‘রক্তের অক্ষর’ : একজন বীরাঙ্গনার করুণ পরিণতি ও সভ্যতার অন্ধকার দিক
কাজী নজরুল ইসলামের একটা কবিতার নাম ‘বারাঙ্গনা’। কবি বলছেন,
অসতী মাতার পুত্র সে যদি জারজ-পুত্র হয়,
অসৎ পিতার সন্তানও তবে জারজ সুনিশ্চয়!
মোটা দাগে বলতে গেলে কবির প্রশ্ন আমার—আপনার বাবা, ভাই, চাচা, শিক্ষক, দাদা না গেলে পতিতালয়ে যায় কারা আসলে। স্বাধীন হয়ে জন্ম হওয়া একটা কন্যা শিশু বেড়ে ওঠার পর শরীর বিক্রির পেশায় যুক্ত হওয়ার পেছনে কারা দায়ী? কামজ আর জারজ এই দুইয়ের মধ্যে প্রভেদ নেই বলছেন কবি।
বনানী বিশ্বাসের একটা বই পড়েছিলাম ‘যৌনকর্মীর জীবন’ নামে। যৌনকর্মীদের চোখের জল, শরীরের খেদ, বঞ্চনা, সুঃখ-দুঃখ, স্বপ্ন-বাস্তবতা নিয়ে এই বই। বনানীর বইটা অনেকটা গবেষণামূলক। রিজিয়া রহমানের সাহিত্যের আশ্রয়ে 'রক্তের অক্ষর' উপন্যাসে তুলে ধরেছেন ইয়াসমিন নামের এক বীরাঙ্গনার জীবন কাহিনি। কীভাবে তিনি যুদ্ধপরবর্তী স্বাধীন দেশে এক প্রকার বাধ্য হয়ে পতিতাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়েন, পতিতালয়ের মেয়ের দুঃখী, মানবেতর জীবন ও তাঁদের বাঁচার আকুতিভরা দীর্ঘশ্বাস রক্তের অক্ষরে ফুটে ওঠেছে।
রক্তের অক্ষরের মূল চরিত্র কে সেটা শেষ পর্যন্ত না পড়লে বলা বা সিদ্ধান্ত নেওয়া মুশকিল। ইয়াসমিনকে মূল চরিত্র ধরে আমরা আলাপ এগোনোর চেষ্টা করব। ইয়াসমিন শিক্ষিত মেয়ে। যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধা যুবক কামালকে তাদের বাড়িতে আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে হানাদার বাহিনী তাকে তুলে নিয়ে যায়। যুদ্ধ শেষে ক্যাম্প থেকে ফিরে সে দেখতে পায় চারদিকের পৃথিবী বদলে গেছে। মামা-চাচা নিরাপদ দুরত্ব রেখে চলছেন। যুদ্ধপরবর্তী সময়ের বর্ণনা পাই আমরা এভাবে,
‘মায়ের বুকে যোদ্ধা সন্তান ফিরে এলো। মানুষের জীবনযাত্রার চাকা আবার স্বাভাবিক গতিতে ঘুরল। খবরের কাগজে নাম গোপন করে অনেক মর্মস্পর্শী রিপোর্ট ছাপা হয়েছে তাদের সম্পর্কে। লোকে সাগ্রহে পড়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ভাবছে—' খুব বেঁচে গেছি, আমার স্ত্রী-কন্যা-বোনের এই দশা হয়নি।'
কেউ তাঁকে আশ্রয় দেয়নি। ফিরে এসে চাচাকে ইয়াসমিন প্রশ্ন করে কেন তাঁর খবর নেয়নি তারা। চাচা উত্তর দিয়েছিল, 'কোথায় খুঁজব? আমি কি ভেবেছি যে তুই বেঁচে আছিস?' ইয়াসমিনের তীক্ষ্ম জবাব শুনে চমকিত হয় তাঁর চাচা। ‘মরে গেলে বোধহয় খুশি হতে। শোনো চাচা! সবাই মরে না। যন্ত্রণার সাক্ষী হয়ে অনেককে বেঁচে যেতে হয়।’ হন্য হয়ে চাকরি খুঁজেছে ইয়াসমিন । চাকরির ভাইবাতে গিয়ে ক্যাম্পে ঘটা দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাওয়া হলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে সে। বিয়েও একটা করেছিল। স্বামী ছিল পাষণ্ড। ইয়াসমিনকে সম্মান করতে পারেনি সেই লোভী, লম্পট স্বামী। স্বামীর হাতে বিভৎস অত্যাচারের শিকার হতে হয়েছিল তাঁকে। এক পর্যায়ে পতিতাপল্লীতে গিয়ে ওঠে ইয়াসমিন।
