আত্মঘাতী কবি রফিক আজাদ 

রফিক আজাদ ষাটের দশকের অন্যতম প্রধান কবি। তাঁর কবিতার মূল উপজীব্য মাটি, মানুষ, প্রকৃতি ও প্রেম। আধুনিক জীবন দর্শন, প্রথাগত ধ্যান-ধারণার এবং ব্যক্তিসত্ত্বার মূল্য অধিক হওয়ার কারণে আত্মকেন্দ্রিক ও মুগ্ধতায় তিনিও হেঁটেছেন দীর্ঘপথ। তাঁর সময়ের অন্য কবিদের থেকে তিনি আপন ধ্যান-ধারণা ও অস্তিত্ব নিয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এই সমাজ ও মানুষের কাছে। অনিবার্য হয়ে উঠেছে তাঁর স্বপ্ন ও বাস্তবতা। অস্তিত্বের এক গভীর রহস্যময় জগত তিনি অবলোকন করতে চেয়েছেন। সামাজিক সত্যের নিগূঢ় ঐতিহ্যকে তিনিও অস্বীকার করতে চাননি। নিজস্ব কাব্যকলার উৎস সন্ধানে তিনি নিসর্গ ও সমগ্র জীবনের তাবৎ সৌন্দর্য বারবার তীক্ষè বাস্তবতার অভিঘাতে আত্মস্বরূপ উপলব্ধি করতে চেয়েছেন। তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে মানব চেতনার গূঢ় রহস্য।


একজন কবির কাছে পাঠকের চাওয়া থাকে গভীর থেকে গভীরতর। জীবনাবেগ ও অনুভূতিময় দর্শনের কাছে একজন মানুষও থিতু হয়ে বসতে চান। কবিরা হলেন সত্যদ্রষ্টা। নির্মাণ করতে চান সত্যতর জগৎ। কবির অন্তরজগতে খেলা করে কাব্য-সাধনার গূঢ় রহস্য। এভাবেই পাঠকের মনোলোকে লগ্ন হয়ে থাকেন কবি। মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে যে সম্পর্ক তা একজন কবির চোখে আরও প্রগাঢ় হয়ে ওঠে।
জ্ঞানীকে জ্ঞান দান করা যেমন ধৃষ্টতার সমান তেমনি একজন সমঝদার পাঠককেও নিজের নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়। কিন্তু আমাদের এমনই দুর্ভাগ্য আকাট মূর্খরা সর্বক্ষণ কুমন্ত্র দান করে কবির মন ও মস্তিষ্ককে ঝাঁঝরা করে দেয়।


একজন সত্যবাদী ও প্রতিবাদী কবি কখনো অন্যায়ের সাথে আপস করেন না। অর্বাচীনদের অগ্রগণ্য তার ধাতে সয় না। অবচেতনা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চান একজন প্রকৃত মানুষ। অনবদ্য সবকিছু ঘৃণা করেন একজন কবি। আপাতদৃষ্টিতে মানুষের জীবনখানা আসলে কি? কখনো কখনো মৃত্যুর মতো মনে হয় জীবনখানা। অসত্য আর বিষাক্ত বিদ্রুপ অগ্রাহ্য করে একজন কবি সারাজীবন সত্যের আরাধনা করেন। আর এতেই তার মনের মুক্তি। ষাটের দশকের কবিতার মূল বিষয় ও সুর ছিল নাগরিক উল্লাস, আত্মরতি ও আত্মখননের দ্বন্দ্ব ও টানাপড়েন। এসব বৈশিষ্ট্য থেকে রফিক আজাদ মুক্ত হয়ে বেরিয়ে এসে প্রবেশ করেছেন এক শিল্পিত আকাক্সক্ষার জগতে। স্বপ্নময়তা তাকে আচ্ছন্ন করে তোলে। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অসম্ভবের পায়ে’- এ গ্রন্থের কবিতাসমূহ বিশ্লেষণ করলে তাঁর শিল্প-স্বভাবের পরিচয় পরিস্ফুট হয়ে ওঠে:

