সেলিম আল দীনের ‘কেরামতমঙ্গল’ প্রান্তিকজনের নরক-পরিক্রমা

বাংলাদেশের নাটকের ইতিহাসে অসামান্য প্রতিভাবান নাট্যকার সেলিম আল দীন (১৯৪৯-২০০৮) আজীবন নাট্যচর্চা করেছেন। তিনি একক সৃজন-প্রতিভায় বাংলা নাটকে একটি নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন। তিনি মনে-মননে নাট্যজন এবং নাট্য-গবেষক; নাটকের অধ্যাপক। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যতত্ত্ব বিভাগে নিষ্ঠার সঙ্গে অধ্যাপনা করেছেন এবং বাংলা নাটকের বিষয়-আঙ্গিক তথা নাট্যশরীর নির্মাণে নতুন নতুন রীতিপদ্ধতি আবিষ্কারে সচেষ্ট থেকেছেন। প্রচলিত নাট্যাঙ্গিক ভেঙে সেলিম আল দীন বাংলা নাটকের একটি নিজস্ব ভুবন তৈরি করেছেন। একই সঙ্গে তাঁর নাটকে উপস্থাপিত জীবনচিত্রও প্রচলিত নাট্যধারণা থেকে পৃথক। তিনি নিবিড় পর্যবেক্ষণের দ্বারা বাংলার প্রাচীন জনপদ এবং আদি সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য নাট্যসাহিত্যে উপস্থাপনে সচেষ্ট থেকেছেন। তাঁর নাট্যচেতনার উৎস বাঙালি সমাজ ও বাংলার প্রাচীন জনপদ। তিনি নাটকে বাঙালি সমাজের শেকড় সন্ধান করেন। ‘তিনি বাঙালি সমাজের শেকড়ের সাথে গবেষণা’ করতে গিয়ে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত হন। এ সময় তিনি মধ্যযুগে বাঙালি সংস্কৃতির অবস্থা এবং প্রাচীন বাংলার ইতিহাস ঐতিহ্যের নানা অনুষঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে বাংলা জনপদের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ। তাঁর শৈশব-কৈশোর কেটেছে উপকূল ঘেঁষা মানুষের সাথে। ফলে তাঁর জীবনাভিজ্ঞতায় সঞ্চিত হয়েছে—বাংলা জনপদের উপকূলীয় প্রান্তিক মানুষের যাপিত জীবনের ঋদ্ধ সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও জীবনবোধ। তিনি গ্রামবাংলার প্রান্তিক মানুষের সমাজজীবন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে উপলব্ধি করেন যে গ্রামীণ মানুষের জীবনাচরণের মধ্যে আছে যেমন স্বাতন্ত্র্য তেমনি এতে নিহিত আছে নাটকীয় উপাদান। তিনি বাঙালি সমাজের এই নাট্যউপাদানকে গভীর নিষ্ঠায় আবিষ্কার করেন এবং তা নিজস্ব কৌশলে রঙ্গমঞ্চে উপস্থাপন করে বাংলা নাটকে এক নতুন যুগের সূচনা করেন। তিনি একান্ত নিষ্ঠায় প্রান্তিক মানুষের নিত্যকার জীবনকথা ও সমাজবাস্তবতা নাটকের বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেছেন। বাংলা নাটকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনাচরণ অবিকল উপস্থাপন করে সেলিম আল দীন একাধারে স্বীয় স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় যেমন দিয়েছেন, তেমনি বাংলা নাট্যসাহিত্যকেও সমৃদ্ধ করেছেন।

বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে সেলিম আল দীন অসামান্য প্রতিভাবান, স্বতন্ত্র ও বৈচিত্র্য-পিয়াসী নাট্যকার। তিনি মনেপ্রাণে নাটকে সমর্পিত আপাদমস্তক নাট্যকার ও নাট্যগবেষক ছিলেন। বাংলা নাটকের নিজস্ব রীতি-প্রকরণ আবিষ্কারে আমৃত্যু সচেষ্ট ছিলেন নাট্যকার সেলিম আল দীন। তিনি নাটকের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন গ্রামবাংলার অতিসাধারণ মানুষের যাপিত জীবনের হাসি-কান্না মিশ্রিত বাস্তবতা। তিনি নাটকের গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন প্রান্তিক মানুষ, তাদের জীবন ও সমাজভাবনার সঙ্গে। তাঁর ‘কেরামতমঙ্গল’ নাটকে মহাকাব্যিক প্রেক্ষাপটে গ্রামবাংলা চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। এ নাটকে তিনি বাংলাদেশের ভৌগোলিক ভিন্নতায় বিভিন্ন সমাজ-গোষ্ঠীর যাপিত জীবনের বিচিত্র ক্যানভাস এঁকেছেন। এ নাটকের নায়ক কেরামতের নরক-পরিক্রমার সঙ্গে সঙ্গে নাট্যকার সেলিম আল দীনও যে স্বীয় জীবনদর্শন নিয়ে গ্রামবাংলার মানুষের বিচিত্র জীবনযাপন প্রত্যক্ষ করেছেন। বলাবাহুল্য কেরামতমঙ্গল সেলিম আল দীনের রচিত নিজস্ব নাট্যধারার সর্বাধিক উজ্জ্বল ও উল্লেখযোগ্য নাটক।

কেরামতমঙ্গল প্রসঙ্গ :
সেলিম আল দীন রচিত কেরামতমঙ্গল (১৯৮৮) মহাকাব্যিক আয়োজনের নাটক। মহাকাব্যের মতোই কেরামতমঙ্গল-এর কাহিনির বিস্তার স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল ব্যাপী। নাট্যকাহিনীর নামকরণ সেলিম আল দীন সচেতনভাবে বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের মঙ্গল কাব্যধারার রীতি অনুসারে করেছেন। কেরামতমঙ্গল-এর কাহিনিতে মহাকাব্যিক আবহে নাট্যকার অনেক চরিত্রের আমদানী করেছেন। এসব চরিত্রের ছোট-খাট সংলাপের মধ্য দিয়ে কাহিনিকে গতিশীল রেখেছেন এবং একটি বিশেষ ঐকতান সৃষ্টি করেছেন। কেরামতমঙ্গল নাটকে এগারটি খণ্ডে আলাদা আলাদা মূল  কাহিনি ও উপকাহিনি আছে, তবে সকল কাহিনির মধ্যে নাট্যকার একক ঐকতান সুকৌশলে সৃষ্টি করেছেন। তাছাড়াও এ নাটকের ঘটনা ও কালগত ঐক্য রক্ষিত হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন স্থান, সময় ও কাহিনির মধ্যেও যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে নাট্যকার ঐক্য সাধন করেছেন।

