বাংলাদেশের ছোটগল্পে বাঁক-পরিবর্তনের আভাস

বাংলাদেশের সাহিত্য সাল-তারিখের বিচারে একাত্তর পরবর্তীকালের হওয়ার কথা; বাস্তবে তা হয়নি। বাংলাদেশের সাহিত্য বলতে অনিবার্য কারণে দুই দশক পিছন থেকে অর্থাৎ সাতচল্লিশের দেশভাগের পর থেকে পূর্ব-পাকিস্তানের [তৎকালীন] দুই দশকব্যাপী রচিত বাঙালির সাহিত্যকৃতিও বাংলাদেশের সাহিত্য হিসেবে গণ্য হয়। সাতচল্লিশের রাজনৈতিক বিভাজনের পর পশ্চিমবঙ্গ ভারতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় সেখানকার বাঙালিদের রচনা বাংলা সাহিত্যের অংশ হলেও তা বাংলাদেশের সাহিত্য হিসেবে গণ্য করা হয় না; ফলে পশ্চিমবঙ্গের লিখিয়েদের রচনা বৃৎদার্থে বাংলা সাহিত্যের কিংবা পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সাহিত্য হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। দেশভাগের কুফল মাথায় নিয়ে পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালিরা যে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের অন্তর্ভুক্ত হলো তা খুব স্বাভাবিকভাবেই সমাজের শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণির মনে প্রভাব ফেলেছিল। বিশেষত পাকিস্তান রাষ্ট্রের পশ্চিমাংশের শাসকশ্রেণির ঔপনিবেশিক মনোভাব বাঙালির মান-মর্যাদায় চূড়ান্ত আঘাত করায় সমগ্র জাতির চেতনায় স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে এবং ক্রমেই তা ধারাবাহিক আন্দোলন পরম্পরায় বৃহৎ আকার ধারণ করে। একদিকে স্বাধীনতার জন্য দুর্মর বাসনা অন্যদিকে বাঙালির ওপর চাপিয়ে দেয়া দেশভাগের যন্ত্রণা-ক্ষোভ-বেদনা বাংলাদেশের বিকাশমান সাহিত্যের ধারায় অন্যতম কাঁচা রসদ হিসেবে ব্যবহৃত হলো। ফলে বাংলাদেশের সাহিত্যের বিরাট অংশ জুড়ে আছে— দেশভাগের যন্ত্রণা-ক্ষোভ-বেদনা এবং মানবিক আর্তি-হাহাকার।
দেশভাগ পরবর্তী বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ [১৯২২-’৭১]; উপন্যাস তো বটেই ছোটগল্পের ভূগোলেও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ নবতর নিরীক্ষা করেছেন। ছোটগল্পে তাঁর নিরীক্ষা সম্পর্কে বিশ্বজিৎ ঘোষের মন্তব্য এরকম :

উপন্যাসের মতো, ছোটগল্পেও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ শিল্পনৈপুণ্য একক অনতিক্রান্ত এবং প্রাতিস্বিকতাচিহ্নিত। শিল্পবোধ ও জীবনচেতনার প্রশ্নে পূর্বাপর সতর্ক, সপ্রতিভ এবং বিশ্ববিস্তারী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ গল্পসমূহ বাংলা সাহিত্যের ধারায় সংযোজন করেছে স্বকীয় মাত্রা। যুদ্ধোত্তর বিনাশী প্রতিবেশে বাস করেও মানবীয় অস্তিত্বের ক্লান্তিহীন সাধনায় তিনি ছিলেন স্থিতপ্রতিজ্ঞ। নিরস্তিত্বের শূন্যতায় ফুরিয়ে যাওয়া নয়, অন্ধকার ভেঙে ভেঙে অস্তিত্বের দায়িত্বশীল স্বাধীন সত্তায় উত্তীর্ণ হওয়াই তাঁর ছোটগল্পের মৌল বৈশিষ্ট্য। —[বিশ্বজিৎ ঘোষ, বাংলাদেশের সাহিত্য, ঢাকা : ২০০৯] 
      
