পশ্চিমপিয়াসী মন তাকাও আপনপানে

দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে স্নায়ুযুদ্ধের উৎকট প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল বার্লিন প্রাচীর। কম্যুনিস্ট পূর্ব জার্মানি ও পুঁজিবাদী পশ্চিম জার্মানি আবারও জোড়া লাগে এই প্রাচীর পতনের পর। ২০০৯ সালে ঐতিহাসিক সেই ঘটনার ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বার্লিনে আয়োজিত হিস্ট্রি ফোরামে একালের অন্যতম প্রভাবশালী ইতিহাসবিদ ও সমাজচিন্তক দীপেশ চক্রবর্তী একটি বক্তৃতা দেন। যার শিরোনাম ছিল A Europe in the World? Twenty years after 1989।

বক্তৃতার শুরুতেই দীপেশ শ্রোতাদের জানিয়েছেন যে, তিনি নিজেও বিভক্ত জনগোষ্ঠীর মানুষ। ১৯৪৭ সালে বাংলাভাষী অঞ্চলটি দু-টুকরো হয়ে দুটি আলাদা দেশের অন্তর্ভুক্ত হয়। তবে পূর্ববাংলা ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যের ফাটলটা গভীরতর। ‘আমাদের মনের মধ্যে যে দেয়াল আমরা খাড়া করেছি সেটা বার্লিন প্রাচীরের মতো এত সহজে ভেঙে পড়বে না। ... তবু সবসময় আমার মনে হয়েছে সারা পৃথিবীর সমস্ত বিভক্ত জনগোষ্ঠীর জন্যে ১৯৮৯ একটি সম্ভাবনা—আবার জোড়া লাগার।’

তবে জার্মানির একত্রীকরণ সম্পর্কে দীপেশের কৌতূহলী হওয়ার প্রধান কারণ অবশ্যই ব্যক্তিগত নয়। তার গবেষণা ও লেখালেখির বড় অংশ জুড়ে রয়েছে ইউরোপীয় উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের শিকার হওয়া দেশ ও মানুষ। বাকি পৃথিবীর ওপর ইউরোপের দখলদারি কতটা ব্যাপক ছিল তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দীপেশ উল্লেখ করেছেন, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে পৃথিবীর ৮০ শতাংশ জমিন কোনো না কোনো ইউরোপীয় শক্তির কব্জায় ছিল। ১৯৪৫ সালের পর থেকে ইউরোপের ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো পিছু হটতে শুরু করে। তাদের ছেড়ে যাওয়া (আসলে ছাড়তে বাধ্য হওয়া) শূন্যস্থানে উত্থান ঘটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো পরাশক্তির। কিছুদিন হলো চীন এবং ভারতও পরাশক্তি হওয়ার ব্যাপারে উচ্চাভিলাষী হয়ে উঠেছে। যেকোনো পরাশক্তি যখন প্রভুত্ব কায়েম করে, তখন তারা অর্থনৈতিক, সামরিক ও প্রযুক্তিগতভাবেও আমাদের ওপর ছড়ি ঘোরায়। তবে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক হুকুমত ও (হাল সময়ের) কোনো পরাশক্তির অর্থনৈতিক-সামরিক-সাংস্কৃতিক প্রভাবের মধ্যে পার্থক্য আছে। পার্থক্য হলো ইউরোপ তার উপনিবেশগুলোতে এমন কিছু ধ্যানধারণা (যেমন মার্ক্সবাদ ও উদারতাবাদ) চর্চার সুযোগ দিয়েছে যার সাহায্যে ইউরোপীয় প্রভুত্বকে দারুণ নৈপুণ্যের সাথে চ্যালেঞ্জ করতে পেরেছে উপনিবেশিত অঞ্চলের চিন্তাবিদ ও আন্দোলনকারীরা।

আরেকটি দেশ বা অঞ্চলের ওপর খবরদারি করতে যাওয়া কোনো দেশই যে পুরোপুরি ধোয়া তুলসীপাতা হতে পারে না, সেটা বলার পর দীপেশ তাই ভারতীয় ও চীনাদের প্রতি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন, ‘তোমরা যে পরাশক্তি হতে চাইছ সেটা আমি বুঝতে পারি এমনকি সমর্থনও করি। কিন্তু তোমরা যদি সত্যিই পৃথিবীর ওপর ছড়ি ঘোরানোর সুযোগ পাও, তোমাদের হুকুমতের সমালোচনা করার কোন পথটা খোলা রাখবে?’

অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এটা সত্যি যে, উইঘুরদের ওপর হান জাতিগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়ার প্রতিবাদে লেখা কোনো নাটক জিনজিয়াং প্রদেশে মঞ্চস্থ করার অনুমতি চীন সরকার দেবে না। অথচ সিপাহী বিদ্রোহের মাত্র ১৫ বছর পর কলকাতায় একটি নাটক মঞ্চায়িত করার অনুমতি দিয়েছিল ঔপনিবেশিক ভারত সরকার। যার মূল উপজীব্য বিষয় ছিল দক্ষিণ-বাংলার নীলচাষীদের ওপর ইংরেজ নীলকরদের পাশবিক জুলুম। ব্রিটিশদের প্রতি ভক্তি আরও বেড়ে যেতে পারে এটা জানার পর যে, বাংলা ভাষায় ছাপা হওয়ার মাত্র এক বছরের মধ্যে নীলদর্পণ-এর ইংরেজি অনুবাদ বেরোয়। অনুবাদক ও মুদ্রাকর দুজনের কেউই বাঙালি নন বরং ছিলেন শ্বেতাঙ্গ সাহেব। তার চেয়ে বড় কথা, সরকারি চাকুরে হওয়া সত্ত্বেও দীনবন্ধু মিত্র এরকম স্পর্শকাতর বিষয়ে নাটক লিখতে পেরেছিলেন। বাংলা সংবাদপত্রে এ নিয়ে লেখালেখিও হয়েছিল।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, ইংরেজরা নেটিভদের জন্যে সমালোচনার নানা পথ খোলা রেখেছিল। তবে পুরো ব্যাপারটা একটু তলিয়ে দেখলে ইংরেজ প্রভুর প্রতি ভক্তিটা আর অটুট থাকে না। ১৮৬০ সালে ঢাকা থেকে নাটকটি প্রথম ছাপানোর সময় ডাক বিভাগের চাকুরে দীনবন্ধু মিত্র নিজের নাম উল্লেখ করার সাহস পাননি। তার আশঙ্কা অমূলক ছিল না। বই আকারে নাটক প্রকাশের পর আদালতে হাজিরা দিতে দিতে দীনবন্ধু মিত্র হয়রান হয়ে গিয়েছিলেন। ইংরেজ আমলের রক্ষাকবচ গায়ের সাদা চামড়াও অনুবাদক রেভারেন্ড লং ও মুদ্রাকর ম্যানুয়েলকে রক্ষা করতে পারেনি। তাদের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড হয়। অপরাধ? ইংরেজ বিচারক স্যার ওয়েলস রায় ঘোষণার সময় বলেন, এই নাটক ইংরেজিতে অনুবাদ করে নীলকরদের সম্পর্কে তারা জনমানসে বিদ্বেষ ছড়িয়েছেন ও মানহানি করেছেন। 

আরও কৌতুককর হলো, এই ‘মানী’ নীলকরদের অত্যাচারের বিবরণ সরকারি নথিতে লিপিবদ্ধ করার অপরাধে বাংলার তৎকালীন লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার জন পিটার গ্র্যান্টকে দোষী সাব্যস্ত করেন ইংরেজ বিচারক! কাছাকছি সময়ে হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকার সম্পাদক হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ১০ হাজার টাকার মানহানির মামলা করে নীলকররা। তাদের অভিযোগ ছিল, নদীয়া জেলার কুলচিকাটায় নীলকুঠির ম্যানেজার আর্চিবল্ড হিলস কৃষককন্যা হরমণিকে ধর্ষণ করেছে, এই খবর পত্রিকায় হরিশ্চন্দ্র ছেপেছেন। ফলে ভদ্রসমাজে নীলকর সাহেবের মানহানি হয়েছে! ভারতবর্ষকে সভ্য করার পবিত্র দায়িত্বে নিয়োজিত ইংরেজদের যদি পদস্খলন হয়ও, সেটা নিয়ে নেটিভরা কিছু বলবে কেন? (১৮৬০ সালে নীলদর্পণ-এর লেখক প্রকাশককে হয়রানি করল অথচ ১৮৭২ সালে একই নাটক রাজধানীতে মঞ্চস্থ করার অনুমতি যে দিল সেটার আসল কারণ ভিন্ন। ১৮৬৫ সালে জার্মানিতে সিনেথেটিক নীল আবিষ্কার হয়। জার্মান নীলে বিশ্ববাজার সয়লাব। কোনঠাসা ইংরেজ হিসেব করে দেখল, বাংলার কৃষককে জোরজবরদস্তি করে নীল উৎপাদন আর লাভজনক হচ্ছে না। তার চেয়ে নীলচুক্তি আইন রদ করলে বরং প্রজার সামনে তার ভাবমূর্তি কিছুটা উজ্জ্বল হবে।)

অতএব ঔপনিবেশিক শাসন তো দূরের কথা, ব্রিটিশ সরকার অত্যাচারী ইংরেজ পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে সমালোচনাও সহ্য করতে পারেনি। আসলে ইউরোপীয় উদারতাবাদের একটি নির্দিষ্ট সীমানা আছে। ঔপনিবেশিক শাসনযন্ত্রের সহযোগী কিংবা প্রতিরোধকারী যা-ই হন না কেন, আপনাকে ঔপনিবেশিক প্রভুর শেখানো ভাষা ও করুণা করে দেয়া উপকরণ ব্যবহার করতে হবে। তাদের শাসন ও শোষণের প্রতিবাদ করা যাবে, তবে ইউরোপের এঁকে দেয়া লক্ষণরেখার বাইরে গিয়ে নয়। উত্তর-উপনিবেশ শাস্ত্রের আরেক মহীরুহ আশীষ নন্দী এটাকে বলছেন সাংস্কৃতিক ঐকমত্য :

