মুক্তিযুদ্ধের সাংস্কৃতিক সংগ্রাম : কয়েকটি উদ্যোগ

মুক্তিযুদ্ধে শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীদের ভূমিকা ছিল অনন্য। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান থেকে একাত্তরের মার্চের অসহযোগ আন্দোলনে তাদের সোচ্চার ভূমিকা জনগণকে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থনজ্ঞাপনে উজ্জীবিত করে। পঁচিশে মার্চের পর অনেক শিল্পী অবরুদ্ধ দেশেও সাংস্কৃতিক লড়াই অব্যাহত রেখেছিলেন। অনেকে ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যে অবস্থান করে স্থির করেছিলেন তাদের কর্তব্যকর্ম। তাঁরা শত প্রতিকূলতা ও বৈরিতার মধ্যেও সাংস্কৃতিক দল গঠন করে পালন করেন জাগরণী ভূমিকা। শরণার্থী শিল্পীরা দেশমাতৃকার ঘোর দুর্দিনে গ্রহণ করেন যথাসাধ্য উদ্যোগ। মুক্তিযোদ্ধা শিবির, শরণার্থী শিবির, যুব শিবির এবং স্থানীয় জনগণের মাঝে মুক্তির গান ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তারা শক্তি ও সাহস সঞ্চার করেছেন। ভারতসহ নানা দেশের শিল্পীসমাজও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন ও তহবিল গঠনে নানামুখী প্রয়াস গ্রহণ করেছিলেন। এখানে মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে বাংলাদেশের শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীদের উদ্যোগে গঠিত ৩টি সাংস্কৃতিক প্রয়াসের কথা উপস্থাপিত হলো।

বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সংস্থা
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও একাত্তরের মার্চের অসহযোগ আন্দোলনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীদের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। ‘জাগরণী’ সংগঠনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সাংস্কৃতিক পটভূমি রচনায় শিল্পীসমাজ সক্রিয় ভূমিকা পালন করে এবং অসহযোগ আন্দোলনে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। ঢাকায় বিক্ষুদ্ধ শিল্পীসমাজের আলোকে শহরের শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীরা এ বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কর্মকাণ্ড পরিচালনায় উদ্ধুদ্ধ হয়। সে-সময় এ কে এম হারুনুর রশীদ ও জীবন বর্মণের গান রেকর্ড করা হয়। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী অল্প দিনের ব্যবধানে বেতার কেন্দ্রটি ধ্বংস করে দেয়। সংস্কৃতিকর্মীরা প্রাণভয়ে আশ্রয় নেন সন্নিবর্তী ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায়।

এরই মধ্যে দেশের, বিশেষত পূর্বাঞ্চলের অনেক শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মী জড়ো হয়েছেন আগরতলার কলেজটিলায় এমবিবি কলেজে। প্রত্যেকে জড়ো হয়েছিলেন আত্মতাগিদে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শিল্পীসমাজ এক্ষেত্রে সূত্রধরের ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। এদেরই সম্মিলিত প্রয়াসে ৩ জুন ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় গঠিত হয় ‘বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সংস্থা’। এমবিবি কলেজের নির্মীয়মাণ ভবনে স্থাপিত হয় সংস্থার কার্যালয়। মুজিবনগর সরকার কর্তৃক স্বীকৃত পূর্বাঞ্চলের একমাত্র এই সাংস্কৃতিক দলে দেশের নানা প্রান্তের শরণার্থী শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীরা সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। শিল্পীদের উদ্যোগে ‘জয়বাংলা’ অফিসে গিয়ে বলা হয়, তারা ক্যাম্পে ক্যাম্পে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জাগরণী গান করবেন। তখন সরকার এদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা করার উদ্যোগ নেয়। এক্ষেত্রে জহুর আহমদ চৌধুরী ও এম আর সিদ্দিকীর ভূমিকা ছিল মুখ্য। ৩ জুন এম আর সিদ্দিকী স্বাক্ষরিত চিঠিতে এ সংস্থা গঠনের কথা বলা হয়। চিঠিতে তালিকাভুক্ত শিল্পীবৃন্দের মধ্যে ছিলেন হরিপ্রসন্ন পাল, অমল দত্ত, চিত্তরঞ্জন ভূঁইয়া, আজিজুল্লাহ চকলেট, আশিষ চৌধুরী, কামালউদ্দীন আহমদ, সালাম কবির, গীতশ্রী চৌধুরী, জয়শ্রী চৌধুরী, ছায়া রায়, সুমিত্রা ভট্টাচার্য, জয়ন্তী ভূঁইয়া, নিয়তি ভূঁইয়া, বেণু চক্রবর্তী এবং সৈয়দ মামুনুর রশীদ। ক্রমান্বয়ে সম্পৃক্ত হয়েছেন অন্যান্য শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মী। সংস্থার আহ্বায়ক ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, নৃত্য ও মঞ্চশিল্পী এ কে এম আজিজুল্লাহ, ওরফে চকলেট। নেতৃভূমিকায় ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের ছাত্র ও মঞ্চাভিনেতা এস এম মহসীন। মুজিবনগর সরকারের পূর্বাঞ্চলীয় জোনের প্রধান জাতীয় পরিষদ সদস্য এম আর সিদ্দিকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি আবদুল কুদ্দুস মাখন এবং শেখ ফজলুল করিম সেলিমের পৃষ্ঠপোষকতা এ সংস্থার কার্যক্রমকে গতিদান করে। 

শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীরা বিপুল উদ্দীপনায় পরিচালনা করছিলেন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। তখনো সাংগঠনিকভাবে এ সংস্থা আত্মপ্রকাশ করেনি। ২৮ মে ১৯৭১ দৈনিক রুদ্রবীণার পক্ষে চম্পা নাগ ‘আটাশের সন্ধ্যা : বাংলাদেশ-আগতদের প্রাণোচ্ছ্বল নজরুল স্মরণিকা : সংগীত-আবৃত্তি-আলোচনা সমৃদ্ধ একটি মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান’ প্রতিবেদনে লিখেন, ‘স্থানীয় এমবিবি কলেজের ছাত্রাবাস প্রাঙ্গণে বাঙলাদেশের নাগরিকবৃন্দের উদ্যোগে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম জয়ন্তী উৎসব অত্যন্ত প্রাণবন্ত পরিবেশে উদযাপিত হয়। অনুষ্ঠানে পৌরহিত্য করেন চট্টগ্রাম আশুতোষ কলেজের সহকারী-অধ্যক্ষ শ্রী অংশুমান হোর এবং প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করেন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং জাতীয় পরিষদের সদস্য জনাব এম আর সিদ্দিকী। বাংলাদেশের লেখক, শিল্পী, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক নেতা এবং কর্মীবৃন্দ বাংলার অগ্নিপুরুষ কাজী কবির সংগ্রামী চেতনার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন। কাজী নজরুল ইসলামই প্রথম কবি, যিনি শোষিত মানুষের দাবিকে শিল্পরূপ দিয়েছেন। ... বাংলার এই মুক্তিসংগ্রামে নজরুলের দান অনেক বেশি। প্রধান অতিথির ভাষণে জনাব সিদ্দিকী বলেন : বাংলার মুক্তিযোদ্ধারা নজরুল ইসলামেরই মানসপুত্র। সভাপতির ভাষণে শ্রীহোর বলেন, পৃথিবীতে যতদিন অন্যায়-অবিচার থাকবে, শোষণ বঞ্চনা থাকবে, ততদিন কবির কবিতা সমাদৃত হবে।’ আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ইকবাল হলের সহ-সভাপতি জিন্নাত আলী, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যাপক বদরুল হাসান, হবিগঞ্জ কলেজের অধ্যাপক বশীরুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের রিডার অজয় রায়, বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমদ চৌধুরী, আহমদ ছফা প্রমুখ।

