দেশবোধ: মানুষের সামাজিক অস্তিত্বের সমাজ-রাজনৈতিক নির্ণিতি ও সমাজমনস্তাত্ত্বিক সংকট

দেশ কী? দেশ কি ভূমি? দেশ কি কেবলই ভূমি? মানুষের সঙ্গে দেশের কিংবা দেশের সঙ্গে মানুষের সংলগ্নতা কী এবং কেমন? দেশ হারালে মানুষ কী কী হারায়? ভূমি পেলেই কি মানুষের দেশ পাওয়া হয়? দেশপ্রেম বলতে মানুষ আসলে কিসের প্রতি প্রেমকে জ্ঞাপন করে? দেশের সীমা বা পরিধি কী? দেশের অবয়ব কী? দেশই কি রাষ্ট্র?

কেবল এই কয়েকটি প্রশ্নই নয়, দেশ বিষয়ে ভাবতে লেগে এমন আরও অনেক প্রাসঙ্গিক প্রশ্নই মনে উথলে ওঠে ও জেঁকে বসে। তখন মনে হয় যে, কেবল ভূমির ধারণা দিয়েই দেশাত্মবোধ ও দেশ ভাবনার সুরাহা হবার নয়। দেশ ভাবনায় সম্পূর্ণতার কাছাকাছি পৌঁছুতে গেলে আরও নানান অনুষঙ্গই প্রসঙ্গে আনতে হবে। দেশ যে কেবল ভূমিই নয়, তার উদাহরণ চোখের সামনেই পাওয়া যাবে, খুব দূরে অনুসন্ধান করতে হবে না। বাংলাদেশ তো একটি দেশ, কিন্তু দেশের ভিতরেও কীভাবে দেশের অস্তিত্ব এসে পড়ে সকলেই জানে সে কথা, কিন্তু হয়তো বোধে নেয় না সচেতনভাবে। দেশ তো আমাদের গ্রামও। শহুরে মানুষদের কাছে তাদের বসবাসের ও কর্মক্ষেত্র নগরটি দেশ নয়; তাদের দেশ হলো গ্রাম।

গ্রামকে দেশ বলার প্রবণতা অন্যত্রও পরিলক্ষিত হয়। অন্তত ইংরেজিতেও এর একটি পরিভাষা খুঁজে পাওয়া যায়। ইংরেজি ‘কান্ট্রি (Country)’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ যেমন দেশ বা রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমা, তেমনই গ্রামও। দেশ শব্দের ইংরেজি পরিভাষা কান্ট্রি, এটা নিশ্চয়ই ইংরেজগণের কাছেই আমরা শিখেছি; কিন্তু, গ্রামকে দেশ বলতে আমরা ওদের কাছে শিখিনি বোধহয় কিংবা গ্রাম অর্থে কান্ট্রি বলতে তারাও আমাদের কাছে পাঠ নেয়নি নিশ্চয়ই। সে যা-ই হোক, কিন্তু, প্রশ্ন তো রয়েই যায়। আমরা কেন শহর বা নগরকে আমাদের দেশ করতে পারি না? কেবল গ্রাম থেকে নগরে মাইগ্রেশন নয়, শহর থেকে গ্রামে কিংবা গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে বাসান্তরের বাস্তবতাও দেশান্তর প্রসঙ্গকে সামনে নিয়ে আসতে পারে, নিয়ে আসে। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে পুনর্বাসনের বেলায় দেখা যায় গ্রামই দেশ, কিন্তু আবার সকল গ্রামই দেশ নয়।

কি, হেঁয়ালীর মতো লাগল কথাটা? একটি উদাহরণে বোধহয় বিষয়টি অধিক স্পষ্ট হবে। ধরা যাক, বাংলাদেশের রহমতগঞ্জের রহিম মিয়া কপাল ফেরে ফজিলতগঞ্জে গিয়ে বাস গড়তে বাধ্য হলো—এখানেও প্রশ্ন, রহিমের দেশ কোনটি? বাংলাদেশ? হ্যাঁ। কিন্তু নিশ্চয়ই কেবল বাংলাদেশই তার দেশ নয়। তার প্রকৃত দেশ তো রহমতগঞ্জ। আর রহমতগঞ্জ একটি গ্রাম, ফলত গ্রামই দেশ। কিন্তু, দেখা গেলো ফজিলতগঞ্জের লোকেরা রহমতকে বৈদেশি বলে সংম্বোধন করতে শুরু করেছে। ফজিলতগঞ্জও তো একটি গ্রাম, কিন্তু রহিমের দেশ নয়। তার মানে গ্রাম হলেও গ্রাম মাত্রই দেশ হয়ে ওঠে না। এবং এ-ও সত্যি যে রাষ্ট্রসীমা বিবেচনার বাংলাদেশও রহিমের কাছে দেশ হিসেবে গুরুত্ব পায় না। কেন? দেশ বিবেচনার অন্যবিধ কারণসমূহও তাহলে বর্তমান নিশ্চয়ই।

দেশ কিংবা দেশপ্রেম বিষয়ে রোকন রকির এই বিবেচনাটি আমলে নেয়া যেতে পারে, ‘রাষ্ট্রীয়ভাবে নির্দিষ্ট কাঠামো দেশ না। ব্যক্তির জন্ম, বেড়ে ওঠা এবং বেঁচে থাকার সঙ্গী, প্রাণ-প্রকৃতি এবং মানুষই দেশ। আমাদের বুঝতে হবে যে রাষ্ট্র আর দেশ এক নয়। রাষ্ট্র একটা সংগঠন মাত্র, আর দেশ ব্যক্তির অস্তিত্বের সাথে, আত্মার সাথে সম্পর্কিত।’  ফলে রাষ্ট্রীয় সীমা দিয়েই দেশ বিবেচনার চূড়ান্তে আসা যাচ্ছে না কিংবা কেবল ভূখণ্ড সেটি গ্রাম বা শহর, তা দিয়েও দেশ বিবেচনার সুরাহা হচ্ছে না। এবং এই উদ্ধৃতি থেকে এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, দেশ ও রাষ্ট্র মোটেই এক ব্যাপার নয়। এই দাবিটি স্বতঃসিদ্ধ, বলা যেতে পারে। ফজিলতগঞ্জের লোকেদের কাছে রহিমের দেশ হলো রহমতগঞ্জ। তাহলে কি দেশ মানে জন্মস্থান? সম্ভবত তাও নয়। এই প্রসঙ্গেই এখানে স্মরণ করছি এমা গোল্ডম্যানের দেশ বিষয়ক কিছু অনুভব ও জিজ্ঞাসা। গোল্ডম্যানের যেটি দেশাত্ববাদ, সেটিকে দেশাত্ববাদ, দেশাত্ববোধ কিংবা দেশানুভূতিও বলা যেতে পারে।

যাহোক, গোল্ডম্যান প্রশ্ন করেন, ‘দেশাত্ববাদ ব্যাপারটা আসলে কী? এটা কি নিজের জন্মস্থানের প্রতি ভালোবাসা? এটা কি সেই স্থান যার সঙ্গে শৈশবের স্মৃতি এবং আশা জড়িত, স্বপ্ন এবং আকাঙ্ক্ষা জড়িত? যেখানে উড়ন্ত মেঘ দেখে শিশুসুলভ সরল মনে ভেবেছি আমরাও কেন ওই রকম দৌড়াতে পারি না, এটা কি সেই জায়গা? সেই জায়গা যেখানে শতকোটি তারা গুনতাম; যা আমাদের মনে ভয়ের সঞ্চার করত? এটা কি সেই স্থান যেখানে আমরা পাখির গান শুনতাম এবং তাদের মতো বড় বড় পাখা চাইতাম দূর দূরান্তে উড়ে যাওয়ার জন্য? অথবা সেই জায়গা, যেখানে মায়ের হাঁটুর উপর বসে মহান সৃষ্টি ও অর্জনের গল্প শুনে আনন্দ পেতাম? মোট কথা দেশাত্ববাদ কি সেই জায়গার জন্য ভালোবাসা, যার শরীরে মিশে আছে আমাদের দুর্লভ ও চমৎকার সব আনন্দ উল্লাস এবং আমাদের দুরন্ত শৈশব?’  দেশ হলো মানুষের একটি আবেগ যা তার জীবন প্রক্রিয়ার ভিতর থেকে জন্মলাভ করে। জন্মস্থান বলতে তো ভূখণ্ড। সুতরাং কেবল জন্মস্থানই দেশ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে না।

মানুষের স্মৃতি, আকাঙ্ক্ষা, আশা, স্বপ্ন, দুরন্ত শৈশবের উল্লাস কিংবা শৈশবের তারাভরা আকাশ, ব্যক্তির জন্ম, বেড়ে ওঠা এবং বেঁচে থাকার সঙ্গী, প্রাণ-প্রকৃতি এবং মানুষই দেশ—এই কথাগুলো খুবই বিমূর্ত কিছু একটাকে নির্দেশ করে এবং তা একটি আবেগের দিকেই মূলত নির্দেশ করে। এবং সেই আবেগটি চূড়ান্তভাবে প্রকাশ পায় এই কথার মধ্যে— দেশ ব্যক্তির অস্তিত্বের সাথে, আত্মার সাথে সম্পর্কিত। এই আবেগটি কিছু অনুষঙ্গের জটিল আন্তঃসম্পর্কের পরিণতি মূলত। এই আবেগটি জন্মস্থান কিংবা ভূমির অনুষঙ্গ না-থাকলেও তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

আবার কখনো মানুষ, মাটি, প্রাণ-প্রকৃতি থাকা সত্ত্বেও এই বোধ তৈরি হয় না। ধরা যাক রহিম রহমতগঞ্জে বাস করতো বটে, কিন্তু সে ছিল মূলত ভূমিহীন। রহমতগঞ্জে তো রহিমের ভূমিই নেই, তাহলে রহমতগঞ্জ কীভাবে রহিমের দেশ হয়? তাহলে দেশ বিবেচনা ভূমি বা বসতভিটা দিয়েও চূড়ান্ত করা যাচ্ছে না। ভূমি দিয়ে দেশ বিবেচনা করা গেলে ফজিলতগঞ্জে এসে রহিম বৈদেশি হয়ে যেতো না, কেন না, রহমতগঞ্জ থেকে ফজিলতগঞ্জে এসে রহিম বসবাসের একটুকরো জমি পেয়েছে। দেখা গেল তাতেও রহিমের সমস্যার সমাধান হলো না। এবং এ-ও ধরা যাক যে, ফজিলতগঞ্জে এসে রহিম কেবল বসতভিটা-ই নয়, সাথে কিছু ফসলি জমির মালিকও হয়েছে কোনো সূত্রে।