When such a cultural consensus grows, the main threat to the colonizers is bound to become the latent fear that the colonized will reject the consensus and, instead of trying to redeem their ‘masculinity’ by becoming the counterplayers of the rulers according to the established rules, will discover an alternative frame of reference within which the oppressed do not seem weak, degraded and distorted men trying to break the monopoly of the rulers on a fixed quantity of machismo. If this happens, the colonizers begin to live with the fear that the subjects might begin to see their rulers as morally and culturally inferior, and feed this information back to the rulers. 

ইংরেজরা ভারতবর্ষের রাজদণ্ড ত্যাগ করেছে ১৯৪৭ সালে। ৭৫ বছর পেরিয়ে গেছে কিন্তু তাদের এঁকে দেয়া লক্ষণরেখা কি আমরা অতিক্রম করতে পেরেছি? আবার ফিরে যাওয়া যাক নীলদর্পণ মঞ্চায়নের প্রসঙ্গে। ১৮৭২ সালের ৭ ডিসেম্বর কলকাতায় মঞ্চায়িত হয় নীলদর্পণ। সেই সূত্রে এবছর সাধারণ রঙ্গালয়ের ১৫০ বছর পূর্তি উদযাপন করা হচ্ছে। বর্তমানে উভয় বাংলায় আমরা যে থিয়েটারচর্চা দেখি সেটা তো ইউরোপীয় ঢংয়ে গড়ে উঠেছে। নাটক রচনা ও নির্দেশনার কৌশলে আজও মূলত ইউরোপের ধারাই অনুসরণ করা হচ্ছে।  

‘পাশ্চাত্য প্রভাব-বলয়ের বাইরে বেরিয়ে বাঙালি সমাজের নিজস্ব গল্প এবং যাপিত জীবনের নাটকীয় উপাদান সংগ্রহ’২ করার জন্যে তাই প্রয়োজন হয় একজন সেলিম আল দীনের। ক্ষণজন্মা এই নাট্যাচার্য বিস্তর পুঁথি-পাঁচালি ঘেটে প্রমাণ করেছেন যে, বঙ্গভূমিতে নাটকের ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো। তবে সেই নাটকের বর্ণনাভঙ্গি ও পরিবেশনার রীতি পাশ্চাত্য রীতির তুলনায় একেবারেই স্বতন্ত্র। সেলিম আল দীনের গবেষণাপত্র বেরোবার আগপর্যন্ত আমরা জানতাম, বাংলা নাটকের সূচনা হয়েছে ১৭৯৫ সালে রুশ নাট্যকার গেরাসিম লেবেদফের হাত ধরে। বইপুস্তক ও সংবাদপত্রে এখনো এই ভুল তথ্যটি হরহামেশা ছাপা হচ্ছে। অর্থাৎ বাঙালির ৮০০ বছরের ইতিহাস লোপাট। যে গাছের শেকড় দুর্বল ও স্বল্পদৈর্ঘ্যের তাকে উপড়ানো সহজ। বিশ্বাস না হলে যে কেউ একটা অশ্বত্থ বা বকুল গাছ উপড়ানোর চেষ্টা করে দেখতে পারেন।

ঔপনিবেশিক কাঠামো ও রীতিতে থিয়েটারচর্চা বিচ্ছিন্ন উদাহরণ নয়। ব্রিটিশদের চালু করা শিক্ষাব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা ও সরকার কাঠামো ভারতীয় উপমহাদেশের জল-হাওয়া-মাটি ও জনমানসের সাথে আদতে খাপ খায় কিনা সেটা নিয়ে পর্যাপ্ত আলোচনা ও বিতর্ক হচ্ছে কি? নাকি আমরা মাছিমারা কেরানির মতো ঔপনিবেশিক মডেলটাই অনুসরণ করছি? ইউরোপীয় সভ্যতা থেকে এসেছে বলেই কোনো মডেল বর্জনীয় নয়। ঔপনিবেশিক পরম্পরার বহু উপাদান আমাদের সামষ্টিক ও ব্যক্তিজীবনকে সমৃদ্ধ করেছে। ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তীর জীবন থেকেই দুটো উদাহরণ দেয়া যেতে পারে—

