ভাবপ্রকাশের বিবর্তন : গুহালিপি থেকে প্যাপিরাস, ছাপাখানা থেকে সামাজিক মাধ্যম

গুহা লিপি থেকে পোড়া মাটির বই 
আদিতে মানুষের ভাব বিনিময়ের লিপি ছিল না। ছিল চিত্রকর্ম, যখন মানুষ পাহাড়ে বা গুহায় ছবি এঁকে নিজের ভাবটি রেখে যেতো। ছবি থেকে একসময় উত্তরণ ঘটে সাংকেতিক রেখায়, অবশেষে সংঘবদ্ধ লিপিতে। এইভাবে ক্রমবিকাশের পথ ধরে ঠিক কখন থেকে যে মানুষ নিজের ভাবনাগুলো লিপিবদ্ধ করা শুরু করে, তা নিয়ে গবেষকরা ভেবেছেন যুগে যুগে, বিস্তর গবেষণা হচ্ছে এখনো। মনে করা হয় ব্যবসা বাণিজ্যের হিসাব রাখার জন্যই প্রাচীন পৃথিবীতে প্রথম লিপির উদ্ভব। এই ধরনের গণনা-লিপির খোঁজ পাওয়া যায় খ্রিষ্টপূর্ব সাড়ে সাত হাজার বছর আগে পারস্য উপসাগরের তীরবর্তী উর্বরা অঞ্চলে। পরবর্তী সময়ে এই সহজ ও সংক্ষিপ্ত গণনা-লিপি বিবর্তিত হয়ে ধীরে ধীরে বিকশিত হয় সাধারণ ভাব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে। এই পর্যায়ে, খ্রিষ্টপূর্ব তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার বছর আগে, মেসোপোটেমিয়াতে প্রথম এই ধরনের ব্যবহারিক লিপির উদ্ভব ঘটে বলে বেশিরভাগ গবেষকরা মত দেন। প্রায় কাছাকাছি সময়ে আলাদাভাবে মিশরেও এর সূত্রপাত ঘটে। শুরুতে ভাব প্রকাশের নিমিত্তে লিখিত এই সব হরফগুলো ছিল ‘কিউনিফর্ম ‘ অথবা ‘হাইরোগ্লাফি‘তে লেখা। পরে তা এক সময় পূর্ণাঙ্গ বর্ণমালার রূপ নেয়। খ্রিষ্টপূর্ব দুই থেকে আড়াই হাজার সালের দিকে দেখা যায় অক্ষর এবং বর্ণমালার আবির্ভাব, যার শুরুটাও এই মিশরেই। আধুনিক প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় পৃথিবীর আরও বহু জায়গায় প্রাচীন লিপির খোঁজ পাওয়া যায়। হরপ্পায় পাওয়া পোড়া মাটির টেবলেটে দেখা গেছে খ্রিষ্টপূর্ব আড়াই হাজার বছর আগের লিপির নিদর্শন। খ্রিষ্টপূর্ব তেরো শত সালের দিকে চীনের শেং সাম্রাজ্যে পুরোদস্তুর লেখালেখির খোঁজ পাওয়া যায়। খ্রিষ্টপূর্ব এক হাজার সালের দিকে মেসো-আমেরিকা অঞ্চলে, মায়ানদের মধ্যেও লিখিত বর্ণমালা দেখা যায়।  

প্রথম দিককার লেখাগুলো ঠিক হাতে লেখা ছিল না, খোদাই করা হতো কাদামাটির প্লেটে, যা শুকানো হতো রোদে, কিংবা শক্ত করা হতো আগুনে পুড়িয়ে। এই প্লেট বা টেবলেটগুলো একত্র করে তৈরি করা হতো বই। এই ধরনের প্রায় ত্রিশ হাজার টেবলেটের একটা সংগ্রহ পাওয়া যায় আসিরীয় সম্রাট আসুরবানিপালের দরবারে; বর্তমান ইরাকের নেনেভা অঞ্চলে আবিষ্কৃত খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০ বছর আগের কীলকাক্ষরে লেখা এই সংগ্রহটিকেই ধরা হয় মানব ইতিহাসের প্রথম গ্রন্থাগার। এতে ছিল নানা বিষয়ের ওপর লেখা বই; রাজ্য শাসন, ধর্ম, যুদ্ধকলা ইত্যাদি বিষয়ের সঙ্গে ছিল সাহিত্য। গিলগামেশের মতো কালজয়ী উপাখ্যানও স্থান পেয়েছিল সেখানে। 