কিন্তু, দেখা যাবে তাতেও রহিমের দেশ সমস্যার সমাধান হয় না; রহিম তখনো বৈদেশি বলেই চিহ্নিত হচ্ছে। রহমতগঞ্জে এসেও রহিম ভূমি, মানুষ, প্রকৃতি-প্রাণ, প্রতিবেশ—সবই পায়, তবে সেখানে তার দেশবোধ তৈরি হয় না কেন? কারণ হঠাৎ করে সেই আবেগটি তৈরি হয় না, হতে পারে  না। তাহলে মানুষের দেশ বা দেশ-আবেগ কী দিয়ে নির্ধারিত হয় এবং কী প্রক্রিয়ায়? ভাবা যেতে পারে, ভূমি না-ই-বা থাক তবু, যে এলাকায় জন্ম হয়েছে সেই এলাকাই তো দেশ, তাই নয় কি? ঠিক আছে, সেটাই ধরা যাক। কিন্তু, এমন যদি হয় যে, রহমতগঞ্জের লোক মতিন বাতেনগঞ্জের পথে পরিভ্রমণকালে তার সন্তান রহিম ভূমিষ্ট হয়েছে, তখন? এখন রহিমের দেশ কোনটি? তার বাপের এলাকা রহমতগঞ্জ নাকি তার জন্ম বা ভূমিষ্ট হওয়ার এলাকা বাতেনগঞ্জ? জন্ম এলাকা, বসবাসের এলাকা—কোনোটিকেই দেশ বিবেচনায় চূড়ান্ত করা যাচ্ছে না।

বাতেনগঞ্জ রহিমের দেশ হচ্ছে না, কারণ সেই স্থানের সাথে রহিমের দেশরূপক আবেগ তৈরি হয় নি। এই আবেগটি তৈরি হতে একটি জীবন পরিসর দরকার পড়ে। এখন জিজ্ঞাসা, ফজিলতগঞ্জেও তো এই জীবন পরিসর পেয়ে যায় রহিম, সে ফজিলতগঞ্জকেও ভালোবাসতে পারে, তাহলে ফজিলতগঞ্জের প্রতি রহিমের কি সেই আবেগটি তৈরি হয় না বা হতে পারে না কিংবা তৈরি নাহলে কেন তৈরি হয় না? এই জিজ্ঞাসার জবাব এমন হতে পারে—হ্যাঁ, সেখানেও এই আবেগ তৈরি হতে পারে এবং না-ও হতে পারে।

তবে, এই নাহতে পারার ঘটনাই ঘটে অধিকাংশ ক্ষেত্রে, কেন না, সেখানে এই না-হতে পারার পিছনে কিছু কারণ বর্তমান থাকে। কিংবা রহিম যখন ফজিলতগঞ্জকে ভালোবাসছে তখনো ফজিলতগঞ্জের লোকেরা রহিমকে বৈদেশি বলছে। কিন্তু এর কারণসমূহ কী? কারণসমূহ ক্রমশ আলোচনায় স্পষ্ট হবে, প্রত্যাশা রাখি। এবং জীবন পরিসরের বিষয়ে আরেকটু দ্বিধার মীমাংসা করার চেষ্টা করা যাক বরং এখানে।

ধরা যাক, রহমতগঞ্জের মতিনের পুত্র তার মাতুল গ্রাম মদনগঞ্জে জন্ম নিয়েছে এবং সেখানেই তার শৈশব, কৈশোর, যৌবন এমনকি পুরো জীবনটাই কাটিয়ে দিয়েছে; তাহলে? তখন রহিমের দেশ কোনটা? রহমতগঞ্জ নাকি মদনগঞ্জ? দেখা যায় আঁতুড় ঘর এবং পুরো জীবনযাপনের প্রতিবেশ মদনগঞ্জ হওয়া সত্ত্বেও রহিমের দেশ, লোকে বলছে ঐ রহমতগঞ্জকেই। তবে কি ভূমি কিংবা অঞ্চল নয়, পিতৃপুরুষই দেশ? দেশ তবে জন্মাতীত ব্যাপার কিংবা জন্মপূর্বের সামাজিক সংঘটনার মাঝে বিরাজমান? পিতৃপুরুষের বসবাসের অঞ্চলই কি দেশ? দেখা যাচ্ছে, মদনগঞ্জের পরিপ্রেক্ষিতে রোকন রকি ও এমা গোল্ডম্যানের দেশ বিবেচনার অনুষঙ্গসমূহের ইতিবাচক উপস্থিতিও মদনগঞ্জকে রহিমের দেশ বিবেচনা করতে সাহায্য করছে না।

অর্থাৎ ব্যক্তির সামাজিক প্রতিবেশে তৈরি হওয়া নিজস্ব আবেগই চূড়ান্ত কথা নয়, বরং সমাজের অপরাপর মানুষেরও একটি বিবেচনা থাকে এই দেশ নির্ধারণের ক্ষেত্রে। তারই-বা পরিস্থিতি কেমন এবং এর পিছনে কী কারণসমূহ ক্রিয়াশীল থাকে? সমস্যাটা কি তবে ফজিলতগঞ্জের ও মদনগঞ্জের মানুষের মনোবাস্তবতায় ও সামাজিক বাস্তবতায়? নিশ্চয় মনোবাস্তবতায় কারণসমূহ নিহিত থাকে এবং সমাজবাস্তবতায় তা জীবন্তরূপে ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে।

দেশ বোধ রহিমের বা তদ্রূপ ব্যক্তিবর্গেরও মনস্তাত্ত্বিক সংকট। ওটা মনস্তাত্ত্বিক সংকট নিশ্চয়, কেন না, তা একটি আবেগ। এবং বিপরীতে সমাজের অপরাপর মানুষেরা যেভাবে রহিমকে বা তদ্রূপ ব্যক্তিবর্গকে প্রত্যাখ্যান করে, তা-ও একটি আবেগ। এই আবেগসমূহ সমাজে চিরায়ত এবং চিরস্থায়ী নয় মোটেই। উপযুক্ত সমাজ-রাষ্ট্রিক-বৈশ্বিক কারণ উদ্ভূত হলে এই আবেগ বাতাসে মিলিয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ রহিম রহমতগঞ্জকে ভুলে ফজিলতগঞ্জকে দেশ ভাবতে পারে এবং ফজিলতগঞ্জের মানুষেরা বা মদনগঞ্জের মানুষেরাও রহিমকে স্বদেশী ভাবতে পারে।

সে-ও মানুষের সমাজমনস্তাত্ত্বিক অভিব্যক্তি। কিন্তু যখন এমন ইতিবাচক পরিণতি ঘটে না তখন সেই নেতিবাচক আবেগটি মানুষের জন্য একটি সংকটই বটে। হ্যাঁ, এই পক্ষ-বিপক্ষের ইতিবাচক-নেতিবাচক দেশবোধ কিংবা দেশাত্মবোধ আসলে মানুষের একটি সমাজমনস্তাত্ত্বিক সংকটই। কীভাবে? উত্তরানুসন্ধানে রহিম কেন রহমতগঞ্জকে ভুলতে পারে না এবং ফজিলতগঞ্জের মানুষেরা কেন রহিমকে নিজের দেশের লোক বলে গ্রহণ করতে পারে না তার কারণসমূহ খতিয়ে দেখা দরকার। একটি কারণকে প্রথমেই বিবেচনা করা যাক, তা হলো মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক। এই অনুষঙ্গটি অনেকটাই কার্যকারণ সিদ্ধ হলেও বিষয়টিকে প্রথমে অনুসিদ্ধান্ত আকারেই নিই যে, দেশ সমস্যার কিছু সমস্যা ও সমাধান মানুষের সম্পর্কের ভিতরেও থেকে যায়।

সম্পর্কের ভিতরে মানে কোনো স্থানের মানুষের সাথে কোনো ব্যক্তির সম্পর্কের ভিতরে, রহমতগঞ্জের মানুষের সাথে রহিমের সম্পর্ক যেমন। ধরা যাক, ফহিলতগঞ্জের মানুষগুলোকে রহিম খুব আপন করে নিতে পারলো এবং ফজিলতগঞ্জের মানুষেরাও অনুরূপভাবে রহিমকেও গ্রহণ করলো। তখন? তখন কি রহিম রহমতগঞ্জকে দেশ ভাবতে পারে? পারে হয়তো, পারবে হয়তো। কিন্তু এই পারার ঘটনাটি খুবই বিরল। ইতিবাচক অনুষঙ্গসমূহ উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও এই ব্যাপারাটি প্রকৃতই সমাজমনস্তাত্ত্বিক সংকট। আবার নতুন স্থানের মানুষগুলো অন্যত্র থেকে আসা মানুষটিকে ভালোবেসে ফেললেও নতুন মানুষটির অস্তিত্বে সেঁটে দেয়া ‘বৈদেশি’ ট্যাগ ও সেই সম্বোধনে রত থাকলে তা নতুন মানুষটির মনস্তাত্ত্বিক সংকট তৈরি করে বটে।

হয়তো এই ট্যাগ বা সম্বোধন আসলে খুবই নির্দোষ একটি ব্যাপার, কিন্তু তা সংকট তৈরি করতে পারে, তৈরি করে। অর্থাৎ এই নির্দোষ সামাজিক পরিচিতি আরোপণও এই দেশ ভাবনার মধ্যে প্রায়শ গোলমাল পাকিয়ে তোলে। এই নির্দোষ চর্চাটি বহুদিন ধরে চলতে পারে, চলতে থাকে এবং মানুষ মনে রাখে যে, রহিমের আদিনিবাস আসলে রহমতগঞ্জ। তবে, মনে রাখা জরুরি যে, এই চর্চাটি সর্বদাই নির্দোষ থাকে না। কখনো কখনো তা চর্চিত হয়ে থাকে সচেতনভাবে উদ্দেশ্যমুখীনতায়। মানুষে-মানুষের সম্পর্কের মাধ্যমে সমস্যা ও সমাধান দুই-ই স্পষ্ট হতে পারে। কিন্তু, সেক্ষেত্রে শুরুতেই বুঝে উঠতে হবে যে, সম্পর্কটি দ্বান্দ্বিক নাকি সহযোগিতামূলক, ভালোবাসার নাকি প্রত্যাখ্যানের। এবং এইসব বোঝাপড়া শেষ হলেও সর্ম্পকের বিষয়টিও দেশবোধের চূড়ান্ত ও প্রকৃত মীমাংসা দেয় না।

এবারে দেশানুভূতির পরিক্ষেত্র হিসেবে রাষ্ট্রের পরিসর বেছে নেয়া যাক। এবং আরেকবার স্মরণ করে নেয়া যাক যে, দেশ আর রাষ্ট্র এক ব্যাপার নয়। রাষ্ট্রের থাকে অভ্যন্তর ও বাহির। রাষ্ট্রের সাথে সংশ্লিষ্ট রাজনীতি,  অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক। রাষ্ট্রভাবনার সাথে সংশ্লিষ্ট থাকে রাষ্ট্রের জাতি ভাবনা ও জাতীয়তাবোধ এবং জাতীয়তাবাদ। যদিও দেশবোধও সর্বদা রাজনীতিমুক্ত থাকতে পারে না, আর, রাষ্ট্র রাজনীতিরই উৎপাদন একটি প্রতিষ্ঠান এবং রাজনীতিই এর স্বভাব কিংবা ধর্ম। এও মনে রাখা যেতে পারে যে, দেশানুভূতি ও দেশপ্রেম দুটি ভিন্ন বোধের প্রত্যয়।

