সাহিত্যের কথা

কথিত আছে, কোনো কিছু সংজ্ঞায়িত করতে গেলেই বিষয়টি খণ্ডিতভাবে উপস্থাপিত হয়। বিষয় হিসেবে ‘সাহিত্য’ নিশ্চয়ই এর বাইরে নয়। তাহলে প্রশ্ন হলো কেন এই কোশেশ? কোশেশ এই জন্য যে, আমাদের যাপিত জীবনে ‘জীবন ও জগৎ’ সম্পর্কে প্রায় সকলেরই কিছু জিজ্ঞাসা থাকে, থাকে অল্পবিস্তর অভিজ্ঞতা। আমাদের যাবতীয় প্রশ্ন, প্রশ্নের উত্তর ও অভিজ্ঞতা সাহিত্যে সঞ্চিত থাকে। তাই ‘জীবন ও জগৎ’কে নিবিড়ভাবে জানবার ও বুঝবার সযত্ন প্রয়াস থেকেই সাহিত্যের স্বরূপ অন্বেষণ।

পানি কী? পানি কী দিয়ে গঠিত? এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় পানি একটি পদার্থ। এটি হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন দ্বারা গঠিত। আমাদের সাদা চোখে তাপমাত্রার ভিন্নতার দরুন এর তিনটি রূপ পরিলক্ষিত হয় কঠিন, তরল ও বায়বীয়। কিন্তু এর বাইরে পদার্থ হিসেবে পানির আরও দুটি রূপ আছে—প্লাজমা ও বেক কন্ডিশন। কিন্তু সাহিত্য সম্পর্কে কি এরূপ কথা অবলীলায় বলা যায়? অবশ্যই না। কারণ ‘সাহিত্য’ শব্দটি বিমূর্ত অথচ পার্থিব। এর রূপ স্থান কাল ও পাত্র ভেদে পরিবর্তিত হয়। অর্থাৎ সাহিত্য একটি ব্যক্তিক মানবিক জ্ঞান (Subjective Knowledge)। তাই এর সার্বজনীন মানদণ্ড নেই। কিন্তু ব্যক্তিকতার (Subjective)  ভেতরেও এক ধরনের নৈর্ব্যক্তিকতা (Objectivity) থাকে। সেটা কী রকম?  
সাহিত্য মূলত এথিকস্ এসথেটিকস্ ও ফিলোসফির সমন্বয়ে গঠিত একধরনের ব্যক্তিক-মানবিক জ্ঞান, যা ব্যক্তিক হয়েও বিষয়ীগত।

একজন রাঁধুনীর নিকট সর্বপ্রকার-উপকরণরন্ধন থাকা মানেই যেমন উৎকৃষ্ট রান্নার নিশ্চয়তা ঠিক নয় তেমনি উপরিউক্ত উপকরণগুলোর ওপর কারোর দখল থাকা মানেই এই নয় যে সে উৎকৃষ্ট সাহিত্যিক; তার সৃষ্টিকর্ম উৎকৃষ্ট সাহিত্য। রাঁধুনীর মতো একজন সাহিত্যিকের জন্য যা অনিবার্য তা হলো মাত্রাজ্ঞান—কিসের সাথে কী, কতটুকু মাত্রায় মেশানো যাবে।