ত্রিপুরা থেকে আলোচনায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিলেন ড. কার্তিক লাহিড়ী, বিজন চৌধুরী, বিকচ চৌধুরী, করবী গুপ্তা। বক্তৃতার পরে ‘মুক্ত স্বদেশে পালন করব তোমার জন্মদিন’ গানটি পরিবেশন করেন রণধীর বড়ুয়া। অনুষ্ঠান সম্পর্কে মন্তব্য করে লেখা হয়, ‘সংগীতাংশটি খুবই আকর্ষণীয় হয়েছিল। আবৃত্তি এবং গানে বাংলাদেশের প্রতিটি শিল্পী অন্তরের দরদ ঢেলে দিয়েছেন; নিতান্ত দুঃসময়েও যে প্রাণ প্রাচুর্যের পরিচয় তাঁদের গানে, আবৃত্তিতে ফুটে উঠেছে তাকে এক কথায় বলা চলে অনবদ্য। নজরুল ইসলামের অনেকগুলি সংগ্রামী গান অনুষ্ঠানে পরিবেশন করা হয়। প্রতিটি গান শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শ্রোতারা উচ্ছ্বাসে কলধ্বনি করে উঠেন।’

অনুষ্ঠানে নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা আবৃত্তি করেন এস এম মহসীন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন অধ্যাপক বদরুল হাসান। অনুষ্ঠানের সমাপ্তি পর্বে আজিজুল্লাহ চকলেট এবং আশিস চৌধুরী যৌথভাবে ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটির ছন্দময় নৃত্যরূপ দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের গ্রামোফোন রেকর্ড অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।

এসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই ‘বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সংস্থা’ আনুষ্ঠানিকভাবে জন্মলাভ করে। সংগীত, নৃত্য, আবৃত্তি, দেশাত্মবোধক গান, রবীন্দ্র-নজরুলের স্বদেশপর্বের গান, জাগরণী সংগীত প্রভৃতির মাধ্যমে গণজাগরণ সৃষ্টি, শরণার্থীজনের মনোবল অটুট রাখা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মনে মুক্তির আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া ছিল এ সংস্থার মূল উদ্দেশ্য। ত্রিপুরায় শরণার্থী শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীর স্বতঃস্ফূর্তভাবে জড়িত হয়েছেন এ সংস্থার সঙ্গে। তাদের কেউ কেউ হয়তো অল্প সময়ের ব্যবধানে অন্যত্র চলে গেছেন কিন্তু কর্মকাণ্ড পুরোদমে চলেছে বিজয়ের দ্বারপ্রান্ত পর্যন্ত। এখান থেকে গিয়ে যারা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন আবদুল গনি বুখারী, সরদার আলাউদ্দিন, অরূপ রতন চৌধুরী, বিপুল ভট্টাচার্য, অজিত রায় আরও অনেকে। মুজিবনগর সরকার-কর্তৃক স্বীকৃত হিসেবে নানা পর্যায়ের রাজনীতিক, সামরিক কর্মকর্তা এ সংস্থাকে অকুণ্ঠ সহযোগিতা করে। ফলে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সংগঠনটি বিশেষ স্ফূর্তি লাভ করে। সেই সূত্রে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে এ সংস্থার কার্যক্রম গুরুত্বসহকারে প্রচারিত হয়।

৯ জুলাই দৈনিক রুদ্রবীণায় প্রকাশিত ‘মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা যোগাতে বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সংস্থার অনুষ্ঠান’ শীর্ষক খবরে বলা হয়, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামীদের প্রেরণা যোগাবার জন্য ‘বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সংস্থা’ ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন মুক্তিফৌজে শিবিরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিচালনা করে চলেছেন। জুন মাসের ৩, ৯, ১৭, ২২, ২৪, ২৫ এবং ২৭ তারিখ সংস্থা বিভিন্ন মুক্তিফৌজ শিবিরে দেশাত্মবোধক সংগীত পরিবেশন করে। অনুষ্ঠানগুলির উদ্যোক্তা ছিলেন সংশ্লিষ্ট মুক্তিফৌজ শিবিরের পরিচালকমণ্ডলী এবং সাংস্কৃতিক সংস্থার শিল্পীদের তত্ত্বাবধায়ক গোলাম রফিক ও হামিদুর রহমান।

আলোচনাসভায় এস এম মহসীন বলেন, ‘প্রয়োজন হলে আমরাও হাতে অস্ত্র নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করব এবং একই সঙ্গে মুক্তির জয়গানে বাংলার আকাশ-বাতাস ভরে তুলব। বাংলাদেশ থেকে শেষ হানাদারটি নিশ্চিহ্ন না হওয়া পর্যন্ত আমরাও মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি থাকব।’ ২৭ জুন বাংলাদেশের মুক্ত এলাকায় মুক্তিফৌজের কোন এক অস্থায়ী শিবিরে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের নেতা জাতীয় পরিষদ সদস্য মিজানুর রহমান চৌধুরী সংস্থার আদর্শ ও উদ্দেশ্যের ভূয়সী প্রশংসা করেন। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’র মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে।

এভাবে বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সংস্থা কাজ করে যাচ্ছিল। দৈনিক রুদ্রবীণা ২০ জুলাই সংখ্যা ‘মুক্তিফৌজের মনোরঞ্জনার্থে সঙ্গীতানুষ্ঠান’ খবরে বলা হয়, ৬ জুলাই মুক্তিফৌজের পূর্বাঞ্চলীয় কো-অর্ডিনেটর ড. আবু ইউসুফের উপস্থিতিতে এক গণসঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন গোকুলনগর মেঘনা যুবশিবিরের প্রধান কর্মকর্তা হামিদুর রহমান এবং সাংস্কৃতিক সংস্থার তত্ত্বাবধায়ক গোলাম রফিক। সংক্ষিপ্ত ভাষণে ড. ইউসুফ ‘জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে মুক্তিফৌজকে নিঃস্বার্থভাবে এভাবে প্রেরণাদানের জন্য সাংস্কৃতিক সংস্থার প্রশংসা করে বলেন, বাংলাদেশের জাগ্রত জনগণ এই সাংস্কৃতিক সংস্থা ও তার শিল্পীদের চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ রাখবেন।’ শহীদদের উদ্দেশে রচিত ‘রক্ত শপথে আজকে আমরা তোমাদের স্মরণ করি’ সঙ্গীতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান সূচিত হয় এবং সমাপ্ত হয় ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ দিয়ে।