আমরা জানি, ওয়ালীউল্লাহ্ স্বল্পপ্রজ লেখক; তিনি গল্প-উপন্যাস-নাটক বেশি কোনোটাই লেখেননি। যেখানে যেটুকু রচনা করেছেন, সেখানেই তিনি স্বাতন্ত্র্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে নব-নিরীক্ষা করেছেন। তাঁর গল্পগ্রন্থ মাত্র দুটি : নয়নচারা [১৯৪৫], দুই তীর ও অন্যান্য গল্প [১৯৬৫]। সংখ্যায় অনেক না হলেও দুটো গল্পগ্রন্থেই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ স্বীয় স্বাতন্ত্র্যের সম্যক পরিচয় তুলে ধরেছিলেন। একইসাথে ব্যক্তিমানুষের বিপন্নতা, মননগত চেতনা, অস্তিত্বের আকাঙ্ক্ষা প্রভৃতি দার্শনিক প্রতিভাষ্য অবলীলায় তিনি বাংলা ছোটগল্পে যুক্ত করেছেন। বিভাগোত্তর কালে ওয়ালীউল্লাহ্ এই সচেতন গল্প-নিরীক্ষা পরবর্তীতে বাংলাদেশের গল্প-ধারায় বিশিষ্টতা অর্জন করেছে গুটিকয়েক লেখকের হাতে।
স্বাধীনতা পূর্বকালে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর স্বল্পতম রচনার মধ্যেই অভিনব কৌশল খুঁজেছিলেন; বিশেষত গল্পের মধ্যে দর্শনের আরোপ করে তিনি যে নিরীক্ষা করেছিলেন, তা স্বাধীনতা পরবর্তীকালে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের [১৯৪৩-’৯৭] হাতে আরও একধাপ এগিয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর যাপিত জীবনের ভূগোল এবং যে ভাষাবৃত্ত তাঁর গল্পের প্যাটার্নে যুক্ত হলো তা অনন্য, স্বতন্ত্র। গ্রাসরুট লেভেলের জনগণের জীবনচেতনার ভিতর-বাহির, আচার-আচরণ-রুচি প্রভৃতি ইলিয়াস গল্পের ন্যারেশনে নিখুঁতভাবে তুলে ধরার পাশাপাশি তাদের কথ্যরীতির ভাষা উপস্থাপনেও মুন্সিয়ানার পরিচয় দিলেন। বাংলাদেশের সাহিত্যে ছোটগল্পের এ ধারাটিই সিরিয়াসধর্মী সাহিত্য হিসেবে বৌদ্ধিক মহলের প্রশংসা লাভ করল। একইসময় প্রচলিত ধারায়ও বাংলাদেশের সাহিত্য এগিয়ে গেল শওকত আলী [১৯৩৬-২০১৮], রাবেয়া খাতুন [জ.১৯৩৫], সেলিনা হোসেন [জ.১৯৪৭], হুমায়ূন আহমেদ [১৯৪৮-২০১২], মঞ্জু সরকার [জ.১৯৫৩], ইমদাদুল হক মিলন [জ.১৯৫৫] প্রমুখ লেখকের হাত ধরে। এঁরা পুরনো রীতির কাহিনিনির্ভর গল্প রচনায়-ই নিজেদের সামর্থ্য প্রদর্শন করলেও পরিণামে তাও বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের অর্জন। জনপ্রিয় ধারার গল্প রচনার ক্ষেত্রেও হুমায়ূন আহমেদ এঁদের মধ্যে স্বতন্ত্র জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর ঝরঝরে গদ্যের নিপাট বুঁননে কাহিনি বর্ণনার ক্ষেত্রেও স্পষ্ট স্বাতন্ত্র্য আছে। বিশেষত তাঁর কাহিনির টানটান উত্তেজনা বিশেষ পাঠকগোষ্ঠী তৈরির ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে বাংলাদেশের গল্প-ধারায়। 
প্রথাগত পুরনো রীতির কাহিনি বয়নের ক্ষেত্রে শওকত আলীর নাম কিংবা আবু রুশদ [১৯১৯-২০১০], রশীদ করীম [১৯২৫-২০১১] প্রমুখ গল্পকারের অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। কেননা এঁদের লেখায় সচেতন ইতিহাস-ঐতিহ্যপ্রিয়তা এবং বাংলাদেশের মিডল ও লোয়ার মিডল ক্লাসের যাপিত জীবনের টানাপড়েনের দ্বিধা-সংকোচ ও সংকট সফলভাবে উঠে এসেছে। শওকত আলীর যেমন প্রদোষে প্রাকৃতজন [১৯৮৪] উপন্যাসের ঘটনাবৃত্তে ইতিহাসের অলিখিত উপাখ্যান উঠে এসেছে; তেমনি রশীদ করীমের প্রেম একটি লাল গোলাপ [১৯৭৮] উপন্যাসের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের শ্রেণির সংকট কিংবা জীবনসমস্যার হুবহু প্রতিফলন ঘটেছে। এঁদেরই সমান্তরালে মাহমুদুল হকের [১৯৪০-২০০৮] নাম প্রযুক্ত হলেও তিনি গল্প বলার ঢঙে একটু স্বতন্ত্র, তাঁর ভাষারীতিও ভিন্ন; তাঁর গল্পে দেশভাগজনিত যন্ত্রণা-ক্ষোভ ও বেদনার হাহাকার মিতব্যয়ী ভাষায় সমন্বিত হয়েছে। আর সৈয়দ শামসুল হক [১৯৩৫-২০১৬] বিষয়-বৈচিত্র্যে স্বাতন্ত্র্যের দাবিদার। গল্প কাহিনির ওপর ভিত্তি করে রচিত হলেও সৈয়দ হকের গল্পে প্রযুক্ত হয়েছে বিবিধ বিষয় ও প্রসঙ্গ। এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার এঁদের সবার গল্পেরই মূল প্যাটার্নে বিশেষ কোনো অভিনবত্ব নেই। কথাশিল্পী হিসেবে প্রত্যেকেই ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতার সমাজঘনিষ্ঠ জীবনকে পুরনো রীতির কাহিনির ফ্রেমে আবদ্ধ করলেও তা বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের ইতিহাসে ফেলনা নয়; হয়তো তাদের গল্পের বয়নকৌশলে কিংবা ভাষারীতি আবার কখনো বা বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রেও বৈচিত্র্যহীন, তারপরও বাংলাদেশের ছোটগল্পের ধারাবাহিক উত্তরণে এঁদের অবদানকে অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু আশির দশকের একটু আগে শহীদুল জহির [১৯৫৩-২০০৮] কথাসাহিত্য নিয়ে হাজির হলে বোঝা যায়—ওয়ালীউল্লাহ্ গল্পের যে ধারা তৈরির নিরীক্ষা শুরু করেছিলেন, যা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের হাতে অনেকটা পথ অতিক্রম করেছিল; সেই ধারার সফল গল্পকার হিসেবে তিনি বাংলাদেশের গল্প-ধারায় নতুন দিগন্ত উন্মোচনে সক্ষম হয়েছেন।  
বাংলাদেশের সাহিত্যের ইতিহাস বলতে গেলে বিগত অর্ধশতকের ইতিহাস। মহকালের হিসেবে সময় খুব অল্প হলেও এ সময় বাংলাদেশের সাহিত্যের অর্জন একেবারে কম নয়; বিশেষত কবিতার ক্ষেত্রে শামসুর রাহমান [১৯২৯-২০০৬], আল মাহমুদ [১৯৩৬-২০১৯]-এর মতো লেখকের জন্ম হয়েছে। বলা হয়ে থাকে কবি জীবনানন্দ দাশের পরে বাংলা কবিতার অনিবার্য পাঠ্যকবি শামসুর রাহমান এবং অনতিক্রম্য আল মাহমুদ। একইভাবে কবিতার মতো বিগত অর্ধশতকে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের অর্জনও চোখে পড়ার মতো। প্রয়াত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস কিংবা শওকত আলী, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হকের [জ.১৯৩৯] মতো লেখক বাংলাদেশের গল্প-ধারায় উল্লেখযোগ্য সংযোজন। কবিতা-কথাসাহিত্যের মতো বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্যও কম এগোয় নি! একথা জোর দিয়েই বলা যায়, একা সেলিম আল দীন বাংলা নাটকের মোড়ই ঘুরিয়ে দিয়েছেন। তিনি একক চর্চায় বুঝিয়ে দিয়েছেন, বাংলা নাটকের জন্ম ইউরোপের অনুকরণে হলেও বাঙালি জাতির নানা প্রাচীন রচনায় নাট্যগুণ বিদ্যমান ছিল। সেই অনাবিষ্কৃত দিক উন্মোচন করে বাংলাদেশের নাটকে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছেন সেলিম আল দীন একাই। নাটক-কবিতাই শুধু নয়, গল্প-উপন্যাসেও ইতোমধ্যে বাংলাদেশের সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য নতুন ধারার সৃষ্টি হয়েছে। শহীদুল জহির, মামুন হুসাইন [জ.১৯৬২], আহমাদ মোস্তফা কামাল [১৯৬৯] প্রমুখ গল্পকারের হাতে বাংলা ছোটগল্পও নতুন এক মোড়ে উপনীত হয়েছে। 
