দাম্পত্য প্রেম বিষয়ে মাহমুদুল হক
বাংলা সাহিত্যে দাম্পত্য-প্রণয় বিষয়ে তেমন কোনো মহত্তম রচনা দেখি না। কবিতায় ছিটেফোঁটা একটা দুটো উদাহরণ থাকলেও উপন্যাসে দাম্পত্য প্রেমের তেমন নজির পাওয়া যায় না। বরং যখন থেকে বিবাহপূর্ব প্রণয়ের জায়গার অনেকটা বিবাহবহির্ভুত প্রেম দখল করে ফেলে তখন সেটা কেমন জমে ওঠে তা বোঝা যায় অনেক সাহিত্যে। বঙ্কিম কিছুটা লিখেছেন রবীন্দ্রনাথে তার চরম সমুন্নতি আর পরবর্তী লেখকেরা এটাকেই প্রেমের আকর্ষণীয় বিষয় করে তুলেছেন। এটা কেমন দুর্লভ মোহনীয় হয়ে ওঠে তার একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে রফিক আজাদের একটা কবিতা থেকে। 'পরস্ত্রী' নামে কবিতায় রফিক আজাদ প্রলুব্ধ করছেন পাঠককে এভাবে : "উত্তর-তিরিশ তুমি, তবু বউ বউ গন্ধ ঝ'রে পড়ে দেখি/ তোমার বিশদ দেহে, শরীরের ভাঁজে ভাঁজে রাধিকা-কল্লোল,/ অতৃপ্তির স্পষ্ট ছাপ শুকনো ঠোঁটে, আর তুঙ্গ স্তনদ্বয় দেখে/ মনে হয় তেমন শিক্ষিত নন গৃহস্বামী—তোমার মর্যাদা/ কখনো বোঝেননি তিনি। বারেক দেখেই তোমাকে ভীষণ দুঃখী/ ব'লে মনে হয়েছিলো।" আহা, কত সংবেদনশীলতা পরস্ত্রীর জন্যে! এদিকে স্ব-স্ত্রীর কী অবস্থা? সেটা আমরা জানি না।
বিবাহ-বহির্ভুত বলতে আমরা পরকীয় বা পরকীয়া প্রেমকে বুঝিয়েছি। কিন্তু দাম্পত্য-প্রেম বিষয়ে বাংলা সাহিত্য কেন নীরব—তার জবাব তেমন পাওয়া যায় না। আনিসুজ্জামান একবার বঙ্কিম-আলোচনায় বলেছিলেন, প্রেম বিবাহপূর্ব বিষয়। সেকালে ছেলেমেয়েদের বিয়ে হয়ে যেতো শৈশবে। প্রেমোপলব্ধি করার বয়স হবার আগেই তাদের বিয়ে হয়ে যেতো। তাই বঙ্কিম নরনারীর প্রেম দেখাতে ইতিহাসের আশ্রয় নিয়েছিলেন। আমরা দেখবো বাংলা উপন্যাসের আদি স্রষ্টা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর নায়ক-নায়িকাদের নিয়েছেন তাঁর সময় থেকে তিন শ বছর পিছিয়ে। কারণ তাঁর কালে ছেলে মেয়েদের বিয়ে হতো শৈশবে। বঙ্কিম নিজে বিয়ে করেছেন আট বছর বয়সে স্ত্রীর বয়স সম্ভবত তিন বছর। তাই প্রেম কথাটাতো তিনি বোঝেন না। কারণ বঙ্কিম প্রেম যখন বুঝতে শুরু করেছেন তখন তিনি বিবাহিত। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন প্রেম বিবাহ পূর্ব বিষয়। পরবর্তীকালে বঙ্কিমের সমকাল নিয়ে লেখা উপন্যাস দুটো ভয়ঙ্করভাবে দাম্পত্য প্রণয় বিরুদ্ধ গল্প হয়ে ওঠে। নগেন্দ্রনাথ-সূর্য্যমুখী কিংবা গোবিন্দলাল-ভ্রমরের প্রেম তো বাস্তবতার কবরখানা।