প্রথমটি তার বয়ঃসন্ধিকালের ঘটনা। ইংরেজি নববর্ষে এক বান্ধবীর কাছ থেকে তিনি ডায়েরি উপহার পেলেন। প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা : think pure thoughts। pure বলতে সেই বালিকা কী বুঝিয়েছে তা বের করতে গিয়ে গোল লেগে গেল। অনেক ভেবেচিন্তে দীপেশ মীমাংসায় পৌঁছলেন যে, চিন্তার ক্ষেত্রে pure কথাটির বাংলা হয় না। ‘এটি একটি ইংরেজি ও ক্রিশ্চানশব্দ যা আরও পাঁচটা ইউরোপীয় শব্দ, আচার-ব্যবহার ও জিনিসের মতো আমাদের জীবনে জায়গা করে নিয়েছে। আসলে ইতিহাসের যে ধারা শিক্ষিত বাঙালির মন তৈরি করেছে, তার “যে পথে ইউরোপীয় পাথর ছড়ানো।” আমাদের ইতিহাসে ওই ক্রিশ্চান pure/impure-এর দ্বন্দ্ব অমনই একটি উপলখণ্ড।’

শুধুই কি চিন্তাভাবনায়? ইতোমধ্যেই ক্ল্যাসিকের মর্যাদা পেয়ে যাওয়া Provincializing Europe বইয়ের মুখবন্ধে দীপেশ তার কৈশোর ও তারুণ্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন, ‘উপনিবেশ-পরবর্তী কলকাতার ট্র্যাফিক আইনকানুনে, ভারতীয়দের নাগরিক কাণ্ডজ্ঞানের অনুপস্থিতি সম্পর্কে মুরব্বীদের আক্ষেপে, ফুটবল ও ক্রিকেট খেলায়, আমার স্কুলের ইউনিফর্মে, সামাজিক অসমতা বিশেষত বর্ণপ্রথার সমালোচনা করে লেখা বাঙালি জাতীয়তাবাদী প্রবন্ধ ও কবিতায়, প্রেম করে বিয়ে নাকি পারিবারিক সম্বন্ধে বিয়ে কোনটা ভালো সেটা নিয়ে বিতর্কে, সাহিত্যসভা ও ফিল্ম ক্লাবে—সবখানে ইউরোপের প্রভাব ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল।’

ইউরোপীয় বণিকরা ষোড়শ শতাব্দী থেকে বাংলায় ব্যবসাবাণিজ্যের কাজে যাতায়াত করলেও ইউরোপীয় ভাবনাজগৎ সম্পর্কে শিক্ষিত বাঙালি আগ্রহী হয় মূলত পলাশীর যুদ্ধের পর। শাসককে তুষ্ট করার স্বার্থে, শাসকের মনস্তত্ত্ব বুঝবার উদ্দেশ্যে এবং নিষ্কাম কৌতূহল মেটাতে ভদ্রলোক বাঙালি সমাজ ইউরোপীয় সভ্যতার ভাণ্ডার থেকে দুহাত ভরে গ্রহণ করে। পরিণতিতে আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির আগাপাশতলা বদলে গেছে। আর জানালা খোলা রাখলে ঘরে বাতাস ঢোকে, মশা-মাছিও। 

আশ্চর্য ব্যাপার হলো, সুদীর্ঘ ইংরেজ শাসনামলে বাঙালির পলাশী-পূর্ব ধর্মবিশ্বাস, লোকাচার ও রীতি-রেওয়াজ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি, অন্তঃসলিলার মতো প্রবাহিত হয়েছে। গোরাদের প্রবল প্রলোভন ও প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আমাদের অস্তিত্বের শেকড় উপড়ে পড়েনি। এর কারণ বোধহয় লুকিয়ে আছে আমাদের ইতিহাসে। কয়েক হাজার বছর ধরে বিশ্ববাণিজ্যের কেন্দ্রে ছিল বাংলা। সওদাগিরির সুবাদে কম জাতির সঙ্গে তো বাঙালির মেলামেশা হয়নি! শক হুন মোগল পাঠান কর্নাটকের ব্রাহ্মণ চালুক্যরাজ কে আসেনি বাংলা দখল করতে? ফলে ভিন্ন সংস্কৃতি থেকে প্রয়োজনীয় রসদ সংগ্রহ করার কৌশল ও সেই উপাদান হজম করার শক্তি আমরা আয়ত্ত করেছি। যে কারণে বাঙালি চরিত্রে অন্য যে ত্রুটিই থাকুক, xenophobia অন্তত নেই।

অন্যদিকে পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে পৃথিবী দখলের উদ্দেশ্য নিয়ে বেরিয়েছিল মূলত ইউরোপের পশ্চিম অংশের লোকজন। ভাষা, ধর্মবিশ্বাস, লোকাচার, গায়ের রং মেলে না এমন জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিলেমিশে বাস করার অভিজ্ঞতা (রোমান সাম্রাজ্য ব্যতিরেকে) তাদের ছিল না। আপন ঘরে ভিন্ন স্বর শুনতে তাদের কান তাই অভ্যস্ত হয়নি। এশিয়া, আফ্রিকা, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় তারা হাজির হলো বিজয়ী শক্তি হিসেবে। ফলে বিজিতের সংস্কৃতির ব্যাপারে তাদের একধরনের উন্নাসিকতা ছিল। 

