অনতিক্রম্য, অনিঃশেষ এবং অনিবার্য রবীন্দ্রনাথ
আকাশে রবি উদিত হলে, কারো ভালো লাগুক আর নাই লাগুক; কেউ নিন্দা করুক, আর কেউ প্রশংসা করুক—তাতে রবির যায় আসে না। তবে যারা নিন্দা করেন, তাদেরও চলে না রবির আলোবিহীন। রবির কৃপা সবার জন্যই অনিবার্য। আলোহীন জীবনের অস্তিত্বই ব্যর্থ। তারপরও কেউ কেউ রবির অনিবার্যতাকে অস্বীকার করতে চান, অথবা কেউ কেউ করেন; কিংবা বলেন—রবিবাবু এখন পুরনো হয়ে গেছেন, উনি ব্যাকডেটেড। কিন্তু যারা এসব কথা বলেন, তারও কিন্তু রবির কৃপায় নিজের জীবনের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রেখেছেন। বাতাস যেমন দেখা যায় না, কিন্তু তার অস্তিত্ববিহীন একমুহূর্তও জীবন বাঁচে না; অনুরূপ রবির কিরণ এবং রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা সার্বজনীন। তিনি এক হাতে লিখেছেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য, নাট্যকাব্য অর্থাৎ সর্বক্ষেত্রেই বিচরণ করেছেন সাবলীল দক্ষতায়। বিশেষত, বাংলা সাহিত্যের গল্প তো তাঁর হাতেই শুরু হয়ে বিকাশও লাভ করেছে। এমনকি উপন্যাসও রবীন্দ্রনাথের হাতে ভিন্ন একমাত্রা লাভ করেছিল। এসব কিছুর বাইরে আছে—রবীন্দ্রনাথের বিশাল গানের ভুবন। এতোকিছু একজন লেখকের পক্ষে তখনই সৃষ্টি করা সম্ভব, যখন তিনি সর্বান্তকরণে নিজেকে নিয়োজিত করেন সাহিত্যের সেবায়। ফলে এরকম বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে যারা রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করেন, বা করতে চান—তারা যে বাংলা সাহিত্যের বিরাট এক বটবৃক্ষকে অস্বীকারের অপচেষ্টায় নিয়োজিত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। একালে নতুন এক ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে—দু’লাইন কিংবা দু’একটা কবিতার বই লিখেই নিজেকে কেউ কেউ রবীন্দ্রনাথের সমকক্ষ অথবা তাঁর চেয়েও নিজেকে বড় ভাবতে শুরু করেন। এসব লেখক জানেন না যে, রবীন্দ্রনাথ আপাদমস্তক সাহিত্যসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন; কোনো অহি নাজেলের পর তিনি লিখতেন না। আমৃত্যু তিনি লেখাটাকে নিজের কর্ম হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। অর্থাৎ লেখার পিছনে তিনি শ্রম দিয়েছেন; সেই শ্রমের ফসল হিসেবে পরিণামে বাংলা সাহিত্যের ঘরে গল্প-কবিতা-নাটক-উপন্যাস বিবিধ রচনার বিশাল পরিধি গড়ে উঠেছে। সুতরাং দু’একটি কবিতার বই লিখে যারা রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করেন কিংবা তাঁকে পুরনো, ব্যাকডেটেড ভাবার দুঃসাহস দেখাচ্ছেন, কালক্রমে তাদের অস্তিত্ব তথা লেখকসত্তা যে প্রশ্নবিদ্ধ হবেই সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ প্রসঙ্গে আরো একটি দিকের কথাও স্মরণ রাখা ভালো—বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিশ শতকের পঞ্চাশ-ষাট দশকের কোনো কোনো কবির কাব্যসংখ্যা সত্তর-আশির