ভারতবর্ষের বিভাজনের অল্পকাল পূর্ব থেকে আরম্ভ করে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং দিকভ্রান্ত সমাজচিত্র, স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের প্রথম পর্যায় পর্যন্ত সময় কেরামতমঙ্গল-এর কাহিনির বিরাট পটভূমি। বাংলা জনপদের বিভিন্ন অঞ্চলের এবং বাঙালি জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন সম্প্রদায় ও নানা জাতের মানুষের সুখ-দুঃখের ঘটনা কেরামতমঙ্গল -এর কাহিনিবৃত্তে স্থান লাভ করেছে। বিশাল কাহিনিতে সমগ্র বাংলাদেশই  যেন উঠে এসেছে একটি অখণ্ড মূর্তিতে। ‘কেরামতমঙ্গল-এর কাহিনিতে হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান, আদিবাসী হাজং-গারো, জমিদার-প্রজা, মুক্তিযোদ্ধা-রাজাকার, রাজনীতিবিদ-কৃষক-মাঝি থেকে শুরু করে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের চালচিত্র নাট্যঘটনায় উপস্থাপিত হয়েছে’। কেরামত এই মহাকাব্যিক কাহিনির কথক। কেরামত বাংলা-জনপদের অতীত ও বর্তমান মানচিত্রের ওপর দিয়ে হেঁটে চলা এক পথিক। নাট্যকাহিনিতে কেরামতের কখনো সক্রিয় অংশ থাকলেও প্রকৃতপক্ষে চরিত্রটিকে নাট্যকার দর্শক বা একজন পান্থ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। কেরামত সম্পর্কে সমালোচক জানিয়েছেন :

এক জীবন এক মানুষ। আপন গৃহ, আপন মানুষ, প্রাত্যহিক মুখগুলো পেছনে ফেলে চলে যেতে যেতে কেরামত আর এক জীবন এক মানুষ থাকে না। স্বার্থবাদী মানুষের ছড়ানো সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প আর জ্ঞাতিদের ষড়যন্ত্র কেরামতকে ঘরছাড়া করে। তারপর থেকে গৃহহীনতাই হয়েছে তার গৃহ। তাকে দেখা গেছে হাজংদের আন্দোলনে, জেলখানার ছোট্ট খুপরীতে, আবার হাজতসঙ্গী গ্রাম্য ডাক্তারের সহকারীও হতে দেখা গেছে তাকে। ... এ নাট্যে কেরামতের আকুতি শমলার ভ্রূণের নিরাপত্তা বিধানের কথা বলে।

বাংলাদেশ নামক একটি রঙ্গমঞ্চের অতীত ও বর্তমানের অভিনীত কাহিনীর দর্শক কেরামত। কেরামত পথের দু’ধারের দৃশ্য দেখে চলেছে অবিরাম। তার দেখা এ জনপদের ইতিবৃত্ত সেলিম আল দীন মোট এগারোটি খণ্ডে দৃশ্যমান করে তুলেছেন। ‘নাটকের প্রতিটি খণ্ডে যে জীবনচিত্র উপস্থাপিত হয়েছে তা প্রতীকী অর্থে দোজখ’ সদৃশ। সমালোচকের ভাষায় : ‘পান্থজন কেরামতের চোখ দেখে ক্লিষ্ট ক্রুর জীবন দোজখ একের পর এক। এ জীবনের শেষ কোথায়? কোথায় সত্য? মানুষের মঙ্গল নিহিত রয়েছে কোথায়? এগারো গণ্ডী, এগারোটি দোজখ অতিক্রম করে সে।’ কেরামত যেন এই দোজখ সদৃশ্য রঙ্গমঞ্চ অতিক্রম করে চলেছে স্বর্গের সন্ধানে। কেরামতমঙ্গল নাটকে প্রতিটি খণ্ডকে এক একটি দোজখের প্রতীকে প্রকাশ করেছেন নাট্যকার। নাটকের এগারো খণ্ডে সেলিম আল দীন এগারোটি প্রতীকী দোজখ বা নরকের চিত্র উপস্থাপন করেছেন। কেরামতমঙ্গল নাটকের প্রতিটি খণ্ড ও তার প্রতীকী নরকের নাম এরকম :

নখল খণ্ড : সম্প্রদায়িকতার নরক; চন্দ্রকোনা খণ্ড : উদ্বাস্তু তথা উন্মূল মানুষের নরক; ফইট্যামারি খণ্ড : সামন্তবাদের সামাজিক নরক; হিজড়া খণ্ড : প্রাকৃতিক বঞ্চনার নরক; হাজং খণ্ড : প্রতিবাদী মানুষের নরক; হাজত খণ্ড : জাগতিক নরক; চিগাস্থান খণ্ড : মিশনারীদের নরক; রাজাকার খণ্ড : মৌলবাদের নরক; জলসুখা লঞ্চঘাট ও বিবাহ খণ্ড : নিরুপায় মানুষের নিরাশার দোজখ; কুসুমপুর খণ্ড : রাষ্ট্রীয় জীবনে স্বাধীনতার নরক; চানতারা খণ্ড : নির্মম নিয়তির নরক।

মূলত বাংলাদেশ এবং বাঙালি সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনব্যাপী অত্যাচার-নির্যাতনের যে ঐতিহাসিক পরিক্রমা চলেছে, তাই সেলিম আল দীন প্রত্যক্ষ দ্রষ্টা কেরামত চরিত্রের সহায়তায় পাঠকের সামনে হাজির করেছেন ‘কেরামতমঙ্গল’ নাট্যঘটনায়।