একবিংশ শতাব্দীতে এসে ইউরোপ আর একমেবাদ্বিতীয়ম নয়। শিগগিরই হয়তো এমন একটা সময় আসছে, পশ্চিম ইউরোপের হাতে নাটাই আর থাকবে না। দীপেশ চক্রবর্তী তার বার্লিন বক্তৃতায় ইউরোপকে চেহারা ও চলন-বলনে ভিন্ন জনগোষ্ঠীকে সঙ্গে নিয়ে চলার মতো উদারচেতা (inclusive) হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। সেইসঙ্গে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, আগামী ৩০ বছরে ব্যর্থ রাষ্ট্রের সংখ্যা বাড়বে এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উদ্বাস্তু মানুষের ঢল নামবে। 

দীপেশ তাই ইউরোপকে দূর্গ-মানসিকতা থেকে দূরে থাকতে আহ্বান জানিয়েছেন। এর মানে এই নয় যে, অভিবাসী-উদ্বাস্তু মানুষকে ঢালাওভাবে তাদের মহাদেশে আশ্রয় দিতে হবে। দীপেশ বলতে চাইছেন, ইউরোপে অভিবাসন আইন ও সীমান্তে সজাগ প্রহরা থাকবে ঠিকই; তবে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে সেখানে যারা পাড়ি জমিয়েছে তাদের প্রতি ইউরোপের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। কীরকম? চীন, বাংলাদেশ কিংবা কেনিয়া থেকে অভিবাসী হওয়া মানুষটি ইউরোপের সংস্কৃতি-ঐতিহ্য আত্মস্থ করে হলুদ, বাদামী কিংবা কালো চামড়ার ইউরোপিয়ানে পরিণত হবে না। বরং একজন অভিবাসী ইউরোপীয় মূল্যবোধের সেরা জিনিসগুলো ধারণ করার পাশাপাশি তার নিজস্ব কষ্টিপাথরটাও কাজে লাগাবে। এটা ইউরোপের জন্যেও তার রীতিনীতি যাচাই-ঝালাই করে নেয়ার একটা সুযোগ হবে।

অথচ গত একযুগে ইউরোপ ঠিক এর উল্টোপথে হেঁটেছে। সেখানে শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদ ও মুসলিম বিদ্বেষ বেড়েছে, ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গেছে, অভিবাসীদের প্রতি দুয়োরানিসুলভ বৈষম্যমূলক আচরণ করোনাকালে প্রকট হয়েছে। সবচেয়ে নিন্দাজনক হলো, গৃহযুদ্ধ ও দারিদ্র্য কবলিত সিরিয়া, আফগানিস্তান, ইরাক ও সেনেগাল থেকে আসা শরণার্থীদের ঠেকাতে ইউরোপের নিষ্ঠুর আচরণ। আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের কোটি মানুষকে ছিন্নমূল করার নেপথ্যে ইউরোপের অবদান কি কম? কিন্তু বিপন্ন দেশগুলোর ভুক্তভোগী মানুষ যখন জান বাজি রেখে নিরাপত্তার আশ্রয়ে ইউরোপের সমুদ্র উপকূলে পৌঁছল, হিউম্যানিজম লিবারেলিজম ডেমোক্রেসির পীঠস্থান ইউরোপ তাদের আশ্রয় দিতে রাজি হলো না। কেন? কারণ এসব শরণার্থীর গায়ের রং সাদা নয়। তাদের ধর্মবিশ্বাস আলাদা, তারা খ্রিষ্টান নয়, মুসলিম। 

এ সরল সত্যটা যারা অস্বীকার করছিলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের পর তারা মুখে কুলুপ এঁটেছেন। সিরিয়া ইরাক থেকে আসা শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার ব্যাপারে সবচেয়ে অনমনীয় ছিল হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড ও চেক প্রজাতন্ত্র। এসব দেশের বহু নাগরিকরা নিজে গাড়ি চালিয়ে সীমান্তে গিয়েছিল ইউক্রেনের শরণার্থীদের উদ্ধার করতে। ইউরোপের মাটিতে ২০ লক্ষ ইউক্রেনীয় শরণার্থীর জন্যে জায়গা মিললেও সিরিয়ার ১১ লক্ষ শরণার্থীর জায়গা হয়নি। কেন তাদের এই দু-মুখো আচরণ?