তবে, কখনো কখনো দেশানুভূতি ও দেশপ্রেম একই অনুভবের বহিঃপ্রকাশ দেখাতে পারে, কিন্তু, পরিসর বিবেচনায় নিলেই এই বিভ্রান্তি দূর হতে পারে। রহিমের রহমতগঞ্জের প্রতি অনুভবকে আমরা দেশপ্রেম বলছি না, বলছি দেশানুভূতি। এই অনুভূতি তৈরির পিছনে কোনো চাপ নেই, বল প্রয়োগ নেই, মগজধোলাই নেই, জাতীয়তাবাদী প্রপাগান্ডা নেই; এটা একেবারেই স্বতঃস্ফূর্ত ব্যাপার। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশের প্রতি রহিমের কোনো স্বদেশ অনুভূতি তৈরি হলে তা-ই মূলত দেশপ্রেম।

 এই দেশপ্রেম প্রকৃত পক্ষে রাজনীতির ফসল। বাধ্যবাধকতার সম্পর্ক রাষ্ট্রের সাথে রহিমের। রাষ্ট্রকে রহিম ভালোবাসতে বাধ্য, রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য দেখাতে রহিম বাধ্য, তা নাহলে রহিম রাষ্ট্রদ্রোহী বলে চিহ্নিত হতে পরে এবং হারাতে পারে তার সমস্ত নাগরিক অধিকার এবং চূড়ান্তরূপে তার উপরে নেমে আসতে পারে রাষ্ট্রের শাস্তির বিধান। ‘দেশপ্রেম মানে দেশের মানুষের প্রতি, প্রাণ-প্রকৃতির প্রতি প্রেম, এটা আত্মিক টান।

কিন্তু, রাষ্ট্র উৎপাদিত দেশপ্রেমে এই আত্মিক টানের চেয়ে পরজাতির প্রতি অর্থাৎ অন্য দেশের প্রতি ঘৃণা, তাদের সাথে প্রতিযোগিতা এবং তাদেরকে নিচু এবং তাদের চাইতে নিজেদের উন্নত বলে আত্মশ্লাঘায় ভোগার একটা প্রবণতা প্রকটভাবে দেখা যায়। তাই এটা শুধু প্রেম না, এটা একটা মতাদর্শে পরিণত হয়। মতাদর্শ মানেই কর্তৃত্ব।’ রোকন রকি এখানে দেশপ্রেমের দুটি পরিসরের কথাই উল্লেখ করেছেন।

দেশপ্রেম মানে দেশের মানুষের প্রতি, প্রাণ-প্রকৃতির প্রতি প্রেম, এটা আত্মিক টান—এই কথাটুকু রহিমের রহমতগঞ্জ বা ফজিলতগঞ্জের প্রতি অনুভবের সাথে অন্বিত করে দেখতে পারি। পূর্বেই বলেছি, এটি একটি আবেগ, স্বতঃস্ফূর্ত বোধ। তবে, স্বতঃস্ফূর্ত হলেও এই আবেগটিকেও একেবারে নির্দোষ ভাবা উচিত নয় মোটেই। কিন্তু, রাষ্ট্র যে দেশপ্রেমের মন্ত্রটি নাগরিকগণের মগজে পুরে দিতে চায় তা সর্বদাই কৃত্রিমতাজাত।

রোকন রকি যথার্থই বলেন যে, পরজাতির প্রতি ঘৃণা, প্রতিযোগিতা কিংবা পরজাতির শত্রুতার মুখে স্বরাষ্ট্র বিপন্ন হতে পারে এই মর্মে প্রচার না চালালে সাধারণত এই দেশপ্রেমের পালে হাওয়া লাগে না। এমনকি এই দেশপ্রেম যদি কেউ মনে পুষে রাখে তা সহজে স্পষ্ট হয় না যদি-না বিজাতীয় শত্রুর একটি অবয়ব ছায়া ফেলে নাগরিকগণের মনে।

মূলত এই দেশপ্রেম জাতীয়তাবাদের নামান্তর। রাষ্ট্র-কর্তৃত্ব এই মতাদর্শকে নাগরিকগণের মনে পুরে দিয়ে একটি জাতিগত সংহতি প্রতিষ্ঠা করতে চায়, নাগরিকগণকে একটি জাতিরূপে চিহ্নিত করে কৃত্রিম একটি গৌরববোধ দিতে চায় তাদের চেতনায়। রুডল্ফ রকার বলেন, ‘তথাকথিত ‘জাতীয় চেতনা’ একটা বিশ্বাস ভিন্ন আর কিছু না।

এই বিশ্বাস প্রচারিত হয় রাজনৈতিক ক্ষমতার চিন্তা থেকে। ... স্বদেশ প্রেমে ‘ক্ষমতার চর্চা’ থাকে না।’  রকারের মতে যেটি তথাকথিত জাতীয়চেতনা, সেটিই আসলে জনপ্রিয় অর্থে দেশপ্রেম, রাষ্ট্র-কর্তৃত্বের অনুষঙ্গে। আর যেটি স্বদেশপ্রেম সেটি আসলে রাষ্ট্রসীমার সাথে অন্বিত বোধ নয়। যেমন রহমতগঞ্জের রহিমের মাঝে এই স্বদেশপ্রেম বা দেশবোধ কাজ করে, তেমনই প্রাকজাতিরাষ্ট্র যুগেও ভূমিপুত্রদের মাঝে এই বোধ ক্রিয়াশীল ছিলো, সমাজৈতিহাসিক বাস্তবতার দোহায় দিয়ে এই কথা জোর দিয়েই বলা যায়।

যেহেতু জাতীয়তাবাদ বা রাষ্ট্র-কর্তৃত্ব আরোপিত ও প্রচারিত দেশপ্রেম কৃত্রিম ব্যাপার এবং তা উদ্দেশ্যমুখী মতাদর্শিক প্রপাগান্ডা, সেই কারণে অনেক তাত্ত্বিকগণই এমন মতাদর্শের প্রতি তাদের বঙ্কিম দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখেন। যেমন গুস্তাভ হার্ভে বলেন, ‘স্বদেশ ভক্তি একটি কুসংস্কার। এটা ধর্মের চেয়েও ক্ষতিকর, পাশবিক এবং অমানবিক। ... দেশত্ববাদ বা দেশপ্রেমও একটি কুসংস্কার যা কৃত্রিমভাবে তৈরি এবং মিথ্যার জাল বিস্তারের মাধ্যমেই যার রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়।

এটা এমন একটি কুসংস্কার যা মানুষের আত্মসম্মান ও মর্যাদা কেড়ে নেয় এবং অহংকার ও দাম্ভিকতা বৃদ্ধি করে।’৫  বুঝতে বাকি থাকে না যে, গুস্তাভ হার্ভে যে স্বদেশভক্তির কথা বলেন তা মূলত জাতীয়তাবাদী চেতনাই। আধুনিক বিশ্বে আন্তর্জাতিক জাতিরাষ্ট্রিক দ্বন্দ্বের বাস্তবতায় হার্ভের কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে ফলে উঠতে দেখা গিয়েছে। বা, হার্ভের কথাগুলো, ধরা যাক, একজন আধুনিক বিশ্বপরিস্থিতির প্রত্যক্ষদর্শীরই কথা। জাতীয়তাবাদী তথা দেশপ্রেমানুভূতিজাত সাম্প্রদায়িকতার নগ্ন রূপ সারাবিশ্বই প্রত্যক্ষ করেছে ইতোমধ্যে। ১৯১৪ সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বেই সেইসব জাতীয়তাবাদী সংঘাত ও দখলদারী ক্ষমতার পাঁয়তারা অতিনগ্নভাবেই তার স্বরূপ দেখিয়েছে। পুরো সতেরো-উনিশ শতক জুড়ে পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রসমূহ অপাশ্চাত্য রাষ্ট্রসমূহের প্রতি যে দখলদারী আগ্রাসন চালায় সেসবের ভিতরেও জাতীয়তাবাদী কর্তৃত্বের মনোভাবই প্রকাশ পেয়েছে। পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রসমূহের নাগরিকগণকেও জাতীয়তাবাদী মনোভাবাপন্নতায় সেই আগ্রাসনকে সমর্থন দিতে দেখা গিয়েছে।

লিয়েভ তলস্তয় উনিশ শতকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে জার্মানির জার্মান বা আর্য-জাতীয়তাবাদী সন্ত্রাস প্রত্যক্ষ করেই বলেন, ‘দেশত্ববাদ বা দেশপ্রেম এমন একটি নীতি যা গণহত্যার প্রশিক্ষণকে বৈধতা দেয়। এটা এমন একটি কারবার যার ভালো ভালো সরঞ্জাম দরকার পড়ে জীবন ধারণের গুরুত্বপূর্ণ; যেমন জুতা, কাপড়, ঘরবাড়ি তৈরির জন্য নয় বরং মানুষ হত্যা করার জন্য।’  সুতরাং দেশবোধের যে পরিসরগত ভিন্নতা ও তার পরিপ্রেক্ষিতে এর যে স্বতঃস্ফূর্ততা কিংবা কৃত্রিমতাও তৈরি হয়, সেটা প্রমাণের জন্য বোধহয় অধিক দোহায় সন্নিবেশের দরকার পড়বে না।

তবে, ভূমিপুত্রের তথা রহিমের যে দেশবোধ, সেটি যদিও স্বতঃস্ফূর্ত এবং সমাজ-মানুষের প্রতি আত্মিক টানের অকৃত্রিম প্রকাশ, তবু তাকেও সম্পূর্ণ নির্দোষ বিবেচনা করা সম্ভব নয়। স্বতঃস্ফূর্তভাবে তৈরি হওয়া সত্ত্বেও স্বদেশপ্রেমের সেই আবেগও আসলে একটি কুসংস্কারই বটে। কেন? কারণ, যে আবেগ যুক্তি ও কার্যকারণের ধার ধারে না, মনে অজ্ঞেয় বিশ্বাসের মতো বেঁচে থাকে এবং মানুষের বেঁচে থাকার অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে তা প্রকৃতই কুসংস্কার ছাড়া আর কিছু নয়। এবং আবারো বলছি, সেটি একটি সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা, সংকট। কুসংস্কার হিসেবেই তা সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক সংকট।

মানুষের দেশ ভাবনার রাষ্ট্রিক পরিসরের আলোচনায় ছিলাম। সেই সূত্রে দেশহারা মানুষের কথা উঠলে এই পরিসরটির বিবেচনায় প্রথমে চলে আসে রাষ্ট্রহারা মানুষের কথা। দেশহারা মানুষ বলতে মূলত রাষ্ট্রহারা মানুষের কথাই বলে থাকে সকলে। এই বলাটার মধ্যে ভীষণভাবে রাজনৈতিক বিচেনা জাগ্রত থাকে। কীভাবে? একবার ভেবে দেখুন, রহিম যখন রহমতগঞ্জ থেকে (দেশ হারিয়ে) ফজিলতগঞ্জে আসে লোকে তখন তাকে বৈদেশি বলে বটে কিন্তু তাকে দেশহারা বা রাষ্ট্রহারা লোক বলে না।

