গিলগামেশ মহাকাব্য : বিষাদের জন্ম, স্তব্ধতার উদয়

আদিতে যখন কিছুই ছিল না, তখন বিষাদও ছিল না। বিষাদ সভ্যতার সহোদরা। মহাকাব্যগুলি তাই বিষাদ–জন্মেরই ইতিকথা। প্রাচীনতম মহাকাব্য মানে বিষাদের আদিতম নমুনা। মানুষের ইতিহাসের প্রাচীনতম মহাকাব্য গিলগামেশ। মানবের আত্মায় জাগ্রত প্রথম বিষাদের প্রথম আস্বাদনও এই আলেখ্য। এই বিষাদের তন্তু দিয়ে তৈরি মানুষের আত্মা। 
গ্রিক মহাকাব্যগুলির অনেক আগে গিলগামেশ রচিত হওয়ার প্রত্নতাত্ত্বিক ও ভাষাতাত্ত্বিক প্রমাণ রয়েছে। নিশ্চয়ই তার আগেও কবি ও কাব্য ছিল; কিন্তু প্রথম যে মহাকাব্যিক বীরের আবির্ভাব ও বিলয়ের গল্প আমরা জানতে পাই, তা সুমেরীয় বীর গিলগামেশেরই। সে দিক থেকে গিলগামেশ হোমারের ইলিয়াড ও অডেসির চাইতেও পুরনো। কেবল তাই নয়, গিলগামেশের শক্তি ও বৈভব এবং তার অভিযাত্রা ও ট্র্যাজেডিই ছিল হোমারের নামে বন্দিত্ব গ্রিক ট্র্যাজেডির বীজ। গিলগামেশের ভাবের থেকেই জন্ম গ্রিক মহাকাব্যের। আজকের ইরাক যে এশিয়ার; গ্রিসও একসময় সেই এশিয়ার অঞ্চল বলেই গণ্য হতো। সুতরাং পশ্চিম এশিয়া থেকেই ইউরোপে ছড়িয়ে গিয়েছিল মহাকাব্যের ভাব ও কাহিনি। গিলগামেশ  সম্পর্কে এটি দ্বিতীয় কথা।   
আখ্যানের দীর্ঘ বর্ণনার জন্যই কোনো সৃষ্টিকে মহাকাব্য বলা হয় না। বীরের ইচ্ছাশক্তির মহান জয়-পরাজয়ের আবেগই মহাকাব্যকে মহীয়ান করে তোলে। আর এ কারণেও যে, এর বিষাদ কিছুটা ঐশ্বরিক আর কিছুটা মানবিক। ঠিক উরুক (প্রাচীন সুমেরীয় নগরী তথা ইরাক) দেশের মহানায়ক গিলগামেশের মতোই : ‘দুই ভাগ দেবতা আর একভাগ মানুষ’
গিলগামেশ পরিপূর্ণ, অজেয়, মহাপ্রতাপশালী। কিন্তু সে অমর নয়। নশ্বর মানুষ নিজের নশ্বরতা সম্পর্কে সচেতন হয়েও যা চায় তা অবিনশ্বর। যদি অমরতা না পায়, তবে চায় অন্তত অবিনশ্বরকে একবার হলেও পেতে। যে প্রেম অবিনশ্বর, যে সুখের স্বাদ অবিস্মরণীয়, যে ঈশ্বর অমেয় তাকে তারা পেতে চায়। উরুক নগরে রাজধানী যার, সেই সম্রাট গিলগামেশের সেটাই অসুখ। মানুষ অবিনশ্বর হতে না পারলেও তার অসুখটা অবিনশ্বর। অবিনশ্বর অতৃপ্তির জ্বরে সে চায় অবিনশ্বর ভোগের শুশ্রূষা। তাই গিলগামেশ হয় তার প্রজাদের দুঃখের কারণ, তার রক্ষক দেব-দেবীদের উদ্বেগের উৎস। কারণ,  