দাম্পত্য প্রণয়ের এ তীব্র ক্ষরা দীর্ঘ কালেও কাটে নি। তার আরেক কারণ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। মানিকের কাঁচা বয়সের অত্যন্ত পাকা লেখা 'দিবারাত্রির কাব্য'। এ উপন্যাসে শিক্ষক চরিত্র হেরম্ব প্রেম সম্পর্কে যে দীক্ষা দেয় পনের বছর বয়সী আনন্দকে, তাতে আমরা দাম্পত্য প্রেমকে নরক বলেই ভাবতে পারি। হেরম্ব বলে, বিয়ের পর প্রকৃত প্রেম একমাসের বেশি টেকে না। তবুও দুটো মানুষ শুধু আপসে আপ বাকি জীবন কাটায়। হেরম্বের এ শিক্ষায় কিশোরী আনন্দ এতো হতাশ হয়ে পড়ে যে, এক সময় সে হেরম্বের সামনে ' নিরাভরণ নিরাবরণ' হয়ে আত্মাহুতি দেয়। এ গল্পে সুপ্রিয়া-অশোক, মালতী-অনাথ এদের দাম্পত্য-সম্পর্ককে 'নরকে অনন্ত ঋতু' ছাড়া আর কিইবা বলা যায়। সম্ভবত বাংলা সাহিত্যে মানিকের এ উপন্যাসটি দাম্পত্য-প্রেম বিরোধী সবচেয়ে প্রভাবশালী ডিসকোর্স তৈরি করে দেয়। অথচ বাংলাদেশে আমরা যে সাধারণ জীবনটা যাপন করি তাতে একটি অনন্য সৌন্দর্য আছে দাম্পত্য-প্রেমের সেটা সাহিত্যের বিষয়ই হলো না খুব একটা। বরং দাম্পত্য প্রেমে সুখী লেখকরাও জয়গান গেয়েছেন পরকীয় বা পরকীয়ার।
দুই.
মাহমুদুল হকের 'কালো বরফ' উপন্যাসটিকে দাম্পত্য প্রেমের উপন্যাস হিসেবে পাঠ করতে চাই। সেটা হবে আমাদের জন্য একটি নতুন অভিজ্ঞতা। খালেক বা রেখা দুজনেই ছিন্নমূল অতীত বহন করে চলেছে। একজন দেশ ছাড়া হয়েছে সর্বশেষ দেশভাগে, সে তার শৈশবের মুগ্ধতা মনিভাইজানকে হারিয়েছে। তার অন্য ভাইয়েরা সুপ্রতিষ্ঠিত, কিন্তু মনিভাইজান তাকে তাড়া করে ফেরে। আর রেখাতো মামার ঘরে মানুষ, আশ্রয় প্রশ্রয়হীন একটা নারী। মামীর অনাদর অবহেলার সঙ্গে লিঙ্গের পরিচয় তাকে আপাদমস্তক নিম্নবর্গীয় করে তোলে। বোঝা যায়, স্বামীর সংসার তার একমাত্র আশ্রয়। লেখাবাহুল্য, বেসরকারি কলেজের বাংলার শিক্ষক তার স্বামী আবদুল খালেক উন্মূল, ছন্নছাড়া আত্মউন্নতিতে হতাশ একজন মানুষ। স্বামীর আয়-রোজগারের খামতি, সর্বোপরি কলেজটি উঠে যাবার আশঙ্কা এসবের মাঝেও তাদের প্রেম হয়। আমরা লিখবো কঠিন দাম্পত্য প্রেম যাকে বলে সেটা। মাহমুদুল হক শক্তিমান লেখক এ গল্পের নানামাত্রিক বিভা আর বর্ণ-গন্ধ সত্ত্বেও আমরা কেবল আলো ফেলবো এ দুজন নারী-পুরুষের অনন্য দাম্পত্য প্রেমের উল্লাসে। বাজারে বেশি আড্ডা দিয়ে বিলম্বে বাড়ি ফিরতে ফিরতে খালেক ভাবে, " মাঝে মাঝে এই যে রেখা তাকে ঝাড়াই করে তা একেবারে অকারণে নয়।" বাংলাদেশে দাম্পত্য-প্রেমে অভ্যস্ত পুরুষদের এ অভিজ্ঞতা নেহায়েত কম নয়। রেখার এ ঝাড়াইটা কেমন আমরা একটু দেখতে চাই।
"'কীভাবে যে তুমি কথা বলো—'
'ঘরের বউয়ের কথা কারোই মিষ্টি লাগে না। সব বুঝি,
তোমার একটা প্রেম করা দরকার হয়ে পড়েছে, তা
করলেই তো পারো। পেয়ারের ছাত্রী তো আর নেহাত
কম নয় তোমার, মন মতো একটাকে বেছে নিলেই হয়।'
আবদুল খালেক দাড়ি কামানো থামিয়ে বললে,
'কাউকে দেখছি তুমি বাদ দিতে চাও না!'