কেরামতমঙ্গল -এর নরক পরিক্রমা
সেলিম আল দীন কেরামতমঙ্গল নাটকের এগারোটি খণ্ডে মূলত গ্রামবাংলার  প্রান্তিক মানুষের নরক সদৃশ জীবনচিত্র তুলে ধরেছেন, যে জীবনের দর্শক নাটকের কথক কেরামত। এ নাটকের কেরামত চরিত্রে নাট্যকারের ব্যক্তিগত জীবনের ছায়া পড়েছে। কেরামতমঙ্গল-এ ভ্রূণহত্যা এবং রক্ষার মধ্য দিয়ে যে মানবিকতার প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে তার সঙ্গে নাট্যকারের ব্যক্তিগত জীবন জড়িত। শিমূল ও পারুলের অসফল মাতৃত্বকে সেলিম আল দীন শিল্পের অবয়বে ধরতে চেয়েছেন। তাঁর নিজের কথায় :

... আমার ও নাসিরউদ্দিন ইউসুফের পারিবারিক জীবনে দুটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে যায়। পারুলের প্রথম সন্তান ভ্রূণের অধিক মনুষ্যরূপে জন্মগ্রহণ করে মৃত্যুতে সমর্পিত হয়। তার কিছুদিন পর শিমূল ইউসুফের অকাল গর্ভপাত ঘটে।
কিত্তনখোলা লেখার আগে এই দুটি ঘটনা ঘটেছিলো। কিন্তু আমার দেহমনে কিত্তনখোলা এমন একটি সুরমূর্চ্ছনা তৈরি করেছিলো যে— আমি শিমূল ও পারুলের অসফল মাতৃত্বের বেদনার দুটি গহ্বর লাফিয়ে পার হয়ে গিয়েছিলাম। সহসা একদিন কোনো এক অচিহ্নিত দিনে মনে হলো আমাদের এই পারিবারিক বেদনাটুকু আমি কিভাবে দেখছি। ক্রমেই বিমর্ষ হতে থাকি। আমার পিতৃত্বের উপরে অপঘাতের যে অন্ধ আলো এসে পড়লো তার জায়নামাজের উপর ধ্যানমগ্ন হই। ... ভাবি যে নিতান্ত একটা পারিবারিক বেদনাকে—যে আমি অনিবার্যভাবে ডুবন্ত—তার পক্ষে কোনো শিল্প অবয়বে বিন্যাসকরণ সম্ভব কিনা।
আত্মগত বেদনা গান কি কবিতা হয়ে বুকের হাড় পাঁজরে ঝাঁপতাল বাজিয়ে দেয় কিন্তু তাকে কি আত্মবিচ্ছেদনের শিল্পরূপে বিস্তারিত করা যায় না এইরকম ভাবতে ভাবতে গল্পটি ধরা দেয়। আমার নিখিল জুড়ে ভ্রূণ বিনষ্টির হাহাকার শুনি। তখন ভূগোল মানুষ জনপদ প্রকৃতি খগোল নিয়ে বসে যাই।

সেলিম আল দীন তাঁর পারিবারিক বৃত্তে সংঘটিত এই ভ্রূণ বিনষ্টির ঘটনাকে তিনি মহাকাব্যিক আয়োজনে কেরামতমঙ্গল-এ রূপদান করেন। যেখানে তিনি ভ্রূণহত্যা ও রক্ষায় ব্যক্তির নির্মম নিয়তিকে অপরিহার্য করে তুলেছেন। সুতরাং বলা যায় নাট্যকার নিজেই কেরামত চরিত্রের মধ্য দিয়ে গ্রামবাংলার পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছেন, দেখেছেন প্রান্তিক মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ও নরকতুল্য জীবনযাপন এবং শত অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেও কেরামতকে সচেষ্ট রেখেছেন ভ্রূণ রক্ষায়।

নখলা : সাম্প্রদায়িকতার নরক
এ পর্বেই নাট্যকার কথক কেরামতের অতীত বর্ণনা করেছেন। কেরামতের জীবনের সাথে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প জড়িয়ে আছে। হিন্দু-মুসলিম ‘রায়টে’ নখলার নিরন্ন প্রান্তিক মানুষের ঘর-বাড়ি, জমি-জমা বেদখল হয়ে যায়। দাঙ্গায় কেরামতের বাবা-মা মারা যায়। এরপর গ্রামের শক্তিশালী মুসলমান তালুকদার ও হিন্দু মহাজনের কূটচক্রান্তে কেরামত এবং সর্বহারা অধরচন্দ্র স্ব-গ্রাম থেকে উচ্ছেদ হয়। কেরামতের যাত্রা শুরু এই সাম্প্রদায়িকতার দোজখ থেকে। নাট্যকারের এই প্রতীক ১৯৪৭ সালের দেশ-বিভাজনকে ঘিরে। কারণ, ধর্মভিত্তিক ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির ফলে সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ রোপণ করা হয়েছিল। সেলিম আল দীন কেরামতমঙ্গল-এর কাহিনিবৃত্তের বাস্তবতার অন্তরালে রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ এঁকেছেন।

চন্দ্রকোনা : উদ্বাস্তু ও উন্মূল মানুষের নরক
নিজ গ্রাম থেকে বিতাড়িত হয়ে কেরামত আশ্রয় নেয় তার খালার বাড়ি চন্দ্রকোনা গ্রামে। এখান থেকে শুরু হয় কেরামত দর্শকের ভূমিকা। সে দেখে, খালাতো বোন নওশাদ বন্ধ্যাত্বের অভিযোগে স্বামীহারা হয়েছে। কিন্তু পেটের দায়ে তালুকদার বাড়িতে নওশাদী কাজ করতে গিয়ে গর্ভবতী হয়। তার পেটের সন্তান নষ্ট করা দেয়া হয়, গণেশ কবিরাজের ওষুধ দিয়ে। অতঃপর নওশাদী কলঙ্কিনীর অভিযোগ নিয়ে গ্রাম ছাড়া হয়। করমচা গাছের তলায় পুঁতে রাখা অপুষ্ট ভ্রূণটিকে কলাপাতায় মুড়ে নিয়ে আসে কেরামত। ভ্রূণটিকে কেরামত ইসলামী প্রথানুযায়ী কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করলে তালুকদার তার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে তাকেও গ্রাম ছাড়া করে। নিঃস্ব কেরামতের সঙ্গে মুচিপাড়ার সর্বহারা মানুষগুলোকেও উৎখাত করে জোতদার।