(বিলাপ)
গিলগামেশ উদ্যত
গিলগামেশ অসহনীয়
পিতৃগৃহে কোনো পুত্র নেই—তারা সবাই গিলগামেশের পরাক্রমে পরাভূত
গিলগামেশ কিশোরী-মোহন
তার কামনার আগুন থেকে ত্রাণ পেয়েছে এমন কোনো প্রেমিকা নেই…

বাসনার এই আগুনই কি গিলগামেশের ট্র্যাজেডির কারণ? না কি সে দেখে ফেলেছে নগরীর দেয়ালের ওপারের নদী দিয়ে ভেসে যাওয়া মরণশীল মানুষের লাশ। আরও পরে যে দুঃখ গৌতমকে বুদ্ধত্বে পর্যবসিত করবে সেই হাহাকার গিলগামেশেরও মনে জাগে, 

নশ্বর এ নগর জুড়ে নশ্বর হৃদয় বেদনা
এবং এইসব তামাদি বেদনা নিয়েই একদিন তারা ঢলে পড়ে মৃত্যুর প্রদেশে
দেয়ালের ওপারে নদী
বেশুমার শরীর দেখেছি ভাসমান
নশ্বর আমি—আমার নিয়তি আমি নশ্বর জানি

গিলগামেশ যখন ভয়াল মহিমা নিয়ে অবিনশ্বর ভোগ আর অমরত্বের দিকে আগ্রাসী তখন প্রজারা স্বর্গের দেবতাদের কাছে ফরিয়াদ জানাল আকুল কান্নায়। উরুকের দেবতা আনু সেই ডাক শুনে জানালেন সমস্ত দেবতাকুলকে। দেবতাকুল ফরিয়াদ জানালেন বিশ্বকর্ম অরুরুর কাছে—যিনিই তৈরি করেছিলেন গিলগামেশকে। তারা অরুরুকে বলে, 

তুমিই তৈরি করেছ এই গিলগামেশ
এখন তৈরি কর তাহার আরশি-সমতুল
আত্মার আরেক অবয়ব
ঝড়ো হাওয়ার বিরুদ্ধে ঝড়ো হাওয়া
হৃদয়ের বিরুদ্ধে হৃদয়

আর তারা চেয়েছে গিলগামেশ ‘আপনিই করুক আপনার অপচয়’ আর শান্তি পাক উরুক নগরী আর তার তাবৎ পুরুষ। অয়দিপাউস থেকে ইউলিসিস প্রত্যেকেই তার অন্তর্গত বাসনায় নিজেকে নিজে খরচ করে মুখোমুখি হয়েছে অন্তিমের। গিলগামেশ কি সেই নিয়তি খণ্ডাতে পারবে?

তাই গিলগামেশেরই সমকক্ষ করে সৃষ্টি করা হলো তারই নেমেসিস এনকিদুকে। এনকিদু অর্ধমানব আর অর্ধপশু। সে অমিত শক্তিশালী কিন্তু তার বেলা যায় বনের পশুদের সঙ্গে লড়ে, সিংহকে তাড়িয়ে মেষপালকে রক্ষায়। পাহাড় থেকে সে নেমে আসে মহাপরাক্রমশালী নক্ষত্রের মতো, পান করে ঝরনার জল। সে সুন্দর ও তৃপ্ত। সে পারতো গিলগামেশকে হত্যা করতে। কিন্তু সর্বজ্ঞ গিলগামেশ তাকে মত্ত করে রতিনিপুণ লজ্জাহীনা পারঙ্গম দেবদাসীদের প্রেমে। প্রকৃতির অংশ হিসেবে তার বিচ্ছেদ-বিষাদ কিছুই ছিল না। কিন্তু সাতদিন সাতরাত্রি অবিশ্রান্ত সঙ্গমের পর সে শিক্ষা পেল শৃঙ্গার ও ছলাকলা। আর