আসুরবানিপালের বিশাল লাইব্রেরিতে ছিল না কাগজ কিংবা কালির ব্যবহার। স্পষ্টতই, মানুষের ভাবনা এবং অনুভূতিগুলোকে স্থায়ীভাবে লিপিবদ্ধ করার জন্য কালি ও কলম আবশ্যিক ছিল না তখন, লেখাকে কালজয়ী করে রাখার জন্য প্রয়োজন ছিল না বিশেষ কোন প্রচার কৌশলের। ভাবতে অবাক লাগে, হাজার বছর পর আমরা এখনো গিলগামেশ পড়ি তবে মাটির টেবলেটে নয় বরং ইলেকট্রনিক টেবলেটে।  

কালি ও কলম থেকে ছাপাখানায়
প্রথম কালির ব্যবহার দেখা যায় মিশরে, প্রায় তিন হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দে, যখন খোদাই করা হায়রোগ্লাফিক লিপিগুলোকে কালি দিয়ে রঙিন করা হতো। কাছাকাছি সময়ে মিশরিয়রা প্যাপিরাস আবিষ্কার করে তার ওপর কালি দিয়ে লেখা শুরু করে। প্যাপিরাস আবিষ্কারের মাধ্যমেই হাতে লেখা পুস্তক শিল্পের শুরু, যার প্রসার ঘটে বিশ্বব্যাপী এবং প্রচলন অব্যাহত থাকে দীর্ঘকাল। 

মাটির টেবলেট, হাঁড়, পাথর, কাঠ ইত্যাদি মাধ্যম পেরিয়ে প্যাপিরাসে লেখা ছিল একটা বৈপ্লবিক উত্তরণ। এর পরের অগ্রযাত্রাটির শুরু কাগজ আবিষ্কারের পর। ধরে নেয়া হয় দ্বিতীয় শতাব্দীর দিকে চীনে কাগজের প্রচলন শুরু হয়, এবং সিল্ক রুট ধরে তা পৌঁছে যায় পৃথিবীর অন্যান্য জ্ঞানকেন্দ্রে। সময়ের সঙ্গে কাগজের গুণগত উন্নতি হয় ধীরে ধীরে। রাজকীয় আমলাতন্ত্র, সামরিক মানচিত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র থেকে শুরু করে সাহিত্য ও জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা আবর্তিত হতে থাকে কাগজে লেখা বই-পুস্তক থেকে। 

কাগজের ওপর লেখার জন্য প্রয়োজন কলমের। বাঁশের কঞ্চি কিংবা উলুখাগড়ার নল দিয়ে কলম বানানোর প্রচলন ছিল দীর্ঘকাল; মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, ভারত ও এশিয়ায় এই প্রচলন চলে কয়েক হাজার বছর। ধাতব নিব সহকারে কলম ব্যবহার শুরু হয় ইউরোপে, রোমান সময়কাল থেকে এর ব্যবহার দেখা গেলেও অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে, শিল্পবিপ্লবের সময়েই এর দ্রুত প্রসার ঘটে। ব্যাপক চাহিদা মিটাতে কলমের কারখানা গড়ে ওঠে বিভিন্ন জায়গায়। 

