ-কীট--
নাইকো ভালোবাসা, নাইকো খেলা। ’
(বধূ:মানসী)

এই যে নির্বাসনের বোধ, অন্যত্রও এর কথা কবি স্পষ্ট করে বলেছেন :
‘But it always is a surprise to me to think that though this closed up hardness of a city was my only experience of the world.Yet my mind was constantly haunted by the home-sick fancies of an exile.’ (`A poet’s school’)

এই যার মনোজগতের পৃষ্ঠভূমি, মনের পরিণতির সঙ্গে সঙ্গে তার পক্ষে প্রাচীন ভারতের গ্রামীণ পটভূমির জীবনের প্রতি আকৃষ্ট হওয়াটা স্বাভাবিক নয় কি? তিনি গাছপালার প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে জীবনকে খুঁজে পেয়েছেন। ‘বনবাণী’র ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আমার ঘরের আশেপাশে যে-সব আমার বোবা-বন্ধু আলোর প্রেমে মত্ত হয়ে     আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে আছে তাদের ডাক আমার মনের মধ্যে পৌঁছল। কথাটা রবীন্দ্রনাথের জীবনে শুধু তত্ত্বকথা হয়ে থাকেনি। গাছপালা সম্পর্কে তার যত গভীর আগ্রহ ও জ্ঞান ছিল তা খুব কম কবির মধ্যেই দেখা গেছে। এদিক দিয়ে কোন কবির সাথে তুলনা করলে রবীন্দ্রনাথকে মহাকবি কালিদাস (সংস্কৃত ভাষার কবি) এর সাথে তুলনা করা যেতে পারে। আর তুলনায় কথাসাহিত্যিক হিসেবে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম আসতে পারে।

রবীন্দ্রনাথের কাব্যেই শুধু নয়, গদ্যরচনাতেও বৃক্ষ ও পরিবেশ-বন্দনার পরিচয় পাওয়া যায় ব্যাপকভাবে। আমরা জানি, এর বাস্তব ও জীবন্ত উদাহরণ  হলো শান্তিনিকেতন। গাছপালার উপস্থিতি যে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের অনুকূল তা আজকাল যারা সাধারণবিজ্ঞান বা উদ্ভিদবিজ্ঞান পড়েন নাই তারাও বুঝেন। শুধুমাত্র দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার আলোকেই এটা বোঝা সম্ভব। উদ্ভিদ জগতের সহযোগিতা ছাড়া যে মানুষের প্রাণধারণ সম্ভব নয় একথা আজকাল সাধারণ মানুষও বুঝতে পারেন। আর ইতর প্রাণীদের ক্ষেত্রে গাছপালার প্রয়োজন ও প্রভাব খুবই ব্যাপক এবং জটিল। গাছপালা থাকলে কীটপতঙ্গ আসে। সেই কীটপতঙ্গ এবং গাছের ফল তথা ফুলের টানে পাখিরা আসে। এইভাবে যে জীবনচক্র বা life cycle তৈরি হয় তা গোটা পরিবেশটাকে ধরে রাখে। 

শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ যে ‘বসন্তোৎসব’, ‘বর্ষামঙ্গল’ আর ‘হালকর্ষণ’ অনুষ্ঠানের প্রবর্তন করেন এর মূলেও কবির পরিবেশভাবনাই কাজ করেছে।  শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ প্রবর্তিত বিভিন্ন উৎসবে যেমন ঐতিহ্য আর আধুনিকতা, মানুষ আর তার জীবন্ত পরিবেশ-এদের জড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ কাজ করেছেন তেমনি শান্তিনিকেতনের বিভিন্ন ভবনের নির্মাণশৈলিতে তিনি পরিবেশভাবনার স্থায়ী ছাপ রেখে গেছেন। শান্তিনিকেতনের সব বাড়িতেই (যেমন : উত্তরায়ন, উদয়ন, কোনার্ক, শ্যামলী, পুনশ্চ, উদীচী ইত্যাদি) খোলা বারান্দা এবং চাতালের প্রাচুর্য ছিল। রবীন্দ্রনাথের এই পরিবেশভাবনাকে গৃহস্থাপত্যে রূপায়িত করতে সাহায্য করেছিলেন সুরেন্দ্রনাথ কর, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, রামকিংকর বেইজ, বীরেন্দ্রমোহন সেন, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর (কবিপুত্র) প্রমুখ শিল্পী ও বাস্তুকারেরা।

