৬-দফা থেকে ১-দফা এবং মুজিবের জনপ্রিয়তা

জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ, ১৯৬৬ সাল। নীল আকাশের নিচে তীর্যক সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত তিন লক্ষ মানুষের মধ্যমাকৃতির নগরী ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলে জনসভাখ্যাত ঐতিহাসিক পল্টন ময়দান। সে ময়দানেই কোনো একটি রাজনৈতিক দলের জনসভা। সে জনসভায় যাবো কি যাবো না ভেবে ভেবে অবশেষে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম। 

আমি তখন ছাত্রলীগ ঢাকা নগর শাখার কার্যকরী পরিষদের একজন নগন্য সদস্য এবং একই সঙ্গে ধানমন্ডি শাখার নিতান্তই প্রতাপহীন সাধারণ সম্পাদক। আসলে নামের বেলাই সাধারণ সম্পাদক আর কাজের বেলায় একজন পরিপূর্ণ দলীয় টোকাই। সে যুগে রাজনীতি করে এমন তরুণদের সংখ্যা হাতে গোনা যেতো এবং শতকরা ৯০ ভাগ ছাত্রই রাজনীতি সম্পর্কে অনীহা প্রকাশ করতো। এমনকি এর আগে ’৬২ সালে কট্টর আইয়ুবী শাসনের সময় শহিদ সোহরাওয়ার্দীর মুক্তির দাবির পাশাপাশি বাংলাকে উর্দু ও আরবি হরফে লেখার চক্রান্তকে প্রতিহত করা এবং ’৬৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তন উৎসবে বিএ পাস গভর্নর মোনায়েম খানের উপস্থিতির বিরুদ্ধে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে তুমুল আন্দোলন গড়ে উঠলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ বিপুল সংখ্যক ছাত্র রাজনীতির বদলে নিজেদের লেখাপড়ার প্রতিই অধিক যত্নবান ছিলেন। তখনো একজন সাধারণ ছাত্রের অভিধানে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, অস্ত্রের ঝনঝনানি, রাজনৈতিক দলের অন্ধ লেজুড়বৃত্তি ইত্যাদি শব্দসমূহের কোনো উপস্থিতি ছিল না।
 
অন্যদিকে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর একটি ক্ষুদ্রকায় সচেতন অংশ পাকিস্তানি উপনিবেশবাদের সর্বগ্রাসী শোষণ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হলেও বিপুলসংখ্যক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তখনো ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানি ধ্যান-ধারণার কট্টর জিঞ্জিরে আবদ্ধ। তাই ’৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর কাশ্মীর প্রশ্নে ভারত পাকিস্তানের মধ্যে মারাত্মক যুদ্ধ শুরু হলে পূর্ব বাংলার সাধারণ জনগণ বিনা দ্বিধায় ভারতের বিরুদ্ধে আইয়ুব খানের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান সরকারের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়। যুদ্ধের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে পশ্চিম রণাঙ্গণে তুলনাবিহীন শৌর্যবীর্য ও বীরত্বের কারণে সর্বাধিক সংখ্যক পুরস্কার ও খেতাবে ভূষিত করা হয়েছিল।
 
এদিকে ধর্ম ও সংহতির মিথ্যা আবরণে ঘুমিয়ে থাকা বিপুল জনগণের সামনে নির্দয় পাকিস্তানি শোষণের পরিণতি সম্পর্কে অত্যন্ত সজাগ আওয়ামী লীগের নবনিযুক্ত সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান ও তার যোগ্য সহকর্মীগণ যেকোনো মূল্যে বাঙালির স্বায়ত্বশাসন তথা আত্মনিয়ন্ত্রণের আন্দোলনকে সামনে এগিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। এমনকি পরিস্থিতিকে বিশেষ করে ’৬৫ সালের যুদ্ধকালীন সময়ে বৈদেশিক আক্রমণের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার নিদারুণ অসহায়তার কথা বিবেচনা করে শেখ সাহেব বাঙালির মুক্তি সনদ নামে পরিচিত ঐতিহাসিক ৬-দফা দাবি উত্থাপন করেন। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ’৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ৬-দফা দাবি উত্থাপনের আগ পর্যন্ত শেখ সাহেব ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে মোটেও মওলানা ভাসানীর সমকক্ষ ছিলেন না। 

