‘দূরস্বদেশে’ বাংলা সাহিত্য চর্চা ও বাংলা বইয়ের সংস্কৃতি

‘দূরবিদেশ’ কথাটির তাৎপর্য  সহজে অনুধাবন করা যায়, কিন্তু ‘দূরস্বদেশ’ কিছুটা বিভ্রান্তিকর মনে হতে পারে। তাই এর অর্থ পরিষ্কার করে নেয়া জরুরি। আগে বাংলাদেশের বাইরে যাঁরা বসবাস করতেন তাঁদের ‘প্রবাসী’ বললেই চলত। যেন এর মধ্যে ফিরে আসার বার্তাও থাকত। সবাই ফিরে আসবেন এমন বোঝানো না হলেও দূরের কোনো দেশে নিজেদের একটা নৃগোষ্ঠীগত বা সংস্কৃতিগত জনগোষ্ঠীর কথা ভাবা হতো না। বিগত চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে যুক্তরাজ্যে, উত্তর-আমেরিকায়, অস্ট্রেলিয়ায় বা ইয়োরোপের আরো কোনো কোনো দেশে বাংলাদেশের মানুষের জনসমাজ গড়ে উঠছে। তাঁদের অনেকেই স্থায়ীভাবে সেসব দেশের নাগরিক হয়েছেন বা হতে যাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, আর বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ফিরে আসার কথা ভাবছেন না এমন মানুষের সংখ্যাও এখন বিপুল। সংখ্যায় তাঁরা এমনই উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে আছেন যে,  দূরের যে-দেশের স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছেন বা হতে যাচ্ছেন সেটি এখন তাঁদের ‘স্বদেশ’ হয়ে উঠেছে। 
নতুন স্বদেশে যাঁরা বসবাস করেন সঙ্গত ও স্বভাবিক কারণেই তাঁদের বিচিত্র সাংস্কৃতিক ভিন্নতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সাংস্কৃতিক এই ভিন্নতা ও বৈচিত্র্য তাঁদের মনে প্রতিক্রিয়া বা চাপ সৃষ্টি করে। সেই সূত্রেই অনেকেরই মনে কিছু কথা জমে। তাঁদের মধ্যে দেশে থাকাকালেও যাঁরা লেখালেখি করতেন তাঁদের অনেকের এমন হয়েছে যে, জীবন যাপনের বাস্তবতার চাপে লেখালিখির প্রতি আত্মতাগিদ ক্রমশ কমে গিয়েছিল। ফলে ধারাবাহিক ভাবে সক্রিয় থাকা সম্ভব হয়নি। কিন্তু অন্য দেশে বসবাস করতে গিয়ে সেখানকার ভিন্ন সাংস্কৃতিকতা ও ফেলে আসা জীবনের স্মৃতির চাপে মনে এমন কিছু কথা জমে যা প্রকাশ করার জন্য মন আকুল হয় তাঁদের! সেই আকুলতাই উদ্বুদ্ধ করে কিছু লিখতে। এই সূত্রে লেখালিখিতে অভিজ্ঞতার চাপ যতটা থাকে ততটা থাকে না পরিশীলনের ধৈর্য! যে দেশের নতুন নাগরিক হিসেবে তাঁরা বসবাস করেন সেখানকার সাংস্কৃতিকতার অনেক কিছুর তাৎপর্য নিজের যাপনের জন্য অনুভব করে ওঠেন না, ফলে পরিশীলনের ঊনতাও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনুভব করে উঠতে পারেন না তাঁরা। অথচ নতুন জীবন যাপন পরিস্থিতির অনুপ্রেরণায় নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা লেখেন। তাঁদের সেইসব লেখা স্থানীয় ক্ষুদ্র