শহীদুল জহিরের গল্পের ভাষা নির্মাণের ক্ষেত্রে যেমন নিজস্বতা আছে, তেমনি বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রেও তাঁর নিজস্বতা চোখে পড়ার মতো; যা তিনি সচেতনভাবে সংরক্ষণে প্রয়াসী ছিলেন আগাগোড়া। তিনি খুব বেশি লেখেননি; কিন্তু তাঁর অল্পসংখ্যক রচনার মধ্যেই অভিনবত্ব এবং নতুন ধারা নির্মাণের স্পষ্ট ছাপ আছে। শহীদুল জহিরের রচিত গল্পগ্রন্থগুলো হচ্ছে : পারাপার (১৯৮৫),  ডুমুর খেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প (২০০৪), ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প (২০০৫)। এছাড়া তাঁর জীবদ্দশায় জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা (১৯৮৮), সে রাতে পূর্ণিমা ছিল (১৯৯৫), মুখের দিকে দেখি (২০০৬) শীর্ষক তিনটি উপন্যাস এবং মৃত্যুর পর আরও একটি উপন্যাস আবু ইব্রাহীমের মৃত্যু (২০০৯) প্রকাশিত হয়। সংখ্যায় নগণ্য হলেও শহীদুল জহির এর মাধ্যমেই বাংলা ছোটগল্পে ভিন্নতর একটি ধারা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন— যেখানে তাঁকে পৃথক হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। তিনি গল্পের ভাষা নির্মাণ এবং বয়নরীতিতে আবর্তন-পুনরাবর্তন পদ্ধতির অসামান্য কৌশলে বাস্তব ও পরাবাস্তবতার সীমানা পেরিয়ে জাদুবাস্তবতার এক মায়াবী জগৎ নির্মাণ করেছেন। বাংলা ভাষায় শহীদুল জহির জাদুবাস্তবতাকে সফলভাবে ব্যবহার করেছেন। বলতে আপত্তি নেই বাংলা গল্পে ম্যাজিক রিয়্যালিটির জগৎ নির্মাণের শহীদুল জহিরই অনন্য। 
শহীদুল জহির যে লাতিন আমেরিকান কথাসাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ   দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন, তা বোঝা যায়—তাঁর গল্পের ভাষা নির্মাণ কৌশলে। ভাষার সঙ্গে সঙ্গে জহির  বাংলাদেশের গল্পে জাদুবাস্তবতার তাত্ত্বিক ধারণার ব্যবহারিক প্রয়োগে সফল ও শিল্পোত্তীর্ণ। শুধু বিষয়েই না, গল্পে ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও মার্কেজের কমপ্লেক্স-বিউটি শহীদুল জহির অনুসরণ করেছেন সচেতনভাবে। জীবদ্দশায় শহীদুল জহির তেমন পাঠকমহলে সারা জাগাতে ব্যর্থ হলেও তাঁর অকাল প্রয়াণের পর তাঁর গল্পের ম্যাজিক রিয়্যালিটির জগৎ ক্রমেই পাঠককে তাঁর সম্বন্ধে আগ্রহী করে তুলছে। তিনি স্বল্পপ্রজ লেখক; ফলে অল্পসংখ্যক রচনার মধ্যেই এখন তিনি পাঠকের নিকট মহার্ঘ্য লেখক হয়ে উঠছেন। 
অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আশির দশকের গল্পকার হিসেবে অমিত সম্ভাবনাময় বলে অভিহিত করছেন ওয়াসি আহমেদ [জ.১৯৫৪] এবং মামুন হুসাইনকে। মহীবুল আজিজকে লেখা এক চিঠিতে ইলিয়াস উল্লেখ করেছিলেন :