অর্থাৎ রাষ্ট্রহারা মানুষের প্রতি মানুষ, রাষ্ট্র ও বিশ্বের যে মানবিক সহানুভূতি তা কিন্তু কখনোই রহিমের প্রতি দেখানো হয় না, তার কেবল জোটে ‘বৈদেশিতকমা। অথচ রহিম তো দেশহারা লোকই। যাহোক, এই রাষ্ট্রহারা মানুষদের ‘দেশহারা’ বোধের হাহাকারের স্বরূপও একটু তলিয়ে দেখা দরকার বটে। বিশ্ব জুড়েই শরণার্থী সংকট এক মহা-সংকট। এই শরণার্থী কথাটির কী অর্থ হয়? শরণ বা ঘর খোঁজা মানুষ? অর্থাৎ ঘরহারা মানুষ, দেশহারা মানুষ নয়? বা, রাষ্ট্রহারা মানুষ নয়? দেশ হারানো মানুষের এক মস্তবড় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আছে ভারতবর্ষে। দেশভাগ মানে ভারতভাগ, কেবল বাংলাভাগ নয়। ভারতভাগ মানে বাংলা, কাশ্মীর, পাঞ্জাব ভাগ।

কেবল যে রাষ্ট্রীয়সীমা বিভাজনের কারণেই মানুষ শরণার্থী হতে বাধ্য হয় তা নয়; বরং সারা বিশ্বেই যুদ্ধ, দখল, সন্ত্রাসবাদ প্রভৃতি কারণেই অসংখ্য বাস্তুহারা মানুষের হাহাকার বাতাসের ফুঁপানির সাথে মিশে রয়েছে। এখানে একটু বলে রাখা ভালো যে, বাস্তুহারা, দেশহারা বা শরণার্থী ব্যাপারটির একটি অন্যরকম অভিব্যক্তিও আছে। সংস্কৃতিহারা মানুষেরাও তো শরণার্থী। নয় কি? সংস্কৃতি মানেও দেশ, ঘর, জনপদ। নিজস্ব সংস্কৃতি দখল হয়ে যাওয়া, লুট হয়ে যাওয়া শরণার্থীর বাস্তবতাও মনে রাখা জরুরি। যাহোক, কেবল বাংলাভাগের বেদনাবোধ নিয়ে যে পরিমাণ আর্তিসাহিত্য সৃজিত হয়েছে, এমন পরিমাণ হয়তো বিশ্বের অন্যত্র পাওয়া কঠিন হবে। বাংলাভাগের ফলে যে মানুষগুলো পূর্ববাংলা ছেড়ে পশ্চিমে গেল, তারা পূর্ববাংলাকে ভুলতে পারলো না বহু বছরেও। তারা কেন পূর্বকে ভুলতে পারলো না? তারা আসলে কীসের জন্য হাহাকার করে? তাদেরকে জিজ্ঞাসা করুন, তারা আসলে কীসের জন্য হাহাকার করে! তারা বলবে, দেশের জন্য।

তাদের কাছে দেশ কী? রাষ্ট্র? পূর্ববাংলা থেকে পশ্চিবাংলায় চলে যাওয়া লোকদের জিজ্ঞাসা করুণ, আপনার দেশ কোনটি? তারা কেউ বলবে—ফরিদপুর, কেউ বলবে—খুলনা, কেউ বলবে—বরিশাল কিংবা যশোর; কিন্তু খুব কম লোকেই বলবে তার দেশ বাংলাদেশ। কিংবা মুখে বাংলাদেশ উচ্চারণ করলেও আদতে তারা অনুভব করে থাকে নিজ জেলা বা গ্রামকে; সেটিই তাদের দেশ।

বাংলাদেশ তো রাষ্ট্র। দেশ তাহলে অন্য ব্যাপার, অনিবার্যরূপেই তা রাষ্ট্ররূপ নয়! দেশের নামে তারা আসলে ফেলে যাওয়া ভিটার জন্য, সামাজিক প্রতিবেশের চেনা ও আপন মানুষের জন্য তথা সামাজিক সম্পর্কের জন্য হাহাকার করে। অন্তত তাদের মর্মমূলের দেশ আসলে সেইসব আঞ্চলিক পরিচিতিই। দেখা যাচ্ছে, তাদের দেশহারা তথা রাষ্ট্রহারা তকমাটি তাদের অন্তরমূল বোধের সাথে অন্বিত নয় মোটেই। ফলে, ভিন্ন রাষ্ট্রে গিয়ে ঘর বা শরণ পেলেও তারা শরণার্থীই থেকে যায়। বা, তারা সেখানে কেবল শরণ নয়, একটি রাষ্ট্রও পায়, বা নাগরিকতাও পায়, তবু, তাদের অন্তরমূলের দেশহারা বোধের সুরাহা হয় না।

তারা ঘর বা বাস্তু পেলেও তারা উদ্বাস্তু বা বসতভিটা থেকে উন্মূলিত মানুষই থেকে যায়, তখন রাষ্ট্র প্রবর্তিত জাতীয়তাবাদী বোধ তাদের বেদনার সান্ত্বনা হতে পারে না। একটি জাতীয়তাবাদ হারিয়ে নতুন রাষ্ট্রে নতুনতর জাতীয়তাবদও তারা পেতেই পারে, তবু, তাদের দেশহারা বোধের মূলে জলের জন্য হাহাকার। এমনকি সংস্কৃতির জন্যও হাহাকার। সংস্কৃতি না-হারালেও তারা অন্য সংস্কৃতির আধারে একঘরে হয়ে পড়ে; ফলে তাদের সামাজিক মিথস্ক্রিয়া বিঘ্নিত হয় লক্ষণীয়ভাবে। তাদের এই দেশবোধ রাষ্ট্রপ্রবর্তিত সেই কৃত্রিম জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেম নয়। রাষ্ট্র নয়; ভূমিপুত্রের শরণ, ঘর, বাড়ি, ভূমি, ভিটেমাটি, সমাজ-মানুষ, প্রতিবেশি, দেশ—একই মর্মমূলের অনুভূতি যেন সব। সেখানে রাষ্ট্রের ভাবনা, রাষ্ট্রের গুরুত্ব গৌণ। তবু রাষ্ট্র, বিশ্ব, রাজনীতি তাদেকে রাষ্ট্রহারারূপেই উচ্চকিত করে, নিগূঢ়ের দেশহারা অনুভূতিকে উপেক্ষা করেই।

রাষ্ট্রহারাগণ নতুন রাষ্ট্র পেলেও তাদের দেশের জন্য আহাজারি থামে না। কেন থামে না? 

আবার দেশ হারানোর বেদনাবোধও কিন্তু সকলের ক্ষেত্রে সমানুপাতিক হয় না। দেখা যায়, বিপরীতক্রমে, যখন পশ্চিমবাংলা থেকে পূর্বে এসেছে এমন লোকদের মধ্যে এই হাহাকার প্রকৃতই কম বা অতিসামান্য। তারাও তো দেশ ত্যাগ করে বা দেশ হারিয়ে এসেছে; তবে তাদের মাঝে কেন দেশহারানোর আর্তি অতোটা প্রকট হয় না? আর্তির এমন তারতম্য কেন? পূর্ববাংলা থেকে পশ্চিমে যাওয়া লোকদের অধিকাংশ কিংবা সকলেরই অভিযোগ থাকে যে তারা সামাজিক নির্যাতন ও নিগ্রহণের কারণে বসতভিটা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।

এই অভিযোগের পুরোটা সত্যি বলে ধরে নেয়া না গেলেও এর অধিকাংশকেই সত্যি বলে মেনে নিতেই হয়। কিন্তু, পশ্চিম থেকে পূর্বে আসা মানুষের ক্ষেত্রে তেমন কোনো অভিযোগ করতে শোনা যায় না। তারা অনেকটা স্বেচ্ছায় ভিটে ত্যাগ করে আসে এখানে এবং এসে সাধারণত পশ্চিমের তুলনায় অধিক ভূমি ও ধন-প্রাচুর্য লাভ করে, এটি একটি সাধারণ প্রচলিত ধারণা। এবং আমার চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা থেকেও অনেকগুলো উদাহরণ আনা যায় এই ধারণার স্বপক্ষে। তবু, এর পূর্ণসত্যতা নাও থাকতে পারে, তবে সর্বোতভাবে তা মিথ্যে নয়।

এজন্যই কি তাদের হাহাকার কম থাকে? পূর্ব বাংলার মানুষেরা সাধারণত যতোটা ভূমি, ধন-প্রাচুর্য রেখে যায়, পশ্চিমে গিয়ে ততোটা পায় না এবং অনেক্ষেত্রেই আর্থিক প্রতারণার শিকার হয় ও নিঃস্ব হয়ে পড়ে (এই প্রচারণার সবটা সত্যি নয় নিশ্চয়)। সেখানে গিয়ে তাদের হাহাকারের মাত্রা বেশি হওয়ার পেছনে এটাও কি একটা কারণ? হতে পারে। এটিও একটি কারণ বটে, তবে এটি একটি গৌণ কারণ নিশ্চয়; কেন না, দেশ ছেড়ে নতুন স্থানে গিয়ে কেউ শ্রম ও বুদ্ধির কৌশলে ধন অর্জন করতে পারে, সম্পদশালী হয়ে উঠতেই পারে, এবং স্বল্প সময়ের পরিসরেই তা হতে পারে।

তাতেই কি তাদের দেশহারা আর্তি থেমে যায়? থামে না, দেখেছি। অধিকাংশ আন্তর্জাতিক শরণার্থীর ক্ষেত্রে, ধরা যাক, মানুষের ঘর সমস্যার সমাধান হলো, তার অন্ন-জলের ব্যবস্থাও ঘটে গেলো; কেন না, পৃথিবীতে মানুষের মানবিক বোধের দেশে মানুষের ঘর ও অন্ন পেতে বিশেষ বেগ পেতে হয় না; কিন্তু, তাতেও যে মানুষের দেশ সমস্যার সমাধান কিছুতেই হয় না। আবার কেবল রাষ্ট্রসীমার বিচারেই দেশান্তর বিবেচনা নয়, ধরা যাক কিছু মানুষ গ্রাম থেকে শহরে আসে তথা দেশান্তরী হয়। গ্রাম বা কান্ট্রি বা দেশ (পূর্বেল্লেখ দ্রষ্টব্য)। তারা শহরে আসে মূলত জীবিকার জন্যই।

সেখানে তারা অনুকূল অর্থনৈতিক প্রতিবেশ পায়, তথাপি তারা নগরকে দেশ ভাবে না, বা ভাবতে পারে না। এখানে দেখা যাচ্ছে যে, অর্থনৈতিক আশ্রয়টা সর্বদাই মানুষের দেশ বোধের শিকড়ে প্রাণদায়ী জল হতে পারছে না। মাথা গোঁজার ঠাঁই ও নৈমিত্তিক আহারের ব্যবস্থা সত্ত্বেও যে বিশেষ বোধসমূহ মানুষের দেশহারা বোধকে হাহাকার স্বরূপে জাগিয়ে রাখে সেগুলোকে নিতান্ত মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার বা আবেগ ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। কিন্তু, এখন আবেগকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করাই যথেষ্ট হচ্ছে না। যখন বলছি এই আবেগটি কিছু অনুষঙ্গের জটিল আন্তঃসম্পর্কের পরিণতি মূলত, তখন সেই অনুষঙ্গসমূহ আসলে মানুষের দেশানুভূতিরূপ আবেগপ্রবণতার পিছনের কারণ এবং ফলত, এখানে বিবেচনায় আনতে হবে এই আবেগসমূহেরও পিছনের কারণসমূহ। তখন মনে হতে পারে যে, আবেগ নয়, বরং আবেগের পিছনের কারণ বা ভিত্তিসমূহই প্রধান।