স্বজাতীয় জনসমাজের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয় সাদরে। দেশে থাকাকালে বাস্তবতা ছাপিয়ে লেখক হিসেবে কাঙ্ক্ষিত সাড়া না পেয়ে একসময় হয়তো লেখক হওয়ার স্বপ্ন মরে গিয়েছিল। কিন্তু ‘দূরস্বদেশে’ সামান্য সামর্থ্যেই সামাজিক সাড়া তাঁদের অনুপ্রাণিত করে বলে প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও তাঁরা লেখকতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে তাঁরা অনুপ্রাণিত হন। সক্রিয়তার সমাদর তাঁদের অনুপ্রেরণার মাত্রাকে বাড়িয়ে তোলে। 
প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজেদের সক্রিয় রাখতে রাখতে অজান্তেই বাংলাদেশের সাহিত্যের নতুন একটি ধারা সৃষ্টির পথে এগিয়ে চলেছেন তাঁরা। এখন চলছে এর গড়ে-ওঠার প্রাথমিক কাল। বাংলাদেশের পটভূমিই যদি বিবেচনা করা হয় তাতে এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, দূর স্বদেশের ভৌগোলিকতা ও সাংস্কৃতিকতায় বসবাস-উদ্ভুত নতুন সাংস্কৃতিকতা বাংলাদেশের চলমান সংস্কৃতিতে যেসব অনুষঙ্গের যোগ ঘটিয়ে চলেছে তার প্রভাব এক সময় বাংলাদেশের সাহিত্যে ভিন্নতায় ও স্বতন্ত্র্যে উজ্জ্বল একটি ধারার যোগ ঘটাবে।
স্বল্প-সংখ্যক লেখক ‘দূরস্বদেশে’ থেকেও হয়তো নিজের মূল দেশের জন্যই সাহিত্য চর্চা অব্যাহত রাখতে পারছেন; তাঁরা হয়তো দেশের পাঠকদের কাছে আগেও গ্রাহ্য ছিলেন এবং ভিনদেশে বসবাস করা সত্ত্বেও অছেন। তাঁরা এখানে ব্যতিক্রম বলে বর্তমান আলোচনায় তাঁরা বিবেচ্য নন। কারণ সচেতনভাবেই তাঁরা বসবাস করেন বাংলাদেশের অতীতের মনোজাগতিকতায়। নতুন সাংস্কৃতিকতার স্পর্শকে তাঁরা দেখে থাকেন স্বদেশের পুরোনো পরিপ্রেক্ষিতেই। আবার বাস্তবতা এই যে, নতুন সাংস্কৃতিকতায় বসবাসরত পরিশীলননিস্পৃহ লেখকদের ভূমিকা সম্পর্কে বাংলাদেশের সাহিত্য সমাজে যেমন গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হয় না তেমনি আবার নতুন ও ভিন্ন সাংস্কৃতিকতায় বিকাশমান জনসমাজও এই স্বাতন্ত্র্য নিয়ে চিন্তা করার মতো পরিণত হয়ে ওঠেনি। এসব নিয়ে নিজেদের মধ্যেকার কথাবার্তা এক ধরনের পিঠ চাপড়ানিমূলক পরিস্থিতিতেই সীমিত থাকে। 
‘দূরস্বদেশবাসী’রা নিজেদের সাহিত্যকর্ম নিয়ে অনুষ্ঠানাদির আয়োজন করে আমন্ত্রণ জানালে সৌজন্যবশত বাংলাদেশ থেকে আসা সারস্বতজনেরা সানন্দে যোগ দেন তাতে। ভিন দেশের ভিন্ন ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে স্বদেশীয়দের সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চার নিদর্শন তাঁদের আনন্দিত করে, সেই সূত্রেই তাঁরা আনন্দ প্রকাশক কথাবার্তা বলে থাকেন। অন্য দিকে সুধীজনের উপস্থিতি এবং এই শুভেচ্ছা বাক্যটুকুতেই আমন্ত্রণকারীদের পরিতৃপ্তি; এটুকু প্রচারণার ঔজ্বল্যেই তাঁরা সন্তুষ্ট। মনোভাব তাঁদের এমন যে, এতেই তাঁদের অর্জনের সম্পন্নতা। 