পড়ে রইল ঘর
পড়ে রইল পাহাড় ও ক্ষিপ্র গতি হরিণী ও বান্ধব। 

কিন্তু সে হারাল আগের জীবন। বুনো বান্ধবদল তাকে দেখে পালায়। তার ভেঙে আসে হাঁটু। সে পরাজিত হয় গিলগামেশের কাছে। আর গিলগামেশ তাকে করে নেয় আপন। শত্রু হতে গিয়ে তারা বন্ধু হয়ে যায়। কিন্তু দুজনেই কিছু হারায়। এনকিদু তার স্ব-ভাব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যৌনসুখ পেল বটে, কিন্তু তার হৃদয় হলো বিভক্ত। তাই তো ওই নারীরা তাদের পোশাক দুই ভাগ করে একভাগ পরালো এনকিদুকে।   
গিলগামেশের লড়াইও দৈবের বিরুদ্ধে, তাঁর সহায়ও দৈবলোকের শক্তি। সেটা এমন এক কল্পনার কাল যখন দেবতাও কামনা করতো মানুষের আনুগত্যের আর অপরাজেয় বীরও কামনা করতো দেবতার আশীষ। দেব ও মানব এভাবেই সমকক্ষ হয়ে উঠতো প্রাচীন মহাকাব্যে। 
দুই ভাগ দেবতার হলেও গিলগামেশের জীবন মানুষের। তাঁর শৌর্য ও বীর্য, তাঁর দম্ভ ও হতাশা সবই মানুষের। তাঁর জীবনের নিয়ন্তাও তিনি।   

তাঁর অভিযান ছিল দীর্ঘ এবং ক্লেশাকীর্ণ 
—অবসন্ন তিনি  
এবং শিলায় গেঁথে রাখলেন তাঁর গৌরবগাথা

এই গৌরবের ভাগীদার তিনি ছাড়া কেউ নয়। কিন্তু কিছুই তাঁকে সন্তুষ্ট করে না। প্রতিটি জয়ের পরে আরও বাধা ডিঙানোর প্ররোচনা তাকে টানে। তিনি যান অরণ্যদেবী শক্তিমতি হুবাবাকে হত্যা করতে। তাঁর যদিও ভয় হয় এক পলকে যে,

হত্যা করি ওকে
দমিত হতেও পারে আলোকিত গৌরব
নিভে যায় 
যদি নিভে যায়
আলো ও মোহিনী মায়া। 

অমরত্বের আকাঙ্ক্ষায় তাঁর অভিযান মর্ত্য, পাতাল ও সমুদ্র পেরিয়ে। শত্রুকে তিনি বধ করেন, প্রতিযোগীকে করেন বশ। দেবতার অনড় ইচ্ছাকে তিনি নিজের পৌরুষ দিয়ে পক্ষে টানেন। কিন্তু এভাবে হারিয়ে ফেলেন ‘আলো ও মোহিনী মায়া’।