আসলে হাতের ওপর হাত রাখা খুব সহজ নয়। নানা প্রসাধনীর প্রলেপে গোপন করা বয়সের বলিরেখার মতোই আধুনিকতার মুখোশের আড়ালে থাকা ইউরোপের জাতিগত বিদ্বেষ ও ধর্মীয় গোঁড়ামি অতর্কিতে বেরিয়ে পড়ে। কবি শঙ্খ ঘোষ যেমন আবিষ্কার করেছিলেন ষাটের দশকের আমেরিকায়। এক লেখক শিবিরে অংশ নিতে তিনি আইওয়া গিয়েছিলেন। একদিকে শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে আমেরিকা উত্তাল। ওদিকে আততায়ীর হাতে মার্টিন লুথার কিং খুন হওয়ার খবরে প্রকাশ্যে উল্লাস করছে সাধারণ শ্বেতাঙ্গ নারীরা। এহেন উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে এক রেডিও শো-তে কালোদের ওপর বৈষম্য নিয়ে শঙ্খ ঘোষ প্রশ্ন তুললে মার্কিনি (এবং সাদা চামড়ার) সঞ্চালক (চোরের মায়ের স্বভাবসুলভ) বড় গলায় দাবি করেন, সাদা-কালোর সমস্যা এদেশে সম্পূর্ণ মিটে গেছে। তোমার নিজের কি তেমন কোনো অভিজ্ঞতা হয়েছে? সঙ্গী কবিদের উপর্যুপরি অনুরোধে শঙ্খ ঘোষ শেষমেশ একটি ঘটনা শোনাতে বাধ্য হন। মিসৌরির সেন্ট লুইসে এক শ্বেতাঙ্গ ট্রাক ড্রাইভারের সঙ্গে কবির পরিচয় হয় : 

সব জায়গাতেই বিদেশীর কাছে মানুষ যেমন জানতে চায়, সেও তেমনি প্রশ্ন করেছিল কেমন লাগছে তাদের দেশ। ‘তুমি কেমন ভাবো তোমার নিজের দেশ বিষয়ে?’ প্রশ্ন করি আমি। উত্তরে গর্বিত ভঙ্গিমায় অনেককিছুই সে বলে আর শেষে জুড়ে দেয়, ‘ভিয়েতনামের যুদ্ধটাই হলো আমাদের দেশের একমাত্র অঘটন, একটা ব্যতিক্রম, শতাব্দীর সবচেয়ে বড়ো ভুল। কিন্তু বাইরের পৃথিবীতে আমাদের শাদাকালোর সমস্যাটাকেও অনেকখানি ফাঁপিয়ে নিয়ে ভাবে। কিন্তু এখানে আর নেই এখন।’

কথা বলতে বলতে শঙ্খ ঘোষ ও সেই ড্রাইভার পৌঁছান এক পানশালার সামনে। ড্রাইভারটি বার্-এ বসে আড্ডা চালিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। অতঃপর—

হালকা চালে বলি : ‘আমি তো কালো, ঢুকতে দেবে তো বার্-এ?’
লোকটি দাঁড়িয়ে পড়ে পথে : ‘ছী ছী! এইরকম বলতে পারলে? বলেছি না এখানে আর নেই ওসব?’
‘আহা আমি ঠাট্টাই করছিলাম। কোনো বার্-রেস্তোরাঁয় কি বসিনি আগে? চলো, যাওয়া যাক।’
অর্ডার নিতে আসে ওয়েটার। আমার দিকে তাকায় একবার। আরো একবার। চলে যায় অর্ডার নিয়ে। 
‘ওরকম তাকাল কেন লোকটা?‘ আমার সঙ্গীটি বলে। 
‘হয়তো বিদেশী বলে।‘
‘না না, এ তো ভালো নয়।‘ ওয়েটারকে সে ডাকে আবার। বলে: ‘লুক, হি ইজ অ্যান ইন্ডিয়ান।‘
ওয়েটার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে: ‘সো হোয়াট?‘ আরো একবার তাকিয়ে সে চলে যায়। 
‘না, ভালো লাগছে না ওর দৃষ্টি। তোমার সঙ্গে পাসপোর্ট আছে নিশ্চয়?‘
‘নিশ্চয় আছে। কিন্তু পাসপোর্টের খোঁজ কেন? তুমি নিশ্চয় ভাবছ না যে সেইটে এখানে বার করব আমি?’
‘ঠিক তা নয়। কিন্তু ও যদি তোমাকে নিগার ভেবে থাকে¬¬¬ —’
‘ভাবলই বা! তুমি তো বলছিলে যে এখানে ওসব কিছু নেই।’
‘তা ঠিক। আইনের কোনো বাধা নেই। কিন্তু —‘ একটু থতমত ভাবে সে বলে, — ‘কিন্তু, দে ডোন্ট লাইক ইট ঈদার! পরে কোনো ঝঞ্ঝাট হবে না তো?’

এটাই হলো গোড়ার কথা। জ্ঞানবিজ্ঞান শিল্পসাহিত্য জীবনমান সুশাসন সামরিক-প্রযুক্তিগত সক্ষমতা সবদিক দিয়েই ইউরোপ বাকি পৃথিবীর তুলনায় যোজন যোজন আলোকবর্ষ এগিয়ে। তাদের এই মনভুলানো বাগান তৈরির জন্যে প্রয়োজনীয় বীজ, পানি, সার ও শ্রম জুগিয়েছে বাকি পৃথিবী। তাই বলে সেই বাগানের এক কোনায় আশ্রয় চাইবে উপনিবেশ নামক জঙ্গল থেকে আসা বনমানুষ? আইনের কোনো বাধা নেই কিন্তু দে ডোন্ট লাইক ইট ইদার! তার ভয়, আশ্রয়প্রার্থী মানুষ যদি তার সুখে ভাগ বসায়?