অনেকে বলেন সাহিত্য হলো ‘জীবনের সমান্তরাল কোনোকিছু’। অর্থাৎ যতদিন জীবন থাকবে ততদিন সাহিত্য থাকবে। কিন্তু সাহিত্য ‘জীবন ও জগৎ’ সম্পর্কে প্রশ্নের উত্তর সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসারে দেয় না। মোটামুটি একটি পদ্ধতি অবলম্বন করে মাত্র। যেমন : একজন দার্শনিক যুক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে অবশ্যই শুধুমাত্র আরোহী অথবা অবরোহী যুক্তির ব্যবহার করবেন। কিন্তু একজন সাহিত্যিক এই ধরনের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত। তিনি হঠাৎ করেই আরোহী যুক্তির পর অবরোহী যুক্তির অবতারণা করতে পারেন। অবশ্য কোনো কোনো মহান সাহিত্যিক তাদের সাহিত্যকর্মে যুক্তির নিখুঁত পরম্পরা মেনে চলতে সচেষ্ট হয়েছেন। যেমন : গ্যয়টে তাঁর ফাউস্ট-এ। এই ধরনের সাহিত্যকর্ম হচ্ছে ‘দর্শনাক্রান্ত সাহিত্য’। যেকোনো বিষয়ের যেমন দর্শন ঠিক থাকে তেমনি বিষয় হিসেবে ‘সাহিত্যের’-ও দর্শন থাকতে পারে। এমনকি বিষয় হিসেবে দর্শনেরও একপ্রকার ‘দর্শন’ থাকে। বিজ্ঞানের সঙ্গে সাহিত্যের মূল পার্থক্য হলো জ্ঞানের পদ্ধতিগত (Epistemology) অনুপুঙ্খতায়। বিজ্ঞান প্রকৃতির কোনো বিষয়কে যত গভীর এবং  বিস্তারিতভাবে দেখে সাহিত্যে ঠিক সেভাবে অগ্রসর হয় না। এর একটি স্থূল উদাহরণ হতে পারে, একটি পুকুরে কতো পেয়ালা পানি আছে? এই প্রশ্নের উত্তরে সাহিত্য বলবে পুকুরের সমান পেয়ালা হলে এক পেয়ালা আর অর্ধেক হলে দুই পেয়ালা ইত্যাদি। কিন্তু বিজ্ঞান বলবে নির্দিষ্ট তাপমাত্রও চাপের ভিত্তিতে পানির আয়তনের কথা। যদি এত তাপমাত্রা ও এত চাপে এত পরিমাণ পানি এত পরিমাণ জায়গা দখল করে তাহলে পুকুরের আয়তন এত হলে এতে এত পরিমাণ পানি আছে। যদি পেয়ালার আয়তন এত হয় তাহলে এতে এত পরিমাণ পানি ধারণ করবে। অতএব, পুকুরে এত পেয়ালা পানি আছে। বিজ্ঞান ও সাহিত্যের আরেকটি উদাহরণ এমন হতে পারে যে, এক ফোঁটা চোখের পানিকে বিজ্ঞান বলবে এটি নিতান্তই গ্রন্থিরস আর সাহিত্য বলবে বেদনার্ত হৃদয়ের আর্তি। এইরূপ উদাহরণ আরও দেওয়া যেতে পারে।

সাহিত্য হচ্ছে মূলত সংশ্লেষণ। একটি বিষয় বা ঘটনা যেরূপই থাকুক না কেন একজন উপস্থাপক বা দর্শক তার ঘটনটি নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করে মাত্র। যেমন : সাহিত্যিক বলতে পারেন ‘ হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছ মহান’। কিন্তু একজন ভিক্ষুক কিংবা দরিদ্র লোক কি ঘটনাটিকে এইরূপে দেখে? কিংবা একাধিক লোক একই ঘটনাকে ভিন্ন রকমভাবে দেখতে পারে, ব্যাপারটা মোটেই বিচিত্র নয়। তবে দর্শনের সঙ্গে সাহিত্যের মিল এই জায়গায় যে, এদের মুখ্য গুণ  হলো দেখায়, চর্চায় কিংবা সিদ্ধান্তে নয়। রবীন্দ্রনাথের দেখার অন্তর্দৃষ্টি ছিল বলেই তিনি ‘আমার ছেলেবেলা’ লিখতে পেরেছেন। কিন্তু আমাদের প্রত্যেকেরই ছেলেবেলা থাকা সত্ত্বেও কি আমরা আমাদের মানস-লোকে তা সবিস্তারে অবলোকন করি! এই জন্যই রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ আর আমরা আমজনতা।

