'প্রতিদিন একটি রুমাল' : জীবনজিজ্ঞাসার জটিল সমীকরণ

বাংলা সাহিত্যের প্রথিতযশা কথাকার মাহমুদুল হক (১৯৪১-২০০৮)। তাঁর ছোটগল্পগ্রন্থ 'প্রতিদিন একটি রুমাল'(১৯৯৪)। ছোটগল্প সাহিত্যপরিবারের নবীন সদস্য। তাই এর যত্নআত্তি একটু বেশিই করতে হয়। লিখিয়েকে মনে রাখতে হয় যে তিনি ছোটগল্প নির্মাণ করছেন। অর্থাৎ এর নির্মাণশৈলী বিশেষ মনোযোগ দাবি করে। এ বিষয়ে তপোধীর ভট্টাচার্য বলেন, "গল্পকার পরিবর্তমান পৃথিবীর ব্যাপক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে সচেতন থাকবেন কিন্তু তাঁর ছোটগল্পের পাঠকৃতিতে ব্যক্ত হবে উপলব্ধির নির্যাস।" এখন দেখার বিষয় ফর্মসচেতন কথাকার মাহমুদুল হক তাঁর ছোটগল্পে কতটা মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়ে শিল্পের নান্দনিক ভুবনে নিজের আধিপত্য বিস্তার করেছেন। 

'প্রতিদিন একটি রুমাল' এ বিভিন্ন সময়ে লেখা মোট ১১টি গল্প রয়েছে। প্রথম গল্প 'হৈরব ও ভৈরব'(১৯৭৮) এ ঢাকী সম্প্রদায়ের প্রসঙ্গ এসেছে। বৃদ্ধ ঢাকী হৈরব বলে, "হাত কি বাজাইব, বাজায় গিয়া মন; পেরথম নিজেরে বাজান শিখ, শ্যাষম্যাষ যা ধরছ হেই বাইজা উঠব, জয়গুরু!" ছেলে ভৈরব পিতার কাছ থেকে বাজনার তালিম নিলে কি হবে ঢাকীদের পেটে ভাত নেই। তাই তো সামন্ততান্ত্রিক সমাজের ভাঙনের সুর এভাবে ধ্বনিত হয়,"'. . .বাবুরা আছিলো, পালপার্বণ আছিলো, ঢাকীগ ভাত আছিলো, গায়ে শাল আছিলো; অহনে পিন্দনের তেনাও নাই—'" এমন বাস্তবতার নিরিখে উপস্থাপিত এই গল্পের আখ্যান। দারিদ্র, জরা, ব্যাধিতে প্রায় অচল হৈরব পাওনাদার উঠতি ধনী গনিমিয়ার হাত থেকে বাঁচতে কাঁথার ভেতর ঢুকলেও রেহাই পায় না। গনিমিয়ার পরামর্শ, ভিটেটুকু বিক্রি করে দেনা পরিশোধ করো। হয়তো ভৈরবের আর কিছুই করার থাকবে না। লেখক সে বিষয়ে কিছু বলেন না। পাওনাদার খালি হাতে যায় না। ঢাকের বাজনা শুনতে চায়। হৈরবের ছেলে ভৈরব দশখুশি বাজাতে গিয়ে নিজের ঢাকটাকেই ভেঙে ফেলে। অর্থনীতির সঙ্গে সংস্কৃতির সম্পর্ক রয়েছে। পুঁজিবাদ মানুষের ঐতিহ্যের ওপর ছোবল মেরেছে। তাই তো হৈরবের আরেক ছেলে ভরত প্লাস্টিকের ফুলের মালী ঢাকীবাবাকে অপমান করতে ছাড়ে না। বেঁচে থাকার জন্য শিল্পের মৃত্যু ঘটে মানে ঢাক ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। পেশা বদলের আভাসে আখ্যান শেষ হয়। বারবার আঘাত আসে নিম্নবর্গের জীবনে, বদল হয় পেশা, বদল ঘটে জীবনের, বদল ঘটে চেনা পৃথিবীর। এমন বদল পরের গল্প 'জোনাকি'(১৯৭৬) তেও দেখা যায়। মধ্যবিত্তজীবনের সংকট নিয়ে এর আখ্যান নির্মাণ করা হয়েছে। অল্প রোজগেরে আবুল হোসেন একনাগাড়ে দশদিন গ্রামে কাটিয়ে শহরে ফিরে দেখেন সংসারের বিশৃঙ্খলা। ছেলে নাগা আর তার বড়লোক মানে ধনবানের সন্তান বন্ধু কামরানের সাথে স্কুল ফাইনাল ফেল করা মেয়ে বুলু কক্সবাজার বেড়িয়ে ঘরে ঢোকে বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে। আবুল হোসেন সন্তানদের স্বেচ্ছাচারিতাকে মেনে নিতে পারে না, শাসন করতে গিয়ে ছেলে নাগার হাতে মার খায় । পুরো ঘটনাটা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়। স্ত্রী সন্তানের পক্ষ নিয়ে বরং দু'চার কথা শুনিয়ে দেয়। অর্থনৈতিক অনিরাপত্তা হয়তো এই অবক্ষয়িত মূল্যবোধের পেছনে দায়ী। স্ত্রীর ভাষায় খুঁটে খেতে শিখতে দিতে হবে ছেলে-মেয়েকে। সেখানে সংস্কার আঁকড়ে থাকলে নাগারূপী সময়ের হাতে জখম হতেই হবে। শেষে দেখা যায় প্রহৃত পিতাকে খেতে ডাকতে আসে বুলু। পিতা আবুল হোসেন এই ডাকে সজীবতা ফিরে পায় কিন্তু পাঠকের বুকের মধ্যে চিনচিনে ব্যথাটা কমে না কেন যেন রয়ে যায়। এই ব্যথাটা আবুল হোসেনের থেকেই সংক্রমিত হয়েছে কিনা…

