আমেরিকায় অভিবাসী বাংলাদেশিদের শিল্পকলা চর্চা 

নিউইয়র্কে বসবাসের শুরুতে নিয়মিত কাজে ঢুকে পড়ার আগের সময়টুকু মুক্ত ছিলাম। কিছুদিন বইয়ের দোকানে ও মিউজিয়ামে ঘোরাঘুরি হলো; বিশ্ববিখ্যাত শিল্পকর্ম দেখতে দেখতে আনন্দও হলো বেশ! বাংলাদেশে থাকা কালে বইপুস্তকের পাতায় যেসব শিল্পকর্মের ছবি দেখে সন্তুষ্ট থাকতে হতো তেমন অনেক মূল শিল্পকর্ম দেখার সুযোগ পাওয়া গেল। সেই সূত্রেই কিছুটা খোঁজ পাওয়া গেল আমেরিকার অধুনাতম শিল্পীদের কর্মভুবনেরও। অনুভূত হলো, এখানে যে-মাত্রায় শিল্পচর্চা চলে তার পরিসর যেমন অনেক বড়; মাত্রাও তেমনি বহুবিচিত্র।  আমাদের শিল্পীদের পক্ষে সম্ভব নিজেদের স্বাতন্ত্র্য নিয়েও ওই বৈচিত্র্যের অংশ হওয়া। কিন্তু আমাদের জনসমাজের সক্রিয় শিল্পীদের এসবের ঠিকুজি জেনে নেয়ার  প্রয়াস এখনো খুব একটা দেখা যায় না। অথচ আমাদের শিল্পীদের কাজের নিজস্বতা তথা ভিন্নতা নিয়েও এই বৃহত্তর ভুবনের অংশ হওয়া অবাস্তব বিষয় নয়। কিন্তু বাংলাদেশি জনসমাজের শিল্পীদের মধ্যে সে বিষয়ে সচেতনতা ও উদ্যমের অভাব রয়েছে। আমাদের জনসমাজের শিল্পীদের কাজ প্রাপ্য গুরুত্ব না পাওয়ার কারণ কার্যকর ও বাস্তবানুগ পদক্ষেপ নিতে পারার ব্যর্থতা। বছর চারেকের বেশি সময় পরিসরে বাংলাদেশি শিল্পীদের কয়েকটি প্রদর্শনী দেখার এবং কয়েকটি প্রদর্শনী সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়েছে। সেই সূত্রে এবং বাংলাদেশি জনসমাজের সাংস্কৃতিকতার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত থাকার কারণে সুযোগ হয়েছে অভিবাসী বাংলাদেশি শিল্পীদের সম্পর্কেও কিছুটা জানবার; সম্ভব হয়েছে নিউইয়র্ক ও আশেপাশে অনুষ্ঠিত অভিবাসী ও অ-অভিবাসী বাংলাদেশি শিল্পীদের শিল্পকলার প্রদর্শনী দেখা এবং শিল্পী ও শিল্পরসিকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা । এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই বাংলাদেশিদের শিল্পকলা ও তার শিল্পী সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ এই রচনায় তুলে ধরার চেষ্টা হলো

নিউইয়র্কে আসার পর পরই, ২০১৭ সালের ২৮ জুলাই থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত অনুষ্ঠিত, ম্যানহাটানের চেলসি আর্ট ডিস্ট্রিক্টের আর্ট গ্যালারি রগ স্পেসে বাংলাদেশের নারী শিল্পীদের একটা প্রদর্শনী দেখতে গিয়েছিলাম। ‘বাংলাদেশের নারী শিল্পীদের চিত্র প্রদর্শনী’ নামে বাংলাদেশের ও আমেরিকায় অভিবাসী ১৮ জন বাংলাদেশি নারী শিল্পীর ওই প্রদর্শনীর আয়োজক ছিল বাংলাদেশের কনসুলেট জেনারেল। এই আয়োজনে সহযোগিতা করে ঢাকার ‘গ্যালারি ২১’, নিউইয়র্কের ‘দ্য নিউ ইয়র্ক আর্ট কানেকশন’। এতে স্থান পায় বাংলাদেশের শিল্পী শামীম সুবরানা, কনকচাঁপা চাকমা, রোকেয়া সুলতানা, ফরিদা জামান, গুলশান হোসেন, নাজিয়া আন্দালিব প্রিমা, দিলরুবা লতিফ রোজি, বিপাশা হায়াত, আফরোজা জামিল কঙ্কা এবং সামিনা নাফিজ। অভিবাসী যেসব শিল্পীদের কাজ প্রদর্শিত হয়েছে তাঁরা হলেন, শামীম বেগম, জেবুন্নেছা কামাল, সালমা কানিজ, মাসুদা কাজী, হালিদে সালাম, শামীম আরা, কানিজ হোসনে আকবরী এবং সাজেদা সুলতানা। প্রদর্শিত হয় মোট ৩০টি ছবি। 