সাম্প্রতিক কালে সমাজ রূপান্তরের বাস্তব অবস্থা এমন যে, বাংলাদেশে রসিকসমাজের কাছে লেখকের ‘প্রকৃত গ্রহণীয়তা’ আর ‘দৃশ্যত গ্রহণীয় মনে হওয়া’র পার্থক্য ঠিক বোঝা যায় না। রাষ্ট্রক্ষমতার নিকটবর্তীদের বস্তুগত সাফল্য বাংলাদেশের সমাজে এমন স্তরে পৌঁছেছে যে রুচির চেয়ে ক্ষমতা ও অর্থবিত্তের প্রভাব অসঙ্গত ক্ষেত্রেও নিরূপক ভূমিকায় থাকে। ‘দূরস্বদেশবাসী’রা স্বল্প-সময়ের মধ্যেই উন্নত দেশে বসবাসের সুযোগ সুবিধার বলে নিজ দেশে ক্ষমতা ও বিত্তের প্রতিনিধি হয়ে উঠতে পারেন। তাঁরা এরই মাধ্যমে প্রকাশিত বই নিয়ে স্বদেশেও আপাত কল্কে পেয়ে যান। বই প্রকাশের সূত্রে স্বল্প আয়াসেই খ্যাতিমান লেখক-সাহিত্যিকদের হাজির করে ফেলতে পারেন ছোটখাট অনুষ্ঠানে। এভাবে খুব সহজেই সারস্বত সমাজে গ্রহণীয় বলে প্রকৃত না হলেও দৃশ্যত বিবেচিত হতে থাকেন। বাংলাদেশের পুস্তক প্রকাশকদের কেউ কেউ এই প্রবণতাকে গ্রহণ করেন পুঁজি সংগ্রহের সুযোগ হিসেবে। লেখক-প্রকাশক লিখিত বা অলিখিত চুক্তি অনুসারে প্রকাশিত প্রয়োজনীয়-সংখ্যক কপি লেখককে দিয়ে দিলেই প্রকাশকের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়। কখনো কখনো বইয়ের খুব স্বল্প সংখ্যক কপি আলোর মুখ দেখিয়েই কর্মসূচির সমাপ্তি ঘটে। পাঠকদের কাছে পৌঁছানোর দায় থাকে না। স্বাভাবিক ভাবেই অধিকাংশ বইই পাঠকের কাছে পৌঁছোয় না। অনেক লেখককে বলতে শুনেছি বাংলাদেশের প্রকাশকদের বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়া ভালো না। কিন্তু বইয়ের বাজারজাতকরণ কিভাবে উন্নত দেশে হয়ে থাকে সেসব দেশে বাস করেও তাঁরা এর সামান্য খোঁজও রাখেন না বলে বইয়ের বাজারজাত বলতে কী বোঝায় তা অনুধাবন করতে পারেন না। আবার বাংলাদেশের  অধিকাংশ বই কেন বইয়ের দোকানে পাওয়া যায় না সে সম্পর্কে বাস্তব কোনো ধারণা ছাড়াই এ ধরনের কথা বলে থাকেন।
লেখকের টাকায় বই বের হওয়াকে দীর্ঘকাল ধরে বাংলাদেশে লেখকের পক্ষে অসম্মানের বলে মনে করা হয়ে থাকে। আবার পাঠক না থাকার হাহাকারের মধ্যে লেখকের মনের অনুপ্রেরণা জ্বালিয়ে রাখতে বই প্রকাশের বিকল্প নেই। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই লেখকেরা নিজের লেখকসত্তার প্রচারণার স্বার্থে প্রকাশককে টাকা দিয়ে বই বের করে এক ধরনের আত্মসন্তুষ্টি লাভ করেন। এরকমটা অনেক খ্যাতিমান লেখককেও করতে হয়; উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পাঠক পাওয়া যাবে না মনে করে অনেক লেখক গুরুত্বপূর্ণ বইও প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রকাশককে সহযোগিতা করেন অর্থ বিনিয়োগ করে। উন্নত দেশগুলোতেও বিপুল পরিমাণে এমন হয়ে থাকে। ইয়োরোপ-আমেরিকায় সবচেয়ে জনপ্রিয় এই প্রক্রিয়া ‘সেল্ফ পাবলিশিং’ নামে পরিচিত। কিন্তু এ কথা ঠিক যে, ‘সেল্ফ পাবলিশিং’ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোও বই-প্রকাশের ন্যূনতম সংস্কৃতি মেনে চলে। যেমন তারা ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড বুক নাম্বার, সংক্ষেপে আইএসবিএন নম্বর পেশাদারিত্বের সঙ্গে ব্যবহার করে। ফলে একটি বইয়ের লেখক, প্রকাশক ও এর সংস্করণ নিয়ে বিভ্রান্ত হন না বইয়ের ক্রেতা বা সংগ্রাহকেরা। ‘সেল্ফ পাবলিশিং’ সেবাদানকারীরা  একটা বইয়ের টেক্সট-ম্যাটারকে সাধারণ মানসম্পন্ন ভাবে উপস্থানের জন্য কিছু স্ট্যান্ডার্ড টেম্পলেট প্রস্তুত করে রাখে। সেই টেম্পলেট অনুসারে বইয়ের টেক্সট-ম্যাটার সাজিয়ে দিলে দৃশ্যত বইকে ন্যূনতম পরিশীলিত রূপেই দেখা যায়। বাংলাদেশের গ্রন্থ-সংস্কৃতির বর্তমান অবহিতির বাস্তবতায় সাধারণ দৃষ্টিতে ইয়োরোপ-আমেরিকায় প্রকাশিত ‘সেলফ পাবলিশিং’-এর বইয়ের সঙ্গে নামি ঐতিহ্যবাহী প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত বইয়ের গুণগত মানের পার্থক্য তাই খুব একটা বোঝা যায় না। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় ‘সেল্ফ পাবলিশিং’-এ প্রকাশিত বইয়ের পার্থক্য শুধু এখানে যে, এখানকার কোনো কোনো মূলধারার নামি প্রকাশনা সংস্থাও লেখকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাঁদের প্রতিষ্ঠানের রীতি-নীতিকে সামান্যতম বিবেচনা না করেই বই প্রকাশ করে থাকেন। এ রকম হরহামেশাই ঘটে বলে সেইসব প্রকাশনা সংস্থার বইয়ের নিজস্ব সাংস্কৃতিকতার ওপর সত্যিকারের ছোট্ট পাঠকসমাজের আস্থা গড়ে ওঠে না। প্রকৃত পাঠক বই পড়তে গিয়ে অনুভব করেন যে তাঁরা ঠকেছেন। ফলে এইসব প্রকাশকের বই তাঁরা কিনতে চান না। অথচ প্রকাশকেরা সবসময় বলতে থাকেন যে, বই বিক্রি হয় না। অন্যদিকে লেখকেরা বিবেচনা করেন না বইটি তাঁরা কোন ধরনের পাঠকের কাছে পৌঁছাতে চান। ভাবলেও যে ধরনের পাঠকের কাছে তাঁরা পৌঁছাতে চান তার জন্য কী উপায় অবলম্বনে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে তা নিয়ে ন্যূনতমও চিন্তা করেন না। বইপ্রিয় মানুষের রুচি কেমন হয়ে থাকে, কোন ধরনের বই কোন রুচির মানুষের কাছে পৌঁছানো দরকার, পৌঁছানোর উপাই বা কী হতে পারে তা নিয়ে না ভেবে বই প্রকাশ করলে যে বই সহজে বাজারে উপস্থাপিতই হবে না তা তাঁরা বুঝে দেখতেও চেষ্টা করেন না!