'অচল সিকি'(১৯৬৩) গল্পটি তো সব বিস্ময়কে ছাড়িয়েছে। মানবমনের গহিনে যে আদি অন্ধকার বাস করে তারই উন্মোচন ঘটেছে এখানে। মধ্যবিত্ত স্বামী-স্ত্রী এনামুল আর জেবুন্নেসা শালবন বেড়াতে আসে। গেটম্যান যখন বলে গতকাল আমেরিকার বার্বোন সাহেব পাঁচটাকা বখশিশ দিয়ে গেছে তখন জেবুন্নেসা তার ব্যাগ থেকে অবলীলায় পাঁচটাকার একটি নোট গেটম্যানের দিকে বাড়িয়ে দেয়। স্বামী এনামুলের কাছে বিষয়টি বাড়াবাড়ি মনে হয়। জেবুন্নেসা স্বামীর কিপটেমি নিয়ে খোঁটাও দেয়। বেড়ানো শেষে ক্লান্ত, অবসন্ন, তৃষ্ণার্ত তারা এক বৃদ্ধের দোকানে চা-বিস্কুট খেয়ে প্রশান্তি লাভ করে। এসবের মূল্যবাবদ স্বামীর অজান্তে অচল সিকি দেয় চোখে ছানিওয়ালা বৃদ্ধ দোকানির হাতে। পরে স্বামীকে গর্ব করে বলে অচল সিকিটা চালিয়ে দিলাম, বৃদ্ধ টেরই পায়নি। এনামুল চোখে ঝাপসা দেখে, সাথে পাঠকও। যে অবলীলায় গেটম্যানকে পাঁচটাকা বখশিশ দেয় সে মূল্য পরিশোধ করে অচল সিকি দিয়ে। মানুষের অবচেতন মনে লুকিয়ে থাকা ক্রুয়েলিটি এখানে বের হয়ে এসেছে। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'বেদেনী' গল্পের কথা মনে পড়ে। 'বুলু ও চড়ুই'(১৯৭৭) গল্পটিতে লেখক মানুষের ওপর আস্থা স্থাপনের চেষ্টা করেছেন যেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় সম্ভ্রম হারানো বুলু আর নির্যাতনের শিকার তার বাবা আজও টিকে আছে। এদের দোষ ছিল এই বাড়ির ছেলে আনু যুদ্ধে গিয়েছিল। প্রতীকী গল্পটিতে বুলুর উক্তি, "মানুষ বড় সুন্দর !" মানুষকে আসলে মানুষের ওপরই আস্থা রাখতে হয়। 