ফইট্যামারি : সামন্তবাদের সামাজিক নরক
‘ফইট্যামারি’ দোজখ। এখানে সেলিম আল দীন তুলে ধরেছেন কলকাতা থেকে আসা জমিদার চুন্নু মিয়ার অত্যাচারের ইতিবৃত্ত। জমিদারের আগমন উপলক্ষে খোসাল খান মহল জুড়ে নানা রঙের সাজগোজ দেখতে যায় কেরামত। উৎসুক দৃষ্টিতে কেরামত জমিদার বাড়ির সাজসজ্জা দেখলে গেলে জমিদারের লাঠিয়ালদের সঙ্গে বাদানুবাদের এক পর্যায়ে জমিদারের নির্দেশে সে শারীরিক নির্যাতন শিকার হয়। কেরামতের চোখে-মুখে জমিদারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আগুন। কেরামতের অন্তরে রয়েছে জমিদারদের বিরুদ্ধে ‘দুইশো বছরের ঘৃণা।’ ঘৃণা নিয়ে কেরামত মাঝরাতে ফইট্যামারি গ্রাম ছাড়ে। এসময় ছামেদ জিজ্ঞেস করে—‘কুনু যাবি তুই।’ ছামেদের প্রশ্নের উত্তরে কেরামত জানায়—‘কুত্তার নগে থাকুম, গাছতলায় হুমু। জমিদারে দেহনের শখ আছাল, মিট্যাগেছে।’৭ সামন্তবাদের নির্যাতনের অসামান্য চিত্র ফুটে ওঠে কেরামতের বক্তব্যে। এটি শুধু কেরামতের নিয়তি নয়, এটা মূলত প্রান্তিক জনজীবনের বাস্তবানুগ চিত্র।

হিজড়া : প্রাকৃতিক বঞ্চনার নরক
কেরামতের সঙ্গে অল্পবয়সী এক হিজড়ার সঙ্গে দেখা হয় মাঘ মাসের শীত-রাতে। হিজড়া নিজেকে কেরামতের কাছে মদিনা সুন্দরী হিসেবে পরিচয় দেয়। হিজড়া মদিনার ছলাকলায় কেরামত ভাঙা দালানে দুই টাকার বিনিময়ে তার সঙ্গে যৌনকর্মে লিপ্ত হতে চাইলে সে আবিষ্কার করে, মদিনা প্রকৃতপক্ষে নারী বা পুরুষ নয়। সঙ্গম ব্যর্থ কেরামত হঠাৎ করেই আরেক প্রাকৃতিক অসহায়ের প্রতি গর্জে ওঠে এবং বলে, ‘দুইন্যার সব হুইয়ারের বাচ্চা—সব হুইয়ারের বাচ্চারা আমারে ঠক দিছে।’৮ যৌন-উত্তেজনা প্রশমিত হলে কেরামতের হৃদয় সমব্যথী হয়ে ওঠে হিজড়ার প্রতি। আত্মগ্লানিতে নিজেকে ধিক্কার দেয় কেরামত এবং হিজড়ার সঙ্গে বসবাসের ইচ্ছা পোষণ করে। কিন্তু এরপর প্রকৃতির বিরুদ্ধে রাগে-দুঃখে-ক্ষোভে এবং আত্ম-যন্ত্রণায় নিরুদ্দেশ হয় হিজড়া। তখন সর্বহারা কেরামতের কণ্ঠে প্রাকৃতিক বৈরিতার শিকার মদিনার জন্য মমতাভরা কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসে :

দুকখিত মদিনারে আদর দেও বাবা, আর না অয় দেও, তোমার তারার ফুলকি আগুনে জালায়া দেও ঠকগো ঘর বাড়ী। না অয় দেও আমার এই পাঁচ আঙ্গুলে পাঁচ সইলতা—এত দুখ যে সংসারে হে সংসারে আমি আগুন নাগায়া দেই।১০

প্রকৃতির বিরুদ্ধে যেমন করবার কিছুই নেই মদিনার; তেমনি সামাজিভাবে বঞ্চিত মানুষ কেরামতের ব্যর্থ ক্ষোভ ও আত্মশ্লাঘা ছাড়া কিছুই করবার ক্ষমতা নেই। মদিনা প্রাকৃতিকভাবে অসহায়; তার এই অসহায়ত্ব তাকে সামাজিকভাবে লাঞ্ছিত করেছে। সহ্যের সীমা অতিক্রম করলে আত্ম-মর্যাদা নিয়ে নিঃস্ব মদিনা নিরুদ্দেশ যাত্রা করেছে।

হাজং : প্রতিবাদী মানুষের নরক
কেরামত যেন এক পর্যটকের মতো বঙ্গভূমিব্যাপী ঘুরে বেড়ায়। আর দেখে নানা ঘটনা ও দৃশ্যাদি। কেরামতের গমন পথের সামনে একসময় ভেসে ওঠে নৃগোষ্ঠী হাজংদের বসতি অঞ্চল। এখানে কেরামত আসে মূলত উদ্বাস্তু হয়ে। নাট্যকার সেলিম আল দীন জানিয়েছেন, স্বভূমি থেকে উৎক্ষিপ্ত হয়ে উদ্বাস্তু অবস্থায় এক বঞ্চিত মানুষের বেশে কেরামত হাজং বসতি এলাকায় আসে নতুন করে বসতি স্থাপনের উদ্দেশ্য নিয়ে। সে চেয়েছিল হাজং সম্প্রদায়ের সঙ্গে জঙ্গল পরিষ্কার করে সেখানেই গেরস্থি করতে। কেরামতের এই সদিচ্ছা হাজং সম্প্রদায়ের জানার কথা নয়। তারা তাকে বাঙালি গুপ্তচর সন্দেহে আটক করে এবং বেদম প্রহার করে। অবশ্য হাজং সম্প্রদায় তখন সংগ্রাম করছিল জমিদারের অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে। হাজংরা জমিদারদের বিরুদ্ধে, খাজনার বিরুদ্ধে সর্বোপরি তাদের ওপর শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে উচ্চকিত হয়েছে। অবশ্য হাজং সম্প্রদায়ের সঙ্গে জমিদারের বিরোধের আরেক কারণ হচ্ছে বাঙালিদের প্রতি হাজং সম্প্রদায়ের অবিশ্বাস। কিন্তু এ সময় তাদের ওপর রাষ্ট্রীয় আধিপত্য বজায় রাখতে পুলিশী নির্যাতন শুরু হয়েছিল। পাকিস্তানী পুলিশের অত্যাচারের করুণ বিবরণ শুনে কেরামত অবশেষে নিজেও হাজংদের পক্ষাবলম্বন করে। ভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায় হলেও কেরামত ন্যায়ের পক্ষে সোচ্চার হয় এবং হাজংদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সরকারের নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে কেরামত পুলিশের হাতে বন্দী হয়। এটি মূলত বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মানুষের দোজখ।