দৈনিক রুদ্রবীণার ২৪ আগস্ট সংখ্যায় ‘দেশাত্মবোধক সংগীত স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দুর্নিবার প্রেরণা জোগায়’ শীর্ষক খবরে বলা হয়, ১১ আগস্ট দুর্গা চৌধুরীপাড়া বিজনা যুবশিবিরে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সংস্থার শিল্পীবৃন্দ দেশাত্মবোধক সংগীত পরিবেশন করেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে মুখ্যমন্ত্রী মন্তব্য করেন, দেশাত্মবোধক সংগীত স্বাধীনতা সংগ্রামীদের এমনই দুর্নিবার প্রেরণা যোগায় যে, সংগ্রামে তাঁরা অপ্রতিহত হয়ে উঠেন। মুখ্যমন্ত্রী উক্ত সাংস্কৃতিক সংস্থার শিল্পীদের প্রশংসা করেন।

এদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচার প্রহসনের তারিখ নির্ধারিত ছিল। অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিলেন উক্ত শিবির প্রধান সৈয়দ এমদাদুল বারী এবং আওয়ামী লীগ নেতা গোলাম রফিক। ‘আমার দেশ বাংলা’ গানটির মাধ্যমে অনুষ্ঠান সূচিত হয়। গণসংগীতশিল্পী অজিত রায় নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ সংগীত পরিবেশন করেন। সংগীতানুষ্ঠানের আগে বক্তাবৃন্দ সারগর্ভ ভাষণ দেন। এরমধ্যে কে পি দত্ত, গোলাম রফিক ও আজিজুল্লাহ চকলেট উল্লেখযোগ্য। প্রধান অতিথির ভাষণে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম আমাদেরও সংগ্রাম। এই সংগ্রামকে জয়যুক্ত করবার জন্য আমাদের সকলেরই অনেক ত্যাগ স্বীকার ও দুঃখ বরণের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সংস্থার শিল্পীদের পরিবেশিত দেশাত্মবোধক সংগীত মুক্তিযোদ্ধাদের মনে গভীর প্রেরণা ও প্রচুর আত্মশক্তি যোগাবে। অনুষ্ঠান শেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য প্রার্থনা করা হয়। এস এম মহসীন এ অনুষ্ঠানের স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, অজিত রায়ের গান শোনে শচীন্দ্রলাল সিংহ তাঁকে আবেগে জড়িয়ে ধরেছিলেন। সে এক অভূতপূর্ব মুহূর্ত।

দৈনিক রুদ্রবীণা ২৫ আগস্ট সংখ্যায় ‘বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সংস্থার মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান’ খবরে বলা হয়, ৪ আগস্ট বাংলাদেশের মুক্তি এলাকায় কোন এক যুবশিবিরে ‘বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সংস্থা’র শিল্পীবৃন্দ এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করেন। অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন উক্ত শিবিরের প্রধান এবং শিল্পীদের তত্ত্বাবধায়ক গোলাম রফিক। বাংলাদেশের ছাত্রলীগ নেতা আবদুল কুদ্দুস মাখন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন আবদুল কুদ্দুস মাখন, গোলাম রফিক, আবদুর রসিদ ও আজিজুল্লাহ চকলেট।

দৈনিক সংবাদ ১৫ অক্টোবর সংখ্যায় ‘মুক্তিসেনাদের শিবিরে মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান’ শীর্ষক খবরে বলা হয়, ২৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ মুক্তাঞ্চলের একটি মুক্তিসেনা শিবিরে প্রায় পাঁচ হাজার মুক্তিসেনার উপস্থিতিতে এক মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর বহু উচ্চ পদস্থ সামরিক কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। ‘মাতৃভূমিকে মুক্ত করার দুর্বার শপথে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করাই ছিল অনুষ্ঠানের প্রধান এবং একমাত্র উদ্দেশ্য। বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সংস্থা-আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে গীতি-নক্সা, আবৃত্তি ও নৃত্য পরিবেশিত হয়। অনুষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন গোলাম রফিক। কথাশিল্পী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনার্থে সংস্থার শিল্পীরা তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ১৫ সেপ্টেম্বর শোকসভার আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন এমবিবি কলেজের বাংলা বিভাগীয় প্রধান রণেন দেব। অধ্যাপক মিহির দেব, অধ্যাপক সরোজ কুমার চৌধুরী, আজিজুল্লাহ চকলেট এবং এস এম মহসীন প্রমুখ বক্তৃতা করেন।

সংস্থাটি বিশালগড়, হাতিমারা, বিশ্রামগঞ্জ, উদয়পুর, লেম্বুচড়া, দুর্গা চৌধুরীপাড়া, বাগমারা, অম্পিনগর প্রভৃতি ক্যাম্পে অনুষ্ঠান করেছে। মুক্তিযুদ্ধে ২, ৩ নং সেক্টরের অর্থাৎ পূর্বাঞ্চলের প্রায় প্রতিটি শরণার্থী শিবির, যুবশিবির ও মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে এবং জনসমাগমস্থলে সাংস্কৃতিক সংস্থা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। ভারতীয় সেনাবাহিনী গাড়ি করে সদস্যদের নিয়ে যেত। জয়শ্রী চৌধুরী অগ্নিঝরা দিনগুলির স্মৃতিচারণে বলছিলেন, আমাদের গানে সবাই একাত্ম হয়ে যেত। আবেগে আপ্লুত হয়ে কেউ কেউ কেঁদে উঠত। মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধারা রাইফেল উঁচিয়ে উদ্দীপনায় স্লোগান ধরত, ‘জয় বাংলা’। গভীর রাত পর্যন্ত গান হতো। অনেক সময় সারা রাত অনুষ্ঠান করে সকালে কাছাকাছি কোনো শিবিরে অনুষ্ঠান করে ফিরে আসত দল। তিনি আরও বলছিলেন, শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীরা অনেক কষ্ট স্বীকার করে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছিল। গান গাওয়ার সময় সেই কষ্ট ও যন্ত্রণা বাঙ্গময়রূপ লাভ করত। এস এম মহসীন বলছিলেন, যুদ্ধে যাওয়ার আগের দিন মুক্তিযোদ্ধাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উজ্জীবিত করা হতো। দেশকে শত্রুমুক্ত করার দুর্দমনীয় ভাব জেগে উঠত তাদের চোখে-মুখে।