চেয়েও বেশি। কেউ কেউ তাঁদের এই রচনাসংখ্যার কথা বিবেচনা করেই হয়তো তাঁদেরকে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বড় কবি ভেবে বসেন; কিন্তু কোনোভাবেই এরকম ভাবার সুযোগ নেই। কেননা, প্রথমত তাঁদের রচনাসংখ্যার কথা বিবেচনা করলে সাময়িক সময়ের জন্য আমাদের মনে হতে পারে—যিনি এত লিখেছেন, তিনি তো বড় কবিই। কথাটি মাথায় রেখেই যদি সেই বিস্তর সংখ্যক কাব্যের জন্মদাতা কবির রচনার বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়, তখন দেখা যাবে—সাকুল্যে হয়তো সেই কবির পাঁচ-ছয়টি কাব্য টিকে যাবে; যেখানে হয়তো তাঁর নিজস্ব ভাষা, প্রকরণ কিংবা দার্শনিক প্রতিভাষ্য নির্মাণ ও উত্তরণ ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন অর্থাৎ গুটিকয়েক রচনা শিল্পোত্তীর্ণ হিসেবে গণ্য হবে। বাকি বা অবশিষ্ট বিরাট সংখ্যক রচনা দেখা যাবে—সেই কবির রচনার অনুবর্তন বা আবর্তন অথবা চর্বিতচর্বণ ছাড়া অন্যকিছু নয়। দ্বিতীয়ত, সংখ্যার বিবেচনায় হয়তো তিনি রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বেশি কবিতা লিখতেই পারেন; কিন্তু তাঁর হাতে কয়টি গল্প, উপন্যাস, নাটক অথবা প্রবন্ধগ্রন্থ রচিত হয়েছে—সেটাও বিবেচনার দাবি রাখে। শুধুমাত্র কবিতা রচনার সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রম করেই নিজেকে রবীন্দ্র-অতিক্রান্ত ভাবার বিশেষ কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। আমাদের নিকট মনে হয়েছে, হিমালয়কে হয়তো-বা অতিক্রম করা যায়, কিন্তু একজীবনে কোনো বাঙালি লেখকের পক্ষে রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রম করা অসম্ভব কিংবা বলা ভালো, তিনি অনতিক্রম্য বা দূরাতিক্রম্য। সুতরাং হাল আমলে যারা, দু’চারখানা পদ্য লিখে অথবা দুএকটি উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে অধ্যাপনা পেশায় নিয়োজিত হয়ে—রবীন্দ্রনাথকে সমালোচনা করেন, তাঁকে অস্বীকার করার মতো ধৃষ্টতা দেখান, তাদের মনে রাখা দরকার—বামন কখনোই চাঁদের নাগাল পায় না। প্রসঙ্গত একথাও বলে রাখি যে, সমকালীন বৈশ্বিক বাস্তবতায় হয়তো রবীন্দ্রনাথের অনেক চিন্তাভাবনা পিছিয়ে পড়েছে; তার মানে এই নয় যে, সমগ্র রবীন্দ্রনাথ পিছিয়ে পড়েছে! কেননা আমৃত্যু সাহিত্যসেবায় নিয়োজিত রবীন্দ্রনাথ ক্রমাগত নিজেকে নিজেই অতিক্রম করেছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ‘ভাণুসিংহের পদাবলি’ [১৮৮৪], ‘কড়ি ও কোমল’ [১৮৮৬]-এ রবীন্দ্রনাথের যে জাগরণ, তা ‘মানসী’ [১৮৯০] কিংবা ‘সোনার তরী’ [১৮৯৪] কাব্যে এক ভিন্নমাত্রা পেয়েছে। আবার ‘গীতাঞ্জলি’ [১৯১০] পর্বে সেই রবীন্দ্রনাথই আধ্যাত্মিকতায় লীন হওয়া এক ধ্যানমগ্ন মানুষ। পূঁজাপর্বের এই রবীন্দ্রনাথকেই আর ‘বলাকা’ [১৯১৬] পর্বের রচনায় খুঁজে পাওয়া যায় না—এখানে তিনি হয়ে ওঠেন এক বিজ্ঞানমনস্ক এক আধুনিক দার্শনিক। এখানেই শেষ নয়, এরপরে