নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে : দেশভাগের মর্মন্তুদ জীবনালেখ্য

অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় এর অনবদ্য সৃষ্টি `নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’। প্রথম প্রকাশ এপ্রিল ১৯৭১ আর দ্বাদশ অখণ্ড সংস্করণ মে ২০১২। উৎসর্গপত্রে লেখা “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এবং আমার মাকে”। এই উপন্যাসটি প্রকাশের কিছুকাল পরেই ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট বারোটি মূল ভারতীয় ভাষায় বইটির অনুবাদ প্রকাশ করে। লেখাটির আখ্যান গড়ে উঠেছে— ‘৪৭ এর দেশভাগকে কেন্দ্র করে। আজকের বাংলাদেশ অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ববাংলার সোনালি বালির নদী তীরবর্তী এক গ্রামের মানুষের সুখ-দুঃখের আলেখ্য। ওই গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর থিতানো জীবনে একটু একটু করে ঢুকে পড়ে রাজনীতি আর তার বিষাক্ত ছোবলে শেকড়চ্যুত হয় এখানকার জল-হাওয়ায় বেড়ে উঠা বাসিন্দারা। হিন্দু ও মুসলমানের সম্মিলিত জীবনাবেগ গ্রামটিতে বহমান আবহমানকাল থেকে। রূপকথার দৈত্য এসে সেই বহমানতাকে রুদ্ধ করে দিল আর অমৃতের সন্তানেরা কেউ আক্রোশে কেউবা অসীম বেদনায় সবকিছু ভবিতব্য ভেবে পা বাড়ালো অনিশ্চিত জীবনের পথে । 