উপরে বর্ণিত প্রত্যেকটি অনুষ্ঠানে ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সেখানে সংস্থার শিল্পীবৃন্দ অংশগ্রহণ করেছেন। পরিবেশনার মধ্যে আরও থাকত নাট্যাংশ, গীতিনাট্য, ব্যাঙ্গচিত্র। নাট্যাংশ ও গীতিনাট্য রচনায় এ কে এম হারুনুর রশীদ ও সুধাময় করের ভূমিকা ছিল মুখ্য। এভাবে জুন মাস থেকে বিজয়ের প্রান্ত পর্যন্ত বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সংস্থা একের পর এক অনুষ্ঠান করেছে। শিবিরে শিবিরে ঘুরে ঘুরে অনুষ্ঠান করত বলে একে ভ্রাম্যমাণ সাংস্কৃতিক সংস্থাও বলা হতো। শুধু মুক্তিযুদ্ধের  প্রচলিত গান নয়, সে-সময়ের প্রেক্ষাপটে রচিত হয় নতুন অনেক গান। সেই গান ধ্বনিত হতো সংস্থার শিল্পীদের মুখে। নতুন গানের গীতিকারদের মধ্যে ছিলেন অসিত চৌধুরী, গজেন্দ্রলাল রায়, সুধাময় কর, সরদার আলাউদ্দিন, অমূল্য ভট্টাচার্য, এ কে এম হারুনুর রশীদ, জীবন বর্মণ ও মৃনালকান্তি দত্ত।

অসিত চৌধুরীর গানগুলির মধ্যে ছিল ‘শক্ত হাতে ধর পতাকা’, ‘আমার পুরব বাংলাদেশ/ তোমায় সালাম নম নম’, ‘বাংলা মোদের মায়ের বুলি/ মায়ের ভাষার মান বাঁচাতে/ ভাইয়েরা বুকে নিল গুলি’। 

এ কে এম হারুনুর রশীদের গানগুলির মধ্যে ছিল ‘সংগ্রাম চলবেই/ জনতার সংগ্রাম চলবেই/ মানুষের সংগ্রাম চলবেই’, ‘চেয়ে দেখ পুবাকাশ লালে লাল হয়ে আছে/ সব শহীদের রক্তজমে সূর্য হয়ে গেছে’, ‘লাল সবুজে জন্ম আমার বাংলাদেশে বাড়ি/ উথাল-পাতাল পদ্মা-মেঘনা পাড়ি দিতে পারি’, ‘বাংলাদেশের মেয়ে আমি বাংলাতে গান গাই/ বাংলা ছাড়া ভাইরে আমার কোন গান নাই’। 

জীবন বর্মণের গানগুলির মধ্যে ছিল ‘লাল লাল রক্তে ভেসে গেছে জনপদ/ কত যে মায়ের কোল/ যে শূন্য করেছে আজ নির্মম পিশাচের দল’, ‘ওরে ও মানুষ দ্বার খুলে দে/ রক্তরাঙা ঐ সূর্য দিল ডাক’, ‘শহীদের লাল রক্তে ভিজে ভূগোল রচিত যে দেশের/ আমি যে মানুষ ঐতিহাসিক সেই সে দেশের’। 

মৃনালকান্তি দত্তের লেখা ও সুরারোপিত গানগুলি ছিল ‘আমরা শপথ নিলাম একই সাথে চলবো’, ‘এ লড়াই বাঁচার লড়াই/ এ লড়াইয়ে জিততে হবে’, ‘ইতিহাস লিখেছি তো আমরা/ আমরা তো কভু হার মানিনি’, ‘বিদ্রোহ আজ বিদ্রোহ চারিদিকে/ আমরা সবাই বাঙালি তাই’, ‘মানবো না মানবো না/ ইয়াহিয়ার কোনো শাসন মানবো না’। 

এছাড়াও ‘মুজিব ভাই আসিয়া/ সোনার বাংলা যাও দেখিয়া’, ‘যুদ্ধ এবার যুদ্ধ/ এবার শুনরে হানাদার দুর্বৃত্ত/ পালাবার পথ রুদ্ধ’, ‘ঝঞ্জা ঝড় মৃত্যু দুর্বিপাক/ ভয় যারা পায়/ তাদের ছায়া দূর মিলাক’, ‘ভাঙ্গবোই কারাগার ভাঙ্গবোই/ বঙ্গের বন্ধুকে আনবোই’ প্রভৃতি গান ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রচলিত সমস্ত গান গেয়ে ফিরেছে সাংস্কৃতিক সংস্থা। গানের সঙ্গে থাকত ধারাবিবরণী। ধারাভাষ্য লিখতেন এ কে এম আজিজুল্লাহ ও এস এম মহসীন। অনুষ্ঠানসমূহে বিভিন্ন সময়ে তবলা সঙ্গত করতেন বেনু চক্রবর্তী, অরূপরতন চৌধুরী, সৈয়দ মামুনুর রশীদ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনুষ্ঠান সঞ্চালন করতেন এ কে এম আজিজুল্লাহ। সার্বিক তত্ত্বাবধানে থাকতেন এস এম মহসীন।

১৯৭৪ সালে এম আর সিদ্দিকী, আবদুল কুদ্দুস মাখন ও এ কে এম আজিজুল্লাহ চকলেট স্বাক্ষরিত সংস্থার শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীর তালিকায় এর সদস্য সংখ্যা ছিল ৫১। প্রথমোক্ত তালিকা ছাড়াও যাঁদের নাম উপরে বর্ণিত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সংবাদে প্রকাশিত হয়েছে, তাঁরা হলেন—মহিউদ্দিন খোকা, অরূপরতন চৌধুরী, এস এম মহসীন, শঙ্করনাথ সাহা, এস এম শাহাজাদা, হাফিজুল কবির লেনিন, এ কে এম হারুনুর রশীদ, ফিরোজ আহমদ, সুজিত আড়েং, সৈয়দ জহির হোসেন, দেলোয়ার জাহান ঝন্টু, শাহাবুদ্দীন আহমদ, দিলারা হারুন, সিঁথি কর। 

উপর্যুক্ত কর্মকাণ্ডে যাঁদের নাম সংগৃহীত পত্র-পত্রিকার সংবাদে আসেনি তাদের মধ্যে আছেন এস এম সেলিম, অমলকৃষ্ণ মজুমদার, সুধেন্দু চক্রবর্তী, রবীন্দ্রলাল পোদ্দার, আজিজুল হক চৌধুরী, শ্যামলকৃষ্ণ মজুমদার, ফরিদউদ্দীন আহমদ, আমিনুল হক, সিদ্দিক মিয়া, মিরাজউদ্দীন আহমদ, ওবায়দুল হক, আবদুস শহীদ, জসীমউদ্দীন আহমদ, মুক্তা চক্রবর্তী, উমেশচন্দ্র রায়, আবদুল মঈন, নারায়ণচন্দ্র ঘোষ, মোতাহার হোসেন খান, হুমায়ুন কবির, মফিজুল ইসলাম, মৃনালকান্তি দত্ত। 

যাঁরা তালিকাভুক্ত নন, কিন্তু সংস্থার কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছিলেন এবং পত্রিকায় যাঁদের নাম প্রকাশিত হয়েছিল তাদের মধ্যে রয়েছেন অনুভা হোর, ছন্দা হোর, নজরুল ইসলাম, অরুণ চৌধুরী, ছায়া চক্রবর্তী, আবদুল গনি বুখারী, প্রদীপ, সুধা কর।