হাজত : জাগতিক নরক
হাজং সম্প্রদায়ের সঙ্গে অধিকার আদায়ের আন্দোলনে যোগ দিয়ে কেরামত পুলিশের হাতে ধরা পড়ে এবং বিনা বিচারে জেল হাজতে প্রায় আট বছর কাটায়। হাজতে বসে কেরামত অতীতের স্মৃতিচারণ করে আর মুক্তির জন্য অপেক্ষা করে। হাজতে তার পরিচয় হয়, আজমত ডাক্তারের সঙ্গে। ঘুষ খাওয়ার অপরাধে পুলিশকে পিটিয়ে আজমত হাজত-বাস করছে। তার সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে কেরামতের। আজমত তাকে আশ্বাস দেয়, তারা মুক্তি পেলেই কেরামতকে সে লেখাপড়া শেখাবে, কম্পাউন্ডার বানাবে এবং গারোদের দেশে গিয়ে দু’জন মিলে বসতি গড়ে তুলবে। তারপর একদিন কেরামত ‘হাজতের হাবিয়া দোজখ’ থেকে মুক্তিলাভ করে এবং মুক্তির স্বাদ উপভোগ করার লক্ষ্যে কেরামত রওনা দেয় ময়মনসিংহের দিকে। হাজত খণ্ডের কাহিনি এভাবেই সমাপ্ত হয়েছে।

চিগাস্থান : মিশনারীদের নরক
কেরামত এবারে এসে পৌঁছায় ময়মনসিংহে, এখানে সে ডাক্তার আজমতের কম্পাউন্ডার হিসেবে কাজ শুরু করে। যে অঞ্চলে গারোদের বসতি তার নাম চিগাস্তান। নাট্যকার সেলিম আল দীন এ খণ্ডের কাহিনিতে মূল দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখিয়েছেন প্রাকৃতজনের ধর্ম বিশ্বাসের সঙ্গে ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্মের দ্বন্দ্বকে। এখানে গারোদের সনাতন ধর্মীয় বিশ্বাসকে ধ্বংসের চক্রান্তে লিপ্ত খ্রিস্টান মিশনারীরা। তারা গারো নৃগোষ্ঠীর দারিদ্র্যের সুযোগ গ্রহণ করে তাদেরকে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করার অপচেষ্টায় রত। কিন্তু একদিন এই নিরন্ন মানুষগুলো ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে নব্য খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত আদিবাসীদের ওপর। অন্যদিকে কেরামতকে উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই তাদের দলের লোক বলে প্রচার করে। সর্বহারা কেরামত শৈশব থেকে ধর্মের নিষ্ঠুরতা দেখেছে; ফলে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি দেখে কেরামত ধর্মের প্রতি আরও বিরাগভাজন হয়ে ওঠে। তবে নিঃস্ব কেরামত এক পর্যায়ে প্রাকৃতজনের সাথে নিজের ঐক্য সাধন করে আদিবাসীদেরই পক্ষাবলম্বন করে। গারোদের চিগাস্থানে যখন ধর্ম নিয়ে দ্বন্দ্ব-কলহ চরম আকার ধারণ করেছে, তখন কেরামত একদিন বেতারে শোনে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ঝিনাই নদীর ওপারে অবস্থান নিয়েছে, বঙ্গভূমি জ্বলে উঠেছে মুক্তি জন্য, স্বাধীনতার জন্য। কেরামতও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়, পাকিস্তানীদের শাসন-শোষণ থেকে মুক্তির আশা নিয়ে।

রাজাকার : মৌলবাদের নরক
পাকিস্তানীদের অপশাসন থেকে মুক্তির আশা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে চায়। বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ সর্বহারা কেরামতকে যুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিতে উদ্বুদ্ধু করেছিল। সে নিজের ভেতর শুনতে পায় কামানের গর্জন। সর্বহারা বাঙালির পক্ষে অবস্থান নেয়া কেরামত যুদ্ধের এক পর্যায় রাজাকারদের হাতে বন্দি হয়। কেরামত সবসময় ন্যায়ের পক্ষে এবং অন্যায়ের বিপক্ষে, তাই সে পাকিস্তানী কমান্ডারের নির্দেশ মতো তাদের গুপ্তচর হতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে বন্দি করে রাজকাররা। তার ওপর শারীরিক অত্যাচার-নির্যাতন করে রাজাকার বাহিনী। আবারো শুরু হয় কেরামতের বন্দি জীবন এবং মুক্তির প্রহর গুণে অপেক্ষা করার পালা। প্রান্তিক বাঙালির ওপর পাকিস্তানী শাসক ও শোষকগোষ্ঠীর অমানবিক অত্যাচার-নির্যাতন দৃষ্টে কেরামতের মন যেন আপনা-আপনি গেয়ে ওঠে ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়।’ নিরীহ বাঙালি জাতির ওপর রাজাকার বাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে নাট্যকার এ খণ্ডে স্বাধীনতাকামী মানুষের নরকযন্ত্রণার কথা ব্যক্ত করেছেন।