তাঁর বিষাদ তাই যায় না। জয়ের অপূর্ণতা যতদিন ততদিন তিনি অসন্তুষ্ট। প্রতিটি জয় তাঁকে আরও উচ্চের, আরও ভয়জাগানিয়া এবং আরও ভালোবাসার আবহ দেয়। পরম বন্ধু ও ভ্রাতা বীর এনকিদুর মৃত্যু তাঁকে মৃত্যুর বিরুদ্ধে, নিয়তির বিরুদ্ধে মানুষের অসহায়তার গভীর বিষাদের স্বরূপ দেখায়। এই বিষাদই তাঁকে নিয়ে যায় সমুদ্রের গভীর থেকে অমরত্বের সঞ্জীবনী শেকড় ছিঁড়ে আনার অন্তিম অভিযানে। এবং এর ব্যর্থতাই তাঁর এক ভাগ মনুষ্যত্বের ট্র্যাজেডিকে নিশ্চিত করে দেয়। 
জার্মান দার্শনিক নিৎশে তাঁর বার্থ অব ট্র্যাজেডি : আউট অব স্পিরিট অব মিউজিক গ্রন্থে মহাকাব্যের বীরদের দুই ধরনের তাড়নার লীলাচলে তাড়িত হওয়ার কথা বলেছেন। একটি যদি হয় নৈরাশ্যবাদী অন্যটি জীবনবাদী। একটি বাস্তবতা মেনে চলে অন্যটি তাতে আনে বিশৃঙ্খলতা। নিৎশে এর নাম দিয়েছেন ডাইয়োনিসিয়ান ও অ্যাপলোনিয়ান দ্বিধাবিভক্তি। আরও পরে তিনি এই দুইকে এক করে মহাকাব্যের বীরের জীবনবাদী অসন্তোষকেই ট্র্যাজেডির চালিকাশক্তি হিসেবে দেখান। এই অসন্তোষই ফ্রয়েড সভ্যতার মর্মে আবিষ্কার করেছেন, থিওডর অ্যাডর্নো দেখেছেন এর মধ্যে হেগেলের বলা অসুখী আত্মার যন্ত্রণা। কবি বোদলেয়ার থেকে র‌্যাঁবো অবধি সত্তার ভেতরকার বিষাদকে নিবারণ করতে চেয়েছে ইন্দ্রিয়ের চরমতম উপভোগের মধ্যে দিয়ে বিলোপসাধনে। ট্র্যাজিক চেতনা তাই মানুষের আত্মচেতনারই সহজাত। 
গিলগামেশ যে একের পর এক বাধা তথা দানবকে পরাহত করবেন, তার তাড়না এই জীবনবাদী অসন্তোষ। দানবের হিংস্রতা আর দেবতার অভিশাপ যেন সেই ডাইয়োনিসিয়ান ও অ্যাপলোনিয়ান শক্তির ছক, যা তিনি ভেদ করতে করতে মুখোমুখি হবেন শেষ দানবের : যার নাম মৃত্যুর দেবী ইশতারের প্রেম অস্বীকার করায় গিলগামেশ মৃত্যুর অভিশাপবিদ্ধ হন। অরণ্যদেবী মার্তৃদেবী হুবাবাকে হত্যা করে আসা বীরের বধু হতে চান প্রেম ও উর্বরতার দেবী ইশতার। কিন্তু গিলগামেশ দেবী ইশতারকে সম্রাজ্ঞী করে রাখতে পারে কিন্তু ‘ঘরের বধূয়া…নহে নহে দেবী, এ নহে হবার’। 

বলো
কারে তুমি কতদিন বাসিয়াছো ভালো
কত থাকিয়াছে তোমার প্রেমিক তব দ্বারে…

তারপর সেসব প্রেমিকের অস্তমিত হবার কাহিনি জানিয়ে গিলগামেশ ইশতারকে প্রশ্ন করে,

সুতরাং
ভেবে দেখো দেবী ইশতার
আমি যদি হই তব প্রেমিকপ্রবর
কী হবে আমার গতি দুই দিন পর