গ্রামীণজীবনের প্রেক্ষাপটে অঙ্কিত গল্প 'বুড়ো ওবাদের জমা-খরচ' (১৯৭৭)। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা থেকে পালিয়ে আসে গ্রামে বুড়ো ওবাদ। যখন যা কাজ পায় তাই করে দিনাতিপাত করে। চোরাকারবারি থেকে শুরু করে পেট চালানোর জন্য সবকাজেই সে আগ্রহ দেখায়। সুবচনীর বাজারে যেদিন নরমেধযজ্ঞ চলে সেদিনও সে ওদের সাহায্যে এসেছিল কিন্তু কোনো পয়সাকড়ি না পাওয়ায় হতাশ হয়। চোখের সামনে একটা জনবহুল প্রাচীন গ্রাম শ্মশানে পরিণত হয়েছিল। সেই মৃত্যুপুরী থেকে তিনটি শিশুর গলিত শবদেহ চুরি করে এনে দাফন করে বেহেশত পাওয়ার আশায় বুড়ো ওবাদ। অথচ এদের হত্যাযজ্ঞ চলার সময় সাহায্য করার বিনিময়ে অর্থ আশা করেছিল হত্যাকারীদের কাছ থেকে। বাস্তবতার নগ্ন প্রকাশে গল্পটি অনন্য হয়ে ওঠে। 'একজন জামশেদ' (১৯৮০) গল্পেও বাস্তবতার নির্মম রূপ প্রকাশ পেয়েছে। বেকার জামশেদ বড় ভাইয়ের আশ্রিত। বড় ভাই আরশাদ পেটে তিনথাক চর্বিওয়ালা স্ত্রীকে লুকিয়ে মেদহীন কাজের মেয়ে রোকেয়ার মাকে ব্যবহার করে ত্রিশ-চল্লিশ টাকার বিনিময়ে। নিজের বেকার জীবনের প্রতি ধিক্কার জন্মালেও জামশেদ প্রেমিকা ঝুনুর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার জন্য শূন্য পকেটে টাকা ভরে রোকেয়ার মায়ের দেহবিক্রির টাকা থেকে তাও আবার তাকে আহত করে। হাল্কা একটু অনুশোচনা হলেও পরক্ষুণেই ফুরফুরে মেজাজে ট্যাক্সি ডাকে প্রেমিকার সাথে দেখা করতে যাওয়ার জন্য। প্রয়োজনের কাছে সবটাই যেন ধরাশায়ী। 'সপুরা ও পরাগল'(১৯৬৪) গল্পটি বীভৎস, অন্ধকারাচ্ছন্ন, কানাগলির কথামালায় ভরা। মালগনি মিয়া মানুষ ধরে এনে ভিক্ষুক বানায়। আর তার কারখানায় তৈরি এসব ভিক্ষুকের আয় তার রোজগারের মাধ্যম। পূর্ণাঙ্গ মানুষকে হাত কেটে, পা কেটে, নুলো বানিয়ে ভিক্ষুক তৈরি করে। অঙ্গ হারানো মানুষগুলো মানসিক পঙ্গুত্বও বরণ করে। লোভ, রিরংসা, পশুত্ব আর ভিক্ষুকরূপী মানবসন্তানের বিপর্যস্ত জীবনের আলেখ্য এই লেখাটি। 

'ছেঁড়া তার' গল্পটি ভাষা-আন্দোলনে আহত নজরুল আর তার বন্ধু মকবুলের। অনেককাল পর ঢাকা শহরে তাদের দেখা। একুশে ফেব্রুয়ারির স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জীবনযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত নজরুল বলে সেদিন আমার আত্মরক্ষা করা উচিত ছিল। কিন্তু সাজানো শহরের বিজ্ঞাপনে ভুল বানান দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। ইটের টুকরো তুলে বিজ্ঞাপনের লাইটবক্সের ওপর ছুঁড়ে মারে। কাচ ভেঙে যায়। আসলে ভাঙে শহরের অন্তঃসারশূন্য বিলাসিতা, আঘাতটা নজরুল ওখানে করে। 'হলধর নিকারীর একদিন' (১৯৭৮) গল্পটি গ্রামীণ নিকারী অর্থাৎ মাছের কারবারিদের নিয়ে লেখা। হলধর টিকে থাকার লড়াইয়ে যেকোনো ধরনের আপস করতে রাজি। মজুতদার দাদন মুনশি, নিষিদ্ধ রাজনৈতিকদলের সদস্য যে কারও সাহায্য সে নিতে পারে। নিজের স্ত্রী মেনকাকে আগে 'মেনকাসুন্দরী' ডাকলেও এখন ডাকে 'মেনকা খানকী'। পাকআর্মি ধরে নিয়ে গেছিলো বলে বিতৃষ্ণা নয় এটা হয়তো তার স্বভাবগত ব্যাপার। বহুগামিতা আরকি। মাছের উৎস নিয়ে উদ্বেগ, মাছ ধরার উপকরণ মজুত করা, ঘাটের দখল নিয়ে লড়াই এমন বহুবিধ বিষয় নিয়ে গল্পশরীর গঠিত। 'অচিনপুর'(১৯৭৩) গল্পটি শহুরে প্রেক্ষাপটে লেখা। বেকার টুপু তার মিনুমামীর মানবেতর জীবনযাপনের গল্প শোনায় আমাদের। মিনুমামীর একমাত্র সন্তান কামরুল হাইজ্যাক পার্টির মেম্বার হয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে জেল খাটছে, স্বামী অন্য মহিলার সঙ্গে সংসার করছে আর পক্ষাঘাতগ্রস্ত মিনুমামী বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে প্রতিমুহূর্তে মরে গিয়ে। টুপুর জীবনও বেদনায় আকীর্ণ। সুখ বাস করে কোনো এক অচিনপুরে যেন, যার নাগাল পাওয়া ভার। 