আখ্যানের কেন্দ্রে আছে হিন্দু সমাজের সম্ভ্রান্ত পরিবার ঠাকুরবাড়ি। শুরুতেই লেখক জানাচ্ছেন—“ঠাকুরবাড়ির ধনকর্তার আঘুনের শেষ বেলাতে ছেলে হয়েছে ।” এই বাড়ির কর্তা বৃদ্ধ মহেন্দ্রনাথের চার ছেলে। বড়জন মণীন্দ্রনাথ যে ছাত্রাবস্থায় এক বিদেশিনীকে ভালোবেসে এখন পাগল। পিতার আদেশে বাধ্য হয়ে বিয়ে করে এবং কয়েকমাস পর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। কীটস এর কবিতা আওড়ায়। পরেরজন চিরকুমার ভূপেন্দ্রনাথ যে বড়দার অবস্থা দেখে সংসারের হাল ধরতে মুড়াপাড়ার জমিদারের কাছারিতে কাজ নেয়। সঙ্গে থাকে সেজজন চন্দ্রনাথ। ছোটজন শচীন্দ্রনাথ বাড়িতে থাকে। তৃতীয় প্রজন্ম পলটু, লালটু আর সদ্য জন্ম নেয়া সোনা। বাড়িতে পুরোনো চাকর ঈশম শেখ। এমন একটা সচ্ছল বনেদি পরিবারের সদস্যরা কী করে পথে নামে তার শৈল্পিক বুনন লেখাটি। সঙ্গে আরও আছে রাজপুত্রের মতো দেখতে ছেলের সঙ্গে বিয়ে হওয়া মালতির পরবর্তীকালে চাল স্মাগলারে পরিণত হওয়ার মর্মন্তুদ কথা। আখ্যানের শুরুতে দেখা যায় নতুন শিশুর আগমন, গ্রামে লীগের (মুসলিম লীগ) কর্মকাণ্ড, ঢাকার দাঙ্গায় স্বামীকে হারিয়ে ভাইয়ের আশ্রয়ে আসা যুবতী মালতিকে। এই তিনটি বিষয় প্যারালালভাবে প্রথম পুরুষে বর্ণিত আখ্যানকে আবৃত করে রেখেছে। নতুন জন্ম জীবনের প্রবহমানতাকে, লীগ সংকটকে আর বিধবা মালতির জীবনের আশু বিপর্যয়কে ফুটিয়ে তুলছে যেন । প্রথম দিকেই দেখা যায় শ্রমজীবী আবেদালির ছেলে জব্বর বলছে—“আমি লীগে নাম লেখাইছি ।. . . হিন্দুরা আমাগ দ্যাখলে ছ্যাপ ফালায়, আমরা-অ ছ্যাপ ফ্যালামু ।” হতবাক আবেদালি ছেলের কথায়। হতাশাদীর্ণ কণ্ঠে বলে—“আল্লা, দ্যাশে এটা কি শুরু হইল!” প্রশ্নটা বিধবা মালতিরও, প্রশ্নটা পাঠকেরও। একসময়ের খেলার সঙ্গী মালতি, রঞ্জিত, সামু (সামসুদ্দীন)। রঞ্জিত ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নিষিদ্ধ রাজনৈতিক কর্মী আর সামু ঢাকায় চাকরির সন্ধানে মালতির স্বামীর পেছনে ঘুরে দাঙ্গার পর গ্রামে এসে লীগের অফিস খুলে বসে। হিজল গাছে সামু ইস্তাহার ঝোলায় কিন্তু বিধবা মালতির জন্য তার মনের কোণে অপার বেদনার সঞ্চার হয়। সেদিন সামু মালতিকে ইসলামের বিপন্নতা বোঝাতে কিংবা ছোট বেলার সঙ্গীকে নিজের কাজের কৈফিয়ত দিতে গিয়ে বলে—“. . . আমার জাতভাইরা বড় বেশি গরু-ঘোড়া হইয়া আছে। একবার চোখ তুইল্যা দেখ, চাকরি তগ, জমি তগ, জমিদারী তগ। শিক্ষা দীক্ষা সব হিন্দুদের।” এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে লেখক তৎকালীন রাজনৈতিক ভাবনার স্বরূপ উদঘাটনের চেষ্টা করেন। বিধবা যুবতী মালতিকে অপহরণ করে জব্বর। কতকটা দারিদ্র্য, কতকটা বিদ্বেষ আর কতকটা লালসা—এক হয়ে জব্বরকে দিয়ে এই কাজ করায়। উপন্যাসের প্রথম খণ্ড শেষ হয় জব্বরসহ আরও তিন পুরুষরূপী নরপশুর পাশবিকতার শিকার মালতির দ্বিতীয়বার (এবার স্বইচ্ছায়) ঘর ছাড়ার মধ্য দিয়ে । সঙ্গী পলাতক রাজনৈতিক কর্মী রঞ্জিত। সন্তানসম্ভবা বিধবা নারীর অন্ধকারজীবনের যাত্রা দিয়ে এই খণ্ড শেষ হয়।

উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ডে দেখা যায় কবরস্থানে জোটনের কাছ ওঠে মালতিরা। ওদিকে ঠাকুরবাড়িতে একটি কন্যা সন্তান জন্ম নেয়। আর পৃথিবীর মায়া কাটায় বড়কর্তা মহেন্দ্রনাথ। ভাগ হয়ে যায় দেশ, তৈরি হয় নতুন মানচিত্র, স্বপ্নরা উড়ে যায় নীলকণ্ঠ পাখিদের দেশে, ফেলু খুন করে পাগল মণীন্দ্রনাথকে তেমন কোনো কারণ ছাড়াই এবং পরে সেও অপমৃত্যুর শিকার হয়। শুধু একদা মেধাবী শিক্ষার্থী, সুদর্শন পুরুষ, ভালোবাসার মানুষকে ভুলতে নিজেকে হারিয়ে ফেলা মণীন্দ্রনাথের মৃত্যুর খবর পৃথিবীর কেউ জানলো না। সবকিছু জলের দামে বিক্রি করে ঠাকুরবাড়ির মানুষরা পা রাখে রাজনীতির বেঁধে ঠিকানায়। সামসুদ্দিন একমাত্র সন্তান ফতিমা (সোনার ছোটবেলার সঙ্গী)কে নিয়ে নতুন রাজধানী ঢাকায় বাস করা শুরু করে। রাজনীতিতে তৈরি হয় তার শক্ত অবস্থান। দেশভাগের ফলে এপার বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মুসলিমরা অল্প কিছু হলেও সুবিধা ভোগ করার সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু বিত্তহীন শ্রমজীবী মানুষদের জীবনসংগ্রামের মাত্রাগত কোনো পরিবর্তন ঘটেনি । 