এই আবেগগুলোর থাকে বাস্তব সামাজিক ভিত্তি, যে ভিত্তিটির কথা এমা গোল্ডম্যান উল্লেখ না করে কেবল আবেগ তাড়িত দ্বিধার কথা উল্লেখ করেছেন। এখানে সেই কারণ বা ভিত্তিসমূহের আন্তঃসম্পর্ক ও আন্তঃসম্পর্কজনিত পরিণাম কীরূপে ফলে তার ব্যাখ্যা দেয়া জরুরি। সেই কারণ বা ভিত্তিটি তবে কি, যে কারণে মানুষের দেশহারা বোধের সুরাহা হয় না? সামাজিক সম্পর্ক? হ্যাঁ, এটি একটি বড় কারণ বটে। এবং এই কারণটি অনিবার্যও বটে। সামাজিক সম্পর্ক একটি বড় সংকট দেশহারা মানুষদের নতুন দেশ না পাওয়ার পিছনে। মানুষ স্বভাবত সঙ্গলিপ্সু প্রাণী।

তবে, এটিও মনে রাখতে হবে যে, কোনো এক কালে মানুষ দেশ বলতে তার জীবনধারণের রসদকেই বুঝতো। প্রাচীন যাযাবর জাতি বা গোষ্ঠীগুলোর কথাই ধরা যাক। তখনো তাদের চিন্তায় দেশ, রাষ্ট্র, ভৌগোলিকসীমার অনুষঙ্গ ঢোকেনি। কোথাও শিকারের প্রচুর পশু ও মাছ পেলো, সংগ্রহের জন্য প্রচুর ফল বা প্রকৃতিজাত খাবার পেলো তো সেই পরিসরই তাদের বসবাসের স্থান হয়ে উঠলো। কোনো কারণে কোথাও খাবার সংকট হলে তারা দল বেঁধে খাবারের সন্ধানে নেমে পড়ে আর যেখানেই খাবার পায় সেস্থানই তাদের ঘর, বাসস্থান হয়ে ওঠে।

অর্থাৎ খাবার বা জীবনধারণের রসদই তাদের দেশ। পশুচারি আর্যগণ ভারতবর্ষের উর্বর ভূমি পেয়ে কৃষিজাত খাদ্যের দীর্ঘস্থায়ী ও নিশ্চিত উৎস পেয়েছিলো। ফলে, ভারতভূমি আর্যদের দেশ হয়ে উঠতে পেরেছিলো। দেশবোধে তারা তাদের উৎসভূমি বা মধ্যএসিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে মনে রাখে নি বা তার জন্য তাদের হাহাকারও ইতিহাসে পরিলক্ষিত হয় না। যাহোক, জটিল বিকশিত সমাজের ক্ষেত্রে সেই বিবেচনা আর যে বিশেষ খাটে না সেটি নিয়ে আর সন্দেহ থাকতে পারে না। ধনপ্রাচুর্যের নিশ্চিন্তিই এখন আর দেশভাবনায় স্থিরতা ও নিশ্চয়তা দিচ্ছে না। এখন সামাজিক সম্পর্ক একটি অনিবার্য অনুষঙ্গ মানুষের বেঁচে থাকার জন্য এবং দেশ বোধের আবেগসূত্র হিসেবেও।

এই সম্পর্কের সমীকরণও এখন ভীষণ জটিল ও নানারকম শর্তসাপেক্ষ। এই সম্পর্কের মধ্যে থাকে নানা মাত্রিক সামাজিক বৈষম্য ও অসমতা। বৈষম্য ও অসমতার ভিতরেই থাকে সামাজিক অধিকারহীনতা, সাংস্কৃতিক অধিকারহীনতা। এই সম্পর্কগুলোও একদিনে হঠাৎই গড়ে ওঠে না। এই সম্পর্কগুলো গড়ে ওঠে দীর্ঘ সময়ের পরিসরে। সাধারণত প্রজন্মান্তরে এর কিছুটা সুরাহা হয়। ধরা যাক পূর্ববাংলা থেকে পশ্চিমে যাওয়া একজন মানুষ সেখানে দীর্ঘ বছর বসবাস করেছে, সেস্থানের মানুষের সাথে তার গভীর সুসম্পর্কও হয়েছে, আর্থিকভাবেও সে সেইস্থানে স্বচ্ছল, তবু সেই পশ্চিমকে দেশ ভাবতে পারে না। এই না-পারার কারণটি যখন কেবলই অন্ধ আবেগ তাড়িত, যৌক্তিকতার নামচিহ্ন নেই যেখানে, সেখানে এই আবেগটি আসলেই একটি কুসংস্কার ছাড়া কিছু নয়। আর সামাজিক সম্পর্কটি নিশ্চিত হলেও দেশবোধের মীমাংসা সর্বদাই হয় না।

ধরা যাক, সম্পর্কের ব্যাপারটিও নিশ্চিত করা গেলো; রহিম বাতেনগঞ্জে, ফজিলতগঞ্জে বা মদনগঞ্জে বাস করেও রহমতগঞ্জকেই তার দেশ মানবে। কিংবা, পশ্চিমবাংলা থেকে পূর্বে আসা একজন বা কিছু লোক পূর্বের সবকছিুর সাথে মানিয়ে নিতে পারবে, কিন্তু, যদি প্রশ্ন করা হয়, আপনার দেশ কোনটি? উত্তর চলে আসতে পারে, প্রায়শ আসে— ‘পশ্চিম’। অর্থাৎ সম্পর্ক, ধনগতসুবিধা, রাষ্ট্র ও নাগরিকতার সনদ দিয়েও তার এই মনস্তত্ত্ব বদলে যায় না। নাগরিক সনদের সূত্রে সে পূর্বের বা পশ্চিমের বা বাংলাদেশের লোক হলেও, তবু, তার মনের কোণে থাকতে পারে দেশ নামের অন্য কোনো জগৎ।

তখনও তার একান্ত দেশবোধ সংকটের নিরসন হয় না। নাগরিকতাও দেশ বিবেচনার চূড়ান্ত সমাধান নয়, প্রকৃতই। কিন্তু, তাদের সন্তান-সন্ততিরা পূর্ব কিংবা পশ্চিম বা ফজিলতঞ্জ বা মদনগঞ্জকে তাদের দেশ হিসেবে ঠিকই ভাবতে পারে। তাহলে কিছু লোকের দেশানুভূতির সংকটটি আসলে কোথায়? প্রজন্মগত দূরত্ব ও বিচ্ছিন্নতা তবে কি দেশ বোধের আরেকটি সংকট? নিশ্চয়, এই অনুষঙ্গটিকেও বিবেচনায় রেখে মীমাংসার পথে এগুতে হবে। এখানে আরেকটি অনুসিদ্ধান্তে আসি—বসবাসের স্থান, জীবনধারণের রসদ, সামাজিক সম্পর্ক—এই বিষয়গুলো বিচ্ছিন্ন বাস্তবতায় এককভাবে দেশ ভাবনায় বিশেষ সুরাহা দেয় না। তবে? দেশ সম্ভবত একটি প্যাকেজ, যাতে জন্মস্থান, বসবাসের স্থান, জীবনধারণের রসদ বা অর্থনীতি ও সামাজিক সম্পর্ক—এই কয়েকটি অনুষঙ্গকে একত্রে যুগপৎ ক্রিয়া করতে হয়; এবং এই যুগপৎ মিথস্ক্রিয়া ঘটতে হয় সমপ্রজন্মের বা আত্মপ্রজন্মের ভিতরে।

আত্মপ্রজন্ম তথা একই ভূমিতে, একই সামাজিক প্রতিবেশে, একই সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার ভিতরে, একই সামাজিক কাঠামো তথা সম্পর্কের ভিতরে একটি প্রজন্মের জন্ম ও বেড়ে ওঠা—এই প্যাকেজ। এটি নিশ্চিত হলেই, তবেই উক্ত পরিসরকে দেশ বলে চিহ্নিত করবে তারা (এই প্রজন্ম)। এই অনুষঙ্গসমূহের যুগপৎ ক্রিয়াশীলতায় মানুষের মনের গহিনে একটি দেশ তৈরি হয়, বাস্তব ভূমি পরিসরের বিবেচনার হেরফের দিয়ে যার কোনো ইতরবিশেষ ঘটে না। রহিম কিংবা অন্যান্য দেশহারা মানুষেরা আসলে দেশহারা হয় অর্থে এমনই এক প্যাকেজপ্রক্রিয়ার ভিতর থেকে ছিটকে পড়ে আসলে। এই অনুসিদ্ধান্ত সত্ত্বেও মানুষের সামাজিক সম্পর্কের অনুষঙ্গটিকে স্বতন্ত্র করে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েই অধ্যয়ন করতে হয়। কারণ, এই শর্তটির অবশ্যই পরিপূরণ ঘটতে হয়; কিন্তু, এই শর্তটির পরিপূরণের পথে এসে পড়তে পারে অনেকগুলো শর্ত, প্রতিবন্ধকতা ও জটিল কিছু সমীকরণ।

মানুষের সামাজিক সম্পর্ক মানে মানুষের সমাজকাঠামোর জটিল আধার। সম্পর্ক তৈরি হওয়ার অর্থ কোনো সমাজকাঠামোতে আশ্লিষ্ট হতে পারা। আর সম্পর্কের দূরুত্ব বা বিচ্ছিন্নতাবোধ মানে ক্ষমতাকাঠামোয় প্রবেশ করতে না পারা বা সমাজকাঠামোতে প্রবেশে কিছু প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হওয়া। এই প্রতিবন্ধকতাসমূহ দূর করতে না পারলে মানুষের এই সামাজিক সম্পর্ক সফলরূপে গড়ে উঠেছে, একথা বলা যায় না। কেবল সমাজকাঠামোই নয়, এর অনেকখানি সমস্যার কারণ ও সমাধান রয়ে যায় মানুষের সংস্কৃতির ভিতরে, সংস্কৃতির আত্মীকরণের কিংবা আত্মীয়করণের প্রক্রিয়ার মধ্যে এবং এমনকি সামাজিক স্তরবিন্যাস ও সামাজিক শ্রেণিকাঠামোর মধ্যে। এই পরিসরে চলে আসে মানুষের সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার প্রসঙ্গটিও।

সামাজিকীকরণ হলো সমাজকাঠামোয় মানুষের আশ্লিষ্ট হওয়ার প্রক্রিয়া তথা সামাজিক সম্পর্ক তৈরি হওয়ারও প্রক্রিয়া। দেশানুভূতি তৈরি হওয়ার জন্য যে একটি আনুষঙ্গিক প্যাকেজ প্রক্রিয়া কাজ করে তাও এই সামাজিকীকরণেরই ফল। সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় সমাজকাঠামোয় আশ্লেষণের মুখে কিছু শর্ত সমস্যা হয়ে দেখা দিতে পারে, সেগুলো হলো সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও সামাজিক ক্ষমতা কাঠামো।