জলসুখা লঞ্চঘাট ও বিবাহ : নিরুপায় মানুষের নিরাশার নরক
বাংলাদেশ স্বাধীন হলো একাত্তরের ষোলই ডিসেম্বর। স্বাধীন দেশে কেরামতের জীবিকা চলে বই ফেরী করে। সদ্য স্বাধীন দেশের নানা সংকট নিয়ে কথা বলে কেরামত সাধারণ মানুষের সঙ্গে। তাদের নিকট কেরামত শোনে, সোনা মিয়ার মাছের আড়তে মেয়েদের ওপর নির্যাতনের কথা। কেরামতের কানে আসে এক শারীরিক নির্যাতনের শিকার এক নারীর আর্তনাদ। নুরজাহানকে নিয়ে হাসপাতালে যায় কেরামত। নুরজাহানের পেটের বাচ্চাকে রক্ষা করতে না পারলে নিজের শরীরের রক্ত দিয়ে বাঁচায় তাকে। নুরজাহানের ভ্রূণটি নদীর ধারে দাফন করে আর ভাবে কেরামত নওশাদীর যে ভ্রূণটি সে দাফন করতে পারেনি, সেই ভ্রূণের সঙ্গে নুরজাহানের ভ্রূণটির মিলন ঘটে। স্বাধীন দেশে প্রান্তিকজনের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের দৃশ্য দেখে কেরামতের কাছে স্বাধীনতার অর্থই প্রশ্নবিদ্ধ হয়। পরে সে নুরজাহানকে বিয়ে করে। শেষ পর্যন্ত নুরজাহান রক্তক্ষরণ জনিত কারণে মারা গেলে কেরামত অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়ে। স্বাধীন বাংলাদেশে সাধারণ তথা প্রান্তিক মানুষের নৈরাশ্যই একমাত্র সত্য হয়ে উঠেছে।

কুসুমপুর : রাষ্ট্রীয় জীবনে স্বাধীনতার নরক
কেরামত রওনা দেয় নুরজাহানের লাশ নিয়ে কুসুমপুরের উদ্দেশ্যে। মৃত স্ত্রীর পাশে বসে কেরামত অনর্গল কথা বলতে থাকে। কেরামতের এই আহাজারিতে প্রাকৃতজনের জীবনসত্য প্রকাশ পেয়েছে এভাবে—‘এইটা  সুখের নাও না, গুদারা না, এইটা দুঃখের নাও, এ নাওতে বেরাঙ্গনার লাশ এই লাশ কুসুমপুরে যায়।’১০ ধর্ষিতা বীরাঙ্গনার কথা শোনে নদীর ধারের সাধারণ মানুষ সমবেদনা জানায়; আর কেরামত ভাবে চিরকাল সোনামিয়ারা টিকে থাকে তারা মরে না, ‘নইলে কি ভুরুণ খসে গর্ভপাত অয়—দুলদুলের শইল্যে একশ এট্টা তীর হান্দায়—থুক থুক—সোনামিয়ারে থুক—জয়বাংলারে থুক; দোজখের গণ্ডীর শ্যাষ নাই সংসারে।’১১ কেরামতের এই আত্মদহনই প্রাকৃতজনের নিকট স্বাধীনতার স্বাদ। অর্থাৎ স্বাধীনতার সুফল প্রান্তিকজনের নিকট পৌঁছেনি। ‘কুসুমপুর’ খণ্ডে অর্থহীন স্বাধীনতার নরকযন্ত্রণার চিত্র তুলে ধরেছেন নাট্যকার।

চানতারা : নির্মম নিয়তির নরক
কেরামত এরপর গমন করে চানতারা গ্রামে। এখানে এসে সে জানতে পারে আহত মুক্তিসেনার মুখে : স্বাধীন বাংলাদেশ তাদের (প্রান্তিকজনের) জীবনে কোনো সুখ বয়ে আনেনি। কেরামত চানতারা গ্রামে আশ্রয় পায় নেতাই ফকিরের ঘরে। এখানে শোনে নেতাই ফকিরের মেয়ে শমলার করুণ জীবন-কাহিনি। গোসল করতে গিয়ে কানের দুল হারিয়ে ফেলার অপরাধে স্বামী ও শ্বশুরের হাতে নির্যাতনে শিকার হয়। এই সামান্য অপরাধে তাকে তালাক দিয়ে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। একদিকে অপ্রকৃতস্থ মেয়ে শমলা সুস্থ হতে চায়। অন্যদিকে নেতাই ফকিরের ছেলের ছোভান ডাকাতি করতে গিয়ে নিহত হয়। এর মধ্যে একদিন জানাজানি হয়, পাগলা বসিরের সন্তান শমলার গর্ভে। এমতাবস্থায় শমলার বাবা নেতাই ফকির সামাজিক মেয়েকে কলঙ্কের হাত থেকে বাঁচাতে ভ্রূণ হত্যার পরিকল্পনা করে, কিন্তু বাধা দেয় কেরামত। নেতাই মেয়ের গলা টিপে ধরলে নিরুপায় কেরামত বাধ্য হয়ে শমলার গর্ভপাতের ওষুধ দেয়। কিন্তু পরদিন কেরামতের ওপর চাপন হয় বসিরের কৃতকর্মের দায়। এই অপরাধে কেরামতকে ছেঁড়া জুতো গলায় পরিয়ে এবং দু’চোখ অন্ধ করে গ্রাম থেকে বিতাড়িত করা হয়। গ্রিক ট্র্যাজেডির নায়ক ইডিপাস যেভাবে নিজ রাজ্য থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়েছিল অনিচ্ছাকৃত পাপের দায়ে; ‘অনুরূপভাবে গ্রীক ট্র্যাজেডির নায়ক ইডিপাসের মতো কেরামত বিতাড়িত হয় চানতারা গ্রাম থেকে’।১২

কেরামতের চারপাশে কৌতুহলী গ্রামবাসীর ঢল, বিনা অপরাধে তাকে কন্যাপ্রতিম শমলার অবৈধ গর্ভের দায়ে শাস্তি দেয়া হয় তাকে। কিন্তু কেরামত আরও শাস্তি চায়, কারণ সে রক্ষা করতে পারেনি শমলার ভ্রূণ। নাট্যকার যেন এই ভ্রূণ হত্যার মধ্যেই লুকিয়ে রেখেছিলেন কেরামতের নরকবাসের যন্ত্রণা :

[...] কেরামত তার বোন নওশাদীর, তার বউ নূরজাহানের কিংবা তার কন্যাপ্রতিম শমলার ভ্রূণরক্ষার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভ্রূণনষ্টের মধ্যেই যেন ভাষা পায় নরকবাসের অভিজ্ঞতা, এবং ভ্রূণরক্ষার আকুলতার মধ্যেই নরক থেকে বেরিয়ে আসার পথ।১৩