সংস্থার সকল কাজে স্থানীয় জনগণের ব্যাপক সাড়া ও সমর্থন ছিল হৃদয়স্পর্শী। এমবিবি কলেজের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সত্যরঞ্জন ভট্টাচার্য ও বিজন চৌধুরী এ কাজে বিশেষ সহযোগিতা করেছিলেন। শিল্পীরাও নিবেদিত ছিলেন দেশমাতৃকার সঙ্কটমোচনে। এসএম মহসীন বলছিলেন, এমবিবি কলেজের নির্মীয়মাণ হোস্টেলে খড়ের উপর চাদর বিছিয়ে বিছানা পাতা হয়েছিল। সেখানেই চলতো মহড়া। নারী শিল্পীদের অধিকাংশ কাছাকাছি কোনো শিবির কিংবা আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে থাকত। অন্যেরা সেখানেই পর্দা টানিয়ে পৃথকভাবে বাস করত। আমরা নিজেরাই রান্না করতাম। এ নিয়ে কোনো মনোবেদনা ছিল না। সংস্থার সাংগঠনিক কাজে নেতৃত্ব দিতেন এ কে এম আজিজুল্লাহ চকলেট ও এস এম মহসীন। সংগীতে নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে ছিলেন প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী অসিত চৌধুরী। 

অনেকে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেও এ সংস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকেছেন, যেমন গীতশ্রী চৌধুরী। তিনি জিবি ও ভিএম হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবী ভূমিকা পালন করে সংস্থার কার্যক্রমে নিয়মিত অংশ নিয়েছেন। এরই মধ্যে নিয়েছিলেন সশস্ত্র প্রশিক্ষণ। সংঘের সদস্য সংগীতশিল্পী ফিরোজ আহমদ বলছিলেন, সাংস্কৃতিক সংস্থার অনেক সদস্য কণ্ঠযুদ্ধের পাশাপাশি  অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলেন। এদের কয়েকজন শহীদ হন। যাঁরা এ প্রয়াসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন তাদের প্রায় সবাই ছিলেন তরুণ। তারুণ্যের বর্ণচ্ছটায় গান, নৃত্য, নাটক, আবৃত্তিতে সেদিন মুক্তির জোয়ার এসেছিল। শিল্প ও সংস্কৃতির নানা মাত্রিক উপস্থাপনায়, রূপ ও রসের ব্যঞ্জনায়, চেতনা ও ভাবনার মিথষ্ক্রিয়ায় শ্রোতামণ্ডলীর মাঝে তৈরি হতো জাগরণ। এ জাগরণে উঠে আসত মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও লক্ষ্য। মুক্তির বাণী ছড়িয়ে পড়তো সর্বত্র, সবখানে। মুক্তিযুদ্ধের সাংস্কৃতিক সংগ্রামে সংস্থার অসামান্য ভূমিকা তাই স্বর্ণাক্ষরে খচিত আছে।

স্বাধীন বাংলা মুক্তিযোদ্ধা সাংস্কৃতিক সংঘ 
কুমিল্লা জেলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সমৃদ্ধির ধারায় সুখেন্দু চক্রবর্তী যোগ করেছিলেন বিশেষ মাত্রা। তাছাড়া জাতীয়ভাবেও তিনি গণসংগীত ও সুরকার হিসেবে অবদান রেখে গেছেন। সুখেন্দু চক্রবর্তীর (১৯২৩-১৯৮০) শিল্পীজীবনের সূচনা পারিবারিক পরিমণ্ডলে। প্রথমে ওস্তাদ সমরেন্দ্র পাল, পরে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা উচ্চাঙ্গ সংগীতশিল্পী সত্যেন্দ্রকুমার চক্রবর্তীর কাছে সঙ্গীতের তালিম গ্রহণ করেন। পরে তালিম নেন ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরুর কাছে। এস্রাজ, সেতার ও তবলাবাদনে ছিলেন পারদর্শী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শামসুন নাহার হলের সংগীত শিক্ষক ছিলেন। সংগীত পরিচালক ছিলেন ‘যে নদী মরুপথে’, ‘দৃষ্টি’ ও ‘ফান্দে পড়িয়া বগা’ প্রভৃতি ছায়াছবির। বাংলাদেশ বেতারের বাণিজ্যিক কার্যক্রমের সংগীত প্রযোজক হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের নিয়মিত শিল্পী ছিলেন। ভাষা আন্দোলন, পূর্ব পাকিস্তান আন্তঃকলেজ সাংস্কৃতিক সম্মেলন (কুমিল্লা, ১৯৫৫), কাগমারী সম্মেলন (১৯৫৭), ঢাকায় অনুষ্ঠিত যুব সম্মেলনে গান গেয়ে অভূতপূর্ব সাড়া জাগান। ষাট ও সত্তরের দশকে ঢাকার সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে ছিল জাগরণী ভূমিকা। কচি-কাঁচা মেলার সংগীতশিক্ষা কেন্দ্র ‘সুরবিতান’ তাঁর হাতেই গড়ে ওঠে। উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী ও আফ্রো-এশিয়া গণসংহতি পরিষদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। আলতাফ মাহমুদ, শেখ লুৎফর রহমান ও আবদুল লতিফ তাঁর শিল্পীজীবনের বন্ধু। প্রগতিশীল সংস্কৃতিচর্চার ধারায় সুখেন্দু চক্রবর্তী মুক্তিযুদ্ধোত্তরকালেও অবদান রাখতে সক্ষম হন। 