রিজিয়া রহমান পাঠককে জানাচ্ছেন স্বাধীনতার অল্প ক'দিনের মধ্যে কীভাবে একটা দেশ হায়েনা-দুর্বৃত্তের লোলুপতার শিকার হয়। বীরাঙ্গনা ইয়াসমিন সবকিছু হারিয়ে পতিতালয়ে আশ্রয় নেন৷ সে আরেক জগত। মেয়েদেরকে বিভিন্ন জায়গা থেকে ফাঁদে ফেলে আনা হয়। প্রথম দিকে কান্নাকাটি করলেও পরে বাস্তবতার নিকট হার মানতে হয় তাঁদের সবাইকে। কারো সৎ মা'র অত্যাচারে ঘর ছাড়তে হয়, কেউ গুণ্ডার হাতে পড়ে, কেউ অভাবে পড়ে, আবার কেউ ভাই বউয়ের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পল্লীতে আসে। কি দুর্বিষহ, মানবেতর জীবন তাদের। হিরু, কালু প্রমুখ দালালের হাতে ওরা বিক্রি হয়ে পল্লীতে আসে। নিয়মিত খেতে পায় না, কিন্তু খদ্দেরের চাহিদা মেটাতে হয় নিয়মিত। মৌলিক চাহিদাবঞ্চিত জীবন যাপন করতে হয় মেয়েদেরকে এখানে। যাদের শারীরিক জৌলুশ বেশি তারা একটু উন্নত জীবনযাপন করতে পারে। এরকম একজন হলো জাহানারা। তাঁর সব দামি কাস্টমার। ভদ্রলোকের চাহিদা মেটাতে, টেন্ডারের ঘুষ হয়ে দামি হোটেলে দেহ বিক্রি করে আসে সে। ভালোমন্দ খাওয়া পরা জুটে তার। অবশ্যই এ নিয়ে অন্যরা তাঁকে ঈর্ষা করে।
মার্ক্সের এলিয়েনেশন তত্ত্বের আলোকে বিচার করলে এরা আসলে চারভাবে বিচ্ছিন্ন বা বঞ্চিত। মার্ক্সের মতে একজন শ্রমিক চার ধাপে বিচ্ছিন্ন। প্রথমত, তাঁর শ্রম দ্বারা উৎপাদিত পণ্য হতে সে বিচ্ছিন্ন। দ্বিতীয়ত, নিজের কর্মক্ষমতা থেকে বিচ্ছিন্ন। তৃতীয়ত, মানুষ হিসেবে বিচ্ছিন্ন। এবং, অন্যান্য কর্মী বা সহকর্মীদের থেকে বিচ্ছিন্ন। রক্তের অক্ষরে উল্লেখিত গোলাপিপট্টির মেয়েরা যৌবনের দাস। অনিচ্ছাসত্ত্বেও দিনরাত শরীর বিক্রি করতে হয় তাদের৷ বিকৃতকাম পুরুষের দাবি মেটাতে গিয়ে তাঁরা ভুলে যায় নিজের কথা। দার্শনিক এমারসনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তারা নিজের আবেগকে পশ্রয় দিতে পারে না। নিজের আত্মার অস্তিত্বের কথা তাদের ভুলে যেতে হয়। স্বাভাবিকভাবে দুজন নারী-পুরুষের মিলনের অন্যতম লক্ষ্য হলো পরবর্তী প্রজন্মের মুখ দেখা। কিন্তু পট্টির মেয়েরা উভয় দিক থেকে বঞ্চিত। তারা না পারে যৌবন উপভোগ করতে, না পারে মাতৃত্ব ভোগ করতে। নানারকম জন্মনিরোধক অষুধ খাওয়ার পরও কেউ গর্ভবতী হয়ে গেলে নিজেকে ধিক্কার দেয় এরা। একে তো নিজে চলতে পারে না, সন্তানকে কি খাওয়াবে? যাদের ছেলেমেয়ে হয়ে যায় তারা মায়ের কাছে বাচ্চা রেখে পাশের ঘরে দেহ বিক্রি করে।
রোগ, শোক, বালাই সবকিছু উপেক্ষা করে খদ্দেরের খোঁজে নামতে হয় পট্টির মেয়েদের । এই কাজ করতে গিয়ে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে নিজেদের মধ্যে। মারামারি, ঝগড়াঝাঁটি তো নিয়মিত ঘটনা তাঁদের। কেউ মরে গেলে সেদিকে ভ্রুক্ষেপ থাকে না অন্য মেয়েদের। কুসুম, পারুল, পিরুর মৃত্যু তাদেরকে নাড়া দিলেও শোক করার অবসর পায় না তারা। একে অপরকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবে। ইয়াসমিন ছাড়া বাকি কারো মধ্যে মানবিক গুণাবলির চর্চা আমরা দেখতে পাই না। এমন না যে তারা মানবিক নয়। শরীর বিক্রির তাড়া তাদেরকে ফুরসত দেয় না মানবিকতা চর্চার। গোলাপিপট্টিতে এ-ও দেখা যায় যে ঘর তুলে মেয়েকে দেহব্যবসা করতে দিচ্ছেন মা।