ক্ষমতাকাঠামো ও অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া পরিসরে উপস্থিত হয় প্রতিযোগিতা, কখনো তা যুদ্ধরূপেও। যুদ্ধে ও প্রতিযোগিতায় জয়-পরাজয়ও ঘটে থাকে। ফলে, এই প্রক্রিয়া সামাজিকীকরণেও প্রতিবন্ধক হয়ে উঠতে পারে তথা দেশানুভূতি তৈরিতেও ভূমিকা রাখতে পারে। ফলে দেখা যাচ্ছে, দেশানুভূতি গড়ে ওঠার বা দেশবোধ সংকটের অনেকখানি জল ও খনিজ আসে অর্থনৈতিক কার্যকারণের ভিতর থেকে ও ক্ষমতাকাঠামোয় অবস্থানগত নিশ্চিতি থেকে। 

মানুষের অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা ও ক্ষমতাকাঠামোয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রবণতার প্রসঙ্গ ধরেই বরং আবার ফিরে আসি ফজিলতগঞ্জে। ধরা যাক, ফজিলতগঞ্জে রহিম গিয়ে দারুণ অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি অর্জন করে বসলো এবং হয়ে উঠলো সেখানে মোড়ল গোছের কিছু একটা। তখন? তখন কি ফজিলতগঞ্জ রহিমের দেশ হয়ে উঠলো? না, হয়ে উঠলো না।

আবার রহিম তার জন্মস্থান রহমতগঞ্জে অতিদরিদ্র একজন, সেস্থানের লোকজনের কাছে সে কিছুতেই মুখ পায় না, সামাজিকভাবে নানা ধরনের নিগ্রহের শিকার হতে হয় তাকে, কিন্তু, তবু রহিম রহমতগঞ্জকেই তার দেশ মনে করে থাকে। কেন? এই নিগ্রহণ তার মনে কি কোনো বিচ্ছিন্নতাবোধের জন্ম দেয় না? হ্যাঁ, প্রায়শই বিচ্ছিন্নতাবোধের বহিঃপ্রকাশ হতে পারে এমন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, তখন হয়তো রহিমের কাছে রহমতগঞ্জও আর প্রকৃত দেশ থাকে না। এমন হলে তখন আসলে কোথাওই মানুষের কোনো দেশ থাকে না। এই পরিস্থিতি আসলে মানুষের জন্য ভীষণ নিরাময়হীন। নিগ্রহণের মুখে রহিমকে দেশ ত্যাগে বাধ্য হতে হয়। তাকে আসতে হয় ফজিলতগঞ্জে।

ফজিলতগঞ্জে এসে রহিমের বৈদেশি অভিধার বিলোপন হয়তো জীবদ্দশায় কখনো হয়, কিংবা তা হয়তো সারাজীবন বয়েও বেড়াতে হতে পারে। এর মীমাংসা আসলে হতে পারে সমাজকাঠামোয় সংশ্লেষণ ও সাংস্কৃতিক আত্মীকরণের মাধ্যমে। রহিম যদি ফজিলতগঞ্জে এসে সেখানের মানুষের সংস্কৃতির সাথে অভিযোজন সম্পন্ন করতে পারে, তবে, সমস্যার আংশিক সমাধান হয়।

নয়তো, আর্থিক ও ক্ষমতাকাঠামোগত প্রতিপত্তি অর্জন সত্ত্বেও সাংস্কৃতিক ভিন্নতার ছাপ তার বৈদেশি পরিচয়কে আজীবন স্পষ্ট করে রাখতে পারে। সাংস্কৃতিক ভিন্নতার ছাপ সামাজিক সম্পর্কে মানুষদের ঘনিষ্ঠ হতেও কিছু পরিমাণে প্রতিবন্ধক হয়ে থাকে। এই সাংস্কৃতিক ভিন্নতার ছাপ রাষ্ট্র হারানো শরণার্থীদেরও ভিন্ন রাষ্ট্রে, ভিন্ন সমাজে অভিযোজিত হতে প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে অনেকটা।

মনে রাখতে হবে যে, সংস্কৃতি অনেকখানি মানুষের মনোজগতের নিয়ন্ত্রক। যদি রহিম ফজিলতগঞ্জে এসে রহমতগঞ্জের সংস্কৃতির কিছু প্রকরণ ত্যাগ করে ফজিলতগঞ্জের হতে চেষ্টা করে, সেটা হয় নতুন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় সুফলদায়ক। কিন্তু সংস্কৃতির এমন কিছু উপাদান থাকে যা মানুষ সহজে ত্যাগ করতে পারে না বা বদলে ফেলতেও পারে না। যেমন : ভাষা।

খুব সামান্য পরিসরের দূরুত্বের কারণেও মানুষের ভাষার বিভিন্নতা তৈরি হয়ে যায়। আর মানুষের মায়ের মুখ থেকে, মাতৃ-পিতৃ অঞ্চলের লোকের মুখ থেকে শেখা ভাষা তার আমৃত্যুর পরিচিতি হয়ে দাঁড়ায়। এক অঞ্চলের মানুষ আরেক অঞ্চলে গেলে তার মুখের কথা শুনে লোকে সহজে বুঝে ফেলতে পারে যে, এই ব্যক্তি এই অঞ্চলের লোক নয় মোটেই। কখনো কখনো ভাষাই মানুষের স্বদেশের স্মারক হয়ে ওঠে। সুতরাং ভাষার এই আইডেনটিটিও রহিমকে ফজিলতগঞ্জে আমৃত্যু বৈদেশি করে রাখতে পারে।

এসব সত্ত্বেও কখনো কখনো নানাবিধ সামাজিক-সাংস্কৃতিক অন্বয়ে সামাজিক সম্পর্কের জটিল জালে হয়তো আপন হওয়া যায়, কিন্তু, এই প্রক্রিয়ায় যদি অর্থনীতি, জীবনের রসদ কিংবা এইসব ঘিরে জীবনের প্রতিযোগিতা এসে সমূহ বাধ সাধে তো দেশ, বৈদেশ সমস্যার সমাধান সহজে হয় না। কীভাবে? এমন যদি হয় যে, ফজিলতগঞ্জে মানুষের জীবিকার যোগান অপ্রতুল; এমন পরিস্থিতিতে সে স্থানে বাহিরের কেউ এসে স্থানীয় জীবিকার বাজারে প্রতিযোগী হলে সামাজিক সম্পর্কের আশ্লেষণ বাধাগ্রস্ত হবেই, আর একজনের ‘বৈদেশি’ পরিচয় তার সামাজিক প্রতিবেশে শ্বাসপ্রশ্বাসে ব্যাঘাত ঘটাবেই।

তখন রহিমের বৈদেশি পরিচয়টি ফজিলতগঞ্জের মানুষেরা বিদ্বেষ ও প্রতিযোগিতার মনোভাবের কারণেই  উচ্চকিত করে রাখতে পারে। আবার, এমন যদি হয় যে, রহিম ফজিলতগঞ্জে এসে সেস্থানের ক্ষমতাকাঠামোয় প্রভাবশালী হয়ে উঠছে বা অনুমিত হয় যে, প্রভাবশালী হয়ে উঠতে পারে এবং তাতে আর কারো সামাজিক ক্ষমতা খর্ব হতে পারে, তবে, রহিমের ফজিলতগঞ্জের লোক হয়ে ওঠা কঠিন হয়ে পড়ে আর সে ‘বৈদেশি’ তকমাটি এড়াতে পারবে না। কেবল তা-ই নয়, তার প্রাত্যহিক যাপনও স্থানীয় প্রতিকূলতায় ব্যাহত হতে পারে।

কিন্তু, পরিস্থিতির মোড় এর বিপরীত রকমেও ঘুরে যেতে পারে। যদি রহিম ফজিলতগঞ্জের স্থানীয় ক্ষমতাকাঠামোয় অনুকূল ভূমিকা রাখতে পারে তবে, অতি দ্রুতই এবং খুব সহজেই সে ‘বৈদেশি’ থেকে ‘স্বদেশি’র মতো হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু, এটা ঘটলেও, এমন হতে পারে যে, রহিম এসব কিছুর পরেও তার ফেলে আসা জীবনের স্মৃতি, দেশ ও মানুষের কথা ভুলতে সক্ষম হচ্ছে না বা ভুলতে চাইছে না।

এমন হবার পিছনেও অর্থনীতি, সংস্কৃতি, ক্ষমতাকাঠামো এবং এমন আরো অনেক সমাজতাত্ত্বিক কারণসমূহ ক্রিয়াশীল থাকতে পারে। এমন যদি হয় যে, রহিম তার স্বচ্ছল ও সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক অবস্থান থেকে এসে নতুন ঠিকানায় নিদারুণ দারিদ্র্যের মধ্যে পড়েছে, তবে, সে তার অতীতের সুখ-স্বাছন্দ্যের কথা ভুলবে না এবং ভুলতে পারবেও না। আর নতুন স্থান ও সে স্থানের মানুষগুলোকেও সহজে আপন করে নিতে পারবে না।

তখন তার অবস্থা হবে ত্রিশঙ্কু; না সে ফেলে আসা দেশের, না সে নতুন ঠিকানাকে দেশ বলে মেনে নিতে পারে। সামাজিক নিগ্রহের কারণে যেমন রহমতগঞ্জ দেশ হওয়া সত্ত্বেও প্রকৃত দেশ হয়ে উঠতে পারে না রহিমের কাছে, তেমনই ফজিলতগঞ্জও দেশস্বরূপ হয়ে উঠতে পারে না সামাজিক প্রতিযোগিতা ও অসহযোগিতাজনিত বিচ্ছিন্নতাবোধের কারণে। ফলে, দেশান্তর-যজ্ঞ করেও এই বিচ্ছিন্নতাবোধ জনিত দেশানুভূতিগত মনস্তাত্ত্বিক সংকটের সুরাহা হয় না।

প্রকৃত দেশ না হওয়া সত্ত্বেও রহিমের কাছে রহমতগঞ্জই দেশ হিসেবে মনের কোণে থেকে যায়। সে এক মনস্তাত্ত্বিক দেশে বসবাস করতে থাকে তখন। কেউ কেউ তো আবার তার জন্মস্থানের নামটিকেই তা সামাজিক নামের অংশ করে নিয়ে সেই স্থানকে তার পরিচিতির স্থায়ী অংশ করে রাখে; যেমন, বশির বাগদাদী, শমসের কাবুলিওয়ালা কিংবা ইসমাইল সিরাজী প্রভৃতি।