সামান্য খোঁজ করলেই বোঝা যাবে, উন্নত দেশে ‘সেল্ফ পাবলিশিং’ পদ্ধতিতে প্রকাশিত বইকে বইয়ের জগতের মূল ধারায় প্রবেশাধিকার পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়, এই ধরনের বইয়ের ক্ষেত্রে অনেক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সাফল্য প্রাপ্তির ঘটনা বিরল ব্যতিক্রম! তবে এও মনে রাখতে হবে, উন্নত দেশগুলোতে প্রচুর পুস্তক-সমালোচনা ও পরিচিতির মাধ্যম রয়েছে। এমনকি ‘সেল্ফ পাবলিশিং’ পদ্ধতিতে প্রকাশিত বইয়ের সমালোচনার জন্যও রয়েছে অনেক মাধ্যম। যদি কোনো বই সেইসব মাধ্যমে বিষয়বস্তু, রচনাসামর্থ্য বা নতুনত্বের কারণে চিহ্নিত হয় তাহলে সে বই মূলধারায় যেতেও পারে। যদিও সে সম্ভাবনা খুবই কম। যুক্তরাষ্ট্রের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, ‘রাইটার্স ডাইজেস্ট’ বা ‘পোয়েটস অ্যান্ড রাইটার্স’ জাতীয় পত্রিকায় প্রচুর ‘সেলফ পাবলিশার্সে’র বিজ্ঞাপন থাকে। নবীন বা সৌখিন লেখকদের মধ্যে প্রকাশনা সেবা দেয়াতেই এই ধরনের মুদ্রণ সংস্থাগুলোর মূল পেশাদারিত্ব। এই প্রতিষ্ঠানগুলো বই প্রকাশের জন্য নানা রকম ‘টেম্পলেট’ তৈরি করে রাখে। লেখকেরা সেল্ফ পাবলিশিঙের জন্য সেই ‘টেম্পলেট’ অনুসারে কম্পোজকৃত রচনা সরবরাহ করলে চাহিদা মতো নির্দিষ্ট সংখ্যক কপি মুদ্রণ বা ই-বুক প্রস্তুত করে দেয় সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। চটজলদি দেখে এইসব প্রকাশনা থেকে বের হওয়া বইয়ের গুণগতমানের পার্থক্য বোঝা যায় না। এমনকি এই ধারায় একজন ক্রেতার জন্য এক কপি বইও প্রকাশ করা সম্ভব! ‘প্রিন্ট অন ডিমান্ড’ পদ্ধতি অনুসরণে এভাবে বই বের করা যায়। সম্প্রতি বিশ্বের সবচেয়ে বড় অনলাইনে বই বিক্রয় প্রতিষ্ঠান ‘অ্যামাজনডটকম’ সেল্ফ পাবলিশিং-এর ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। 'অ্যামাজনডটকম' তাদের নিজস্ব টেম্পলেট অনুসারে প্রকাশনার কাজ নির্বাহ করে দেয় মাত্র। এর জন্য প্রকাশককে খুব সামান্য অর্থ ব্যয় করলেই চলে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রকাশক হিসেবে লেখক তাঁর দায়িত্ব নিজ হাতে তুলে নেন, অথবা প্রকাশনা সংস্থার নামের জায়গায় যে কোনো একটা নাম বসিয়ে দেন। তবে এ কথাও ঠিক যে, ‘সেল্ফ পাবলিশিং’ পদ্ধতিতেও পূর্বোক্ত পরিস্থিতির চেয়ে উন্নততর ব্যবস্থাও রয়েছে। অনেক নামি প্রকাশনা সংস্থাও বিপুল সংখ্যায় বই উৎপাদন করে মজুত বাড়ায় না। ক্রেতাদের চাহিদা যতটুকু থাকে ততটুকুই প্রকাশ করে।
‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাবলিশার’ নামে চিহ্নিত আরেক ধরনের প্রকাশনা সংস্থা আছে যারা পেশাদারিত্বের সঙ্গে প্রকাশনার কাজ সম্পাদন করে থাকে। তারা প্রকাশনা ব্যয়ের আংশিক বা পুরোটাই লেখকের কাছ থেকে নিয়ে থাকতে পারে। তারাও মূলত ‘সেল্ফ পাবলিশিং’ পদ্ধতিতেই বই প্রকাশ করে থাকে; কিন্তু এই ধারার প্রকাশনা সংস্থাও নানা স্তরের সম্পাদনার মধ্য দিয়ে পাণ্ডুলিপির মান উন্নয়ন করে। কারণ প্রকাশনাসেবা দানকারী পেশাদারিত্বের অনুশীলনের মধ্য দিয়েই তারা সেবা দিয়ে থাকে। ভালো প্রকাশনা সংস্থার মতোই তারা বাজারে উপস্থাপনের প্রক্রিয়াগুলোতে অংশগ্রহণ করে। এই ধারার প্রকাশনা সংস্থাগুলো সাধারণত বই প্রকাশ করে থাকে স্ব স্ব নীতিমালার আওতায়। ভালো পাণ্ডুলিপির বইরূপও এই ধারার প্রকাশনার মধ্য দিয়ে মাঝে মাঝে পাওয়া যায়। বিপণনের এক ধরনের নেটওয়ার্কেও তারা থাকতে পারে। 
পাশ্চাত্যে ‘ভ্যানিটি পাবলিশার’ নামে আরেক এক ধরনের প্রকাশনা সংস্থা আছে যারা লেখকের কাছ থেকে অর্থ সহায়তা নিয়ে থাকে। বইকে লেখকের কাঙ্ক্ষিত মানে প্রকাশের জন্য লেখকের কাছ থেকে ফি হিসেবে অর্থ সহায়তা নিয়ে থাকে। তারা বই প্রকাশ করে নির্দিষ্ট সংখ্যক কপি লেখকের কাছে বাণিজ্যিক মূল্যে বিক্রির শর্তে। 
‘স্মল প্রেস’ নামে পরিচিত আরেক ধরনের প্রতিষ্ঠান আছে যারা পেশাদারিত্বে বড় প্রকাশকদের মতোই উন্নত। কিন্তু বাণিজ্যিকতার চেয়ে জ্ঞানগত বা সংস্কৃতিগত তাৎপর্যকে তারা অগ্রাধিকার দেয়। এইসব সংস্থার পুঁজিগত আকার খুব বড় হয় না। সাধারণত সাহিত্যে বা জ্ঞানচর্চায় নিবেদিত ব্যক্তিবর্গের সামাজিক পুঁজির ওপর নির্ভর করে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে তারা কাজ করে। রাষ্ট্রসংস্কৃতির সবকিছুই তারা পেশাদারিত্বের সঙ্গে অনুসরণ করে থাকে। অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে তালিকাভুক্ত থাকে বলে তারা অন্য বাণিজ্যিক প্রকাশনা সংস্থার তুলনায় রাষ্ট্রীয় কিছু আর্থিক সুবিধা বা অনুদান পায়। কিন্তু লেখকের সঙ্গে চুক্তি করার সময় বা পাণ্ডুলিপি উন্নয়নের সময় তারা থাকে পুরো পেশাদার। এমনকি এইসব বইয়ের মূল্যও একটু বেশি হয়ে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা জানে যে এর বাজার খুব ছোট। পেশাদারিত্বের পরিমণ্ডলে থেকেও তাদের ভূমিকা অনেকটা যথার্থ লিটল ম্যাগাজিনের মতো।