সাহিত্যের আরেকটি মুখ্য গুণ হচ্ছে তার মাধ্যমের লিবার্টি, ফ্লেক্সিবিলিটি। একজন ব্যক্তিসাহিত্যিক তার মাধ্যমের এই সুবিধাটি উপভোগ করেন। বিজ্ঞান এবং দর্শনে এই দুটি গুণের তুলনামূলক অনুপস্থিতির কারণে হয়তো এরা তুলনামূলকভাবে কম জনপ্রিয়; অল্পসংখ্যক লোকের পঠন-পাঠনের বিষয়। তাছাড়া বিজ্ঞানের কোনো একটি বই সাধারণত এই কারণে অধিক সময় টিকে থাকে না। কোনো বিজ্ঞানের বইয়ে এই গুণ থাকলে তা অধিক সময় টিকে থাকে এবং জনপ্রিয় হয়। যেমন : ডারউইনের ‘প্রজাতির উৎপত্তি’ একটি হার্ডকোর বিজ্ঞানের বই হয়েও উৎকৃষ্ট বিজ্ঞানসাহিত্য, যা জনঘনিষ্ঠও বটে। একই কথা দর্শনে প্লেটোর ‘গণরাজ্য’র ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

সাহিত্য তার উপকরণ হিসেবে বিজ্ঞান, দর্শন, অর্থনীতি ইতিহাসসহ হেন বিষয় নেই যা ব্যবহার করতে না পারে। এটা বিষয় হিসেবে ‘সাহিত্য’র বিশেষ গুণ। যা সচরাচর অন্য কোনো বিষয়ের নেই। এইদিক থেকে সাহিত্যিক অন্যদের চাইতে ভাগ্যবান। ভাগ্যবান সাহিত্যের পাঠকরাও। কেননা বিজ্ঞান, দর্শন, অর্থনীতি পাঠ করতে গেলে গণিতসহ অন্যান্য কিছু বিষয় আত্মস্থ করা অবশ্যই কর্তব্য। কেউ কেউ দর্শন পাঠে গণিতের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন করতে পারেন। কিন্তু এটা স্মর্তব্য যে প্লেটো তাঁর অ্যাকাডেমির ওপর লিখে রেখেছিলেন—‘যে বা যারা গণিত জানে না তাদের অ্যাকাডেমিতে প্রবেশ নিষেধ’।

মনোকাঠামোর দিক দিয়ে একজন ঔপন্যাসিকের সঙ্গে একজন বৈজ্ঞানিকের সাদৃশ্য লক্ষণীয় হলেও সার্বিকভাবে একজন সাহিত্যিকের মনোকাঠামোর সঙ্গে একজন বৈজ্ঞানিক বা দার্শনিকের মনোকাঠামোর মিলের চাইতে অমিল বেশি। একজন কবি অঙ্গহীন আলিঙ্গনের কথা অনায়াসে বলতে পারেন কিন্তু একজন বৈজ্ঞানিক বা দার্শনিকের পক্ষে এটা মেনে নেওয়া কষ্টকর। এটাও মেনে নেওয়া কষ্টকর যে, রামের জন্মস্থান অযোধ্যার চাইতে সত্য, কিংবা চেতনার রঙে পান্না হলো লাল ইত্যাদি। মূলত সাহিত্যে একজন সাহিত্যিক ঘটনা বা বিষয় বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকেও বর্ণনার অবকাশ পান, যা বিজ্ঞান বা দর্শনে প্রায় অসম্ভব। যেকোনো বিষয় বা ঘটনার ন্যূনতম তাত্ত্বিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও নন্দনতাত্ত্বিক-এই ছয় প্রকার তাৎপর্য আছে। যার মনোকাঠামো যেরূপ সে নির্দিষ্ট একটি বিষয় বা ঘটনার সেইরূপ ব্যাখ্যা দেবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সাহিত্য বিষয়গুলোকে একত্রে ধারণ করে। তাই যেকোনো সাহিত্যকর্মে বা ব্যক্তি-সাহিত্যিকের পক্ষে এই ছয়টি দৃষ্টিকোণের যেকোনো একটি, একাধিক বা সকল দিক থেকেই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার অবকাশ থাকে। তাই কেউ বলেন সাহিত্য শ্রেণিসংগ্রামের হাতিয়ার, আবার কেউ বলতে চান সাহিত্য শুধুই নন্দনের অবগাহন। আবার কেউ কেউ উভয়কে মিলিয়েই দেখেন। একইভাবে, সাহিত্যিক সম্পর্কে বলেন; অমুক সাহিত্যিক কম্যুনিস্ট, বুর্জোয়া, আস্তিক, নাস্তিক, ইত্যাদি। 

সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন ইত্যাদি মূলত সাধারণীকৃত শব্দ। যেমন : বিজ্ঞান বলতে পদার্থ, জীব, রসায়ন, প্রাণ-রসায়ন ইত্যাদি অনেক বিষয়কেই বোঝায়। কিন্তু আলাদা আলাদাভাবে পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান বলতে ঠিক কী বোঝায়? শুধু পদার্থ বিজ্ঞানেই আছে ক্লাসিক, নিউক্লিয়ার, ইলেক্ট্রিক, ইলেক্ট্রনিক্স, ইলেক্ট্রো-ডাইনামিক্স, কোয়ান্টাম মেকানিক্স ইত্যাদি অংশ। তাই একজন মানুষ পদার্থবিজ্ঞানী হলেও তিনি পদার্থ বিজ্ঞানের কোনো অংশ চর্চা করেন তা আগে থেকে জানা না থাকলে পদার্থবিজ্ঞানী’ শব্দটি দ্বারা ঠিক কী বোঝায় তা নির্ণয় করা মুশকিল। বর্তমানে মানবীয় জ্ঞান এতদূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছে যে, একজন লোকের পক্ষে একই বিষয়ের সব উপবিষয় আত্মস্থ করা অতিব্যতিক্রমবাদে প্রায় অসম্ভব। যেমন : পদার্থ বিজ্ঞানে একজন ক্লাসিক্যাল পণ্ডিত কোয়ান্টাম মেকানিক্স অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণে সমর্থ্য হবেন এটা ভাবা চরম বোকামি। তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক এই দুই দিক মিলিয়ে পদার্থ বিজ্ঞানের সর্বশেষ সব্যসাচী ছিলেন এরিক ফার্মি। কিন্তু তিনি ছিলেন—অতি অতি বিরলপ্রজ; অর্থাৎ একই বিষয়ের উপবিষয় চর্চাকারীরা পরস্পরের বিষয় অনুধাবনে পর্যন্ত সক্ষম নয়। অতএব ভিন্ন বিষয় চর্চাকারীদের অবস্থা বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয় নিশ্চয়ই!

‘সাহিত্য’ নিজে একটি সাধারণীকৃত শব্দ। গদ্য, পদ্য, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, ছড়া, প্রবন্ধ ইত্যাদি শব্দের সরলীকরণ থেকে ‘সাহিত্য’ শব্দটির উদ্ভব। স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায়, একজন সফল কবি সার্থক প্রাবন্ধিক না-ও হতে পারেন। একজন সফল ঔপন্যাসিক সফল ছোটগল্প লিখতে সক্ষম হবেন এটা বলা যায় না। তবে এর ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। যেমন : রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একাধারে সফল কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রবন্ধকার, নাট্যকার, গীতিকার, সুরকার ইত্যাদি। কিন্তু ব্যতিক্রম ব্যতিক্রমই, তা উদাহরণ হতে পারে না। প্রায় একই কারণে উদাহরণ হতে পারেন না লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি কিংবা গ্যয়টে। অবশ্য সাহিত্যের সম্ভাব্য প্রায় সকল অনুষঙ্গচর্চা করার পরও রবীন্দ্রনাথকে কবিগুরু বলা হয়, নাট্যকার বা প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথ নয়। কারণ রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্মগুলোর মধ্যে তাঁর কবিতায় কবিত্বশক্তি প্রবল। অবশ্য কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক হলেও এরকম কথাও প্রচলিত আছে, বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রনাথের চাইতে সফল কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, গীতিকার, সুরকার ইত্যাদি থাকলেও রবীন্দ্রনাথ একত্রে সকল বিষয়কে সফলভাবে চর্চা করেছেন। তাই রবীন্দ্রনাথ ‘রবীন্দ্রনাথ’।