গিলগামেশ জানে অজস্র প্রেমের শহীদদের মাড়িয়ে তার কাছে এসেছে ইশতার। তার প্রেমে নত হওয়া মানে নিজেকেও তার কামনার বেদীতে উৎসর্গ করা। হয় মৃত্যু নয়তো প্রেমের আত্মদান, এ দুয়ের মধ্যে বেছে নিতে হতো গিলগামেশকে। ঠিক এনকিদুর মতোই : হয় অজেয় বন্যতা নয়তো প্রেমের লীলায় বিসর্জন। কিন্তু বিজ্ঞ গিলগামেশ প্রত্যাখ্যান করে মৃত্যুর চ্যালেঞ্জই। 
কিন্তু তার পিতৃকুলের দেবতারাই শলা করে গিলগামেশের বদলে তাঁরই দোসর এনকিদুর মৃত্যুর বরাত দেন। এনকিদুর মৃত্যু নিয়তির মতো আসে, আর নিয়তির থাবার আঘাতে বন্ধুহারা গিলগামেশ বিবাগীর বেশে নামে জীবনের শেষ অভিযানে। খেয়াল করার বিষয়, সে যুগে নর–নারীর প্রেমের চাইতেও বড় ছিল বন্ধুত্বের প্রেম। নারী সেখানে কাম আর বন্ধু সেখানে আত্মার সহোদর। তাই কামবিরহ নয় বন্ধুর বিদায়ের আঘাতেই গিলগামেশ নামে তার শেষ অভিযানে : অমরত্বের অবিনশ্বর বাসনার পথে। 
বিষাদের আগে থাকে শোক। সিগমুন্ড ফ্রয়েড তাঁর মৌর্নিং অ্যান্ড মেলাংকলিয়ায় বলেন, শোক তখনই হয় যখন হারানোর ব্যাপারটা নিশ্চিত। শোক হবে তখনই যখন ভালোবাসার মানুষ আর ফিরে আসবে না। তার মরদেহের সামনে তাদের শোক চরম হবে। তারা কাঁদবে। এনকিদুর মৃতদেহের সামনে গিলগামেশও তার বন্য রোদন খুলে দেয়। নিজেকে যন্ত্রণা দেওয়ার ভায়োলেন্সও শোক প্রকাশেরই অংশ, যেমনটা গিলগামেশ করে, যেমনটা আমরা দেখি মহরমের মর্সিয়ায়। এনকিদুর মৃত্যুতে রুদালি গান গিলগামেশ কাব্যের সবচেয়ে মর্মস্পর্শী অংশ। 
কান্নার মাধ্যমে একসময় শোক নিষ্কাশিত হওয়ার কথা। কিন্তু রাজা গিলগামেশের শোক পরিণত হয় স্থায়ী অবসাদে। এটা সেই পরিস্থিতি যখন হারানোর ক্ষতি মেনে নেওয়া যাচ্ছে না, প্রিয়কে বিদায় দেওয়া যাচ্ছে না শোকের ভেলায়। ক্ষতিটা তো শুধু প্রেম বা প্রেমাষ্পদের না-থাকার নয়। এই বিশুদ্ধ ক্ষতি অপরিমেয় ও অবোধ্য। এখানে হয়তো ক্ষতিটা ভালোবাসার ধন হারানোর নয় শুধু, মৃত্যু তো ঘটে সম্পর্কেরও। ফ্রয়েড বলেন, বিষাদগ্রস্থ হয়তো পরিষ্কারভাবে জানেও না কী তার হারিয়েছে। সে হয়তো তার ক্ষতি সম্পর্কে সচেতন; তার অনুভূতিতে হয়তো ধরা দেয় কাকে সে হারিয়েছে, কিন্তু তার মধ্যে সে নিজের কী হারিয়েছে তা নির্ণয় করতে পারে না।
এনকিদু ছিল গিলগামেশের বীরত্বের সঙ্গী ও স্বীকৃতির আয়না। সে তারই আরেক রূপ। এনকিদুর মৃত্যু তাই এক বিশুদ্ধ ক্ষতি। সকল ক্ষতির বড় ক্ষতি—যা হারালে অন্য কোনো কিছুই আর সুখী  করতে পারে না। অন্য কাউকে দিয়ে এর পরিপূরণও অসম্ভব, কারণ সে তো জানে না সে কী হারিয়েছে! শোক কখনো চেতনের তলায় লুকায় না, কিন্তু বিষণ্নতা লুকিয়ে থাকে মনের অচেতন স্তরে। 
এটাই হলো মজনু দশা। প্রেমাষ্পদকে হারানোর মধ্যে দিয়ে মজনু আসলে নিজেকেই হারায়। যে প্রেমাষ্পদে সে গরীয়ান ছিল, ভরাট ও মহিমাপূর্ণ্ ছিল তার অহং, তা হারিয়ে সে নিঃস্ব ও শূন্য। শোকের বেলায় দুনিয়া ফাঁকা হয়ে যেত, আর বিষাদে যা শূন্য হয় তা তার আত্ম, সেলফ, তার ইগো। তাই মজনু দশায় দেখা দেয় বিবাগীপনা ও প্রতিরোধহীনতা। এনকিদুকে হারিয়ে তাই নিজেকেই হারিয়ে ফেলে গিলগামেশ। অমরত্বের খোঁজে দীর্ঘ অভিযানে নিজের রূপ, শৌর্য ও গরিমা খুইয়ে ফেলে সে।  
মৃত্যুর আগ্রাসনের মুখে গিলগামেশ একইসঙ্গে শোকার্ত ও বিষণ্ন হলেও তার অহং লুপ্ত হয় না। এখানেই ফ্রয়েডের শোক ও বিষাদের ব্যাকরণ ভেঙে তার যাত্রা চলে। মৃত্যুকে জয় করবার জেদ আর মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করার সাহসে গিলগামেশ হয়ে ওঠে আরও দুর্ধর্ষ। একইসঙ্গে বিষণ্ন ও বিদ্রোহী বৈশিষ্ট্যের মহানায়কের আদল হয়ে ওঠা তাই গিলগামেশের ভবিতব্য। পরে আমরা দেখব, গ্রিক ট্র্যাজেডির নায়কেরাও বিষণ্নতা আর বিদ্রোহের ব্যাকরণে নিজেদের নিয়তি রচনা করে চলেছেন। তাঁরা দুঃখী কিন্তু পরাজিত নন।  
গিলগামেশ মহাকাব্যে প্রেম নাই। দেবী ইশতারের প্রেম প্রত্যাখ্যান করে গিলগামেশ। জগতের কোনো নারীই যার অভোগ্যা নয়, তাকে শোকে বিবশ করে বন্ধুর প্রতি প্রেম। পৃথিবীর আদি মহাকাব্যে নরনারীর মধ্যে কাম আছে কিন্তু প্রেম নেই। কেননা, নারীরা তো পুরুষের সমকক্ষ নয় মিথের জগতে। দেবী হলেও সে বিশ্বাসযোগ্য নয়। বিশ্বাস ও বন্ধুত্ব হবে কেবল পুরুষের সঙ্গেই, যে সহযোদ্ধা, সহমর্মী এবং সহগামী। কিন্তু কে এই এনকিদু?