দেশভাগ মুষ্টিমেয় কিছুর ভাগ্যের ইতিবাচক পরিবর্তন আনলেও সামগ্রিক চিত্রটা অবনতির। দেখা যায় ঈশম শেখ না খেয়ে মরছে, রক্ষণশীল হিন্দু পরিবারের মালতি সব হারিয়ে আর দশটা অন্য ধর্মের শ্রমজীবী মহিলাদের সঙ্গে চাল চোরাচালানের মতো কাজ করছে, পেটের ক্ষুধা সোনাবাবুদের সংসারের বন্ধনকে আলগা করে দিয়েছে, বিশাল ও ব্যস্ত শহর কলকাতা কোনো আশার বাণি নিয়ে অপেক্ষা করছিল না এপার বাংলার তাদের জাত ভাইদের জন্য। তাই এক সম্ভ্রান্ত পরিবার তিন বছরের মধ্যে ক্ষুধার তাড়নায় বিনিদ্র রাত কাটায়, উনুনে সেদ্ধ হয় কোন পানি, কোন শস্য দানা নয়। পরিবারের এই দুঃসময়ে সোনাবাবু জাহাজের কাজের জন্য আসে। অপমান, অবহেলা, অনাহার আর আতঙ্ক নিয়ে কাজ পাবার আশায় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা সোনা ঘুঘু পাখির ডাক শুনতে পায়, ঘুঘু পাখির ডাক তাকে বাংলাদেশের কথা মনে করিয়ে দেয়। জাহাজের কাজটা পেলে সাত টাকা হাতখরচ আর দুবেলা খাবার জুটবে। তাই কাজটা তাকে পেতে হবেই। সেকেন্ড অফিসার তাকে স্যার না ডাকার অপরাধে সোনার গালে ঠাস ঠাস করে চড় বসিয়ে দেয়। সোনার মুখের ভেতর তখন রক্তের নোনতা স্বাদ যা সে জিভ দিয়ে লালার সঙ্গে চেটে নেয় এই ভেবে—“পেটে তবু যা হোক কিছু যাচ্ছে ।” দেশভাগের ভয়ংকর পরিণতি মনে হয় এর চেয়ে তীব্রভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব নয়। এখানেই শেষ নেই লেখক চাবুকের কষা হেনেছেন তখন যখন চাকরিদাতা আজন্মসংস্কারে লালিত উচ্চ বর্ণের হিন্দুসন্তান সোনাকে বলে বিফ খেতে হবে জাহাজে কাজ করতে হলে। তখনকার সোনার ভাবনা, “বিফ! আমি বিফ খাব কেন! আমি হিন্দুর ছেলে, হিন্দুস্থানে চলে এসেছি। আমি বিফ খাব কেন! যারা পাকিস্তানে আছে তারা বিফ খাবে। বিফের ভয়ে আমার জ্যাঠামশাই গঙ্গার পাড়ে ঝোপজঙ্গলে বাড়ি করেছেন।” এরপর লেখকের আর কিছু বলার প্রয়োজন নেই। চোখের সামনে ভেসে উঠে একটা চকচকে ধারালো তরোয়াল ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে ধর্মের নামে তৈরি করা নিয়মের বেড়াজালকে, রাজনীতি নামক শক্তির অন্তঃসারশূন্যতাকে, মানবসেবার আড়ালে লুকিয়ে থাকা স্বার্থপরতার পুরু পর্দাকে। সোনাকে রাজি হতে হয়। আর বাংলাদেশের সামসুদ্দীনরা ঠিক সেই সময় নিজের জাত ভাইদের সঙ্গে মুখের ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নেমেছে মাঠে। রক্ত ঝরাচ্ছে রাজপথে। একই সমান্তরালে দুঅঞ্চলের মানুষের ভিন্ন ধরনের লড়াইকে তুলে ধরেন লেখক। লড়াইয়ের উদ্দেশ্য কিন্তু এক—টিকে থাকা। মানুষকে যারা উন্মূল করে দেয় প্রকৃতিরাজ্যে তাদের কি কোনো ক্ষমা আছে...? 