সন্ধ্যে থেকে যোজন-যোজন দূরে যখন ছিলাম-
দেখেছি তোমার ঠোঁটে বা মনে উৎসবের আলো;
দ্রুত কাছে এসে দেখি: ঠা ঠা হাসে অন্ধকার! আর
‘প্রবেশ নিষেধ’- বলে জ্বলে এক রক্তচক্ষু-বালক!
[হে দরোজা]

এভাবেই বাস্তবতার মুখোমুখি ক্রমাগত দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এ নগর, নাগরিক উল্লাস ও নারীর রহস্যময় জগতে তাঁর অনুপ্রবেশকে অনুভূতিহীন ও অস্তিত্বহীন ভাববার কোনো কারণ নেই। তাঁর জীবনের সমগ্রতা এক স্বপ্নময় জগতের অবিচ্ছিন্ন ধারায় প্রবাহিত :

কী মসৃণ আলো ফ্যালে দুর্গন্ধে আমার!
অবাস্তব উটপাখি, তোমার পিঠের ‘পরে চড়ে
জরায়ুতে চলে যাই ভবিষ্যতে যাই-
খটখটে মৃত্তিকায় শিকড় চাড়িয়ে দিই, কিংবা
আইয়ো-র শিংয়ের মতো বাঁকানো শৈশব ঘুরে আসি।
শিখাহীন অলৌকিক তোমার আগুনে পুড়ে যায়-
পরিত্যক্ত বাঁশঝাড়, গাছপালা, গোপন বাগান।

অথবা

আমার বাস্তব-স্বপ্নে কখনো আসো না আর ফিরে!
তবে অশ্রুজল ছাড়া ঐ-পদপল্লবে
আর কি দেবার আছে? ...কেবল চোখের জলে ভরে দিতে পারি
একটি অদৃশ্য, শুষ্ক বঙ্গোপসাগর 
[স্মৃতি, চাঁদের মতো ঘড়ি]

‘অসম্ভবের পায়ে’ কাব্যগ্রন্থের কবিতার মধ্যে পরাবাস্তবতার সুর অনুরণিত হয়ে ওঠে। আকাক্সক্ষা ক্ষুধা যন্ত্রণা অপেক্ষা বিপদ সবকিছু মূর্ত হয়ে উঠেছে এ গ্রন্থের কবিতার ভেতর:
খ-িত ব্রিজের মতো নতমুখে তোমার প্রতিই
নীরবে দাঁড়িয়ে আছি: আমার অন্ধতা ছাড়া আর
কিছুই পারিনি দিতে ভীষণ তোমার প্রয়োজনে;
উপেক্ষা করো না তবু, নারী- তোমার অনুপস্থিতি
করুণ, বেদনাময়-বড় বেশি মারাত্মক বাজে

২.
তুমি সেই লোকশ্রুত পুরাতন অবাস্তব পাখি,
সোনালি নিবিড় ডানা ঝাপটালে ঝরে পড়ে যার
চতুর্দিকে আনন্দ ....

৩.
রোশনা বালুকা-বেলা খেলা করে রৌদ্রদগ্ধ তটে;
অস্তিত্বের দূরতম দ্বীপে এই দুঃসহ নির্জনে
কেবল তোমার জন্যে বসে আছি উন্মুখ আগ্রহে-

৪.
সুন্দর শাম্পানে চড়ে মাধবী এসেই বলে- ‘যাই’ 
[মাধবী এসেই বলে : যাই]