মানবিক সভ্যতা থেকে সম্পূর্ণ বিমুক্ত 
এনকিদু অপার্থিব 
চপলা হরিণীর সাথে তাহার সমূহ বিচরণ পাহাড়ে আর উপত্যকায় 
ক্ষুধা পেলে নরম ঘাস
আর পাহাড়ের একটেরে ঝর্ণায় নিবারণ জল তৃষ্ণা তার

এই এনকিদু দেবতাদের নির্মাণ, প্রকৃতির সন্তান। বন্য প্রাণীদের মতোই সে সুখী ও সক্ষম। তার অভিলাষ নেই, বিষাদও নেই। সে বাসনাহীন, নিজেতেই তৃপ্ত এক অচেতন প্রাণীসত্তা মাত্র।  
এনকিদু যেন গিলগামেশেরই শৈশবিক আদিম দশা। 
কিন্তু তাকে তো সৃষ্টি করা হয়েছিল গিলগামেশের দম্ভ গুঁড়িয়ে দিতে। তাই শোনামাত্রই ফাঁদ পাতে গিলগামেশ। তাকে প্রলুব্ধ করতে দেবদাসী পাঠানো হয় বনের পারে। ঝরনায় জল পান করতে এলে নগ্ন সুন্দরী শামাত তাকে প্রলুব্ধ করে। শেখায়, কী বাসনা করতে হয়। আর বাসনা এমন যে, তা আরও আরও বাসনার দিকে ধাবিত করে মন। এভাবে বাসনার ক্ষুধার মধ্যে দিয়ে এনকিদু হারায় তার অতিপ্রাকৃত সত্তা। তার মধ্যে জন্ম নেয় সভ্যতার প্রথম ব্যাধি—অতৃপ্তি ও বিষণ্নতা। এনকিদু,