পঁচিশে মার্চের কালরাতের পর সপরিবারে কুমিল্লা শহর ছেড়ে সন্নিবর্তী ত্রিপুরার সোনামুড়ায় আশ্রয় নেন সুখেন্দু চক্রবর্তী। সেখান থেকে মে মাসের শেষ দিকে শরণ নেন উদয়পুরে, রাজারবাগ শরণার্থী শিবিরে। বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের নানা পর্যায়ে ভূমিকা পালনকারী এই শিল্পীর পক্ষে নিষ্কর্ম হয়ে বসে থাকার উপায় ছিল না। ভাবছিলেন কী করে নিজের শিল্পীসত্তার প্রকাশ ঘটাবেন জাতির এই সঙ্কটলগ্নে। উদয়পুরে শরণার্থী শিবিরে পেয়ে যান নিজ শহর এবং নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও ফেনীর কয়েকজন সংস্কৃতিপ্রেমী ও শিক্ষিত তরুণকে। তারাও কিছু করার কথা ভাবছিলেন। সুখেন্দু চক্রবর্তীকে পেয়ে তারা পথের দিশা খুঁজে পেলেন। তাঁদের নিয়েই গঠন করলেন ‘স্বাধীন বাংলা মুক্তিযোদ্ধা সাংস্কৃতিক সংঘ’। সংগীত ও বক্তৃতার মাধ্যমে দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলা এবং বিপদের দিনে মনোবল অটুট রাখার লক্ষ্য নিয়ে সংগঠনটির জন্ম। এমন একটি সাংস্কৃতিক সংঘের কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য দরকার পড়লো পৃষ্ঠপোষকতার। এ কাজে  সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন উদয়পুর জেলার এডিএম শচীতানন্দ ব্যানার্জী। সুখেন্দু চক্রবর্তীর নেতৃত্বে সংঘের সদস্যদের তিনি ডেকে বললেন তাঁর কাছে কিছু তহবিল আছে। সংগীতের এই দলটিকে তিনি সহায়তাদানে ইচ্ছুক। এজন্য সংঘটির সাংগঠনিক কাঠামো প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে উদয়পুরে বিভিন্ন ক্যাম্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজনীতিক ও জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে জাতীয় পরিষদ সদস্য ক্যাপ্টেন সুজাত আলী, চট্টগ্রামের আবদুল্লাহ আল হারুন, আবদুল্লাহ আল নোমান, নোয়াখালীর আবদুল মালেক উকিল, ফেনীর এবিএম তালেব আলী, শহীদউদ্দিন ইস্কান্দার কচি মিয়াকে উপদেষ্টা করে সংঘের কমিটি গঠিত হয়। সুখেন্দু চক্রবর্তী সভাপতি; সহ-সভাপতি নৃপেন্দ্র কুমার চক্রবর্তী, সাধারণ সম্পাদক মাহবুব চৌধুরী। সদস্যদের মধ্যে ছিলেন অভিজিৎ সাহা পিনাক, জোৎস্না রাণী ভৌমিক, মায়া সাহা, শাকিলা চৌধুরী, শর্মিষ্ঠা চৌধুরী, মলয় কর, অজয় চক্রবর্তী, দেবাশীষ চৌধুরী, প্রদোৎ পাল, সুকুমার সাহা, নীলিমা সাহা, রত্না বিশ্বাস ও আরও অনেকে। দলের সদস্যরা প্রত্যেকে একটি করে কম্বল পান এবং প্রত্যেকের মাসিক ভাতা ১৫০ টাকা। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সম্পৃক্ততার ফলে সংঘের কাজ বিস্তৃতি লাভ করে। বিশেষ করে পালাটানা ক্যাম্পের প্রধান সুজাত আলীর সহযোগিতা ছিল অকুণ্ঠ। সর্বোপরি সুখেন্দু চক্রবর্তী ছিলেন এ কর্মযজ্ঞের প্রাণপুরুষ।

শুরু হলো সাংস্কৃতিক সংঘের কার্যক্রম। সুখেন্দু চক্রবর্তী দেশ ছাড়ার সময় শত প্রতিকূলতার মধ্যেও হারমোনিয়ামটি সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেটি দিয়ে রেওয়াজ চলল। মহড়ার জন্য পর্যাপ্ত পরিসর প্রয়োজন। এ কাজেও এগিয়ে আসেন শচীতানন্দ ব্যানার্জী। সংঘের সহ-সভাপতি নৃপেন্দ্র কুমার চক্রবর্তী বলছিলেন, শচীতানন্দের স্ত্রী সাথী ব্যানার্জী কুমিল্লা শহরের মেয়ে এবং সুখেন্দু চক্রবর্তীর এককালীন ছাত্রী। রেওয়াজ ও মহড়ার জন্য তাঁদের ধনিসাগরপাড়ের সরকারি বাসা অবারিত করে দেন। শুধু তাই নয়, সাথী ব্যানার্জী সংঘের সদস্যদের নিজ হাতে আপ্যায়ন করতেন। উদয়পুর রমেশ হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ধীরেন দত্ত নিজ বাসায় রেওয়াজের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। আরও রেওয়াজ হতো জগন্নাথদিঘির পাড়ে তারু মিয়ার বাসায়। এভাবে ত্রিপুরাবাসীর আন্তরিক সহযোগিতায় সংঘের কার্যক্রম বিশেষ গতি লাভ করে।

জনগণের মনোবল বৃদ্ধি ও দেশকে স্বাধীন করার দীপ্তমন্ত্রে উজ্জীবনের লক্ষ্যে সুখেন্দু চক্রবর্তী গণসঙ্গীতের দল নিয়ে সেদিন পালন করেছিল সোচ্চার ভূমিকা। সুখেন্দু চক্রবর্তীর নেতৃত্বে গীত গানগুলির মধ্যে ছিল ‘যুদ্ধ যুদ্ধ বাংলায় যুদ্ধ’, ‘ইতিহাস জান তুমি আমরা পরাজিত হইনি’, ‘ওরা নাকি আমাদের ক্ষেতে আর খামারের সবুজের স্বপ্ন কেড়ে নিতে চায়’, ‘চেয়ে দেখ পূবাকাশ লালে লাল হয়ে গেছে’, ‘মা গো তোমার জন্য জীবন দিলাম’, ‘ভয় কী মরণে’, ‘ঐ না নদীর তীরে তীরে সবুজ শ্যামল গাঁওরে’, ‘আমরা করি না ভয়, অত্যাচারের হিমালয়’ প্রভৃতি। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস কণ্ঠসৈনিক হিসেবে শরণার্থী শিবির, যুব শিবির ও মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে অবিরাম জাগরণী গান গেয়ে ফিরেছে এ সংঘ। ক্যাম্পগুলির মধ্যে ছিল পালাটানা, কোনাবন, ধ্বজনগর, খিলপাড়া, রাজারবাগ, মাতারবাড়ি প্রভৃতি। এছাড়া বিভিন্ন স্কুলের মাঠ ও জনাগমন স্থলেও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। এর মধ্যে রয়েছে মেলাঘর ও কাকড়াবন হাইস্কুল মাঠ। অনুষ্ঠানগুলিতে স্থানীয় জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল প্রেরণাদায়ী। দলের মধ্যে অধিকাংশ ছিলেন শিক্ষিত যুবক। তারা নানা পর্যায়ের শিক্ষকতা করতেন। গণসঙ্গীতের অংশগ্রহণের পাশাপাশি তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও যৌক্তিকতা বক্তৃতার মাধ্যমে তুলে ধরতেন। গানের মাঝে মাঝে চেতনার প্রকাশ পুরো অনুষ্ঠানকে দিয়ে যেত ভিন্ন মাত্রা। গানের আসর বসতো সন্ধ্যায়। সুখেন্দু চক্রবর্তীর উদাত্ত কণ্ঠের সঙ্গে দলের তরুণপ্রাণের মিলনে সৃষ্টি হতো অন্যরকম শিহরণ। দেশমাতৃকার মুক্তির আকুতি ছেয়ে যেত পুরো পরিবেশ। বিপদে ধৈর্য ধারণ ও মাতৃভূমিকে মুক্ত করার প্রবল প্রত্যয় জেগে উঠত মুক্তিযোদ্ধাদের মনে, যুবশিবিরবাসীর প্রাণে, শরণার্থী শিবিরের প্রতিটি মানুষের অন্তরে। সংঘের সাধারণ সম্পাদক মাহবুব চৌধুরী বলছিলেন, গান শোনে স্থানীয় লোকজন স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাহায্য করত। সেই অর্থ প্রদান করা হতো মুক্তিযোদ্ধা শিবিরের তহবিলে।