এই প্রদর্শনীটিতে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন নিউইয়র্কস্থ বিভিন্ন দেশের কনসাল জেনারেল সহ কূটনীতিকবৃন্দ এবং বাংলাদেশি জনসমাজের সুধীবৃন্দ। আয়োজকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি ইতিবাচক ধারণা তৈরির লক্ষ্যে কনসুলেট জেনারেলের কূটনীতি কার্যক্রমের অংশ হিসেবে এই প্রদর্শনীর আয়োজন হয়। দূর বিদেশে নিউইয়র্কের মতো মহানগরীতে এই রকম একটা আয়োজনের গুরুত্বও অস্বীকার করা যায় না! কিন্তু কয়েক বছর পরে ফিরে তাকালে প্রশ্ন জাগে মনে, এ রকম আয়োজনের পেছনে যে পরিমাণ বিনিয়োগ হয় সে তুলনায় ফল মেলে কতটুকু? বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে কূটনীতিকেরা ছবির ক্রেতা হিসেবে উল্লেখযোগ্য হতে পারেন। সেজন্য ঢাকার কোনো গ্যালারিতে আয়োজিত চিত্র প্রদর্শনীতে বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের আমন্ত্রণ জানানোর একটা তাৎপর্য থাকতে পারে। কিন্তু নিউইয়র্কের মতো বড় শিল্প বাজারের মহানগরীতে এত ছোট পরিসরকে লক্ষ্য হিসেবে ধরলে আমাদের জনসমাজের অভিবাসী শিল্পীদের কাজের কতটুকু মূল্য পাওয়া সম্ভব তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।

আরেকটি প্রদর্শনীর কথা মনে পড়ছে। সেই প্রদর্শনীটির তাৎপর্য অবশ্য ভিন্ন। শিল্পোৎকর্ষের নিদর্শন হাজির করা মূলত এর লক্ষ্য নয়, এর লক্ষ্য বাঙালি-সাংস্কৃতিকতার উপস্থাপন। বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি-আকাঙ্ক্ষার উজ্জীবনী ধারক অনুষঙ্গের প্রয়োগের মাধ্যমে বাঙালির উৎসচেতনার সঙ্গে অভিবাসী সত্তার মেলবন্ধন ঘটানো এই আয়োজনের উদ্দেশ্য। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০১৯ সালের ১৮ জানুয়ারিতে আয়োজিত প্রদর্শনীটি দেখার সুযোগ হয়েছিল। বাংলাদেশের ও অভিবাসী বাংলাদশি শিল্পীদের ২৫টি শিল্পকর্ম স্থান পায় প্রদর্শনীতে। ‘সত্তার খনন’ নামে প্রদর্শনীটিতে ২২ জন শিল্পীর ২৫টি শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হয়। এতে স্থান পায় মতলুব আলী, খুরশিদ আলম সেলিম, শামীম বেগম, কাজী রকিব, নাজমা চৌধুরী, জামাল আহমেদ, মুস্তাফা খালিদ পলাশ, মাসুদা কাজী, নাজিব তারেক, কাজী ইকবাল টুলু, জেমরিনা বিনতে আলী, মিথুন আহমেদ, সৈয়দ আজিজুর রহমান তারিফ, টিপু আলম, শুভা রহমান, আফজাল হোসেন, এমডি টোকন, মাহফিল আলী, লায়লা ফারজানা, ফারজানা আফরোজ বাপ্পী, আখতার আহমেদ রাশা, আলমা ফেরদৌসী লিয়া। প্রদর্শনীটি কিউরেট করেন মিথুন আহমেদ। 

এই প্রদর্শনীটি বাঙালিদের দেশপ্রেমের অনুভূতির প্রকাশ। এই প্রদর্শনীর ছবিগুলো বিক্রির উদ্দেশে উপস্থাপিত হয়নি। অভিবাসী জনসমাজের এতে অংশগ্রহণ প্রধানত আবেগের ব্যাপার। তবে এ কথাও ঠিক, বাংলাদেশ থেকে অভিবাসী হয়ে আসা শিল্পীদের অভিবাসী জীবনের সংগ্রামে উৎসদেশের আবেগ অনুভূতির সক্রিয়তা তাদের স্বাতন্ত্র্যের সবল উৎস হয়ে থাকবে। সেদিক থেকে ‘সত্তার খনন’ প্রদর্শনীটিকে মূল্য দিতে হবে। 