কখনো যদি সে এই দেশানুভূতিকে অস্বীকার করতেও চায়, তখন সমাজের অন্যান্য মানুষেরা তাকে তার দেশ পুনঃপুন স্মরণ করিয়ে দেয়, যেমন ফজিলতগঞ্জের লোকেরা তাকে বার বারই মনে করিয়ে দিতে পারে—সে আসলে রহমতগঞ্জের লোক। কেবল প্রতিযোগিতা কিংবা বিদ্বেষ মানসেই নয়, অনেকটা নির্দোষ এবং কারণবিরোহিতভাবেই ফজিলতগঞ্জের মানুষ রহিমকে বার বার বৈদেশি বলে সম্বোধন করতে পারে। ফলে, দেশগত এই অনুভূতি ও পরিচিতির একটি আরোপণ বাস্তবতাও বিদ্যমান। এই আরোপণ নির্দোষ কিংবা বিদ্বেষপ্রসূত—দুইভাবেই হতে পারে। যে দেশহারা মানুষেরা এটিকে ভুলতে পারে না বা ভুলতে চায় না, কিংবা ভুলতে চাইলেও যারা কখনোই তা ভুলতে দেয় না একটি পরিচিতি আরোপের মাধ্যমে—এই দুই পক্ষেরই এই দেশভাবনা একটি সমাজমনস্তাত্ত্বিক সংকট। 

দেশবোধজনিত মনস্তাত্ত্বিক সংকটের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ নিয়ে এই পরিসরে আলোচনা করা যেতে পারে। দেশানুভূতির সংকটকে জিইয়ে রাখে মানুষের আরেকটি অনুভব, ‘আমরা ও তারা (We and Others)’ মনোভাব। এই ‘আমরা’ মনোভাবটি একেবারেই নির্দোষ কোনো বোধ নয় মোটেই। কথার কথা ‘বৈদেশি’ সম্বোধনের ভিতরে যদি এই আমরা বোধটি সক্রিয় থাকে তবে তাকে আর কিছুতেই নির্দোষ বলা যায় না। এই ‘আমরা’ বোধটি আসলে এক ধরনের বিষবাচক সামাজিক মনোভাব ও মনোক্রিয়া।

এই মনোভাবটি রাষ্ট্রকাঠামোর অনুষঙ্গে বিবেচনা করা গেলে তাকে নিঃসন্দেহে জাতীয়তাবাদ বলে চিহ্নিত করতে পারি। কিন্তু, স্থানিক পরিসরেও এই বোধ থাকে এবং এমন ক্ষেত্রে লোকেরা এই বোধ বিষয়ে সচেতন না থাকলেও, সেটিও একটি জাতীয়তাবাদই আসলে। স্থানিক পর্যায়ে এই বোধ গড়ে ওঠার পিছনে সাধারণত কোনো প্রচার, বাজারজাতকরণের প্রচেষ্টা থাকে না। এই জাতীয়তাবোধ স্বতঃস্ফূর্ত জাতীয়তাবোধ। পূর্বে যেমন বলেছি একটি প্যাকেজ অনুষঙ্গ মানুষের ভিতরে দেশ বোধ তৈরিতে প্রধানত ভূমিকা রাখে।

সেই প্যাকেজ অনুষঙ্গটিই আসলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই ‘আমরা’ ধরনের জাতীয়তাবোধও তৈরি করে দেয়। এই বোধকে খুব সহজেই সাম্প্রদায়িক বোধ হিসেবে চিনে নেয়া যায়। এই ‘আমরা’ বোধ উভয়মুখীভাবেই মানুষের সামাজিক সম্পর্কের সংকটকে জটিল করে তুলতে পারে। রহিম রহমতগঞ্জকে ভুলতে পারে না মানে হলো সে আসলে তার ‘আমরা’ বোধকে ভুলতে পারে না এবং ফজিলতগঞ্জে তার সেই ‘আমরা’ বোধের পুনর্গঠন হয়ে ওঠে না কিছুতেই। এ-ই হলো তার দেশহারা বোধের সার কথা। ফজিলতগঞ্জের মানুষেরাও তাদের ‘আমরা’ বোধের কারণেই রহিমকে স্বদেশী বলে গ্রহণ করতে পারে না। ফলে, ‘বৈদেশি’ সম্বোধনটি নির্দোষ থাকে কিনা, এখানে একটি সূক্ষ্ম প্রশ্ন ও সন্দেহ থেকে যায়। এই ‘আমরা’ বোধের সাথেই সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনের অন্যান্য প্রতিবন্ধক কারণসমূহও জড়িয়ে থাকে।

এই ‘আমরা’ বোধটি সাধারণত মানুষের অস্তিত্বের স্মারক হয়ে ওঠে, ফলে, সামাজিক নিগ্রহণ সত্ত্বেও এই ‘আমরা’ বোধের হাহাকার বা দেশের জন্য হাহাকার আমৃত্যু থেকে যেতে পারে। যেমন, রহিমের দেশ ত্যাগের কারণ যদি হয় সামাজিক নিগ্রহণ, তা সত্ত্বেও তার দেশবোধের বিলাপ আসলে সেই অস্তিত্বেরই হাহাকার। এই সাম্প্রদায়িক অনুষঙ্গটি আন্তর্জাতিক পরিক্ষেত্রে আরো ভীষণরূপে প্রকট হয়।

সাম্প্রদায়িক মানসিকতার জটিল বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় সমাজে নানান রূপে। জাতীয়তাবাদীসহ নানান রকমের সাম্প্রদায়িকতা মানুষের মনোজগৎকে আচ্ছন্ন করে রাখে। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা সেগুলোর অন্যতম। উদাহরণে আসি: পূর্ববাংলার হিন্দুরা সামাজিক নিগ্রহণে পশ্চিম বঙ্গে যায়, তারা আসলে হিন্দুদের কাছেই যায় দেশ ফেলে। তাদের তো যাবার জন্য বিশ্বের আরও কত দেশই আছে।

অনেকেই হয়তো তাদের ফেরাতো না। এটা স্বাভাবিক যে, শরণার্থী হলে মানুষ প্রতিবেশি দেশেই যায় সাধারণত। তবু, পূর্ববঙ্গের বা বাংলাদেশের হিন্দুদের পশ্চিমবঙ্গে কিংবা পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমদের পূর্ববঙ্গে শরণার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে তাদের মনকোণে ধর্মীয় সহানুভূতির স্থান থাকাও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু, দেশানুভূতির ক্ষেত্রে এই স্বাভাবিকতার বাহিরেও কিছু ব্যতিক্রম ঘটতে পারে।

যেমন, এই ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক অনুভূতি সত্ত্বেও পশ্চিম বঙ্গের হিন্দুদের কাছে পূর্ববঙ্গের হিন্দুরা ‘অপর’, আর তারা হলো ‘আমরা’। এই ‘আমরা’ বোধ হলো তাদের স্থানিক জাতীয়তাবাদ। দেশবোধ কিংবা রাষ্ট্র লালিত জাতীয়তাবাদ কিংবা ক্রিয়াশীল সামাজিক দ্বন্দ্ব-প্রতিযোগিতাসমূহ যা পূর্ববঙ্গীয়দের গ্রহণে মনস্তাত্ত্বিক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে।

পূর্ববাংলার হিন্দুদের কাছেও কিন্তু পশ্চিমবাংলার হিন্দুরা এক অর্থে অপর, কেন না, পূর্ববঙ্গীয়দেরও আছে এক ‘আমরা’ অস্তিত্বের বোধ। একই বোধ ও সংকট ক্রিয়াশীল থাকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে পূর্বে চলে আসা মুসলিমদের মধ্যেও। এই অপরের কাছে ‘আমরা’ হয়ে থাকা এবং ফেলে আসা আমরাকে ভুলতে না পারা, শরণার্থী মানুষদের মনে তা দেশহারা বোধ হয়ে টিকে থাকে কাঁটার মতো। পৃথিবীর সকল অঞ্চলের শরণার্থী মানুষের যেমন এই সংকট থাকে, তেমনই এই সংকট থেকে মুক্ত থাকতে পারে না জীবন-জীবিকার জন্য দেশান্তরী বা রাষ্ট্রান্তরী প্রবাসীরাও।

দেশবোধের মুখে সাম্প্রদায়িক চেতনার এ হলো নেতিবাচক ভূমিকা। কিন্তু, এর একটি ইতিবাচক ভূমিকাও দেখা যায়, যদিও তাকে চূড়ান্ত বিচারে ইতিবাচক বলা নাও যেতে পারে। সেটি হলো সাম্প্রদায়িক চেতনাজাত সংহতিবোধ। এমন যদি হয় যে, ফজিলতগঞ্জ থেকে রহমতগঞ্জের কেবল রহিম নয়, আরও অনেকেই এসে বসবাস করছে; তখন রহমতগঞ্জের লোকেরা ফজিলতগঞ্জে আরেক রহমতগঞ্জ তৈরি করে ফেলতে পারে। এমন হলে তাদের মধ্যে ফজিলতগঞ্জের লোক হয়ে ওঠার আগ্রহ কমে বৈকি এবং সেই সাথে ফেলে আসা দেশের জন্য হাহাকারও যথার্থরূপে থাকে না।

তেমনই নিজ অঞ্চল, শহর, গ্রাম বা দেশ ফেলে কিছু বরিশালের লোক যখন ঢাকা শহরে একত্রিত হয় তখন ঢাকাতেই তাদের আরেকটি দেশ তথা বরিশাল তৈরি হতে পারে। বিভিন্ন দেশে শরণার্থীরা তাদের অস্তিত্বের যাপনকে সহজ করতে এই একই কাজ করে থাকে। কেবল শরণার্থীরাই নয়, প্রবাসীগণও এই একই উপায়ে প্রবাসে প্রতিকূল সামাজিক প্রতিবেশে টিকে থাকে, বাঁচে নিরন্তর। মনে রাখা জরুরি, এও এক দেশানভূতি এবং তা ভীষণভাবে অস্তিত্বের স্মারক। আরেক বার স্মরণ করা যাক যে, দেশবোধ কোনো চিরস্থায়ী অনুভূতি নয় মোটেই। কিন্তু, এই অনুভূতি বা বোধকে ভুলতে না পারার, ভুলতে না দেয়ার কিংবা ভুলতে না-চাওয়ার যথেষ্ট কারণ বিদ্যমান থাকে রাষ্ট্রিক, আন্তর্জাতিক পরিসরের সামাজিক প্রতিবেশে।

আন্তর্জাতিক সামাজিক প্রতিবেশে ঔপনিবেশিক শাসন, উত্তর-উপনিবেশী রাজনৈতিক বাস্তবতা, ইউরোপ-আমেরিকান বর্ণবাদ ও আর্ন্তজাতিক রাজনীতিতে বৈষম্যমূলক নাগরিক চেতনা দেশবোধের আরেক জটিল তাত্ত্বিক ক্ষেত্র তৈরি করে রেখেছে। এ পর্যন্ত আলোচনায় মনে হয়েছে যে মানুষ কখনো তার দেশানুভূতি থেকে বের হতে পারে না এবং তা তার আমৃত্যু পরিচিতির স্মারক হয়ে থাকে। কিন্তু, প্রবাসী, উপনিবেশী, উত্তর-উপনিবেশী মানুষদের সামাজিক বাস্তবতা এই ধারণায় কুঠারাঘাত হানে।

তৃতীয় বিশ্বের মানুষ যখন উন্নত জীবন-জীবিকার জন্য ইউরোপ-আমেরিকায় যায়, তখন সেখানে গিয়ে তারা উন্নত-জীবিকার মোহে স্বদেশ কাতরাতাকে মন থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে বটে, কিন্তু সেখানে কিছু বছর অতিবাহিত করে সমাজ-রাষ্ট্রিক আনুগত্যে নাগরিকত্ব লাভ করেও সেই দেশকে তার স্বদেশ ভাবে না বা ভাবতে পারে না।