অপরাধ না করেও কেরামত শাস্তি ভোগ করেছে। অথচ সেই শাস্তির চেয়েও তার কাছে বড় হয়ে উঠেছে শমলার ভ্রূণহত্যার যন্ত্রণা। এজন্য কেরামত আরও শাস্তি চায়, আরও শারীরিক আঘাতে-যন্ত্রণায় বিদ্ধ হওয়ার বাসনা প্রকাশ করে। তথাপি অপরের জন্য কেরামতে কণ্ঠে আশীর্বাদের ধ্বনি উচ্চারিত হয় : ‘আদম সুরত বেবাক মায়ের গর্ভে শক্তি দিক— আরাম দিক। শমলার পোলা য্যা ফিরা আহে নানার ভিটায়।’১৪ শমলার ভ্রূণ রক্ষা করতে না পারার যে যন্ত্রণা তা নাট্যকার নরকযন্ত্রণার সমার্থক হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। কেরামত ভ্রূণহত্যার মতো নরকযন্ত্রণা এ নাটকের এগারোটি খণ্ডেই ভোগ করেছে। কিন্তু এর প্রতিকার করতে পারেনি, সে যেন শুধুই এক দর্শক। অনিবার্য নিয়তিই যেন তাকে টেনে নিয়ে যায় নরকের পথে। এভাবেই কেরামত এ নাটকে একের পর দোজখ অতিক্রম করে এবং শেষপর্যন্ত দর্শক হয়েও সমগ্র কাহিনির ট্র্যাজিক হিরো হয়ে উঠেছে।

প্রান্তিক কথন :
কেরামতমঙ্গল-এ সেলিম আল দীন সর্বমোট ৭০টি চরিত্রের সমাবেশ ঘটিয়েছেন অত্যন্ত সফলভাবে। এ নাটকের নায়েব, চুন্ন মিয়া এবং উডওয়ার্ড ছাড়া বাকি ৬৭টি চরিত্রই নিচু শ্রেণির তথা প্রান্তিকজন। নাটকের অনেক চরিত্রের মিছিলে কেরামতের অবস্থান একাধারে কথক ও নায়কের। জনম দুঃখী কেরামত যেন সাত দোজখ প্রদক্ষিণরত এক মহান চরিত্র। কেরামত মহান মানুষের রূপান্তরিত চরিত্র স্বরূপ। তাই সবার জন্যই দরদ, সকলের জন্যই তার অন্তর কেঁদে ওঠে। কেরামতমঙ্গল-এ বিভিন্ন সময়-প্রেক্ষিতে ক্লান্তিহীন পর্যটক কেরামতের সর্বহারা জীবনাভিজ্ঞতায় সমাজজীবনের  শোষণের চালচিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। সেলিম আল দীন এ নাটক সম্পর্কে উল্লেখ করেন : 

যে এই নাটক দেখে—সামাজিক মঙ্গল সাধনে সে যেন তৎপর হয়। অন্যায় অবিচারের শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। যে এই নাটক দেখে সে যেন শমলার অপরিপুষ্ট ভ্রূণের নিরাপত্তা বিধান করে। পৃথিবীর সমস্ত ভ্রূণের জন্য যেন সে মমতার হাত বাড়ায়। মানব জনমকে সামাজিকগণ যেন স্বাগত জানায়। এই নাটক দর্শনে বন্ধ্যা নারী যেন ফলবতী হয়।১৫

কেরামত বঙ্গভূমির সকল বঞ্চিত দুস্থ নির্যাতিত মানুষের প্রতিনিধি। কেরামত তাই কখনো দাঙ্গাবিধ্বস্ত কৃষক, কখনো ক্লীব হিজড়ার সঙ্গী, বিদ্রোহী হাজং সম্প্রদায়ের অধিকার আন্দোলনের মিছিলে, গারোদের বন্ধু, বারাঙ্গনার দয়িত, কিংবা ভ্রূণ নষ্ট করা হতভাগিনীর পিতা। নাট্যকাহিনিতে এসব কেরামতকে ঘিরে উন্মোচিত হয়েছে দেশ-কালের চিরন্তন মনুষ্যত্ববোধ ও আদর্শ। এই আদর্শের তাড়নায় কেরামত বোন নওশাদীর, স্ত্রী নূরজাহানের ও কন্যাপ্রতিম শমলার ভ্রূণরক্ষার প্রচেষ্টা চালায়। নাট্যকার কেরামতের জীবনের অভিজ্ঞতাকে ভ্রূণহত্যার যন্ত্রণাকে নরকবাসের সমতুল্য করেছেন। অন্যদিকে ভ্রূণরক্ষার আদর্শিক প্রয়াসে নিহিত আছে নরকযন্ত্রণা থেকে পান্থ কেরামতের আত্মমুক্তির বেরিয়ে আসার উপায়। তার মানবিক বোধ, মানসিক কারুণ্য, অপরের প্রতি সহানুভূতি—কেরামতের সর্বস্ব। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার সঙ্গিনী হিজড়া, সেই ক্লীবের জন্যও তার সমবেদনা; তার স্ত্রী ধর্ষিতা মুমূর্ষু এক নারী, শেষপর্যন্ত স্ত্রী মারা গেলে তার মৃতদেহ নিয়ে কেরামতকে নৌকা ভাসাতে হয় কুসুমপুরের উদ্দেশ্যে। কন্যাপ্রতিম মেয়ে শমলার ভ্রূণরক্ষার ব্যর্থতায় গর্ভপাতের দায় তাকেই বহন করতে হয়।

কেরামতমঙ্গল-এর জনতার লাঞ্ছনা কেরামতকে করে তুলেছে একালের যিশু। স্বশ্রেণির দুঃখ-কষ্ট আপন অঙ্গে ধারণ করে কেরামত যেন যিশুর কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। কেরামত গ্রামবাংলার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত ঘুরে বেরিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে। পান্থ কেরামতের অভিজ্ঞতায় নাট্যকার ফুটিয়ে তোলেন : দোজখ বা নরক সাত কিংবা এগারো নয়, অসংখ্য। কেরামতের ভাষায় : ‘যত লোম্বার কূপ তত দোজখ।’ তারপর সেলিম আল দীন এ নাটকে কেরামতের যাত্রাপথে পূর্ণিমার চাঁদ, দূরে চৈত্রসংক্রান্তির ঢোলের বাজনায় নতুন সম্ভাবনার প্রতীক নির্মাণ করেছেন। এসব প্রতীকে মানবজীবনের নবউদ্যমে জেগে ওঠার আহ্বান ইঙ্গিতে আভাসিত হয়েছে। বলার অবকাশ রাখে না যে, মহান দ্রষ্টা পান্থ কেরামত স্বয়ং প্রান্তিক মানুষের প্রতিনিধি। কেরামত সমাজজীবনের দোজখ স্বরূপ পাপ-পঙ্কিলতার ভিতর দিয়ে যে পথ অতিক্রম করেছে তার মধ্য দিয়ে পৌঁছাতে চেয়েছে নতুন এক সমাজে। তার এই পথ-পরিক্রমায় আছে নবজীবনের প্রত্যাশা। কেরামত না পারলেও তার উত্তরসূরিগণ হয়তো একদিন ঠিকই এই নরকপ্রতিম জীবনযন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে।