কিন্তু প্রশ্ন হলো গল্প, কবিতা নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ সাহিত্য হিসেবে অভিহিত হলেও কীভাবে একে অপর থেকে পৃথক? এর উত্তর হচ্ছে সম্ভবত ফর্ম এবং স্টাইলে; শব্দের বিন্যাস এবং সমাবেশে; রচয়িতার মনোকাঠামোর ভিন্নতায়। কিন্তু এই দার্শনিক প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন, গোলাপ যেমন ‘গোলাপত্ত্বের’জন্য গোলাপ; তেমনি সাহিত্যের ‘অত্ত্ব/তত্ত্ব’টা কী, যার জন্য সাহিত্য সাহিত্য? সম্ভবত এই প্রশ্নেরই উত্তর এই প্রবন্ধের ছত্রে ছত্রে পরোক্ষভাবে ছড়িয়ে আছে।

এখন কথা বলা যাক সাহিত্যের তত্ত্ব নিয়ে। অবশ্য তত্ত্বের সাহিত্য নিয়েও বলা যেতে পারে। যেকোনো কিছু যেমন নির্মিতির পর তত্ত্ব নিরূপণ করা যায় আবার তত্ত্ব অনুযায়ীও নির্মাণ করা যায়, সাহিত্যও ঠিক তেমনি। একজন কবির কবিতা লেখার জন্য ছন্দের প্রয়োজন হলেও শুধুমাত্র ছন্দকে মাথায় রেখে সার্থক কবিতা লেখা মুশকিল। কবি ছন্দকে এমনভাবে আত্মস্থ করেন যে, কবিতার প্রয়োজনে সার্থক কবিতায় ছন্দই কবির অবচেতনে ব্যবহৃত হয়। অবশ্য ফর্ম এবং স্টাইলকে সচেতনভাবে মাথায় রেখেও সফল সাহিত্যকর্ম রচিত হতে পারে তা স্বীকার করতে হবে। যেমন : সনেট-এর অষ্টক-ষষ্ঠক আগে থেকে মাথায় রেখেই কবিরা সনেট রচনা করে চলছেন। বর্তমানে কবিরা চেষ্টা করছেন ছন্দ ছাড়া কবিতা লেখার। আর সাহিত্যের অন্যান্য ক্ষেত্রে চলছে পূর্বনির্ধারিত কোনো মতাদর্শ, ফর্ম ও স্টাইলের আলোকে সাহিত্য রচনার সযত্ন প্রয়াস। নির্দিষ্ট মতাদর্শের ভিত্তিতে সাহিত্যকর্ম বিন্যাসের দৃষ্টান্ত ইতোপূর্বে থাকলেও, বর্তমানে ফর্ম এবং স্টাইল ব্যবহারের মাধ্যমে সাহিত্যচর্চা বিশেষ গতি ও মাত্রা পেয়েছে। যেমন : পোস্টমডার্ন কবিতা, সুররিয়ালিস্টিক কিংবা অ্যাবসার্ড গল্প, উপন্যাস ইত্যাদি। অবশ্য ‘তত্ত্বের সাহিত্য’ বলতে সমালোচনা-সাহিত্যকেও বোঝায়। বাংলা সাহিত্যে এর অতীত মোটামুটি উজ্জ্বল হলেও এর বর্তমান অবস্থা করুণ।