[...] মামুন হুসায়েনের গল্প সংকলন এবারেও বেরুবে কি-না সন্দেহ। ও এখন কাজ করে রাজশাহীতে, ঢাকায় এলেও সহজে দ্যাখা করে না; আর ওর লেখা কিংবা বই নিয়ে জিজ্ঞেস করলেও এড়িয়ে যায়। সুশান্ত খুব চেষ্টা করছে, কিন্তু মামুন এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। আমার কথা তো পাত্তাই দেয় না, তুমি বরং তাগাদা দিয়ে চিঠি লিখতে পারো ওকে। ওর বই বেরুনো খুব দরকার। কলকাতা ও ঢাকায়, বিশেষ করে কলকাতায় যথার্থ ভালো পাঠকেরা মামুনের লেখা খুব পড়তে চায়। অনুষ্টুপের গত বছরের শারদীয় সংখ্যায় ওর গল্প ‘সনকার কালাবুড়ি ও আমাদের দিন যাপন’ দারুন সাড়া তুলেছে। —[মহীবুল আজিজ, সাহিত্য : ইলিয়াস ও অন্যান্য নক্ষত্র, ঢাকা : ২০১০]

একথা বলার অপেক্ষা রাখে না, মামুন হুসাইন ইতোমধ্যেই সিরিয়াস ধারার গল্পকার হিসেবে ইলিয়াসের ভবিষ্যৎবাণীকে সত্য প্রমাণ করেছেন। গত তিন দশকে মামুন হুসাইন শান্ত সন্ত্রাসের চাঁদমারি [১৯৯৫], আমাদের জানা ছিল কিছু [২০০০], মানুষের মৃত্যু হলে [২০০০], বালক বেলার কৌশল [২০০২], নিরুদ্দেশ প্রকল্পের প্রতিভা [২০০২], কয়েকজন সামান্য মানুষ [২০০৩], একটি স্মারক গ্রন্থের জীবন প্রণালী [২০০৫], রাষ্ট্রযন্ত্রের খেলাধূলা [২০০৭], কর্নেল ও কিলিং বিষয়ক এন্ডগেম [২০০৯], যুদ্ধাপরাধ ও ভূমিব্যবস্থার অস্পষ্ট বিজ্ঞাপন [২০১১], অন্ধজনের জাতককথা [২০১৪], সংক্ষিপ্ত সন্ধ্যাভাষা [২০১৬] প্রভৃতি গল্পগ্রন্থ রচনা করেছেন। দশের অধিক গ্রন্থসংখ্যা হলেও মামুনের গল্পের সংখ্যা খুব বেশি নয়, ৪০টির মতো। কেননা তাঁর প্রায় সব গল্পই বৃহদায়তনের। কোনো কোনো গ্রন্থে দেখা যায়, মাত্র দুটি অথবা তিনটি গল্প আছে। মামুন হুসাইন বাংলা ছোটগল্প-ধারায় ভাষা এবং কাহিনি বিন্যাসের ক্ষেত্রে প্রচলিত সব ধরনের রীতিকেই ভেঙেছেন। নিজস্ব বয়ন-কৌশল এবং বিমূর্ত ভাষা-শৈলী নির্মাণ করেছেন; যা আপত অর্থে কমপ্লেক্স— তবে একই সময় তা নান্দনিকও। বিষয়ের ক্ষেত্রেও তিনি প্রথাগত কাহিনির বর্ণনা এড়িয়ে নবতর কৌশলে কাহিনিকেই ভেঙে দিয়েছেন। ফলে মামুনের গল্পের ঘটনা সুনির্দিষ্ট বিশেষ কালের বা টাইমফ্রেমে আবদ্ধ না থেকে হয়ে উঠেছে চিরকালীন। মামুনের গল্পের আখ্যানে মূলত অসংখ্য বিচ্ছিন্ন বাক্য এবং শব্দ থাকে, যা সংযুক্ত করে নিতে হয়, পাঠককেই। আর এটা করা সম্ভব হলে, কখনো কখনো অস্পষ্ট একটি কাহিনিও হয়তো তৈরি করা যায়, তবে সেটা বিশেষ কোনো অর্থ বহন করে না কিংবা গুরুত্বপূর্ণও না। কেননা, মামুন হুসাইন প্রতিটি বাক্যেই একটি গল্পের বীজ উপ্ত রাখেন—যা মেধাবী পাঠকের মস্তিষ্কে একটি পূর্ণাঙ্গ কাহিনির জন্ম দিতে সক্ষম। তিনি যেহেতু পাঠককে কাহিনির অভিজ্ঞতার বয়ান দিতে চান না, তারপরও সেই অস্পষ্ট বা ভাসা ভাসা তৈরি হওয়া কাহিনির বয়ানে পরিণামে তিনি তাঁর ম্যাসেজটি ঠিকই পাঠকের নিকট পৌঁছে দিতে সক্ষম হন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, মামুনের এই আপাত বিচ্ছিন্ন বাক্য-নির্মাণ এবং তার অভ্যন্তরে সূক্ষ্মতর সংযোগ স্থাপনের যে কৌশল, তা সম্ভবত তিনি মার্কেজ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে করেছেন। সেটা করলেও মামুনের