একথাও অজানা নয় ‘শ্রীনিকেতন’এর প্রতিষ্ঠাও পরিবেশভাবনাকে সামনে রেখেই। মূলত রবীন্দ্র-পরিবেশ চিন্তার পুরো ঝোঁকটাই ছিল ভবিষ্যতের দিকে (futuristic)। যার কারণে রবীন্দ্রনাথের চিন্তার মর্ম দেশবাসী সহসাই বুঝে উঠতে পারেননি। ‘সভ্যতার প্রতি’ রবীন্দ্রনাথের আহ্বান ছিল ‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর’। প্রশ্ন উঠতে পারে তাহলে কি রবীন্দ্রনাথ নগরায়নের বিপক্ষে ছিলেন ? আমরা তা মনে করি না। কারণ তিনি পৃথিবীর ৩০টিরও বেশি দেশ এবং শতাধিক নগর পরিক্রমা করেছিলেন। প্রায় সব জায়গায় তিনি পরিকল্পিত নগরায়ন দেখেছেন। তার মত একজন আধুনিক মানুষের পরিকল্পিত নগরায়নের পক্ষে থাকাটাই স্বাভাবিক।

শতাব্দীব্যাপী পৃথিবীতে যে নগরায়ন হয়েছে তাতো হয়েই গেছে। এখন গোটা বড় শহরকে ভেঙে আবার নতুন করে গড়ে নেয়া সম্ভব নয়। তাই পৃথিবীর পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় নতুন করে নগরকে দূষণমুক্ত করার কাজ চলছে। যেমন- শহরের কেন্দ্রস্থলের বিস্তীর্ণ এলাকায় মোটর গাড়ির চলাচল বন্ধ করে দিয়ে পায়ে হাঁটা এবং সাইকেল চালানোর ব্যবস্থা হচ্ছে। আমাদের মনে হয় রবীন্দ্রনাথ আজ বেঁচে থাকলে এই ভাবনাকে সমর্থন করতেন। কারণ আমরা নগরায়নে এতদূর এগিয়ে গেছি যে ওখান থেকে আর ‘অরণ্যে’ ফেরা সম্ভব নয়। প্রযুক্তির প্রসার, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, শিল্পকারখানার বিস্তৃতি ইত্যাকার কারণে পূর্বের অবস্থা বা অবস্থানে  হুবহু ফিরে যাওয়ার বাস্তবতা নেই। 

রবীন্দ্রনাথের পরিবেশভাবনার আলোকে দূষণমুক্ত পৃথিবী গড়তে হলে এমনভাবে নগর-পরিকল্পনা করতে হবে যাতে প্রকৃতির সাথে আমাদের বিচ্ছেদ না ঘটে আবার নাগরিক-জীবনের সুখ-সুবিধাও বজায় থাকে। সারা দেশকে আমরা শান্তিনিকেতন এর মত বাগানে (স্থানীয় আদিবাসী সাঁওতালেরা শান্তিনিকেতনকে বলতেন ‘বাগান’) পরিণত করতে পারব না (শান্তিনিকেতনও আগের সেই অবস্থায় নেই) একথা যেমন সত্য আবার এটাও মাথায় রাখতে হবে সভ্যতা টিকিয়ে রাখতে হলে রবীন্দ্র-পরিবেশভাবনার বিকল্প নেই। 

[প্রবন্ধটিতে বেশির ভাগ তথ্য নেয়া হয়েছে দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘রবীন্দ্রনাথ ও বিজ্ঞান’ (কলকাতা ২০০০) গ্রন্থ থেকে]

menu
menu