টীকা ও তথ্যপঞ্জি :
১. সেলিম আল দীন ‘মধ্যযুগের বাঙলা নাট্য’ শীর্ষক পিএইচডি গবেষণা অভিসন্দর্ভ রচনা করেন। এটি বাংলা একাডেমী থেকে ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হয়। নাট্য-গবেষণা কেন্দ্র করে সেলিম আল দীন নাটকের সাথে গাঁটছড়া বাঁধেন। তাঁর এই বন্ধন আমৃত্যু অটুট ছিল।
২. সমালোচকের কথায়ও এর সমর্থন মেলে : ‘এ নাটকে যোগ হয়েছে লোকজ জীবনের বিপুল জীবনভাষ্য। হিন্দু-মুসলমান, গারো-হাজং, ক্যাথলিক-খ্রিস্টান, মুনি-ঋষি, হিজড়া, জমিদার, জেলে, মাঝি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধোত্তর অবক্ষয় প্রভৃতি অজস্র জাতি, প্রজাতি, ধর্ম, মানুষ ও প্রসঙ্গ নিয়ে গড়ে উঠেছে নাটকটির বিশাল আখ্যানভাগ। এর সঙ্গে লোকজ উপাখ্যান, উপকথা, কিংবদন্তীর সার্থক সমন্বয় ঘটেছে।’
—আফসার আহমদ, মঞ্চের ট্রিলোজী ও অন্যান্য প্রবন্ধ, ১ম প্র, ঢাকা : গ্রন্থিক, ১৯৯২; পৃ. ৮৮
৩. মাসুম রেজা, ‘নিভে দীপ অধিক উজ্জ্বল’, হাসান শাহরিয়ার সম্পাদিত,‘থিয়েটারওয়ালা’, ১০ম বর্ষ : ১-২ যৌথ সংখ্যা, ঢাকা : জানুয়ারি-জুন, ২০০৮; পৃ. ১২১
৪. এ নাটকের দোজখ প্রসঙ্গে সেলিম আল দীন পরিশিষ্টে স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন : ‘আর যে কেরামতমঙ্গল নাটক— কোরানে ঈশ্বর বর্ণিত সপ্ত দোজখের সপ্তবর্ণ অগ্নি আপনার প্রতি লোমকূপে অনুভব না করেই অভিনয় নিমিত্ত মঞ্চে অবতীর্ণ হয়— সে অভিশপ্ত। অভিশপ্ত।’
—সাইমন জাকারিয়া [সংকলন ও গ্রন্থন], সেলিম আল দীন রচনাসমগ্র ২, ১ম প্র, ঢাকা : মাওলা ব্রাদার্স, ২০০৬; পৃ. ৩০৬ [কেরামতমঙ্গল : ১২, পরিশিষ্ট : ক] 
৫. আফসার আহমদ, মঞ্চের ট্রিলোজি ও অন্যান্য প্রবন্ধ, পূর্বোক্ত; পৃ. ৮৬
৬. সেলিম আল দীন কর্তৃক কেরামতমঙ্গল নাটকের সূচীপত্র সংস্করণের ‘কথাগুচ্ছ’-এ তাঁর এই পারিবারিক ঘটনার কথা উল্লেখ করেন।
—উদ্ধৃত : সেলিম আল দীন রচনাসমগ্র ২, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৬৫ (পরিশিষ্ট) 
৭. রামেন্দু মজুমদার সম্পাদিত, বাংলাদেশের নির্বাচিত নাটক, [সেলিম আল দীন, কেরামতমঙ্গল], ১ম প্র, ঢাকা : মুক্তধারা, ১৩৯৫; পৃ. ২১৭
৮. সেলিম আল দীন, কেরামতমঙ্গল, পূর্বোক্ত, পৃ. ২২০ 
৯. তদেব, পৃ. ২২১
১০. তদেব, পৃ. ২৭৬
১১. তদেব, পৃ. ২৭৬
১২. গ্রিক নাট্যকার সফোক্লিসের থীবির রাজা ইডিপাস ছিলেন দেবতার হাতের ক্রীড়নক। চেষ্টা করে অনিবার্য নিয়তি এড়াতে চেয়েও ইডিপাস ব্যর্থ হয়েছিলেন। শেষপর্যন্ত থীবীর নাগরিকবৃন্দের সামনে তাঁর অনিচ্ছাকৃত পাপের ইতিকথা প্রকাশ হয়ে পড়লে, তিনি নিজেরই তার দু’চোখ অন্ধ করেছিলেন এবং স্বেচ্ছা নির্বাসনে যান। কিন্তু সেলিম আল দীনের সৃষ্ট কেরামত পাপ না করেও শাস্তি পেয়েছে এবং তার চোখ অন্ধ করে দিয়েছে চানতারা গ্রামবাসী।
১৩. অরুণ সেন, সেলিম আল দীন : নাট্যকারের স্বদেশ ও সমগ্র, ১ম প্র, বগুড়া : দুই বাংলার থিয়েটার প্রকাশন, ২০০০; পৃ. ৪৪
১৪. সেলিম আল দীন, কেরামতমঙ্গল, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৭৬
১৫. সাইমন জাকারিয়া, সেলিম আল দীন রচনাসমগ্র ২, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩০৬ [কেরামতমঙ্গল : ১২, পরিশিষ্ট : ক]


অনুপম হাসান গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও গবেষক। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বিএ ও এমএ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। অধ্যাপনা পেশায় যুক্ত আছেন। তিনি রাজশাহীতে বসবাস করেন। 

menu
menu