২০১৯ সালের আরেকটা প্রদর্শনীর কথা বলা যায়। নিউইয়র্কের কুইন্স বরোর রুজভেল্ট অ্যাভিনিউতে অবস্থিত ছোট্ট ‘গ্যালারি নোঙর’-এ অনুষ্ঠিত হয় অভিবাসী বাংলাদেশি শিল্পী কে সি মংয়ের ৪০টি ছবির একক প্রদর্শনী। ২০১৯ সালের ২৬ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত সে প্রদর্শনীতে তেলরঙ, অ্যাক্রিলিক, জলরং, পেন্সিল স্কেচ ও ড্রইং স্থান পায়। এর আগে ২০১৫ সালে মুক্তধারার নিউইয়র্ক বাংলা বইমেলায় এই শিল্পীর প্রথম একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বাংলাদেশের ধরনে আয়োজিত নোঙর গ্যালারির এই প্রদর্শনীটিকে এক অর্থে সফল বলা যেতে পারে। কারণ বাংলাদেশি জনসমাজের মানুষই ছিলেন ওই প্রদর্শনীর ছবিগুলোর দর্শক ক্রেতা। মাঝে মাঝে এমন প্রদর্শনী যে অভিবাসী শিল্পীদের অনুপ্রাণিত করবে তাতে সন্দেহ নেই। তবে এই ধরনের প্রদর্শনী শিল্পীসত্তার উৎকর্ষে ভূমিকা রাখতে পারে কমই। কারণ প্রকৃত শিল্পরসিকেরা এতে যথেষ্ট সমাদর পাবেন না এই ধরনের অভিবাসী শিল্পীদের কাজের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ না হওয়ায়। আমেরিকার শিল্পবাজারে শিল্পকর্ম উপস্থাপনের যে সংস্কৃতি রয়েছে তার সঙ্গে সমন্বিত পর্যালোচনার দিকে   

নিউইয়র্কের ম্যানহাটানের চেলসি এলাকার সুন্দরম টেগোর গ্যালারি যুক্তরাষ্ট্রের ভারতীয়দের দ্বারা পরিচালিত মূলধারার একটি চিত্রশালা। ২০১৯ সালের ২ মে থেকে ১ জুন পর্যন্ত বাংলাদেশের শিল্পী তৈয়বা বেগম লিপির একক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী হয় সেখানে। নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত প্রদর্শনীটির আগেই এই শিল্পীর কয়েকটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের একক ও যৌথ প্রদর্শনী হয়েছে নিউদিল্লি, ইস্তাম্বুল ও লন্ডনে। তাঁর কাজের মাধ্যম চিত্রকলা, মুদ্রণমাধ্যম, স্থাপনাকলা এবং ভিডিও। তাঁর কাজে নারীত্ব বিশেষ তাৎপর্য পায়। বিশেষ রূপ পায় রাজনৈতিক ও জেন্ডার সম্পর্কিত সন্ত্রাস!  

২০০০ সালে ডাবলিনের ‘আইরিশ মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টে’র ‘আর্টিস্ট ইন রেসিডেন্ট’ হন তিনি। এ ছাড়া ২০০৩ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশিয়ান আর্ট বিয়্যেনালে গ্র্যান্ড প্রাইজ জমা হয় তাঁর ঝুলিতে। জাকার্তা আর্ট বিয়্যেনাল, কলম্বো আর্ট বিয়্যেনাল ও ঢাকা আর্ট সামিটে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে তাঁর।  ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত ভেনিস বিয়্যেনালে বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নের কমিশনার থাকার সূত্রে আন্তর্জাতিক পরিসরে তাঁর পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে। ২০১২ সালের কলম্বো বিয়েন্যালও তাঁর কাজ স্থান পায়। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার, ২০১২ সালে নিউইয়র্কের গুগেনহেইম মিউজিয়ামে সমকালীন দক্ষিণ এশীয় শিল্পকর্ম প্রদর্শনীতেও তাঁর কাজ স্থান লাভ করে।