গ্রন্থের শেষ লেখাটি নামগল্প 'প্রতিদিন একটি রুমাল' (১৯৭৪)। মুক্তিযুদ্ধ কাউকে ভীত (যেমন: সবুজ) আর কাউকে বেপরোয়া (যেমন : আলতাফ) করে তুলেছে এই গল্পে। মানুষের নিঃসঙ্গতা, গভীরতাহীন আবেগ কিংবা আবেগের প্রাবল্য, অস্থিরতা, মানবমনের জটিলতা এমন বৈচিত্র্যময়তায় ভরা এর আখ্যান। রুমাল হারানোর প্রতীকে হয়তো মধ্যবিত্তের পিছুটানকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। বেসরকারি কলেজশিক্ষক সবুজ প্রায়শই রুমাল হারায়। 

মাহমুদুল হক তাঁর গল্পের শরীরজুড়ে এমনকিছু এঁকে চলেন যা অন্য গল্পের বা অন্য বাস্তবতার সন্ধান দেয় সচেতন পাঠককে। অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতির পরম্পরা, আবহমান মূল্যবোধ, শহর, গ্রাম, উচ্চবর্গ ও নিম্নবর্গ সবাই নিজস্বতা নিয়ে প্রতিনিধিত্ব  করছে  'প্রতিদিন একটি রুমাল' গল্পগ্রন্থের অবয়বজুড়ে। আখ্যানে আছে উপলব্ধির নির্যাস আর চরিত্রায়নে ভেতরের ব্যক্তিমানুষকে তুলে আনার প্রয়াস। মাহমুদুল হক কী বলেন আর কীভাবে বলেন দুটোই বিশেষ মনোযোগের দাবি করে। তাঁর মেদহীন গদ্য আর বিষয়ের গভীরতা এমন এক মোহনীয় জগৎ তৈরি করে যেখানে পাঠক পেয়ে যায় আকণ্ঠ নিমজ্জনের আনন্দ। এই আনন্দ তার বোধে ঘা মেরে চেতনালোককে অন্য আলোয় উদ্ভাসিত করে। এই 'অচল সিকি' গল্পটার কথায় ধরুন না…। গল্পের মধ্যে গল্প খুঁজে পাওয়ার পর পাঠককে আবার নতুন করে শুরু করতে হয়। কিংবা 'হৈরব ও ভৈরব' গল্পটি। এখানে ঢাকী সম্প্রদায়ের জীবনের ক্ষয়িষ্ণু দিক দেখাতে গিয়ে বহুকৌণিকভাবে পুরো সমাজকে তুলে এনেছেন তার সকল পরিবর্তনসহ। পাঠকের চিন্তার বিস্তার করার ক্ষেত্র তৈরি হয়ে যায় যেন। তাই বলা যায় দ্রুত কোন সিদ্ধান্ত কোনভাবেই এই লেখকের ব্যাপারে নেওয়া যায় না। বারবার পাঠ অনুভব পাল্টে যায়। অভিজ্ঞতাও পাল্টে যায়। জীবনজিজ্ঞাসা বহুধাবিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে মনের কোণে কোণে। নিঃসন্দেহে স্বল্পপ্রজ কথাকার মাহমুদুল হক এর 'প্রতিদিন একটি রুমাল' গল্পগ্রন্থটি বিষয় ও করণকৌশলের বিশেষত্বের নিরিখে বাংলা সাহিত্যের একটি বিশিষ্ট সংযোজন। আর এর বহুধাবিভক্ত জীবনজিজ্ঞাসা জটিল সমীকরণে আবৃত সেটাও বলার অপেক্ষা রাখে না। 


নূর সালমা জুলি, অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিক, রাজশাহী 

menu
menu