উদয়পুর রাজারবাগ শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে এসেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহ ও ডেপুটি স্পিকার এরশাদ আলী চৌধুরী। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সমবেত দেশাত্মবোধক গানের পর সুখেন্দু চক্রবর্তী নিবেদন করেন ‘মুজিব বাইয়া যাও রে, নির্যাতিত জাতির মাঝে জনগণের নাওরে মাঝি বাইয়া যাও রে’ গানটি। ইন্দিরা গান্ধী গানটি শুনে খুশি হয়ে বললেন, খুব আচ্ছা গান গায়া তুম। অনেক মানুষের প্রাণের আকুতি প্রকাশ পেয়েছিল সেসব দিনের গানে। এভাবে সুখেন্দু চক্রবর্তীর নেতৃত্বে ‘স্বাধীন বাংলা মুক্তিযোদ্ধা সাংস্কৃতিক সংঘ’ মুক্তিকামী প্রতিটি মানুষ ও উদয়পুরবাসীর মনে সাহস সঞ্চার করেছিল; শক্তি জুগিয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের। কত মানুষের কত রকম ভূমিকার ফলে মুক্তিযুদ্ধ বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল এ সংঘের গঠন ও কার্যক্রমের মধ্যে তা উপলব্ধি করা যায়। যে অনন্য ভূমিকা রেখে গেছে তারা স্বাধীনতার জন্য তা ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছে; অমলিন হয়ে আছে মানুষের অন্তরে। তাই স্মরণ করি মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদান রচনাকারী সুখেন্দু চক্রবর্তীসহ দলের সবাইকে, যাঁরা এ প্রয়াসে যুক্ত হয়েছিলেন আন্তরিকভাবে; স্বপ্ন দেখেছিলেন তিমির বিনাশে। সবার প্রতি গভীর প্রণতি, সালাম।

স্বাধীনতা সংগীত দল
১৯৭১। ত্রিপুরার আগরতলার নোয়াবাদী শরণার্থী শিবির থেকে একটি গণসংগীতের দল বের হলো। পঞ্চাশোর্ধ সৌম্যকান্তির একজন মানুষ কাঁধে হারমোনিয়াম বেঁধে উদাত্ত কণ্ঠে গণসংগীত গাইছেন, তাঁকে অনুসরণ করছেন ১০-১২ জন নবীন-নবীনা। একের পর গান গেয়ে অগ্রসর হচ্ছে এ দল। দেশের গান, দুর্দিনে ধৈর্য ও মনোবল অটুট রাখার গান; প্রবল প্রতিরোধ ও সংগ্রামের গান। তারা গান গেয়ে চলেছেন শরণার্থী শিবিরে, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে, পথিমধ্যে কোনো জনসমাবেশে। হারমোনিয়াম কাঁধে সেই মানুষটি আর কেউ নন। তিনি কুমিল্লা শহরের গণমানুষের শিল্পী ওস্তাদ কুলেন্দু দাস। একাত্তরের মে মাস থেকে দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত জাগরণের এই প্রয়াস তিনি অব্যাহত রেখেছিলেন।

কুমিল্লা জেলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে শচীন দেববর্মণ, ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু, সুরসাগর হিমাংশু দত্ত, ফজলে নিজামী, সুখেন্দু চক্রবর্তী যে মাত্রা সৃষ্টি করেছিলেন সংগীত ও নৃত্যশিল্পী কুলেন্দু দাসের (১৯২০-১৯৮৫) নাম একই সূত্রে গাঁথা। সংগীতশিক্ষার হাতেখড়ি জ্যেষ্ঠবোন শিল্পী শৈল দেবীর কাছে। তালিম গ্রহণ কবি নজরুলের কাছে। তাঁর নামটিও নজরুলেরই দেয়া। খেয়াল, ঠুংরী, রাগপ্রধান, টপ্পা ও গণসঙ্গীতে তিনি অর্জন করেছিলেন বিশেষ দক্ষতা। শ্যাম ভট্টাচার্যের নিকট নৃত্যশিক্ষা লাভকারী এই কৃতী শিল্পীর কম্পোজকৃত নৃত্যের মধ্যে রয়েছে ‘সাপুড়ে’, ‘শিকারী’, ‘জিপসী’, ‘রানার’, ‘অবাক পৃথিবী’, ‘কোন এক গাঁয়ের বধূর কথা শোন’, ‘কারার ঐ লৌহকপাট’। রচনা, সুরারোপ ও পরিচালিত নৃত্যনাট্য ‘ঝরাফুল’, ‘নবান্ন’, ‘নিদয়া গোমতী’। ‘ফসলের ডাক’, ‘তাসের দেশ’, ‘ভাঙ্গাগড়া নোয়াখালী’, ‘এক দশকের বাংলাদেশ’ প্রভৃতি নৃত্যনাট্যে সংগীত ও নৃত্য পরিচালনা করেন। চল্লিশের দশকে আকাশবাণী, পরে রেডিও পাকিস্তান ঢাকা ও চট্টগ্রাম কেন্দ্রে নিয়মিত সংগীত পরিবেশন করতেন কুলেন্দু দাস। সম্পৃক্ত ছিলেন পল্লী উন্নয়ন একাডেমীর সমবায় আন্দোলনে। ‘বাণীবিতান’, ‘সুরবিতান’, ‘কুমিল্লা সংগীত বিদ্যালয়’ ও ‘নোয়াখালী সংগীত বিদ্যালয়’ স্থাপনের মাধ্যমে প্রসার ঘটান সংগীত শিক্ষার। 