নিউইয়র্কে আসার অনেক আগে, বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রদর্শনীতে তাঁর শিল্পকর্ম দেখার সুযোগ হয় আমার। ২০১৫ সালে  ওর কাজ দেখেছিলাম ঢাকার গুলশানের বেঙ্গল আর্ট লাউঞ্জে। ব্লেড দিয়ে তৈরি স্বতন্ত্র ব্যঞ্জনার কাজ দেখে মুগ্ধ হয়ছিলাম। ‘নো ওয়ান হোম’ নামের প্রদর্শনীটিতে স্থান পেয়েছিল ‘মেয়েদের জুতা’, ‘বুট’,‘হাইহিল’, ‘সেলাই মেশিন’, ‘ট্রড মিল’, ‘মেয়েদের অন্তর্বাস’, ‘প্যারাম্বুলেটর’ ইত্যাদি। ওই প্রদর্শনীর কাজগুলো স্মৃতিতে ছাপ রেখে যায়।  নিউইয়র্কে এসে জানলাম ওই ধারারই একটি কাজ ‘লাভ বেড’ গুগেনহেইম মিউজিয়ামে সংগৃহীত হয়েছে। গুগেনহেইমের ওয়েবসাইটে ‘লাভবেডে’র ছবি দেখে মনে হলো এই কাজটিও আমার কোথাও দেখা! এ ছাড়াও ম্যাসাচুসেটসের নর্দাম্পটনে অবস্থিত স্মিথ কলেজ মিউজিয়াম অব আর্ট-এ, ডেনমার্কে LOFTF কাউন্সিলে, সিডনির শারম্যান কনটেম্পরারি আর্ট ফাউন্ডেশনে, ঢাকার বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর গ্যালারি ও বেঙ্গল গ্যালারিতে, নিউদিল্লির ফ্লাডলাইট ফাউন্ডেশন গ্যালারিতে, মুম্বাইয়ের জেএসডব্লিউ ফাউন্ডেশন এবং হারমনি আর্ট ফাউন্ডেশনে তাঁর শিল্পকর্ম সংগৃহীত হয়েছে।  নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত তৈয়বা বেগম লিপির প্রদর্শনীটির তাৎপর্য এখানে যে তা অনুষ্ঠিত হয়েছে এখানকার মূলধারার একটি আর্ট গ্যালারিতে। কূটনীতিক তৎপরতা হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পরিচিত শিল্পী লিপির কাজকে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের মধ্যে পরিচিত করিয়ে দেয়ার গুরুত্ব নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু তার চেয়ে বেশি গুরুত্বের হতো এখানকার শিল্পভুবনের সঙ্গে শিল্পীদের কার্যকর সংযোগ ঘটিয়ে দেয়া! আজ যে তৈয়বা বেগম লিপির কাজের সুখ্যাতি বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে তা তো বিশিষ্ট গ্যালারিগুলোর সঙ্গে তার কাজের তৎপর্যপূর্ণ সংযোগের কারণেই!

বাংলাদেশের শিল্পী-প্রতিনিধি হিসেবে এই প্রদর্শনীটি যে মানের গ্যালারিতে আয়োজিত হয়েছে ন্যূনপক্ষে তেমন গ্যালারিতে আয়োজন করা দরকার অভিবাসী শিল্পীদেরও প্রদর্শনীর। কারণ শিল্প-সংযোগের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয় ভালো গ্যালারিরই সূত্রে। এ ধরনের সম্ভাবনাকে কার্যকর করতে হলে শিল্পীদের পাশাপাশি আর্ট কিউরেট করার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেয়া দরকার। কারণ আমেরিকার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের কেবল শেখায়ই না, তাদের সামনে এ সংক্রান্ত নানা জনসংযোগেরও দুয়ার খুলে দেয়। বাংলাদেশ থেকে আসা শিল্পীদের এখানকার বাস্তবতা বিবেচনা করতে হবে। শিল্পকলা ব্যবসায়ী হওয়ার লক্ষ্য নিয়েও এগিয়ে আসতে হবে কাউকে কাউকে। বাংলাদেশি শিল্পীদের বিশিষ্টতা কী তা এখানকার শিল্পরসিকদের জানা থাকার কথা নয়। ভালো কিউরেটরেরাই পারেন বিশাল শিল্পবাজারে বাংলাদেশের শিল্পীদের কাজকে পরিচয় করিয়ে দিতে। এখানকার প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চ শিক্ষাই পারে আমেরিকার শিল্পকলার বাজারে শিল্পীদের প্রবেশের পথ চিনিয়ে দিতে। বাংলাদেশিদের মধ্যে যাঁরা একটু ভালো ভাবে আমেরিকার শিল্প অঙ্গনের খবর রাখেন তাঁরা জানে এই ক্ষেত্রে ফ্রিল্যান্সিংয়েরও সুযোগ আছে। কিন্তু এর জন্য নিতে হবে ধৈর্য সহকারে সাধারণ দূরলক্ষ্যী সংস্কৃতি চর্চার প্রয়াস। কাজটা কঠিন হলেও অসম্ভব নয় মোটেও। ফল পেতে হলে আগে কাজ তো শুরু করতে হবে! 