সাহিত্যে নন্দন একটি উল্লেখযোগ্য দিক। এখানেও রয়েছে নানা মুনির নানা মত, পথ। বুর্জোয়া নন্দনতত্ত্ব, প্রলেতারিয়েতের নন্দনতত্ত্ব ইত্যাদি। বুর্জোয়া নন্দন, এথিক্স এবং কগনেশনের সহাবস্থান সবক্ষেত্রে অনুমোদন করে না। বলাবাহুল্য প্রলেতারিয়েতের নন্দন তা করে। অবশ্য সার্বজনীন নন্দন বলেও কিছু বিষয় আছে। যেমন : আয়তন এবং সৌষম্যবোধ, অনিবার্যতা ও সম্ভাব্যতা, অন্তর্দৃষ্টি, বিশ্লেষণ ও উপস্থাপন-ক্ষমতা ইত্যাদি। আয়তনের অতিব্যাপ্তি এবং অ-ব্যাপ্তি দুই-ই সৌন্দর্যের অন্তরায়। সৌন্দর্য মূলত আমাদের ইন্দ্রিয়ের সীমা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। পিঁপড়া প্রজাপতি কিংবা হাতি প্রত্যেকেই সুন্দর। এদের প্রত্যেকেরই সুন্দরের মাত্রাফেরের কারণ মুখ্যত আয়তন। হাজার মাইল লম্বা কিংবা অতিক্ষুদ্র প্রাণীকে আমরা ধারণায় আনতে পারি না। অতএব এর সৌন্দর্য অবান্তর। প্রচলিত সৌন্দর্যবোধকে আঘাত করার জন্য কিংবা সমর্থন করার জন্য সৌষম্যবোধ অনিবার্য। সাহিত্যে বর্ণিত ‘কাহিনির প্রত্যেক ঘটনা, চরিত্রের প্রত্যেকটি আচরণ কাহিনির ভেতর থেকেই উদ্ভূত হওয়া বাঞ্ছানীয়, বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া যাবে না’—এটাই সর্বজনীন নন্দনের অনিবার্যতা এবং সম্ভাব্যতা। নন্দনের রাজনৈতিক অংশের ভিন্নতা স্বীকার করেও একজন সফল সাহিত্যিক সর্বজনীন নন্দনের এইসকল শর্ত চেতন-অবচেতনে আত্মস্থ করে তবেই প্রয়োগ করেন তাঁর সাহিত্যে।

মানবীয় কোনো সৃষ্টিকর্মই কালসীমার আওতার বাইরে নয়। তাই প্রত্যেক লেখকই তার নিজস্ব সময় দ্বারা নিশ্চিতভাবে প্রভাবিত। সম্ভবত এ কারণেই প্রত্যেক লেখক তার সৃষ্টিকর্মে যাপিত সময়ের ছাপ রেখে যেতে বাধ্য। এছাড়া নির্দিষ্ট ভূ-প্রকৃতি, ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-অর্থনৈতিক চিহ্নও লেখকের লেখায় দৃশ্যমান থাকে। এইভাবে সাহিত্য খানিকটা ইতিহাসেরও ভূমিকা পালন করে। অবশ্য সাহিত্য নিজে সরাসরি কিছু করতে পারে না। পরোক্ষভাবে দীর্ঘ সময়ব্যাপী কিছু প্রভাব রাখতে পারে। বাস্তবের তাৎক্ষণিক পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন রাজনীতি, সাহিত্য নয়। তবে সাহিত্য দীর্ঘ পরিসরে রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে পারে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়— 

‘সাহিত্য তুমি ভুবনে ভুবনে
কাজ করে যাও, গোপনে গোপনে।’


• ঢাকা

menu
menu