ইংরেজ শাসনের আমল থেকেই গড়ে ওঠা সর্বশক্তিমান জমিদার শ্রেণি ও সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থার প্রতিভূ বিপুল সংখ্যক সংখ্যাগরিষ্ঠ গরিব মেহনতি জনতার রক্ত চুষে বেড়ে ওঠা। পাকিস্তানি অভিজাত সম্প্রদায় তথা নবাবজাদা, সাহেবজাদা ও পীরজাদাদের স্বার্থ রক্ষাকারী প্রচণ্ড রক্ষণশীল, দক্ষিণপন্থী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বলপূর্বক ক্ষমতা দখলকারী এক জেনারেলের দীর্ঘ দশ বছরকালীন শাসনের একটি বিরাট অংশ জুড়ে প্রগতিশীল আন্দোলন তথা গরিব মেহনতি মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু বলে দাবিদার মওলানা ভাসানী ও তার বিপ্লবী অনুসারীগণ যতটুকু না ছিলেন আইয়ুব বিরোধী, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিলেন আইয়ুব সমর্থক। ’৫৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনে মওলানা সাহেব পাকিস্তানিদের উদ্দেশ্য ‘আচ্ছালামু আলাইকুম’ বলেও ষাটের দশকের প্রারম্ভে সরকারি চীন নীতির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে আইয়ুবের ব্যক্তিগত প্রতিনিধি হিসেবে দীর্ঘ সাত সপ্তাহব্যাপী চীন সফর করে এসে দীর্ঘ ৬ বছর ধরে আইয়ুব বিরোধী সকল আন্দোলন থেকে নিজেকে সযত্নে সরিয়ে রাখলেন। সম্ভবত মওলানা সাহেব তখন তারই দলীয় মেনিফেস্টোর ভাষায় দুনিয়ার নিকৃষ্টতম সাম্রাজ্যবাদের দালাল ও দেশীয় শোষকদের সেরা প্রতিভূ, একটি চরম প্রতিক্রিয়াশীল সেনাবাহিনীর তথাকথিত লৌহমানব আইয়ুব খানের সাহায্য নিয়েই সমগ্র পাকিস্তানে অতি সহজেই মাওবাদ-লেনিনবাদ তথা শ্রেণিহীন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটানোর এক মহান স্বপ্নে বিভোর হয়ে বসেছিলেন। তবে এ ব্যাপারে মওলানা সাহেব যতটুকু না উৎসাহী ছিলেন তারচেয়ে শতগুণ বেশি উৎসাহী ছিলেন তার দলের অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতারা। মসিউর রহমান যাদু মিয়া, মোহাম্মদ তোয়াহা, হাজী দানেশ, আবদুল মতিন, আবদুল হক, আলাউদ্দীন আহমেদ, নূরুল হুদা, কাদের বকশ, মোহাম্মদ সুলতান, আনোয়ার জাহিদ, দেবেন সিকদার, সাইদুল হাসান ও তাদের কট্টর অনুসারী ছাত্রনেতা রাশেদ খান মেনন, কাজী জাফর আহমেদ, মাহবুবুল্লাহ, মোস্তফা জামাল হায়দার প্রমুখেরা তখন পশ্চিম বাংলার নক্সালবাড়ি আন্দোলনের চরমপন্থি নেতা চারু মজুমদারের প্রশংসায় উন্মুখ হয়ে সমগ্র পাকিস্তানে শ্রেণি সংগ্রাম তথা গ্রাম-বাংলায় একটু অবস্থাপন্ন গৃহস্থদের গলা কেটে শ্রেণিবিহীন সমাজতান্ত্রিক পাকিস্তান কায়েমের খোয়াব দেখছিলেন। 