'ছাত্রীরা যেভাবে আসে, তা তো নিজ চোখেই দেখি
রোজ। সাজনগোজন ঠাঁটবাট দেখে গা জ্বলে যায়,
যেন নাগর ধরতে এসেছে। আমরাওতো কলেজে
পড়েছি, পড়তে এসে এতো ঢলাঢলি কিসের!'
'ঢলাঢলিটা দেখলে কোথায়? '
'কথা তো বলে না, যেন গায়ে উল্টে পড়ে। তোমাদের
সঙ্গে কথা বলতে গেলে মুখে খৈ ফোটে, আবার
আমাদের সামনে এলে ভেজা বেড়ালটি, সাত চড়েও রা
কাড়তে চাইবে না—'
আবদুল খালেক বললে, 'তোমার দেখায় অনেক ভুল
আছে রেখা। এভাবে দেখো না। এভাবে দেখা উচিত না।
যারা এভাবে দেখে, তারা কেবল নিজের মনের শান্তিই
চুরমার করে।'
'কত শান্তিতে তুমি আমায় রেখেছ।'
আমার ধারণা বাঙালি মধ্যবিত্ত বেশিরভাগ পরিবারের দাম্পত্য ঝগড়ার সাধারণ দৃশ্য এটি। কিন্তু এ দৃশ্য প্রেমের আনন্দে ভাসতে বাধা দেয় না। উচ্চকণ্ঠ স্ত্রী, নিম্নকণ্ঠ স্বামী কেন এমন করে ঝগড়ায় মাতাল হয় তার কারণ যার যার আলাদা কিন্তু প্রকাশভঙ্গি একই।
দুটো মানুষ একসাথে দীর্ঘ কাল থাকলে এমন হয় কিন্তু এটা তাদের জীবন যাপনের জন্য আলাদা কিছু বিড়ম্বনা তৈরি করে না। আমরা আরেকটা উদাহরণ দেবো। খালেক রেখার দাম্পত্য জীবনের বয়স নিতান্ত কম নয়। সংসারে তাদের সাত বছরের একটা সন্তান আছে। কিন্তু দীর্ঘ দিনের সম্পর্কের ক্লান্তি অবসাদ ওরা নানাভাবে কাটিয়ে ওঠে। যেমন,
" আবদুল খালেক মুগ্ধ গলায় বলে, 'তোমার গায়ের গন্ধ
ভারী সুন্দর। মনে হয় কখনো কোনো মানুষজন মাড়ায়
না এমন একটা চুপচাপ নিস্তব্ধ সরু রাস্তা ধরে হাঁটছি,
একচিলতেও রোদ নেই, কেবল সারি সারি বকুল
গাছের আদুরে ছায়া—'
রেখা বললে, 'যা সুন্দর করে তুমি বলো, অন্য মেয়েরা
শুনলে রোগা হয়ে যাবে—'
'খুলি?'