কোনো কোনো নামি প্রকাশনা সংস্থা বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে রেফারেন্স বই হিসেবে চাহিদা থাকতে পারে এমন বিবেচনায়ও কিছু বই প্রকাশ করে। কিন্তু নামি প্রকাশকেরা ন্যূনতম সংখ্যক কপি বিক্রি না হলে বিনিয়োগ ব্যর্থ হতে পারে বিবেচনা করে লেখকের কাছ থেকেই সম্ভাব্য ক্রেতার খোঁজ চায়। তারা অনেক সময় এই রকম নিশ্চয়তা চায় যে, বইটি প্রকাশিত হলে বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে কেনা হবে। পাণ্ডুলিপি ভালো থাকলেও এই ধরনের নিশ্চয়তা ছাড়া বই প্রকাশক পাণ্ডুলপি গ্রহণ করে না। বাংলাদেশের বৌদ্ধিকতার পরিমণ্ডলে সক্রিয় মানুষেরাই তাঁদের জ্ঞানগত দিক থেকে পাঠকের সম্পর্ক কী হবে তা নিয়ে ভাবেন না। ফলে বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বইয়ের বাজার গড়ে ওঠেনি। সংগত কারণেই দূরস্বদেশবাসী লেখকেরাও বাংলাদেশের প্রকৃত পাঠকের কাছে সহজে পৌঁছতে পারেন না। বন্ধুবান্ধব বা নিকটজনদের কাছেই তাঁদের যত সমাদর! ফলে লেখক হিসেবে নিজেদের মধ্যে উৎকর্ষপ্রয়াসের তাগাদা জন্মে না। পরিণামে অনেক সময় স্বল্পসংখ্যক রুচিশীল পাঠকের উন্নাসিকতার শিকার হয়ে তাঁর ব্যথিত হন।


‘দূরস্বদেশে’র বাংলাদেশি জনসমাজে যে সাহিত্য চর্চার ছোট্ট ইতিহাস গড়ে উঠতে শুরু করেছে তাতে এখনো যোগ হয়নি এই সমাজের আত্মবিশ্বাস! ফলে এখানকার লেখকদের মধ্যে দু-একজন ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলাদেশে বই প্রকাশের জন্য পাণ্ডুলিপি উপস্থাপন করা হয় পাণ্ডুলিপির গুণ বিচারের ভরসা করার তার চেয়ে অর্থের ওপর ভর করে। এই প্রবণতা বেশি বলে বিগত বছরগুলোতে দূরস্বদেশবাসী লেখকদের বই এভাবেই বের হয়। মূল ধারার ‘সেল্ফ পাবলিশিং’-এর দ্বারস্থও খুব বেশি কেউ হন তেমন নয়। কাউকে কাউকে দেখা যায় ফটোকপি জাতীয় মুদ্রণযন্ত্রের সেবা নিয়ে কিছু বই বের করতে যার অধিকাংশকেই কোনোভাবে মান সম্পন্ন কাজ বলা যায় না। অথচ এভাবে বই বের করে প্রকৃত পাঠকের কাছে হাজির না হয়েও এখানকার লেখকদের সন্তুষ্ট থাকতে দেখা যায়। যেনতেন প্রকারে প্রকাশনার সংস্কৃতি অনুসরণ না করে বাংলাদেশ থেকে ছাপা ও বাঁধাইয়ের কাজ সম্পন্ন করেও কেউ কেউ বই প্রকাশ করেন। ‘দূরস্বদেশে’র ছোট্ট জনসমাজে লেখক হিসেবে তাঁরাও নিজেদের অগ্রসর শ্রেণির প্রতিনিধি বলে নিজেদের বিবেচনা করে থাকেন। মূল ধারার ‘সেল্ফ পাবলিশিং’ পদ্ধতির দুয়ারেও তাঁরা কড়া নাড়তে এখনও সমর্থ নন এই ধারার ব্যবসায়ীদের ন্যূনতম পাঠকসমাজ নেই বলে! 