আছে ‘পুনশ্চ’ [১৯৩২], ‘পত্রপুট’ [১৯৩৬]-এর মতো কাব্যগ্রন্থ; এসব কাব্যে রবীন্দ্রনাথ পূর্বের সব দার্শনিক ভাষ্যকে অতিক্রম করে নতুনতর ভাষা ও চিন্তাকে আরেক নতুন মাত্রা দিয়েছেন। এই রবীন্দ্রনাথ আবার ‘রোগশয্যায়’ [১৯৪০], ‘আরোগ্য’ [১৯৪১], ‘জন্মদিনে’ [১৯৪১] অথবা ‘শেষ লেখা’ [১৯৪১] কাব্যে পুনরায় নতুনতর কথা বলেছেন, যা পাঠককে অনিবার্যভাবেই ভিন্নতর এক বোধের স্তরে নিয়ে যায়। সুতরাং শুধুমাত্র কবিতার ক্ষেত্রেই রবীন্দ্রনাথ নিজেকে কতবার অতিক্রম করেছেন—সেকথা নিশ্চয়ই ভাবনার বিষয়। এসব কথা গেল রবীন্দ্রনাথের কবিতা নিয়ে; কবিতার বাইরেও পড়ে রইল রবীন্দ্রনাথের বিরাট সাহিত্যভাণ্ডার। সেখানে আছে তাঁর গল্প-উপন্যাস-নাটক-প্রবন্ধ এবং গীতবিতানের বিরাট গানের সম্ভার। ‘বৌ-ঠাকুরাণীর হাট’ [১৮৮৩] উপন্যাস লিখে রবীন্দ্রনাথ যে যাত্রা শুরু করেছিলেন, সেই গৎবাঁধা কাহিনীর বৃত্তের নিজেকে আটকে রাখেন নি; অল্প পরেই তিনি ‘চোখের বালি’ [১৯০৩] লিখে বাংলা উপন্যাসের ধারাকে এক ভিন্নখাতে প্রবাহিত করেছেন; যেখানে কাহিনীর পরতে পরতে রয়েছে মানবচরিত্রের মনোজগতের অনুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণ। এই রবীন্দ্রনাথ আবার চরিত্রের মনোজাগতিক বিষয়াদি তুলে আনার পাশাপাশি সমকালীন রাজনীতিকে তুলে আনলেন ‘গোরা’ [১৯১০] অথবা ‘ঘরে-বাইরে’ [১০১৬] উপন্যাসে—যেখানে রবীন্দ্রনাথকে পুনরায় নতুনভাবে আবিষ্কার করে তন্বিষ্ঠ পাঠক। অথবা তাঁর ‘শেষের কবিতা’ [১৯২৯] উপন্যাসকেও কী নিছক প্রেমের উপন্যাস ভাবার সুযোগ আছে? এখানেও তিনি দেখিয়েছেন প্রেমের বিচিত্র রূপ-রঙ-রস এবং আছে, আছে তার ভিন্নতর ইহজাগতিক নানাদিক এবং বহুস্তরের দার্শনিক ভাষ্য-প্রতিভাষ্য। একইভাবে তাঁর গল্প-নাটকের ক্ষেত্রেও বিচিত্র উত্তরণ এবং দার্শনিকতার সন্ধান মেলে সহজেই। যে রবীন্দ্রনাথ এত বিচিত্র, যাঁর ভাবনা এত বৈচিত্র্যময়, তাঁকে বাঙালি লেখক-পাঠকের পক্ষে কী করে অস্বীকার করা সম্ভব—সেটা ঠিক বোধগম্য হয় না।
রবীন্দ্রনাথের মতো এত বড় প্রতিভার জন্ম না হলে, বাঙালির পরিচয় বিশ্ব-দরবারে আজ অবধি হতো কিনা, তা সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়! তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি বাঙালিকে বাঙালি হিসেবে বিশ্বের দরবারে উপস্থাপন করেছেন। এরপরে হয়তো আরো দুএকজন বাঙালির প্রতিভায় বিশ্ব চমকে উঠেছে, তবে তা রবির কিরণের মতো সর্বগ্রাসী নয় কোনোভাবেই। একথা মেনে নিতে লজ্জা নেই যে, রবীন্দ্রনাথের পরে অদ্যাবধি বাঙালির ঘরে এতো বড় প্রতিভার জন্ম হয় নি! সেই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মের দেড়শ’ বছর অতিক্রম হওয়ার পর আজকাল বাঙালি সমাজে প্রায়শ শোনা যায় : ‘রবীন্দ্রনাথ পুরনো হয়ে গেছেন’, ‘এখন আর রবীন্দ্রনাথের দরকার নেই’, অথবা ‘রবীন্দ্রনাথ বাঙালির পিছুটান’ — এই জাতীয় কথাবার্তা! অনেকের কাছে নাকি রবীন্দ্রনাথের দোষ-ত্রুটির