ভাষাআন্দোলন, সাংস্কৃতিক সম্মেলন ও ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে দেশাত্মবোধক ও গণসঙ্গীতের মাধ্যমে তিনি সৃষ্টি করেন গণজাগরণ। শহরের সংস্কৃতিচর্চায় তাঁর ছিল বিরাট ভূমিকা। একাত্তরের বৈরী পরিস্থিতিতে সপরিবারে চলে আসেন ত্রিপুরার আগরতলায়। আশ্রয় নেন আগরতলার সন্নিহিত পশ্চিম নোয়াবাদী শরণার্থী শিবিরে। কিন্তু এই সংস্কৃতিগত দেশপ্রাণ মানুষটির পক্ষে মাতৃভূমির ঘোর দুর্দিনে হাত গুটিয়ে বসে থাকা সম্ভব ছিল না। কণ্ঠকে অস্ত্র করে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন সাংস্কৃতিক যুদ্ধে। শরণার্থী শিবিরে বসেই তবলাবাদক শেফাল রায়-সহযোগে গঠন করেন ‘স্বাধীনতা সংগীত দল’। সেই দলে আরও ছিলেন কুলেন্দু দাসের সন্তান কল্যাণ দাস, কণিকা দাস, বেবী দাস, কৃষ্ণ দাস; শেফাল রায় এবং তাঁর কন্যা দীপালি রায়; উমা, হেনা, শান্তি—আরও অনেকে। দল তো গঠন হলো, হারমোনিয়াম পাবেন কোথায়? শরণার্থী শিবিরে ওস্তাদ কুলেন্দু দাসের আগমনের কথা শুনে স্থানীয় পঞ্চায়েত-প্রধান তার মেয়েকে গান শেখাতে বলেন। সেখান থেকে সংগৃহীত হলো হারমোনিয়াম। শেফাল রায় কোত্থেকে জোগাড় করলেন তবলা। রেওয়াজও চলল পঞ্চায়েত-প্রধানের বাড়ি কিংবা শিবিরের অপেক্ষাকৃত কোলাহলমুক্ত পরিসরে। দলের জন্য পুরোনো গান নয়, সময়ের প্রয়োজনে নিজে গণসংগীত লেখা শুরু করলেন কুলেন্দু দাস। শরণার্থী শিবিরে বসে গান লিখেছেন, বেঁধেছেন সুর। সেই গান নিবেদন করেছেন জনতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সমীপে। এভাবে পশ্চিম নোয়াবাদী শরণার্থী শিবির, গোমতী যুবশিবির, দুর্গা চৌধুরীপাড়া যুবশিবির, ইছামতি যুবশিবির প্রভৃতি স্থানে গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দীপ্ত করার কাজে ব্রতী হন। গণসংগীত পরিবেশনের সময়ে যুবশিবিরের শত শত মুক্তিযোদ্ধা স্লোগান ধরতো—‘জয় বাংলা’! মনে হতো গানের বাণী আপ্লুত করছে প্রতিটি মুক্তিকামী তরুণের মন। 

ওস্তাদ কুলেন্দু দাস-রচিত গানগুলির মধ্যে ছিল ‘চল ভাই সবাই মিলে মুক্তিযুদ্ধে নাম লেখাই’, ‘ভাগো ভাগো ভাগো—ইয়াহিয়া ভাগো, ভুট্টো ভাগো’, ‘ধর্ ধর্ ধর্ ভুট্টোরে ধর্’, ‘এই বার, তিন শয়তানে লেজ গুটাইয়া ভাগেরে’, ‘চাচায়, গদ্দি ছাইড়া ভাগেরে খেত কোনাইচ্যা পথে’, ‘চাচা কি ভাব গো নিরালে বসিয়া’, ‘এই মাটিতে সোনা ফলে, এই মাটিতে কি না ফলে’, ‘হায়রে নিদয়া ইয়াহিয়া’, ‘আমাদের বাংলা মা স্বাধীন হল রে’ ইত্যাদি। আসর শুরু হতো ‘আমার সোনার বাংলা’ ও ‘ধন্যধান্যে পুষ্পভরা’ দিয়ে। তারপর একুশ ও স্বাধিকার আন্দোলনের গান। এরপরই মঞ্চ মুখর হয়ে উঠত অগ্নিঝরা সব গানে। গানের মাঝে মাঝে ছিল ধারাভাষ্য। তা-ও কুলেন্দু দাসেরই লেখা। দিনরাত শিবিরে-শিবিরে গান গেয়ে ফিরেছেন। শরণার্থীরা গান শুনে মনোবল ফিরে পেতেন।

কীর্তিমান এই শিল্পীর জীবন ও কর্ম নিয়ে প্রণীত স্মারকগ্রন্থে মুক্তিযুদ্ধকালে রচিত গানগুলি সংকলিত হয়েছে। মলিন-পাণ্ডুর গানের সেই খাতাটি আজও আগলে রেখেছেন সেদিনের দলের যাত্রী ও কুলেন্দু দাসের মেজোপুত্র কল্যাণ দাস। গানগুলির প্রতিটি অক্ষর রক্তঝরা দিনগুলিকে স্মরণ করিয়ে দেয়। স্মরণ করিয়ে দেয় মুক্তিযুদ্ধে অসংখ্য মানুষের আত্মদানের কথা—অশ্রু ও বিষাদের গান। মুক্তিযুদ্ধে নানা জায়গায় নানা সাংস্কৃতিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। এর মূল লক্ষ্য ছিল সাংস্কৃতিকভাবে মানুষকে মুক্তিচেতনায় উজ্জীবিত করা। সেক্ষেত্রে ‘স্বাধীনতা সংগীত দল’-এর ভূমিকা বিশেষ গুরুত্ববহ। কত মানুষের কত রকম ত্যাগ ও সাধনার মাধ্যমে সেদিন বিজয় অর্জিত হয়েছিল সেকথা আমরা যেন ভুলে না যাই। তাই শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করি গণজাগরণের শিল্পী কুলেন্দু দাসের প্রতি, স্মরণ করি মহৎ সেই কাজের সঙ্গে জড়িত প্রতিটি মুক্তিকামী প্রাণকে। শিবিরের মুক্তিযোদ্ধাদের মতো আজ দীপ্ত কণ্ঠে বলে উঠি—‘জয় বাংলা’!

মুক্তিযুদ্ধে অস্র হাতে যুদ্ধের পাশাপাশি নানা শ্রেণি-পেশার পালন করেছিলেন বিরাট ভূমিকা। সেদিন শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীরা অন্তরের দরদ ঢেলে শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের যে সাহস জুগিয়েছিলেন তা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তেমন গুরুত্ব পায়নি। কিন্তু সেদিনের প্রেক্ষাপটে শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীদের ভূমিকা ও অবদানকে কোনো মতে উপেক্ষা করা যায় না। তাদের ভূমিকা সম্পর্কে পত্র-পত্রিকায় কমই লেখালেখি হয়েছে। এজন্য তা বিদ্বৎসমাজের আলোচনায়ও তেমন ওঠে আসেনি। কিন্তু জনসমাজের স্মৃতিসত্তায় তা আজও জাগরূক আছে। শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীদের ভূমিকায় অসহায় মানুষ যে সেদিন ভরসা পেয়েছিলেন, মুক্তিযোদ্ধারা পেয়েছিলেন বিপুল উদ্দীপনা নানাজনের স্মৃতিচারণায় এর সাক্ষ্য মেলে। আজ তাই গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি তাদের, যারা জাতির দুর্দিনে সংস্কৃতির অমিয়ধারায় উজ্জীবিত করেছিলেন মানুষকে, জাগিয়ে তুলেছিলেন মুক্তির তৃষ্ণা, ছড়িয়ে দিয়েছিলেন মুক্তির বারতা।


মামুন সিদ্দিকী প্রাবন্ধিক ও গবেষক। ইতিহাসচর্চায় অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ লাভ করেছেন কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার (২০১৭), জাতীয় অধ্যাপক সালাহউদ্দীন আহমদ পুরস্কার (২০১৮), বারিস্টার আবদুল রসুল স্মৃতিপদক (২০১৭), বিনয় সাহিত্য সংসদ সম্মাননা (২০১৬)। কর্মজীবনে বাংলা একাডেমির কর্মকর্তা।

menu
menu