আপাত শেষকথা
তবে বিষয় কী, আজকাল স্পেন ও পর্তুগালকে বলেকয়ে পরাজিত করে মরক্কো উঠে যায় সেমিফাইনালে, জাপানের কাছে ধরাশয়ী হয় বিশ্বচ্যাম্পিয়ন জার্মানি ও স্পেন। ফুটবলের মাঠ কিংবা ভূ-রাজনীতিতে আঠারো বা উনিশ শতকের মতো একপেশে প্রতিযোগিতার সম্ভাবনা কমে গেছে। ইউরোপ যত অন্তর্মুখী ও উগ্রবাদী হয়ে উঠবে এবং শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদকে প্রশ্রয় দেবে, বাকি পৃথিবীর ওপর তার অর্থনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রভাব তত কমতে থাকবে। 

সোনার ডিম প্রসবকারী উপনিবেশগুলো একে একে হাতছাড়া হওয়ার পরও কীভাবে নিজের আয়ুষ্কাল বাড়ানো যায় পশ্চিম ইউরোপ সেটা বরং শিখতে পারে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের (৩৩০-১৪৫৩ খ্রিষ্টাব্দ) কাছ থেকে। বাইজেন্টাইনরা প্রথমে হারিয়েছিল রোমকেন্দ্রিক সাম্রাজ্যের পশ্চিম অংশ (৪৭৬ খ্রি.)। তারপর মুসলিমদের কাছে হারাল তাদের রাজস্ব ও শস্যের প্রধান তিনটি উৎস বৃহত্তর সিরিয়া (৬৩৪-৬৩৮), মিশর (৬৩৯-৬৪২) এবং উত্তর আফ্রিকার রাজ্যগুলো। চতুর্দিকে শক্তিশালী শত্রু ও ধারাবাহিক অন্তর্দ্বন্দ্ব সত্ত্বেও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য আরও ৮০০ বছর যে টিকে ছিল তা সত্যিই বিস্ময়কর বৈকি। এই সাফল্যের রহস্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মার্কিন সমর ইতিহাসবিদ এডওয়ার্ড লুতওয়াক বলছেন, ‘বাইজেন্টাইনরা সামরিক শক্তির চেয়ে persuasion—এর অন্যান্য উপায়ের ওপর বেশি নির্ভর করেছে। এর মধ্যে ছিল প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর সাথে মৈত্রীচুক্তি, শত্রুকে (উপঢৌকন দিয়ে বা অন্য কোনোভাবে) নিরস্ত করা  এবং সম্ভাব্য শত্রুদের মধ্যে কোন্দল লাগিয়ে দেয়া।’

পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকায় আগের মতো দাপট নিয়ে চলতে না পারলেও নানান ফন্দিফিকির করে বাইজেন্টাইনরা দ্বিতীয় সারির খেলোয়াড় হিসেবে দীর্ঘকাল মাঠে টিকে ছিল। ইউরোপীয়রা তাদের কীর্তিমান পূর্বসূরিকে অনুসরণ করার কথা ভেবে দেখতে পারে। সুপরিচিত শরৎ-বচনটি একটু বদলে নিলেই তারা মন্ত্র হিসেবে দিব্যি জপতে পারবে—‘টিকিয়া থাকাই চরম সার্থকতা, অতিকায় হস্তীরূপ লোপ পাইলেও তেলাপোকা হইয়া আমরা টিকিয়া থাকিব।’
 আর আমাদের পূর্বপুরুষকে ইউরোপ কীভাবে বুদ্ধু বানিয়ে জল ঘোলা করল এবং মনের সুখে মাছ শিকার করল সেই ইতিহাস জানার ব্যাপারে আমরা যতদিন মুখ ফিরিয়ে রাখব ততদিন টিকে থাকবে উপনিবেশ। কেননা, colonialism is also a psychological state.

শেষ করছি একটি পুরনো কৌতুক দিয়ে। এক টুপি বিক্রেতা সারাদিন গ্রামের পথে পথে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। বিরাট বটগাছ দেখতে পেয়ে একটু জিরোনোর জন্যে সে বসল এবং ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘণ্টাখানেক পর চোখ মেলে দেখে তার ঝোলা থেকে বেশ কিছু টুপি হাওয়া। চারপাশে খুঁজে সে হয়রান। তারপর ওপরদিকে তাকিয়ে সে হতভম্ব। ডালে ডালে বানর বসে আছে টুপি মাথায় দিয়ে! 