এক নিরাসক্তভঙ্গীতে অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় এই অঞ্চলের অন্যতম স্পর্শকাতর আখ্যানকে মহাকাব্যিক ব্যাপ্তিতে উপস্থাপন করেছেন। গ্রামীণ প্রকৃতি, ভূমিসন্তানদের লড়াই, ধর্মীয় উৎসব, ব্যক্তিমানুষের যৌনজীবন, স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের শৈল্পিক উপস্থাপনা লেখাটি। সাদত হাসান মান্টো, মাহমুদুল হক বা হাসান আজিজুল হকদের মতোই মুহাজির হতে হয়েছিল অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তাই নিজের জীবনের মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতাটি শিল্পের ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন যথার্থভাবেই। আর সেই যথার্থতার মধ্য থেকে পাঠক এই অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হয় যে দেশভাগের মন্ত্র সাধারণ মানুষ কীভাবে কণ্ঠস্থ করলো? উত্তরটা মনে হয় এমন হিন্দু-মুসলমানের ধর্মকে কেন্দ্র করে আজন্মলালিত সংস্কার তাদের সংকটকে ত্বরান্বিত করেছে। সম্পর্কের মধ্যে ফাটল তৈরি করেছে। আর ওই ফাটলে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে রাজনীতি তার সমস্ত অপশক্তি নিয়ে ঢুকে বেনোজলে ভাসিয়ে দিয়েছে বিফ খাওয়া না খাওয়া অমৃতের সন্তানদের। 

সোনা এদেশ ছাড়ার সময় নিখোঁজ পাগল জ্যাঠামশাইর জন্য অর্জুন গাছের গায়ে বার্তা লিখে রেখে যায়, “জ্যাঠামশাই, আমরা হিন্দুস্থান চলিয়া গিয়াছি—ইতি সোনা ।” এই বার্তা বিশাল একটা দীর্ঘশ্বাসের মতো ঘুরে বেড়ায়। বস্তুত, প্রস্থান মানেই বেদনার আর সেটা যদি প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে যাওয়া হয় তা আরও গভীর হয়ে বাজে মর্মে। আখ্যানের শেষে একরাশ বিষাদ পাঠকের হৃদয়কে আচ্ছন্ন করে ফেলে। অতঃপর আকাশজুড়ে নেমে আসে অন্ধকার আর একটা অব্যক্ত আর্তনাদ সোনালি ডানার চিল হয়ে উড়ে উড়ে বেড়ায় কাঁটাতারের বেড়া কিংবা অস্ত্র হাতে উর্দি পরিহিতদের নাগালের অনেক ওপর দিয়ে । এবং মাটির পৃথিবীতে রাজনীতির পাশাখেলায় হেরে যাওয়া মানুষরা পাবে না জেনেও সংশপ্তকের দৃঢ়তায় নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে একটু একটু করে ক্ষয় হতে থাকে—


নূর সালমা জুলি, অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিক, রাজশাহী 

menu
menu