গল্পের ভাষা বাংলার অন্তর্গত সৌন্দর্যে ভরপুর এবং তিনিও এ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সচেতন। বলতে বাধা নেই, মামুনকে সিরিয়াসধর্মী লেখক আখ্যায়িত করা হলেও তাঁর গল্প-ভাষার আপাত কমপ্লেক্সিটি ভেদ করে সাধারণ পাঠক রসাস্বদন করতে অনেকাংশেই ব্যর্থ হন; ফলে সমকালের সবচেয়ে শক্তিশালী লেখক হয়েও তাঁর আমলের অনেক গল্পকারের চেয়েই কম পঠিত হয়েছেন তিনি। তারপরও তিনি প্রথাগত কাহিনি নির্ভর গল্প রচনা থেকে সচেতনভাবেই বিরত রেখেছেন নিজেকে। 
মামুনের কথা প্রসঙ্গে আমাদের স্মরণে রাখা দরকার ওয়াসি আহমেদ, ইমতিয়ার শামীম [জ.১৯৬৫] অথবা শাহাদুজ্জামানের [জ.১৯৬০] কথা। অবশ্য একই সারিতে আছেন সুশান্ত মজুমদার [জ.১৯৫৪], সেলিম মোরশেদ [জ.১৯৬২], সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ [জ.১৯৬৫], মহীবুল আজিজ [জ.১৯৬২], হুমায়ুন মালিক [জ.১৯৫৭], আহমাদ মোস্তফা কামাল, সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ [জ.১৯৬২], কাজল শাহনেওয়াজের [জ.১৯৬১] নামও। এঁরা সকলেই গল্পে অভিনবত্ব আনয়নে প্রয়াসী হয়েছেন; কেউ ভাষায়, কেউ আবার কাহিনির বয়ন-কৌশলে। তবে এঁদের মধ্যে অনেকেই আর লিখতে পারেননি; দুএকজন যাঁরা লেখালেখি অব্যাহত রেখেছেন, তাঁরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শেষ পর্যন্ত কাহিনি-বয়নের প্রথাগত পুরাতন রীতির মধ্যেই বিলীন হয়েছেন। ফলে তাঁদের যে মাত্রায় স্বতন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার সুযোগ ছিল—তা অল্পদিনের মধ্যেই সূচনার পর অপগত হয়েছে এবং তাঁরা সেই নিরীক্ষাধর্মী ধারা থেকে সরে গিয়ে প্রথাগত গল্প-ধারায় নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছেন। 
বাংলাদেশের গল্পে আশির দশকে একটা নতুন ধারা নির্মাণের সূচনা হলেও নব্বই দশকে তা পুনরায় পেছনের দিকেই হেঁটেছে এবং কাহিনির বৃত্তে আবদ্ধ হয়েছে। অন্যদিকে শূন্য দশকের গল্পকাররা নব্বইয়ের মৃত সেই লাশকেই উত্তরাধিকার সূত্রে বহন করে চলেছে। ফলে এখানেও নতুন কিছুর সম্ভাবনা আপাতত দেখা যাচ্ছে না। অবশ্য একথা সত্য, কেউ কেউ আবার নব্বইয়ের দশক থেকেই বাংলা গল্পে ভিন্নতর এক ধারার সূচনা হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন। এ বক্তব্যের সঙ্গে আমরা সম্পূর্ণ একমত হতে পারিনি; বরং আমাদের মনে হয়েছে, আশির দশকে যে বাঁক-পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল, তা নব্বই এবং শূন্য দশকের গল্পকারদের হাতে খুব একটা এগোয়নি। তবে দুএকজন তরুণ গল্পকার সেই ধারাকে এগিয়ে নেয়ার ব্যাপারে প্রত্যয়ী হলেও এখনো তাদের লেখা স্বতন্ত্র আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠতে পারেনি। এজন্য আরও কিছু সময়ের প্রয়োজন। 