দেবদাসী সঙ্গমে ক্লান্ত, দেব থেকে মানবে পতিত, সঙ্গী হরিণেরা পারে না চিনতে

প্রকৃতির রাজ্য থেকে বিচ্যুত এনকিদু মানুষ হয়ে উঠল। তাকে সভ্য করে তুলল মোহনীয় শামাত, আর তার মধ্যে ঢুকিয়ে দিল সংস্কৃতি-সম্পর্ক-বন্ধুত্ব এবং উচ্চাভিলাষ। কিন্তু সভ্যতার খেসারত হিসেবে তাকে হারাতে হলো দৈবক্ষমতা। বাসনার বিষেই সে বন্যসুন্দর থেকে জরাকাতর মানুষ হয়ে উঠল। তাই নগরে এসে গিলগামেশের সঙ্গে যুদ্ধ পরাস্ত হয়ে তারই বশ এবং তারই বান্ধব হতে হয় তাকে। এভাবে বাসনাজাত অভাববোধের সমিলে দুই বীরের বন্ধন জন্মালো। এই অভাববোধই কি প্রকৃতি থেকে বিচ্যুত আধুনিক মানুষের ব্যাধি নয়? নয় কি তার যুদ্ধ ও ভোগবাসনার মূলে? এ–ই কি নয় তার গন্ধম? আর এভাবেই কি সে পরাস্ত নয় নিজের কাছে? এনকিদুর পতন আধুনিক ভোগবাদী পণ্যায়িত সংস্কৃতিরই প্রতীক যেন। 
শুধু গ্রিক মহাকাব্যের বীজই নয়, গিলগামেশ কাব্য যেন মানবতার চিরকালীন সংকটগুলিরই পরীক্ষাক্ষেত্র। বাইবেলের অনেকগুলি কাহিনির উৎসও এই আখ্যান। নারীর সঙ্গে সঙ্গমে এনকিদু হারায় তার শুদ্ধক্ষমতা। কিন্তু একে গন্ধমজাত পাপ হিসেবে দেখেননি এর রচয়িতারা। পাপবোধ থেকে গিলগামেশও মুক্ত। তাদের জীবনের উদযাপনে ক্লান্তি আছে ক্লেদ নাই। 
বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতিতে যে মহাপ্লাবনের মিথের আবির্ভাব দেখা যায়, তারই প্রথম আবির্ভাব দেখা যায় গিলগামেশে। বাইবেলে যেখানে মানুষের পাপের ফলে প্লাবনে পৃথিবী ডুবে যায়, গিলগামেশে তা ঘটে নিছকই দেবতার প্রতিহিংসায়। 
গিলগামেশ বলে যায় মানুষ অমৃতের দুর্দমনীয় সন্তান, তার পাপ নেই, তার কেবল আছে বিষাদ ও আনন্দের যুগলবন্দি। ট্র্যাজেডির কারণ কেউ সন্ধান করেছেন নিয়তির মধ্যে, কেউবা করেছেন নায়কের চরিত্রের মধ্যেকার কোনো দুর্বলতায়। ট্র্যাজেডিকে দুর্ভাগ্যের সঙ্গেও তুলনা করা হয়। খারাপ কিছু ঘটলেই বলা হয় নিয়তি, যেন যা কিছু নিরীহ ও সুখের তা নিয়তি–নির্ধারিত নয়। নিয়তির কবল থেকে মুক্ত এনকিদুর জীবন নিরীহ ও সুখী। কিন্তু যেই তার মধ্যে কামবাসনা ঢুকে পড়লো অমনি সে শিকার হলো দুর্ভাগ্যের। এভাবে নিয়তির ফলকে একদিক থেকে পাপের ফল হিসেবে দেখা হয়। এই দেখা ধর্মীয়, এই দেখা মানুষকেই তার পরিণতির জন্য দায়ী করে শাস্তি দেবার পক্ষে। ফ্রেডরিখ জেইমসন তাঁর ‘ফেইট অ্যান্ট ক্যারাক্টার’ প্রবন্ধে বলছেন, অন্যদিকে চরিত্র বা ক্যারাক্টার হলো স্বভাবের মধ্যে থাকা একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি। তাহলে যা স্বভাবগতভাবে হয়ে চলে তা নিয়তি নয়, নিয়তির সেখানে কিছু করার নাই। এভাবে দেখলে জীবনকে বোঝার ব্যাপারে নিয়তি ও চরিত্র দুই–ই একে অন্যকে কাটাকুটি করে বাতিল হয়ে যায়। 