এক ধরনের স্বপ্নাচ্ছন্ন অনুভূতিলোক সৃষ্টির আকাক্সক্ষা ও যন্ত্রণা যা তাঁর স্বপ্নের নারীর ভেতরে দেখতে চান। তাঁর স্বপ্নের জগৎ স্মৃতিঘন চিত্রপট সমর্পিত হতে চায় বারবার। অপার বেদনা তাঁকে গ্রাস করে। অন্তরঙ্গ আশ্চর্য জীবনধারা অভিন্ন সত্তায় রূপান্তরিত করেছে। মাধবী এসেই বলে: 'যাই' কবিতার ভেতর তাঁর কবি-অভিব্যক্তির সম্পূরক এক স্বতন্ত্র প্রত্যয় মূর্ত হয়ে উঠেছে। যেখানে অপেক্ষা আর নিবিড় যন্ত্রণা প্রগাঢ় চেতনার অভিঘাত জীবন-বিমুখতা সোনালি লাভার ¯্রােতে উঠে আসে গ্রাম ও নগর। কখনো তুমুল একাগ্রতায় আবদ্ধ হতে চেয়েছেন আবার কখনো অবচেতনের অবতলে প্রাণপাত ধ্যানমগ্ন হয়ে থেকেছেন প্রিয়তমার জন্য। এভাবে ক্রমাগত স্বপ্নমগ্ন হয়ে উঠেছেন তিনি।
একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁর জীবনের রক্তিম আকাক্সক্ষা ও বাস্তবতা তাঁর সৃষ্ট কবিতার ভেতরে বিস্তৃত হয়েছে। তাঁর সময়ের অন্য কবিদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে এক নতুন কাব্যজগৎ নির্মাণ করেছেন তিনি। জন্মের চাকা কীভাবে ঘোরে কীভাবে জীবনের স্বতন্ত্র ভূখ- আবেগ দ্বারা আক্রান্ত হয় কীভাবে অন্তরঙ্গ দীর্ঘশ্বাস কবন্ধ করে রাখে এসব তাবৎ মর্মস্পর্শী বহুবিদ সংকট স্বপ্নকে ঝাঁঝরা করে দেয়-


মানুষেরা-মাছিদের মতো-শুধু ক্ষতস্থান খোঁজে,
মাছিদেরও চেয়ে তারা বেশি পারঙ্গম এ-ব্যাপারে।
শেষোক্ত প্রাণীরা শুধু ক্ষতস্থান খুঁজে তুষ্ট থাকে-
ক্ষত সৃষ্টি সাধ্যের অতীত ব’লে তারা তো কেবলই
মানুষের সৃষ্ট ক্ষতে ব’সে ক্ষরিত রক্তের থেকে
বিষ পান করে শুধু জেনে-শুনে, পান ক’রে থাকে;


সুচতুর মনুষ্য-সন্তান নিতান্ত নির্ভুলভাবে
সকলের অগোচরে কাজ সারে বলে আজকাল


অথবা সে ক্ষত কারো কীর্তি নয়, নিজস্ব নিয়মে
প্রকৃতি-সদৃশ বাড়ে-রক্ত ঝরে নীরবে, নিভৃতে!