সীমা-পরিসীমা নিয়েও বিস্তর তথ্য-উপাত্ত আছে বলে শোনা যায়! বিশেষত একালের দু’পাতা পড়া সাহিত্যের কতিপয় অধ্যাপক, তথাকথিত পণ্ডিত-গবেষক রবীন্দ্রনাথের ত্রুটি-বিচ্যুতির সন্ধান করে তাঁকে নানাভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য আদাজল খেয়ে উঠেপড়ে লেগেছেন। এদের সাঙ্গাত স্বরূপ সাথে জুটেছে হাল আমলের কর্পোরেট ভিউ মিডিয়াও। কোনো একটা ছুঁতোয় রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা করতে পারলেই যেন হয়ে গেল, তাদের মিডিয়া হাউজের বাজার কাটতি বেড়ে যাবে, মুনাফার অংক লাফিয়ে উঠবে উপরের দিকে। আসলে ভিউ মিডিয়ার কর্পোরেট বেনিয়ারা রবীন্দ্র-সমালোচনার মধ্য দিয়ে সাহিত্যের কী ক্ষতি-বৃদ্ধি হলো তা ভাবতে চায় না, তারা নিজেদের মুনাফার দিকে তাকিয়ে থাকে; দর্শক বাড়লেই তাদের মুনাফা বাড়বে; এক্ষেত্রে রবীন্দ্র-সমালোচনা তাদের কাছে বড় হাতিয়ার। কারণ, বাঙালি জাতি খুব সহজে রবীন্দ্র-সমালোচনা সহ্য করতে নারাজ। ফলে তারা মিডিয়ার পলিসি না বুঝেই এর দর্শক হয়ে পড়ে; যা প্রকারন্তরে কর্পোরেট বেনিয়ার মুনাফার গ্রাফকে করে শীর্ষমুখি।
অন্যদিকে আছেন বাংলা সাহিত্যের কতিপয় নখদন্তহীন অধ্যাপক; তাঁদের বিদ্যাবুদ্ধির দৌড় যে খুব একটা দীর্ঘ না, সেটা তাদের কথাবার্তা কিংবা আচার-আচরণে ফুটে ওঠে; সেই বিদ্যা নিয়ে রবীন্দ্র-সমালোচনা করতে গিয়ে লেজেগোবরে অবস্থার সৃষ্টি করেন। রবীন্দ্রনাথকে সমালোচনা করার আগে তাঁরা একবার ঠাউরে দেখছেন না যে, যে প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনার সুবাদে তাঁরা রবীন্দ্র-সমালোচনা করছেন, সেই প্রতিষ্ঠানই হয়তো ‘রবীন্দ্র-গবেষণা’য় হাজারকোটি টাকা ব্যয় করছে অথবা হাজার হাজার বিদ্যার্থী উচ্চতর গবেষণা করে ডিগ্রি অর্জন করছে কিংবা সেই প্রতিষ্ঠান রবীন্দ্রনাথের নামে উচ্চতর গবেষণার সনদপত্র বিতরণ করে ধন্য হচ্ছে। তারপরও সেইসব প্রতিষ্ঠানের তথাকথিত পণ্ডিত-অধ্যাপকদের বোধোদয় হচ্ছে না—এ বড্ড আশ্চর্য ও আত্মঘাতী ব্যাপার বটে! প্রশ্ন হচ্ছে, এসব পণ্ডিতরা কেন রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা করছেন? আমাদের ধারণা, তাঁরা সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের উপায় স্বরূপ রবীন্দ্র-সমালোচনার মাধ্যমে নিজেকে সামনে নিয়ে আসতে চান; নিজের পরিচিতি তুলে ধরতে চান। প্রকৃতপক্ষে এর পশ্চাতে আছে তাঁদের খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টা। অর্থাৎ এদের কাছে রবীন্দ্র-সমালোচনা হচ্ছে একধরনের বিজ্ঞাপন; যে বিজ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে নিজের প্রতি অন্যের নজর কাড়ছেন আর নিজেকে কেউকাটা গোছের কিছু ভাবছেন। নিশ্চয় এসব পণ্ডিতমূর্খদের এ ধরনের বিজ্ঞাপন সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য নয়, বরং এ জাতীয় কর্ম যে আত্মঘাতী তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ ধরনের বিজ্ঞাপন যারা প্রচার করছেন, তার কোনোদিনই মধ্যবিত্ত বাঙালির মনজয় করতে পারবেন না। বাঙালি সমাজে একটা প্রবাদ আছে, সহসা জনপ্রিয়তা অর্জন করতে চাইলে এমন কোনো মহৎ ও উচ্চ-প্রতিভার সমালোচনা অথবা বেফাঁস মন্তব্য করো—যা আদৌ বিশ্বাসযোগ্য নয়! আসলে দু’পাতা পড়া বিদ্যার জোরে সেইসব কথিত অধ্যাপকরাই রবীন্দ্র-সমালোচনা করছেন, যাদের গোপন উদ্দেশ্য হচ্ছে—সাহিত্যমহলে আলোচিত হওয়া এবং নিজের পাণ্ডিত্যের প্রতিষ্ঠা পাওয়া। এ কর্ম যে, পরিণামে স্পষ্টতই হিতে বিপরীত হবে তা বোধকরি ঢাকঢোল পিটিয়ে বলার দরকার নেই।
বলার অপেক্ষা রাখে না, আমাদের বক্তব্য ভিন্নতর; একালের অথবা হাল-ফ্যাশনের বাইরে দাঁড়িয়ে আমরা মনে করি, বাংলা সাহিত্যে এবং বাঙালির জীবনে রবীন্দ্রনাথের প্রয়োজনীয়তা অনিবার্য এবং অনিঃশেষ। কারণ, এক জীবনে কোনো বাঙালি পাঠক ‘রবীন্দ্রনাথ’ [সমগ্র সাহিত্য] পড়ে শেষ করতে পারবেন বলে মনে হয় না, কিংবা সে জাতীয় বিশ্বাসের খুব একটা সুযোগ নেই। আর যে লেখকের সব লেখা আদ্যোপান্ত পাঠ করা হলো না বা গেলো না, তাঁর সম্বন্ধে যে কোনো ধরনের সমালোচনাই কোনো ব্যক্তির পক্ষে অনুচিত! এ তো গেল, সমগ্র রবীন্দ্রনাথ পাঠের প্রসঙ্গ। একইসাথে একথাও বলা দরকার, যারা দু’পাতা পড়েছেন তারা নিশ্চয় জানেন, রবীন্দ্রনাথ এক হাতে কত কী রচনা করেছেন! কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, গান, ভ্রমণকথা, স্মৃতিকথা— কত বিচিত্র শাখায় রবীন্দ্র-প্রতিভার অবাধ বিচরণ। রবীন্দ্রনাথ শুধু সৃষ্টিসম্ভারেই নয়, বরং বলা দরকার তিনি বাংলা সাহিত্যের অনেক শাখার পথিকৃৎও বটে; অর্থাৎ তিনিই প্রথম সেই ধারার রচয়িতা। এক্ষেত্রে আমরা পূর্বেই রবীন্দ্রনাথের অনবদ্য সৃষ্টি বাংলা ছোটগল্পের কথা বলেছি। এছাড়াও গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য প্রভৃতি রবীন্দ্রনাথের হাতে যেমন শুরু হয়েছে, তেমনি তাঁর একক প্রয়াসে এসব ধারা বাংলা সাহিত্যধারায় পূর্ণরূপে বিকশিতও হয়েছে। এমনকি বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ্বে বৈশ্বিক সাহিত্য-সংকটের সময় পশ্চিমা বা ইউরোপীয় সাহিত্য ধারায় যে কাব্যনাটকের জন্ম, তার অনেক আগেই রবীন্দ্রনাথ সেই পথে হেঁটে নাট্যকাব্য বা নাট্যকবিতা রচনা করেছেন। এমন বাস্তবতার কথা যারা জানেন, তারা কীভাবে বলবেন : রবীন্দ্রনাথ একালে অপ্রাসঙ্গিক অথবা পুরনো! আমরা স্পষ্ট করেই বলতে চাই, রবীন্দ্রনাথ কোনোকালেই পুরনো বা ব্যাকডেটেড নন; তিনি চিরকালই শুধুমাত্র বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির চেতনায় অবিনশ্বর হয়ে থাকবেন। এখানে ‘মধ্যবিত্ত’ প্রসঙ্গটি ব্যাখ্যার প্রয়োজন মনে করছি। কেন, বাঙালি মধ্যবিত্ত? উচ্চবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত নয় কেন? এ ব্যাপারটি বিশদ ব্যাখ্যা করা দরকার। রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর সৃষ্টিসম্ভার অনিবার্যভাবেই বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের সম্পদ; শুধু রবীন্দ্রনাথ নিজেই নন—বাঙালি লেখক সমাজের সব সৃষ্টিই মধ্যবিত্ত শ্রেণির সম্পদ। বেশিরভাগ লেখকও যেমন মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজের অন্তর্ভুক্ত, তেমনি তাঁদের সৃষ্টি জুড়েই মধ্যবিত্ত শ্রেণির পরিচয় বিধৃত হয়েছে। সেই অর্থে বাংলা সাহিত্যের লেখক-পাঠক উভয়ই মধ্যবিত্ত শ্রেণির বললে খুব একটা অত্যুক্তি হয় না। মধ্যবিত্তের ড্রইংরুমে রবীন্দ্র-রচনাবলির পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের গানের অস্তিত্ব আজো অনিবার্য; কিন্তু একই বাঙালি সমাজের উচ্চবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্তের ঘরে কিংবা ড্রইংরুমে রবীন্দ্রনাথকে পাওয়া যাবে না। এ কারণেই আমরা রবীন্দ্রনাথকে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির সম্পদ বলার প্রয়াস পেয়েছি। একদিকে উচ্চবিত্তের ঘরে গেলে শুনতে হবে মাইকেল জ্যাকসন, ম্যাডোনা, জন এলটন প্রমুখ পশ্চিমা শিল্পীদের গান, অন্যদিকে তাদের পাঠাভ্যাস থাকলে ড্রইংরুমে পাওয়া যাবে পশ্চিমা ইংরেজি বইপুস্তকে স্তূপ। একইভাবে বাঙালি সমাজের নিম্নবিত্তের ঘরে জারি-সারি, কবিগান, পালাগান কিংবা বিচারগান বড়জোর ভাটিয়ালি-পল্লীগীতি অথবা লোকগান পাওয়া সম্ভব। কোনোভাবে নিম্নবিত্তের ঘরে রবীন্দ্র-সংগীত পাওয়া সম্ভব না। কেন তারা রবীন্দ্রনাথ শোনে না? তাঁর একটি সাধারণ গানের কথাই উদাহরণ হিসেবে গ্রহণ করা হলে দেখা যাবে, সেই গানের বাণী তাদের অন্তরে পৌঁছায় না। যেমন ‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়েছিলে, দেখতে আমি পাই নি তোমায়’; এ গানের ‘হিয়া’ শব্দটির অর্থ বাঙালি নিম্নবিত্তের লোকজনের নিকট স্পষ্ট না কিংবা এর অর্থ তারা জানে না। এর ফলাফল খুব সোজা, যে গানের বাণী শ্রোতার কাছে অর্থহীন সেই গান শ্রোতা শুনবে না, এটাই স্বাভাবিক। অথচ রবীন্দ্রনাথের রচনাদির বয়স প্রায় একশো বছর অতিক্রম করেছে, তারপরও বিগতকালে তিনি এখনো মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজের গণ্ডি পার হতে পারেন নি। এই পৌঁছাতে না পারাটা কিন্তু গীতিকার রবীন্দ্রনাথের ব্যর্থতা না; এ দায়ভার সমগ্র বাঙালি সমাজকেই গ্রহণ করতে হবে। একথা রবীন্দ্রনাথের মতো বাঙালি অন্যান্য লেখকদের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। একথা পূর্বেই বলা হয়েছে যে, বাঙালি লেখক-পাঠক উভয় শ্রেণিই বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ যাঁরা লিখছেন অথবা যাদের জন্য লিখছেন— উভয়ই সেই অর্থে একই শ্রেণিভুক্ত। এখানে অবশ্য মনে রাখা দরকার, রবীন্দ্রনাথ কিন্তু ভিন্ন শ্রেণিভুক্ত অর্থাৎ তিনি উচ্চশ্রেণির [জমিদার ঘরের সন্তান ছিলেন] মানুষ। তবে তিনি নিজে উচ্চবিত্তের মানুষ হলেও তাঁর লেখায় কিন্তু ঘুরেফিরে উঠে এসেছে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির কথা, তাদের সমস্যার কথা, সংকটের কথা অথবা তাদের জীবনবাস্তবতার বহুমাত্রিক চিত্র ও কতকথা। উদাহরণ স্বরূপ ‘শাস্তি’গল্পের চন্দরার কথাই বলুন, কিংবা হৈমন্তী বা মৃণালের কথাই বলুন না কেন, পরিণামে এরা কিন্তু মধ্যবিত্ত শ্রেণিরই মানুষ। এসব কারণেই আমরা বলতে চেয়েছি, রবীন্দ্রনাথ বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের সম্পদ। নীরদ সি চৌধুরী সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের এই শ্রেণিচ্যুতি দেখেই তাঁকে ‘আত্মঘাতী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কেননা তিনি যে সমাজে জন্মেছেন, বেড়ে উঠেছেন পরিণামে তিনি তাদের হয়ে উঠতে পারেন নি। তাঁর এই শ্রেণিচ্যুতির কারণে নীরদ সি চৌধুরী যদি রবীন্দ্রনাথকে ‘আত্মাঘাতী’ উপাধিতে ভূষিত করে থাকেন, সেটা খুব বেমানান হয় নি। উপরন্তু এন সি চৌধুরী তো বাঙালিকেও ‘আত্মাঘাতী’ জাতি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। চৌধুরী মহাশয়ের এ মন্তব্যের পরেও আমরা যেমন বাঙালি সমাজ ও জাতকে ত্যাগ করতে পারি না কিংবা বাঙালি অচ্ছুত হয়ে যায় না, অনুরূপভাবে রবীন্দ্রনাথও আমাদের নিকট পরিত্যাজ্য হয় না। এ প্রসঙ্গে আমরা স্পষ্টতই বলতে পারি, বাংলা সাহিত্যের সর্বত্র রবীন্দ্রনাথের বিচরণ; এমন বাস্তবতায় তাঁর কোন কোন সৃষ্টি বা রচনাকে অস্বীকার করবেন পণ্ডিতমূর্খের দল। গল্প-কবিতা-নাটক-উপন্যাস-প্রবন্ধ কিংবা গানের বিশালভাণ্ডার জুড়ে রবীন্দ্রনাথের অনবদ্য সৃষ্টিসম্ভার—তার কোনটি অস্বীকার করা সম্ভব! সুতরাং একথা বলাই যায় যে, এক জীবনে একক কোনো ব্যক্তির পক্ষে রবীন্দ্রনাথকে পূর্ণাঙ্গভাবে পাঠ করাই সম্ভব না; আর যাঁকে পরিপূর্ণভাবে পাঠ করাই গেল না, তাঁকে সমালোচনা করা যায় কীভাবে, তাঁর দোষ-ত্রুটি ধরা যায় কীভাবে কিংবা তাঁকে অস্বীকার করা যায় কীভাবে? এই বিবেচনায় আমাদের কথা খুবই সোজা এবং স্পষ্ট, রবীন্দ্রনাথকে একজীবনে কোনোভাবেই অতিক্রম করা সম্ভব না। তাই আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট : রবীন্দ্রনাথ অনতিক্রম্য, অনিঃশেষ এবং বাঙালির জীবনে-মননে অনিবার্য। একইসাথে তিনি বাঙালির জীবনে অপরিত্যাজ্যও বটে! কারণ, রবীন্দ্রনাথকে ত্যাগ করলে কিংবা তাঁকে অস্বীকার করলে বাংলা সাহিত্যের অর্ধেক ভাণ্ডার মুহূর্তেই নাই হয়ে যাবে।
এক গীতিবিতানের রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রম করাই যেখানে দুঃসাধ্য মনে হয়, সেখানে গল্পের রবীন্দ্রনাথ, উপন্যাসের রবীন্দ্রনাথ কবিতা কবিতা-নাটক, প্রবন্ধসহ আরো আরো কত বিচিত্র শাখায় রবীন্দ্রনাথের পদচারণা; সেই রবীন্দ্রনাথকে কিভাবে অস্বীকার করবেন? সেই রবীন্দ্রনাথকে বাঙালির পিছুটান মনে হয় যাদের কাছে তারাই প্রকারন্তরে বাঙালিকে পেছনের দিকে টেনে ধরেছেন। আমরা মনে করি, রবীন্দ্রনাথ অনিঃশেষ এবং বাঙালির জীবনে তাঁর প্রয়োজনীয়তা অনিবার্য।
• রাজশাহী