বাংলাদেশের ছোটগল্পেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধিত হয়েছে স্বাধীনতা উত্তরকালে; এ সময় আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও হাসান আজিজুল হকের মতো দুজন কথাশিল্পী বাংলাদেশের গল্পের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেছেন। উল্লেখযোগ্য এই পরিবর্তনকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়েছেন শহীদুল জহির। তিনি খুব বেশি লিখে যেতে পারেননি, তথাপি অল্প কিছু গল্প ও গোটা চারেক উপন্যাস রচনা করেই বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের নব দিগন্তের উজ্জ্বল আলোয় ভরে দিয়েছেন। কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক, এই কথাশিল্পী সম্পর্কে এক মন্তব্যে জানিয়েছেন— তিনি ‘বিশিষ্ট লেখক’। এছাড়াও তিনি মনে করেন সে রাতে পূর্ণিমা ছিল উপন্যাস রচনার মাধ্যমে শহীদুল জহির ‘কেল্লাফতে’ করেছেন। এ মন্তব্যের মধ্য দিয়ে হাসান আজিজুল হক মূলত বোঝাতে চান, শহীদুল জহিরের লেখনী শক্তির সবটুকু প্রকাশ পেয়েছে সে রাতে পূর্ণিমা ছিল উপন্যাসে। একজন লেখক যে সেরা লেখাটির জন্য অবিরাম লিখে যান, শহীদুল জহিরের সে রাতে পূর্ণিমা ছিল তাঁর সেরা রচনা। হাসান আজিজুল হক প্রসঙ্গত আরও যুক্ত করেন, তাঁর পরের উপন্যাস মুখের দিকে দেখিতে ম্যানারিজম স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ তিনি বেঁচে থাকলে হয়তো আরও লিখতেন, তবে তা আদৌ আবর্তন পুনরাবর্তনের মাঝ থেকে বেরিয়ে আসতে পারত কিনা তা নিয়েও সন্দেহ পোষণ করেছেন হাসান আজিজুল হক।  
সে যাই হোক না কেন, একথা সত্য সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ এবং আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের লেখায় গল্পের যে ধারা গড়ে উঠেছিল, তার উৎকৃষ্ট রূপ ধরা পড়েছে শহীদুল জহিরের গল্পে। তাঁর ইন্দুর বিলাই খেলা কিংবা ডুমুর খেকো মানুষ, ডলু নদীর হাওয়া প্রভৃতি গল্প সেই উৎকৃষ্টতার স্বাক্ষর বহন করে। গল্পের মধ্যে অসংখ্য গল্প থাকা কিংবা ছোট্ট একটি লাইনের ঘটনাও যে গল্প হয়ে উঠতে পারে, তা শহীদুল জহিরের লেখায় আবিষ্কৃত হলো। এই ধারায় বাংলাদেশের সাহিত্যে আরও কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ এ সময়ের গল্পকার হচ্ছেন ইমতিয়ার শামীম, মামুন হুসাইন, ওয়াসি আহমেদ, শাহাদুজ্জামান, হুমায়ুন মালিক, আহমাদ মোস্তফা কামাল প্রমুখ। বাংলাদেশের এই গল্পের ধারা এঁদের হাতে ক্রমশ সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে।বিশেষত এঁদের গল্প বলার ধরনও তরুণ প্রজন্মকে যথেষ্ট আকৃষ্ট করছে, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। ইতোমধ্যে শূন্য দশকের তরুণ গল্পকারদের অনেকেই শহীদুল জহিরের গল্প বয়ন-কৌশল কিংবা ভাষাগত কাঠামোকেও আত্মস্থ করে নিজস্ব পথ নির্মাণে সচেষ্ট হয়েছেন। 
বলার অপেক্ষা রাখে না, সাহিত্য কোনো বদ্ধ জলাশয় নয়। ক্রমাগত সাহিত্যের গঠনকৌশল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে। হয়তো ভবিষ্যতে আরও নতুন নতুন ফর্ম আসবে বাংলা গল্পে, এমন প্রত্যশা এখন তরুণ প্রজন্মের গল্পকারদের নিকট করা যেতেই পারে। বাংলাদেশের তরুণ গল্পকারগণই হয়তো ভবিষ্যতে নির্মাণ করবেন বাংলা ছোটগল্পের আরো অভিনব কিংবা চমকপ্রদ বয়ন-কৌশল।


• প্রাবন্ধিক ও অধ্যাপক, বাংলাদেশ।

menu
menu