তাই বাতিল হয়ে যায় এনকিদুর ইনোসেন্স আর গিলগামেশের চরিত্রের কোনো দায়। বরং দেখা যায় গিলগামেশের অমরত্বের বাসনা, জয়ী হবার দুর্দম ইচ্ছাই তার জীবনকে অন্যদের থেকে আলাদা করে। ট্র্যাজেডির জগৎ বহুদেবতা, অর্ধদেবতা, অর্ধমানবের জগত। মানুষও সেখানে দেবতাদের প্রতিস্পর্ধী। প্রতিস্পর্ধী হয়েই, সীমাটা পার হয়েই, পর্দা ভেদ করে দেয়ালের ওপারের জগত সে দেখে ফেলে। ট্র্যাজেডি তাই চরিত্রের বিশুদ্ধতা হারানো কিংবা কর্মফলে ইশ্বরের শাস্তি যোগ্য হওয়ার জন্য হয় না, ট্র্যাজেডি ঘটে তখন, যখন প্যাগান মানুষ দেখতে পায় সে তার দেবতাদের চাইতে উত্তম। ‘ট্র্যাজেডিতে প্রথমবারের মতো তার মাথা পাপ-পূণ্য ও ভুল-সঠিকের মেঘমালার ঊর্ধ্বে উঠে আসে, সে লঙ্ঘন করে অশুভ নিয়তির নির্দেশ। (ফেইট অ্যান্ড ক্যারেক্টার :  রিফ্লেকশনস / ফ্রেডরিখ জেমিসন / ১৯৭৮)। জেমিসন বলছেন, এই উপলব্ধি তাকে স্তব্ধ করে দেয়। নিজেকে আরও শক্তিমান হিসেবে ঘোষণার বদলে সে অন্তরালে সঞ্চয় করতে থাকে তার শক্তিগুলো। 
মৃত্যুর আগে গিলগামেশ তাই নীরব হয়ে যায়। ট্র্যাজেডিতে মহিমাপূর্ণ প্রতিভার জন্মের কূটাভাস এই যে, নৈতিক বিচার করতে গিয়ে তাকে নীরব হয়ে যেতে হয় অথচ পৌরাণিক দেবতারা সেখানে দণ্ড হাতে কতই না সরব। 

ফুটনোট : ব্যবহৃত উদ্ধৃতিগুলি নেয়া হয়েছে মোহাম্মদ জামানের করা গিলগামেশ মহাকাব্য বই থেকে। প্রকাশ করেছে দিব্যপ্রকাশ, ২০১৬ সালে। বাংলাদেশে হায়াৎ মামুদ গিলগামেশের অনুবাদ করেছেন, তবে তা সংক্ষিপ্ত কিশোরপাঠ্য আদলে। কবি মোহাম্মদ জামানের কাব্যিক, গম্ভীর ও সংহত অনুবাদে বাংলা ভাষায় গিলগামেশ পড়বার সার্থকতা হলো। একজন কবি ও ভাবুকের পক্ষেই সম্ভব এই প্রাচীনতম মহাকাব্যের জগতকে বাংলা ভাষায় তুলে আনা। এর প্রাচীন ভাব আর জীবনবাদী উল্লাস কেবল অনুবাদের কাজ নয়, তা পুনঃসৃজন করার শিল্পীসুলভ দায়। মোহাম্মদ জামান তাই বহু পাঠকের ধন্যবাদার্হ হবেন।


• কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও সাংবাদিক,  বাংলাদেশ।

menu
menu