২ ও ৩ অক্টোবর ২০২১-এ জ্যাকসন হাইটসের প্রাইমাভেরা গ্যালারিতে শিল্পী টিপু আলমের ‘এক বক্স কার্টুন’ শীর্ষক কার্টুন প্রদর্শনী হয়। টিপু আলম নিউইয়র্কে বাস করছেন বেশ কয়েক বছর হলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএফএ করে আসা এই শিল্পী সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক থেকে শিল্পকলা বিষয়ে স্নাতকোত্তরও করেছেন। দীর্ঘ কালের বসবাস সূত্রে এখানকার বাংলাদেশি জনসমাজের বৈশিষ্ট্য ও ব্যক্তি মনস্তত্ত্বের ধরন ধারণ ভালোভাবে জানেন বলে তাঁর কার্টুন বাংলাদেশ ভিত্তিক কার্টুনের তুলনায় ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। এখানে লেখাপড়া করার সূত্রেই হয়তো টিপু আলম এখানকার শিল্পীদের জীবন যাপনের বাস্তবতাও জানেন। ফলে ‘নিউইয়র্ক সিটি আর্টিস্ট কর্পসে’র বৃত্তি সংগ্রহ করতে পেরেছেন। 

নিউইয়র্কের মতো শিল্পবান্ধব মহানগরীতে বা এর আশেপাশে যে অভিবাসী বাংলাদেশি শিল্পীরা বসবাস করেন তাঁদের  কিছুটা আয়াস যুক্ত হলেই তাঁরা এর থেকে ফল তুলে নিতে পারবেন। শিল্পসাধনার যে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল এখানে বিরাজিত তার সঙ্গে কেবল সমন্বিত করে তুলতে হবে বাংলাদেশি-আমেরিকান শিল্পীদের; শুধু নিজেদের জনসমাজের বৃত্তে আটকে থাকলে চর্চার ধারা বেগবান হয়ে উঠতে পারবে না! 

নিউজার্সিতে বসবাসরত আখতার আহমেদ রাশার ফেলনা কাঠের ভাস্কর্য প্রদর্শনী ‘অগ্রজ সান্নিধ্যে শিল্পসন্ধ্যা’ দেখার সুযোগ হয় ৭ নভেম্বর ২০২১। এর আগেও এই শিল্পীর দুটি প্রদর্শনী দেখেছি যথাক্রমে ২০১৭ ও ২০২০ সালে। এই শিল্পীও মূলত আমাদের জনসমাজকেই তাঁর লক্ষ্যভোক্তা মনে করেছেন। তবে তিনি অন্যান্য আর্ট নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযুক্ত হতে চেষ্টা করছেন; আশা করা যায় একসময় তাঁর শিল্পকর্মকে এখানকার শিল্পকলার বৃহত্তর ভুবনে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হবেন।

সম্প্রতি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে কানাডায় বাংলাদেশি শিল্পীদের একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে ওখানকার স্থানীয় শিল্পরসিকদের লক্ষ্য করে। একজন কিউরেটর পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজটি করার প্রয়াস পেয়েছেন। বাংলাদেশের শিল্প-প্রধান শিল্পীদের কাজ এখানে প্রদর্শিত হচ্ছে যাতে বাংলাদেশের শিল্পকলার বৈশিষ্ট্যকে কানাডার শিল্পরসিকেরা যেন অনুধাবন করতে পারেন। এই প্রদর্শনীতে উত্তর-আমেরিকার অভিবাসীদেরও কোনো কোনো শিল্পীর কাজ রাখা হয়েছে। বাংলাদেশি শিল্পীদের পক্ষে এ ধরনের প্রয়াসকে এক রকম যাত্রা শুরু বলা যেতে পারে। বলা যেতে পারে এ রকম উদ্যোগ নেয়ার মতো পরিস্থিতিও এখানে বিরাজ করছে।


আহমাদ মাযহার প্রাবন্ধিক, গবেষক, শিশুসাহিত্যিক, অনুবাদক ও সম্পাদক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর। মৌলিক রচনাসহ অনূদিত সম্পাদিত বইয়ের সংখ্যা ষাটের অধিক। বইয়ের জগৎ নামে বই-সমালোচনা বিষয়ক ত্রৈমাসিক সম্পাদনা করেছেন। তিনি বর্তমানে আমেরিকায় বসবাস করেন। 

menu
menu