উপরের উদ্ধৃত কবিতাংশ থেকে মানুষ যে মানুষের জন্য কষ্ট ও ভয়াবহ দৃশ্যের অবতারণা করে মর্মের গভীরে যন্ত্রণা উস্কে দেয় সেটি কঠিন বাস্তবতা দিয়ে তিনি উপলব্ধি করেছেন। এই যে নির্ভুলভাবে তাঁর চিন্তার বিস্তার পাঠককে সচেতন করে তোলে। আপাত দৃষ্টিতে তাঁর এই নির্ভুল অতিক্রম তাঁর কবিতাকে মেদহীন, উপমা ও বলিষ্ঠ বক্তব্যের দিক থেকে স্পষ্ট করে তুলেছে। জাগতিক সকল অসঙ্গতিকে তিনি কটাক্ষ করে আবিষ্কার করেছেন মানুষের মুখোশ।
আধুনিক কবিতা সম্পূর্ণরূপে বেড়ে উঠেছে পাশ্চাত্যের আবহময় যুদ্ধ-সন্ত্রাস নৈরাজ্যের পটভূমিতে। নিঃসঙ্গ ও এককেন্দ্রিক জীবনবোধ কাব্যের প্রাণকে আবেগের অগ্রগণ্য থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। জটিলতাকে পরিহার করতে এক সময় দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। ব্যক্তিস্বরূপ আত্মপ্রবঞ্চনার কাছে থিতু হয়ে বসে। অর্জিত অভিজ্ঞতা ও সম্পর্কের দৃঢ়তা সমাজ ও সভ্যতার পারিপার্শ্বিক সংশয় আধুনিক কবিতার ওপর ভর করে। তখন অস্তিত্বের সংকট তীর্ব হয়ে ওঠে। অভিজ্ঞ পাঠক মাত্রই নিগূঢ় সত্য উপলব্ধি করতে পারেন তার বুদ্ধিমত্তা ও শ্রেণি সচেতনতা দিয়ে।
জনপ্রিয়তার দিক থেকেও রফিক আজাদ পাঠকের স্বপ্নলোকে বিচরণ করেন। প্রকৃতি মগ্নতার অভিলাষ মনেপ্রাণে লালন করেন তিনি। শব্দশিল্পী হিসেবে তিনি সুন্দরের প্রতি এক ধরনের পক্ষপাত; প্রকৃতি ও নারীর রূপের সমন্বয়, অভিজ্ঞতার অভিঘাত নাগরিক অনুষঙ্গের ভেতরে নিয়ে আসেন।
অনিবার্য কারণে কখনো কখনো একজন কবিকেও রহস্যময় জগতে প্রবেশ করতে হয়। সীমাহীন রহস্যলোকে রফিক আজাদের যে যাত্রা সেখানে কেবলমাত্র তাঁর কাব্যভাবনা-অন্তর্গত বিষ ও সম্ভাবনাকে নিরাসক্ত করে তুলতে চাননি; তাবৎ বিষয়াদি যা জীবনের জন্য প্রয়োজন তা তিনি সম্পূর্ণভাবে চেয়েছেন:
সম্পূর্ণ বর্জন নয়, গ্রহণে-বর্জনে গ’ড়ে নিই
মানুষের বসবাসযোগ্য চিরস্থায়ী ঘর-বাড়ি;
রহিরঙ্গে নাগরিক-অন্তরঙ্গে অতৃপ্ত কৃষক;
স্থানকাল পরিপার্শ্বের নিজ হাতে চাষাবাদ করি
সামান্য আপন জমি, বর্গাজমি চষি না কখনো।
[অন্তরঙ্গে সবুজ সংসারে]


কবিতার জগতে তাঁর এই দীর্ঘ পরিভ্রমণ দেশকাল মানুষ এবং তাঁর অভিজ্ঞতার জারিত রস তাঁর সৃষ্ট কবিতার ভেতরে সরাসরি উঠে এসেছে। একজন কবির জীবন খুব কাছ থেকে দেখলে তার ক্ষুধা যন্ত্রণা অপেক্ষার ভেতরে প্রগাঢ় ক্ষত থাকে। যা একসময় তাঁর কবিতায় ভর করে। জীবন জিজ্ঞাসার কাছে একজন কবিও থিতু হয়ে বসে। ক্লান্তিকর জীবন থেকে সেও মুক্তি পেতে চায়:

নিতান্ত নির্ভুলভাবে কোনো কাজ করতে পারিনি;
হাতের কুঠার ফেলে কাঠ কাটা ভুলে বারবার
... ... .... 
পরিণামে অভুক্ত থেকেছি দীর্ঘ তিরিশ বছর।

... পত্র-পুষ্প সুশোভিত বনে
ভুলক্রমে মিশে গেছি প্রাকৃতিক জীবন-প্রবাহে।
[নবীন কাঠুরের উক্তি]

মূলত অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যাত্রার অতিক্রান্তির যে দ্বৈরথ সেই আত্মপ্রকাশের ধরণ ও অস্তিত্বজ্ঞান তাঁর কবিতার পরতে পরতে যেন সাজানো। বিচূর্ণ ও স্বপ্নহীন সময়কে তিনি ভাঙতে চেয়েছেন বারবার:


শিকড়েরা চলে যায় স্তর-পরম্পরাক্রমে
মৃত্তিকার গভীর গহ্বরে,


জীবনদায়িনী ঐ আর্দ্রতা আমিও
সামান্য জীবনে ব্যেপে অনেক দেখেছি 
[শিকড়েরা]

শ্রেণি সচেতন, সমকালীন সমাজ আর জীবনের ঐকান্তিক অনুভবের ভেতরেও কবি শুনতে পান নাগরিক উল্লাস; অন্যদিকে স্মৃতি মগ্নতার গভীর অধ্যয়ন তাঁর কবিতায় লক্ষ্যণীয়:


আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থেকেছি,
হেমন্তে পাতা-ঝরার শব্দ শুনবো বলে
নিঃশব্দের অপেক্ষা করেছি বনভূমিতে
কোনো বন্ধুর জন্যে
কিংবা অন্য অনেকের জন্যে হয়তো ভবিষ্যতেও
অপেক্ষা করবো...
[প্রতীক্ষা]


আমার একটি আগ্নেয়াস্ত্র দরকার
আমার কোনো শত্রু নেই, আমার কোনো বন্ধু নেই
শত্রু-নিধন বা বন্ধুদের মুখ বন্ধ করার জন্য নয়,
কিংবা আত্মহত্যা করবার জন্যেও নয়-

৩ 
বিশ্বাস করুন, এটি আমি কোনো লোকের বিরুদ্ধে
ব্যবহার করবো না 
[আমার একটি আগ্নেয়াস্ত্র চাই]

কখনো কখনো তাকে মনে হয় শিশুর মতো সরল। ‘গরল’ শব্দটি তাঁর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের ক্ষয়িষ্ণু সমাজ ও সমাজের মানুষকে তিনি খুউব কাছ থেকে দেখেছেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁর দেখার ধরণ যেমন স্বচ্ছ ও দেশাত্মবোধে উজ্জ্বল তেমনি জীবনকে তাৎপর্যম-িত করে তুলতে অনিবার্যভাবে জীবন জিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। 

মানুষ খুন করার মতো কোনো
যুক্তিগ্রাহ্য কারণ আমি দেখি না!'

দৈনন্দিন জীবনের বিচিত্র অনুষঙ্গ ক্রমাগত তার কবিতায় বিস্তৃত হয়েছে বটে! জীবন-জিজ্ঞাসার মুখোমুখিও দাঁড় করিয়ে দেয়। খুউব সত্য উচ্চারণ কখনো কখনো একজন কবিকে সন্ত্রস্ত করে তোলে। দ্বিধাহীনভাবে একজন কবিও বিবিধ বিষয়াদি খুঁড়ে খুঁড়ে তুলে আনতে চায়। অস্তিত্বের সংকট ভয়াবহভাবে একজন কবিকে গ্রাস করে তখন সে আশ্রয় খোঁজে প্রকৃতি লোকে। 

ফুলেরা ঝরে যায় মানুষ বসে থাকে
পাতারা উড়ে যায় মানুষ বসে থাকে
বাতাস বয়ে যায় মানুষ বসে থাকে 
(মানুষ)

‘মানুষ’ কবিতাটি অদ্ভুত দ্যোতনায়। কৌতূহলের উদ্রেক করে। আধুনিক বাংলা কবিতার আবহমান ধারাকে তিনি সামাজিক অঙ্গীকার ও বোধের মধ্যে লালন করেছেন। স্বপ্ন ও বাস্তবতাকে জীবনের গভীরে একটু একটু করে তীব্রতর করেছে। তাঁর কবিতা তত্ত্ব দর্শনের মধ্যে ইতিহাস, ঐতিহ্য, মৃত্তিকা ও জীবনসংলগ্ন স্বরূপ প্রতীকী ব্যঞ্জনায় তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। 

সুন্দরের দিকে চোখ রেখে অনন্ত ঝর্ণার জলে 
বনকে বিন্যস্ত করে তবেই উদ্যান,
না-হলে তো বন সে শুধু-ই প্রকৃতি।

তাঁর অসংখ্য কবিতার বক্তব্য রাজনীতিনির্ভর। মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী সময়ের প্রেক্ষাপটে যেসব কবিতা তিনি লিখেছেন তা আজও সচেতন পাঠকের চিন্তাকে আরো উস্কে দিয়েছে। তাঁর বিখ্যাত কবিতাসমূহের মধ্যে ‘হাতুড়ির নিচে জীবন’, ‘রফিক আজাদের মুক্তি চাই’, ‘ভাত দে হারামজাদা’, ‘চন্দ্রাহত কেরানির রবিবার’, ‘দরকারি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধের সুপারিশ’ উল্লেখযোগ্য।
অন্যদিকে জীবন যে কত বিষাদময় তা বাস্তবতার মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করেছেন। একজন কবির অভিজ্ঞতা ও চেতনার মধ্যে সময় ও জীবনের মৌলিক স্বর মূর্ত হয়ে ওঠে। সুন্দরের প্রতি তাঁর এক ধরনের দুর্বলতা রয়েছে যা তাঁর অধিকাংশ কবিতার ভেতরে দেখা যায়। সুন্দরের প্রতীক হিসেবে নারী ও প্রকৃতিপ্রেম এবং স্বপ্নলোকের অনুসন্ধান তাঁর কবিতার প্রধান উপজীব্য বিষয়। 