তারপর কী হয়েছিল সেটা আপনারা জানেন। বুদ্ধিমান লোকটি ঝোলা থেকে একটি টুপি বের করে পরল। তারপর বানরগুলোর দিকে তাকিয়ে মাথা থেকে টুপিটা খুলে মাটিতে ছুড়ে ফেলল। তার দেখাদেখি বানরগুলোও একই কাজ করল। সে তড়িঘড়ি করে টুপিগুলো তুলে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়। তো, এই ঘটনার বহু বছর পর সেই গাছের নিচে আরেক টুপি বিক্রেতা বিশ্রাম নিতে এলো। সেও ঘুম থেকে উঠে দেখল টুপি নেই। বানর নিয়ে গেছে। এই তরুণটি আসলে আমাদের ওই টুপি বিক্রেতার নাতি। তার মনে পড়ে গেল, দাদার কাছে এরকম ঘটনা সে শুনেছে। সে যথারীতি মাথা থেকে টুপি খুলে মাটিতে ছুড়ে ফেলল। 

তখন গাছের ওপর থেকে এক বানর নেমে এলো। গম্ভীর মুখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে টুপি বিক্রেতার গালে কষে এক চড় বসাল। তারপর বলল, এই ব্যাটা, তুই কি একাই দাদার কাছে গল্প শুনেছিস? আমরা শুনি নাই?

দুষ্টু বানরের মতো আমরা কারো টুপি চুরি করিনি কিন্তু আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ, ঐতিহ্য, আত্মমর্যাদাবোধ ও আত্মবিশ্বাস লুট হয়ে গেছে। অতএব দাদা-দাদির কাছে বসে গল্পটা শুনুন। অসর্তকতার সুযোগ নিয়ে কেউ যেন পুনরায় সিঁদ কেটে ঘরে ঢুকে না পড়ে। বহুরূপী লুটেরা এবার হয়তো ক্লাইভের মতো বণিকের ছদ্মবেশে নয়, পশ্চিমা উন্নয়ন-তত্ত্বের ঝুনঝুনি বাজাতে বাজাতে বিশেষজ্ঞের চেহারায় হাজির হবে। কিন্তু দীপেশ আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, আধুনিকতার একক সার্বজনীন কোনো রূপ নেই এবং ইউরোপই আধুনিকতার একমাত্র মঞ্জিল নয়। 

অতএব পশ্চিমপানে তাকিয়ে হীনমন্যতায় ভোগার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। অপূর্ব সুন্দর নদী জলাভূমি বনবাদাড় ধ্বংস করে বসবাসের অযোগ্য আধুনিক নগর গড়ারও প্রয়োজন নেই। আমি আমারই মতো সুন্দর।

তথ্যসূত্র  
১. দ্য ইন্টিমেট এনিমি, আশীষ নন্দী, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০২২। পৃ. ১১
২. সেলিম আল দীন-এর নাটকে প্রান্তিক মানুষ ও সমাজ-জীবন, অনুপম হাসান, থিয়েটারওয়ালা, জানু-জুন ২০০৮
৩. ইতিহাসের জনজীবন ও অন্যান্য প্রবন্ধ, দীপেশ চক্রবর্তী, আনন্দ পাবলিশার্স, ২০১৬। পৃ. ১০ 
৪. Provincializing Europe, দীপেশ চক্রবর্তী, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৭। পৃ. ৯
৫. ঘুমিয়ে পড়া অ্যালবাম, শঙ্খ ঘোষ, প্যাপিরাস, ২০১০। পৃষ্ঠা, ১৩৩-৪
৬. ১৩ অক্টোবর ২০২২ বেলজিয়ামে অবস্থিত ইউরোপিয়ান ডিপ্ল্যোম্যাটিক একাডেমিতে দেয়া এক বক্তৃতায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র নীতিবিষয়ক প্রধান জোসেফ বেল মন্তব্য করেন, ইউরোপ হলো সমৃদ্ধ বাগান। আর বাকি পৃথিবীর বড় অংশই জঙ্গল এবং জঙ্গল বাগানকে গ্রাস করতে পারে।  
https://www.euronews.com/myeurope/2022/10/19/josep-borrell-apologises-for-controversial-garden-vs-jungle-metaphor-but-stands-his-ground
৭. দ্য গ্র্যান্ড স্ট্র্যাটেজি অব বাইজেন্টাইন এম্পায়ার, এডওয়ার্ড এন লুতওয়াক, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৯
৮. দ্য ইন্টিমেট এনিমি, আশীষ নন্দী, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০২২। পৃ. ২ 
৯. আমার দীপেশ আবিষ্কার, শাহাদুজ্জামান, মাওলা ব্রাদার্স, ২০২০। পৃ. ১৩


রেজওয়ানুর রহমান কৌশিক প্রাবন্ধিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে বিবিএ ও এমবিএ সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে গবেষণা কাজে নিযুক্ত আছেন।ঔপনিবে শিকতা ও বিশ্বায়নের প্রভাবে সমাজ, অর্থনীতি ও ভূ-রাজনীতির পালাবদল সম্পর্কে তার আগ্রহ রয়েছে।
 

menu
menu