পূর্ব বাংলার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর পাকিস্তানি শিল্পপতি, জমিদার ও সামন্তপ্রভুদের স্বার্থরক্ষাকারী একটি চরম প্রতিক্রিয়াশীল গণবিরোধী সামরিক সরকারের নিদারুণ জুলুম, অত্যাচার ও নির্দয় শোষণের দিকটি ভুলে গিয়ে লাল ঝান্ডা তোলা শহরে বিপ্লবীরা সেদিন প্রধান জাতীয় দ্বন্দ্ব নির্ণয়ে মারাত্মক ভুল করে ৬-দফা তথা বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের বিরুদ্ধে ব্যাপক তৎপরতা চালিয়ে পাকিস্তান সরকারের প্রকাশ্য দালালিতে লিপ্ত হয়েছিলেন। ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে মওলানার চেয়ে তার সাগরেদ চেংড়া বিপ্লবীরাই ছিলেন বেশি তৎপর। ব্যক্তিগত জীবনে একটি পরিবারে অতীব বৃদ্ধ দাদা-নানারা যেমন ছেলে মেয়েদের কাছে দ্রুত কর্তৃত্ব হারিয়ে বসে নেতায়েত সিম্বলিক প্রধান হিসেবে বেঁচে থাকেন তেমনি ষাটের দশকে আশি উত্তর বৃদ্ধ জননেতা মওলানা ভাসানীও তার দলের মুজিব বিরোধী অতি তাত্ত্বিকও অতি বিপ্লবীদের মাঝে পড়ে নিজের সাধারণ সত্ত্বাটুকুও হারিয়ে ফেলেছিলেন। এসব তথাকথিত বিপ্লবীদের প্রায় সবাই শেখ মুজিব ও ৬-দফায় জনপ্রিয়তায় রাগে শোকে অন্ধ হয়ে গিয়ে পাঞ্জাবি গোষ্ঠীর দালাল, আমাদের স্বাধীনতার ঘৃণ্যতম জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে গলা মিলিয়ে জাতিগত নিপীড়নের প্রত্যক্ষ পূর্ব বাংলার জনগণের প্রাণপ্রিয় দাবি ৬-দফার বিরুদ্ধে আদাজল খেয়ে লেগেছিলেন। শেখ মুজিবসহ সকল আওয়ামী নেতাদের জেলে ভরে তাদের পত্র-পত্রিকা সব বাজেয়াপ্ত করে এবং জামাত ও ভাসানী ন্যাপ সকল বিরোধী দলসমূহের সরাসরি সমর্থন পেয়েও পাকিস্তান সরকার ৬-দফা আন্দোলন নিয়ে বেকায়দায় পড়ে যান। যতই দিন যেতে থাকে ততই বাংলার জনগণ ৬-দফার পতাকাতলে সমবেত হতে থাকেন। অতঃপর ঐতিহাসিক ৭ জুনে ঢাকা শহরে নিরস্ত্র মানুষদের মিছিলের ওপর গুলি চালিয়ে কমপক্ষে ১৫ জন শ্রমিককে হত্যা করে, সর্বাধিক প্রচারিত পত্রিকা ইত্তেফাক বন্ধ করে আন্দোলনকে সাময়িকভাবে দাবিয়ে দেয়া হয়। 

এরপর খোলা ময়দানে গোল দেবার মহা সুযোগের সদ্ব্যবহারের অপেক্ষায় ছিলেন ভাসানী ন্যাপের তৎকালীন বিপ্লবী বন্ধুরা। তাদেরই উদ্যোগে পূর্ব বাংলার অন্যান্য শহর, নগর, বন্দর ও গঞ্জের মতো ঢাকা শহরেও ৬-দফা তথা বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার আন্দোলনের তীব্র বিরোধীতায় তারা ব্যস্ত হলেন আইয়ুব প্রশাসনের প্রত্যক্ষ আনুকূল্যে। আজও আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে ’৬৬-র জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ঢাকার পল্টন ময়দানে হাজার দশেক মানুষের জনসভায় দাঁড়িয়ে তৎকালীন ভাসানী ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ তোয়াহার ৬-দফা ও মুজিব বিরোধী জঘন্য মিথ্যাচারের কথা। মুজিবকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দালাল ও ৬ দফা সিআইএ আবিষ্কার বলে সেদিন তারা আইয়ুব মোনায়েমের প্রকাশ্য দালালি করে শেষ রক্ষা করতে পারেননি। বিকল্প কর্মসূচি না দিতে পেরে শুধুমাত্র ৬-দফা ও মুজিব বিরোধীতার রাজনীতি চালাতে গিয়ে তারা অচিরেই মুজিবকে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতায় পরিণত করেছিলেন এবং ৬-দফার দাবিকে বলপূর্বক দাবাতে গেলে সমগ্র পূর্ব বাংলায় অচিরেই এক দফা দাবি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। 


• লস এঞ্জেলেস, যুক্তরাষ্ট্র

menu
menu