স্মরণীয় যে, সম্প্রতি বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার ইংরেজি ভাষায় লেখা বই A Broken Dream এই মাধ্যমে প্রিন্ট অন ডিমান্ড পদ্ধতিতে প্রকাশিত হয়েছে ‘অ্যামাজনডটকম’ মাধ্যমে। কিন্তু ন্যূনতম বাজার নেই বলে ‘অ্যামাজনডটকম’ ‘সেল্ফ পাবলিশিং’ পদ্ধতিতে বাংলা বই প্রকাশের প্রক্রিয়া এখনো ভালোভাবে শুরু করতে পারেনি। ইংরেজি ভাষায় বাংলাদেশি লেখকদের আরেও বেশ কয়েক জনের  বই ‘অ্যমাজনডটকম’-এ পাওয়া যায়। অতি সম্প্রতি ফ্লোরিডার কামরুন জিনিয়া সম্পাদিত বাংলাদেশি ডায়াস্পোরা লেখকদের বাংলা-ইংরেজি দ্বিভাষিক রচনার সংকলন AKASHLEENA: A LITERARY ANTHOLOGY OF BANGLADESHI DIASPORA-ও আমাজন মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা ফন্টে বই প্রকাশ করে অ্যামাজনডটকম হয়তো প্রথমবারের মতো বাংলা বইয়ের ‘সেলফ পাবলিশিং’ অধ্যায়ে প্রবেশ করল। অতি সম্প্রতি বইয়ের হাটও বাংলা ‘অ্যামাজনডটকমে’র মাধ্যমে বাংলা বইয়ের প্রকাশনা শুরু করেছে। আশা করা যায় বাংলাদেশ ও ভারতের বাংলাভাষী লেখকদের সঙ্গে ‘দূরস্বদেশে’র বাংলাভাষী লেখকেরাও উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় সেখানে  উপস্থিত হবেন। ফলে বাংলা বই প্রকাশের বর্তমান সংস্কৃতিরও সম্প্রসারণ ঘটতে শুরু করবে।
যাঁরা ইংরেজি ভাষায় লেখালিখি করেন তাঁদের এগোতে হয় মূল ধারার সংস্কৃতি অনুসরণ করে। তাঁদের খোঁজ প্রবীণ বাংলাদেশি জনসমাজের কাছে ঠিক মতো পৌঁছায় না! কারণ নবীন প্রজন্মের ভূমিকাই সেখানে বেশি। তাঁদের আর ‘দূরস্বদেশবাসী’ জনসমাজের পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করা হয় না। তাঁর হয়ে ওঠেন মূলধারার লেখক। কক্ষচ্যুত নক্ষত্রের মতো হঠাৎ হয়তো তাঁদের কাউকে স্বদেশি জনসমাজে দেখা যায় দ্বিধান্বিত পরিতৃপ্তি নিয়ে। এ পর্যন্তই তাঁদের অস্তিত্ব স্বদেশি জনসমাজে।
‘দূরস্বদেশে’ বসবাসরত বাংলাদেশের বাংলাভাষী লেখকদের বই প্রকাশনার যে চিত্র এই রচনায় আঁকা হলো তা নিয়ে হয়তো এখনই যথেষ্ট আশা করার কারণ নেই। বাস্তব প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়ে সংগ্রাম করতে গিয়ে এখনো তাঁরা স্বসমাজে নিজেদের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুভব করে উঠতে পারেননি। কিন্তু ক্রমবর্ধমান বাংলাদেশি জনসমাজ যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তাতে বাংলাভাষার সাহিত্য স্বল্প কালের মধ্যেই যে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে উত্তীর্ণ হয়ে উঠবে সে প্রত্যাশা অবাস্তব নয়। এখন কেবল দরকার লেখকদের আত্মবিশ্বাস এবং উৎকর্ষমুখি আন্তরিক অনুশীলন। এখন যাঁরা কেবলই স্বদেশি সাংস্কৃতিকতার স্মৃতি ও ‘দূরস্বদেশে’র সাংস্কৃতিকতার বাস্তব টানাপোড়েনে আত্মবিশ্বাসহীন পরিস্থিতিতে সাহিত্য সৃষ্টি করে চলেছেন একদিন তাঁদের কাজ স্বদেশি সাহিত্যের স্বতন্ত্র ধারা হিসাবেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে এবং স্বসমাজের প্রগতিতে চেতনাগত ভূমিকা রাখবে এমন ভাবনা অসম্ভবকল্পনা নয়।


• প্রাবন্ধিক, গবেষক, শিশুসাহিত্যিক ও সম্পাদক, যুক্তরাষ্ট্র।

menu
menu