ইয়াসমিন যাকে বাড়িতে আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে পাক সেনাদের লোলুপতার শিকার হয়েছিল সেই কামাল একদিন আসে তার কাছে খদ্দের হয়ে। মুক্তিযোদ্ধা কামাল স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিপথে চলে যায়। জুয়া,মদ ও নারী শরীর হয়ে উঠে কামালের ভোগপিপাসা। কামালের সঙ্গে তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে কামালের মাথা ফাটিয়ে দেয় ইয়াসমিন। ক্ষিপ্ত ইয়াসমিন বলেন,
‘আমার যা হয়েছে তা নিয়ে তোমার আর মাথা না ঘামালেও চলবে। আজকের যে তোমাকে দেখছি সেই তোমাকে আমরা বাড়িতে আশ্রয় দেইনি। আশ্রয় দিয়েছিলাম একজন মুক্তিযোদ্ধাকে। যে দেশের জন্য, সবার জন্য যুদ্ধে গিয়েছিল। যার জন্য সেদিন আমি বাবা-মা, ভাইবোন সবাইকে হারিয়েছি। আর আমি হয়েছি বেশ্যা।’
আত্মপক্ষ সমর্থন করে কামাল নিজেকে পরিস্থির শিকার বলতে চাইলে ইয়াসমিন বলেন, ‘ও কথা বলে নিজেকে ধোঁকা দিও না কামাল। দেশে আরো অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছে যারা তোমার মতো হয়ে যায়নি। তারা এখনো সুস্থ মানুষ।’
গোলাপিপট্টির অন্য দশজন মেয়ের চেয়ে আলাদা ইয়াসমিন। পড়ালেখা তাঁকে আলাদা ব্যক্তিত্ব দিয়েছে। গোলাপিপট্টির অন্য মেয়েরা তাঁকে সমীহ করে। ইয়াসমিন চায় পট্টির মেয়েদের মধ্যে কিছুটা সচেতনতা তৈরি করতে। এই কাজে পাশে পায় দেলোয়ার নামক এক ভদ্রলোককে। কাস্টমার হিসেবে এসে দেলোয়ার তার সঙ্গে আলাপ করে তারাশঙ্করের কবি'র বসন্তের কথা। তাদের আলাপে উঠে এসে শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের গণিকার কথা। পরবর্তীকালে দেলোয়ার পট্টির মেয়েদের সুখে দুঃখের বন্ধু হিসেবে উপস্থিত হয়। প্রথমবারের মতো পট্টির কোন মেয়েকে সে ডাক্তার দেখানোর কথা বলে। ইয়াসমিনের সঙ্গে দুনিয়াজুড়ে নারীমুক্তি আন্দোলনের যে চল শুরু হয়েছে সে বিষয়ে আলাপ করে। ইয়াসমিনকে নানারকম বইপত্র দিয়ে যায়।
দীর্ঘদিনের পচন কি একদিনে সারা যায়? পট্টির মাসী যে নিজেও একদিন মালিকের বাঁধা সেবিকা ছিল তার হয়ে অন্য মেয়েদেরকে শাসায় প্রতিবাদ না করতে। মুখ বুজে শরীর বিক্রি করে তিলে তিলে নিজেকে শেষ করার প্ররোচনা দেয়। উপন্যাসের শেষের দিকে বেশ্যার দালাল হিরু গোলাপি নামের এক যুবতী মেয়ে এনে চার পাঁচ জন মিলে ধর্ষণ শুরু করলে ইয়াসমিন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেননি। অন্য মেয়েদের সমর্থন আদায়ে ব্যর্থ হয়ে সে নিজে এগিয়ে যায় উন্মত্ততা থামাতে। নিজের প্রাণ হারায় দালাল হীরুর হাতে। তার হাতে থাকা বইয়ের ছেঁড়া পাতা রক্তে ভিজে যায়। রক্তের দাগ লেগে থাকে বইয়ের পাতায়। যেখানে লেখা, 'Man is born free, but everywhere is in chain'।
রিজিয়া রহমান বাংলা সাহিত্যের একজন অগ্রগণ্য সাহিত্যিক। চা শ্রমিকদের জীবনসংকট নিয়ে দুর্দান্ত বয়ানে লিখেছেন ‘সূর্য সবুজ রক্ত’, ডায়াস্পোরা নিয়ে লিখেছেন ‘শিলায় শিলায় আগুন।’ রক্তের অক্ষর পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বলি দেহশ্রমিকদের জীবন আখ্যান। রাতের আঁধারে পুরুষ তাঁদের বুকে স্থান দিলেও, সমাজে তাঁদের কোনো জায়গা হয় না। সমাজে তাঁরা অচ্ছ্যুত। ইয়াসমিন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় 'স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন'।
আলমগীর মোহাম্মদ শিক্ষক ও অনুবাদক, কুমিল্লা