আর, এই অভিবাসীরা নাগরিকতা পেলেও ইউরো-আমেরিকার সাদা মানুষেরা তাদের বর্ণবাদী মনোভাব থেকে এই প্রবাসী বা অভিবাসী নাগরিকদেরকে সগোত্রীয়, স্বদেশীয় হিসেবে কিছুতেই মেনে নেয় না। এমন সামাজিক দূরত্ব ও নিগ্রহণের কারণে এই অভিবাসী নাগরিকগণ সকলে সংহত হয়ে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এক দেশ তৈরি করে ফেলে। সেই দেশ তাদের ফেলে যাওয়া দেশ নয়, এমনকি তারা নতুন যে দেশের নাগরিক তা সেই দেশও নয়। দেশের ভিতরে আরেক দেশ। তারা তখন সেখানে না-স্বদেশি না-বিদেশি। কিন্তু, এটাকে এমনও মনে করার কারণ নেই যে, এই দেশ রহিমের রহমতগঞ্জের মতো পূর্বোল্লেখিত প্যাকেজ অনুষঙ্গজনিত দেশ বোধের অনুরূপ।

পূর্বে যেমন বলেছি, স্থানান্তরিত লোকেরা নতুন স্থানে গিয়ে স্বদেশ বোধ নতুন করে তৈরি করতে পারে না; তবে তাদের উত্তর প্রজন্ম, যারা নতুন স্থানে জন্ম নিয়ে সেই স্থানের সামাজিক প্রতিবেশে বেড়ে ওঠে, তারা সেই স্থানকে নিজদেশ বলে ভাবতে পারে বা স্বতঃস্ফূর্ত এক দেশানুভূতি তৈরি হতে পারে তাদের মনোবাস্তবতায়। কিন্তু, বাস্তবে অভিবাসী বা প্রবাসীদের সন্তানেরা যারা জন্মসূত্রেই ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে নাগরিকত্ব লাভ করে, তাদের মধ্যে সেই নতুন স্থানের বা দেশের প্রতি স্বতঃস্ফূর্ত দেশবোধ নাও কাজ করতে পারে।

আনুগত্যের খাতিরে তারা সেটিকে মুখে দেশ স্বীকার করে, ভোটাধিকার ভোগ করে বটে, কিন্তু, বর্ণবাদী আচরণের মুখে তাদের দেশানুভূতি কখনোই স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ওঠে না। কেবল বর্ণবাদই নয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতির বৈষম্যমূলক নাগরিকচেতনাও থাকে এর পিছনে। অর্থাৎ অভিবাসীরা ও তাদের সন্তানেরা সাদাদের কাছে তৃতীয় বিশ্বের লোক, ওরা অপর। এই ‘আমরা’ বোধের মুখে ‘অপর’ হয়ে থাকা অভিবাসীদের সন্তানেরা স্বদেশবোধ তৈরি হওয়ার সম্পূর্ণ প্যাকেজ অনুষঙ্গের ভিতরে বেড়ে উঠলেও আমৃত্যু নিরাময়হীন এক বিচ্ছিন্নতাবোধের মধ্যে পড়ে আর নিজের আত্মীয়-পরিজন ও অন্যান্য অভিবাসীদের সাথে আরেক কুঠরি দেশ গড়ে তোলে। কেবল এমন কুঠরি দেশই নয়, তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ও হয় আলাদা। সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের বিচারেও তারা সম্পূর্ণ ইউরোপীয়-আমেরিকান হয়ে উঠতে পারে না।

তারা নতুন যে সংস্কৃতি তৈরি করে তা তাদের পিতার দেশের সংস্কৃতি ও তাদের ইউরোপ-আমেরিকীয় সংস্কৃতি থেকে আলাদা, দুই সংস্কৃতির মিশ্রণে তা হয়ে ওঠে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে সম্পূর্ণ নতুন সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির সাথে কোনো দেশ পরিচিতি নেই, এই সংস্কৃতির সাথে কোনো দেশানুভূতিও বিশেষ থাকে না। সংস্কৃতির বিচারেও তারা না-দেশি না-বিদেশি। তারা হয়ে ওঠে ‘ক্রেওল (Creole)’। এই ক্রেওল মূলত ঔপনিবেশিক বাস্তবতা থেকে উদ্ভূত মিশ্রভাষাতাত্ত্বিক পরিচয়।

পরে এই ক্রেওল অভিধাটি মিশ্র-সাংস্কৃতিক পরিচয়েরও পরিভাষা হয়ে উঠেছে। আফ্রিকা, ওয়েস্টইন্ডিজ, আলজিরিয়ার মতো আরো অনেক ভূখণ্ডই দীর্ঘ যুগ-শতাব্দী ধরে ঔপনিবেশিক শাসনে থাকার ফলে সেখানকার একটি প্রজন্ম তাদের পিতৃপুরুষের ভাষা-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে ঔপনিবেশিক শাসকদের ভাষা-সংস্কৃতিরও কিছু বৈশিষ্ট্য গ্রহণ করে এক নতুনতর ভাষা-সাংস্কৃতিক প্রকরণ তৈরি করেছে। সেই ভাষা-সংস্কৃতি না ইউরোপীয়-আমেরিকান, না সেই উপনিবেশিত ভূমির। এরা নিজেদের না ইউরোপীয়-আমেরিকান মনে করে, না পিতৃপুরুষের ভাষা-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে অহং বোধ করে। এরাই ক্রেওল।

এই ক্রেওলদের একটা বড় অংশ আমেরিকান আদিবাসীগণের নতুন প্রজন্ম। উন্নত জ্ঞান-প্রযুক্তির ধারক সাদা মানুষদের হাতে এই আদিবাসীদের প্রাচীন ভাষা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। তারা অবর্ণনীয় সামাজিক নিগ্রহণ ও নির্যাতনের শিকার হয়, দাস জীবন গ্রহণে বাধ্য হয়। পরিশেষে তারাও প্রতিরোধ-সংগ্রামে নামতে বাধ্য হয় আর নিজেদের কালো পরিচয়ের অহংকে শক্তি হিসেবে নিয়ে জীবন সংগ্রামে নব্য ভাষা-সাংস্কৃতিক পরিচয়কেই নিজেদের শক্তির আধার করে নেয়।

এদেরও তৈরি হয় আমেরিকার মধ্যেই আরেক দেশ বা উত্তর-ঔপনিবেশিক স্বভূমির ভিতরে নতুন সাংস্কৃতিক পরিচয়ে আরেক স্বভূমি। এমন ক্ষেত্রে এই দেশ পরিচয়ের জন্য ভাষা-সাংস্কৃতিক পরিচয়কে তখন আর উচ্চকিত করার দরকার পড়ে না, বরং তাদের গায়ের রং তাদের মিশ্র ভাষা-সংস্কৃতিই দেশগত পরিচয়ের উপরে প্রধান রূপে চিহ্নিত হয়ে যায়।

বর্ণবাদকে টক্কর দিতে এদেরই একটি প্রজন্ম স্বতন্ত্র আমেরিকান হয়ে বেঁচে থাকে। এরা মূলধারার সাদা আমেরিকানদের মতো সামাজিক স্বীকৃতি পেতে ব্যর্থ হয়, কিন্তু ঐতিহ্যবাহী আদিবাসী পরিচয়টিও ছাড়তে বাধ্য হয়। ফলে, তারা আমেরিকান হয়েও প্রকৃত নাগরিক নয়। আমেরিকাও তাদের প্রকৃত স্বদেশ বিবেচিত হতে পারে না কিংবা দেশবোধটিই তাদের কাছে গৌণ হয়ে পড়ে তখন। ফলে, মানুষের দেশানুভূতি এক জটিল মনস্তত্ত্ব হয়ে কেবল জিজ্ঞাসা ও সংশয় জন্ম দিয়ে অস্তিত্বের দ্বিধান্বিত পরিচয়স্মারক হয়ে থাকে।


তথ্যসূত্র ও টীকা
১. রোকন রকি, সঙ্ঘবদ্ধতা, মতাদর্শ ও শাসনকল্প, দেশাত্ববাদ : রাষ্ট্র-কর্তৃত্বের মতাদর্শিক দ্বেষপ্রেম, (ঢাকা : দ্যু প্রকাশন, ২০২০), পৃ. ১৫
২. এমা গোল্ডম্যান, দেশাত্ববাদ: স্বাধীনতার প্রতিবন্ধকতা, অনু. রোকন রকি, পূর্বোক্ত, পৃ. ৯৮
৩. রোকন রকি, সঙ্ঘবদ্ধতা, মতাদর্শ ও শাসনকল্প, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৪
৪. রুডল্ফ রকার, রোমান্টিকতা ও জাতীয়তাবাদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ৬১
৫. উদ্ধৃত, এমা গোল্ডম্যান, দেশাত্ববাদ : স্বাধীনতার প্রতিবন্ধকতা, পূর্বোক্ত, পৃ. ৯৯;  
৬. তদেব, পৃ. ৯৮
৭. আমেরিকা এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বীপপুঞ্জের কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিরা নিজেদের ক্রেওল বলে দাবি করে। তাদের বক্তব্য এই যে, তারা আফ্রিকান, এশিয়ান, ইউরোপিয়ান বা আমেরিকান নয়। তারা ঔপনিবেশিক প্রভাবে কিংবা ভিন্ন দেশ ও সমাজে দীর্ঘকাল বসবাসের ফলে, ধরা যাক কিছু ক্যারিবীয় আমেরিকায় বসবাসরত তারা তাদের অতীত ঐতিহ্যিক ভাষা-সংস্কৃতি ভুলে নতুন যে সাংস্কৃতিক বাস্তবতায় রয়েছে তা না-ক্যারিবিয়ান না-আমেরিকান; হয়তো তারা ইংরেজি, ক্যারিবীয়, পুর্তগিজ, স্প্যানিস কিংবা আরও কিছু ভাষার মিশ্রণে যে নতুন সংকর ভাষা তৈরি করেছে সেই ভাষাতেই অহং বোধ করে এবং তাদের সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও একই বাস্তবতা দেখা যায়, ফলে তাদের এই নতুন পরিচয়টি স্বকীয় স্বতন্ত্রতায় দৃঢ়; এই পরিচয়টিই ক্রেওল। আত্মপরিচয়ের পারম্পরিক অতীত ঐতিহ্যকে অস্বীকার করা এবং নানান প্রভাবে পরিবর্তিত বাস্তবতায় নয়া রূপকে আত্মপরিচয়ের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করাই ক্রেওলত্ব।—ক ফজলুল আলম, সংস্কৃতির যত শত্রু (ঢাকা : অনন্যা, ২০১৫), পৃ. ২৯ 


শামীম সাঈদ কবি, গল্পকার এবং প্রাবন্ধিক। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : এই কথা বৃষ্টিবাচক, এভাবে খুলবে না আঁচলের খুঁট, সদা ভাগতেছে ভববান। প্রবন্ধগ্রন্থ : বাঙালির দ্বিধার চলক। তিনি রাজশাহীতে বসবাস করেন।

menu
menu