১৯৭৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’- গ্রন্থটি। এই গ্রন্থের অধিকাংশ কবিতার বক্তব্য-সুন্দর প্রকৃতি, নারী, মৃত্তিকা ও ফসলের তীব্র আকর্ষণ জীবনবৃত্তে আবর্তিত হয়েছে। প্রকৃতি ও নারীর প্রতি তাঁর গভীর অনুভূতি নিগূঢ় বিন্যাসে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে: 

আমার কাছে তো তুমি এক মূর্তিমান অভিধান: 
খুচরো অথবা খুব দরকারি ভারি শব্দাবলী
টেবিলে ঈষৎ ঝুঁকে নিষ্ঠাভরে যে রকমভাবে
দেখে নিতে হয়, প্রয়োজনে তোমাকে তেমনি পড়ি। 
(নারী : কবির অভিধান)

ক্রমাগত রফিক আজাদের কবিতা পাঠ করলে এক বোধের জগতে পৌঁছানো যায়। কীভাবে একজন কবি তার মৌলিক স্বর চিহ্নিত করেন অবলীলায় তার বর্ণনা ও যাপিত জীবনের তাবৎ বিষয়াদি একটু একটু করে অনুভব করা যায়।

আমার ত্বকের নিচে আছে এক মৌলিক কুকুর
আমাকে উলঙ্গ করে উঠে আসে ত্বকের ওপরে
আমারই ভিতরে তার স্বভাবের বিকাশ ঘটায় 
চীৎকারে-চীৎকারে ভাঙে মানবিক মূল্যবোধগুলি;
নিজেকে আঘাত করে, বারবার, ছিন্নভিন্ন হই-
(আমার ত্বকের নিচে)

রফিক আজাদ আধুনিক বাংলা কবিতার ভূখ-কে ঐশ্বর্যম-িত করেছেন। তাঁর সময়ের কবিদের থেকে বক্তব্য ও বিষয়-এর দিক থেকে তাঁর কবিতা অনেকটাই আলাদা। একদিকে নাগরিক জীবনের হতাশা আর অন্যদিকে নিসর্গের আনন্দলোকে তার যে পরিভ্রমণ তা বাঙালি জীবনের অবিচ্ছিন্ন ধারার মতো প্রবাহমান: 

চুনিয়া শুশ্রুষা জানে,
চুনিয়া ব্যান্ডেজ বাঁধে, চুনিয়া সান্ত¡না শুধু-
চুনিয়া চীৎকার খুব অপছন্দ করে,
চুনিয়া গুলির শব্দ পছন্দ করে না।
(চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া)

এই কবিতার মধ্যে দেশপ্রেম এবং শান্তির তকমা এঁকে দিয়েছেন তিনি। বক্তব্যধর্মী শৈল্পিক সুষমায় কবিতাটি হয়ে উঠেছে জীবন্ত। 
দেশ, মাটি ও মানুষের প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগ রফিক আজাদের কবিতায় মূর্ত হয়ে উঠেছে। অগণিত পাঠকের হৃদয়কে তিনি স্পর্শ করেছেন। আধুনিক বাংলা কবিতার প্রাণপুরুষ কবি রফিক আজাদ এ দেশের কবিতার ভূমিকে পূর্ণতা দিয়েছেন। কবিতাপাঠক হিসেবে সৃষ্টির রহস্য উন্মোচন করাই যেন প্রধান কাজ। ক্রমশ রহস্যের তোরণ খুলে সংকট ও শূন্যতাকে অনুধাবন করা যায়। তাঁর কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে এরকম একটি অনুভব ছুঁয়ে ছুয়ে যায়।

menu
menu