'তোমার ইচ্ছে—'
... .... .....
'টুকু যখন তোমার কোলে এল, তোমাকে দেখলাম, গর্ব
হল, তুমি কী সুন্দরই না হয়েছ। যখন কোলে নিয়ে বসে
থাকো, নানান ছলচাতুরী করে তোমাকে দেখি। মনে হয়
জীবন ভর তোমাকে দেখি। আগে দেখতাম শুধু চোখ
দিয়ে, ওই প্রথম আমার মন দিয়ে দেখতে শেখা—'
রেখা বললে, 'রাতে তোমার হাত গায়ে না থাকলে
আমার ঘুম আসে না—'
'অভ্যাস করেছো বলে অমন হয়।'
'তুমি চাও না আমি ঘুমাই?'
'একশ বার চাই।'
'তাহলে অমন কুঁকড়ে, হাত-পা মুড়ে শুয়ে থাকো কেন?'
'তুমি বললেই পারো।'
'আমাকে বলতে হবে? বলতে যাব কেন? তোমার যদি
ভালো না লাগে, জোর করব কেন। পুরনো হয়ে গেলে
মেয়েদের কীই বা এমন থাকে।'
আবদুল খালেক বললে, 'সব থাকে। আমি তো
পুরোনোই চাই।'
সন্তান, মান-অভিমান, শরীর—এসব দাম্পত্য প্রণয়ের সাধারণ উপাদান। এগুলোর মধ্যে রেখা-খালেক আলাদা করে সময় বের করে নেয়। সেটা নিজেদের জন্য। উপন্যাসের শেষ দিকে দেখছি, খালেক রেখাকে নিয়ে নদী আর জঙ্গল দেখতে বেরিয়ে পড়ে। সেখানে ওরা ভালোবাসায় মাতামাতি করে, সাদা চোখে যাকে পাগলামি বলে মনে হবে। কিন্তু বিবাহবহির্ভূত প্রেমের মতো মাতলামি এটি নয় পাঠক ঠিকই বুঝে যান। আর আবদুল খালেক 'ঘুমোবার আগে রোজ যা হয়, সেই হাত-পা মুড়ে, হাঁটু দ-করে টুকুর মতো এই এতটুকু হয়ে গেল সে। তারপর এক সময় হাতড়ে হাতড়ে রেখার একটা পায়ের ওপর হাত রেখে সে বললে, 'আমাকে কোলে তুলে নাও মাধুরী—'
আর আমরা বলি, পাঠকের হাতে তুলে দেন একটা অনন্য দৃষ্টান্ত রহিত দাম্পত্য প্রেমের গল্প। তিনটা বিষয়ে তিন বাক্যে আমার কথা শেষ করবো। খুব কর্তৃত্বপরায়ণ স্বামীদের এ উপন্যাস ভালো না-লাগার কথা আবদুল খালেকের জন্য। কিন্তু ভালোবাসাপ্রবণ স্বামীরা এটিকে আকরগ্রন্থ মনে করবে। আমরা যাপন করি প্রধানত দাম্পত্য প্রেমে কিন্তু পড়ি আর লিখি বিবাহবহির্ভূত প্রেমের গল্প। এ স্ববিরোধ পেয়েছি ইউরোপ থেকে। কারণ সেখানে বিয়েটা প্রধান বিষয় নয়। মনে একটা প্রশ্ন এলো, রেখা খালেক এমন তরল, গীতল অনুভূতি সঞ্চারি পারস্পরিক প্রেমের শক্তিটা কোথায় পেলো? আমার ধারণা ওদের দারিদ্র্যে এ শক্তি নিহিত। অনেক টাকা পয়সা থাকলে হয়তো বহুগামিতার চোরাবালিতে আটকা পড়ে যেতো এপ্রেম। আশা করি, অনেকে আমার সঙ্গে দ্বিমত করবেন।
• মো. মেহেদী হাসান, অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিক, কুমিল্লা