তখনকার দিনে হাতে লেখা বই আক্ষরিক অর্থেই ছিল জ্ঞানের আধার। কিন্তু পুস্তক প্রস্তুতির কাজটা ছিল কষ্টসাধ্য এবং সময় সাপেক্ষ। এবং সঙ্গত কারণেই হাতে লেখা বইয়ের প্রচার ও প্রসার ছিল সীমিত। কিন্তু পুস্তক প্রকাশনার প্রকৃত বিপ্লবটি সাধিত হয় প্রিন্টিং প্রেস আবিষ্কারের মাধ্যমে। প্রচলিত ধারণা হলো, জার্মান বংশদ্ভুত জোহান্স গুটেনবার্গ প্যারিসে নির্বাসিত অবস্থায় ১৪৪০ সালে এর ওপর কাজ শুরু করেন এবং ১৪৫০ সালে জার্মানির মেইন শহরে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে ছাপার কাজ প্রতিষ্ঠা করেন। গুটেনবার্গের প্রেসে ল্যাটিন ভাষার বাইবেলের ২০০ কপি ছাপতে সময় লেগেছিল তিন বছর। সেই আমলে, যখন ধীর গতিতে হাতে লেখা একেকটা বই প্রস্তুত করতেই বছর খানেক লাগতো, তখন এই আবিষ্কার ছিল যুগান্তকারী। 

গুটেনবার্গকে ছাপাখানার আবিষ্কারক হিসেবে ইউরোপে প্রতিষ্ঠিত করলেও এর বহু আগে এশিয়াতে ছাপা দলিলের নিদর্শন পাওয়া যায়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় ব্লক প্রিন্টে ছাপানো একটি বিখ্যাত বৌদ্ধ গ্রন্থ বজ্রচ্ছেদিকা সূত্র Diamond Sutra প্রায় অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেছে চীনে, বলা হয়ে থাকে এটাই এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে প্রাচীন ছাপানো বই, যা বর্তমানে সংরক্ষিত আছে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে। বিশেষজ্ঞদের মতে, চীনা ভাষায় অনুদিত এই গ্রন্থটি কাঠের ব্লকে ছাপানো হয় ৮৬৮ খ্রিস্টাব্দের দিকে, ত্যাং রাজবংশের শাসনামলে। প্রায় কাছাকাছি সময়ে ধাতব ব্লকে ছাপানো শুরু হয় তাও এবং বৌদ্ধ ধর্মীয় অনুশাসনগুলো, যা এখনো সংরক্ষিত আছে। এর প্রায় একশো বছর পরে চীনের হুবেই নগরে বি শেং আবিষ্কার করেন বারবার ব্যবহার যোগ্য অক্ষর, যা সাজিয়ে প্রস্তুত করা হতো পুরো রচনা এবং এতে কালি মাখিয়ে কাগজে চাপা দিয়ে ছাপা হতো সেই রচনা। একই পদ্ধতির আরও উন্নতি সাধন করেন চীনের ওয়াং চেং। এই পদ্ধতিতে ছাপাখানায় ছাপা হয় নাং শো নামের একটি বই, ধরে নেয়া হয় পৃথিবীর প্রথম বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ছাপানো বই, যা ইউরোপে রফতানি করা হয় ওই সময়। সময়কালটা গুটেনবার্গের ছাপাখানার অনেক আগে। 

লন্ডনে প্রথম বাণিজ্যিক ছাপাখানার শুরু ১৪৭৬ সালে, চসারের বিখ্যাত বই ‘কেন্টাবেরি টেলস’ ছাপা হয় ওই ছাপাখানায়। ব্লক ছাপা থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ছাপাখানার প্রসার ঘটতে থাকে মধ্যযুগীয় ইউরোপে। বর্তমান সভ্যতা ও জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে ছাপাখানার প্রযুক্তিগত উন্নতির ইতিহাসও চমকপ্রদ। হাতে বসানো অক্ষর থেকে শুরু করে, টাইপ করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অক্ষর বিন্যাস, সাইক্লোস্টাইল করে ছাপা, এর পরে অফসেট ছাপা ইত্যাদি স্তর পার হয়ে এখন সরাসরি কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত ছাপার ব্যবস্থা।  

মুদ্রণযন্ত্রের উন্নতির পাশাপাশি পুস্তক প্রকাশনায়ও ধারাবাহিক বিবর্তন আসে। প্রকাশনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাণিজ্যিকরণের উপাদান। শুধু পুস্তক প্রকাশ নয়, প্রকাশনা জগতে আবির্ভূত হয় সংবাদপত্র, যা বর্তমান সভ্যতার সামাজিক-রাজনৈতিক-দার্শনিক প্রেক্ষাপট রচনায় অন্যতম ভূমিকা রাখে। সাহিত্যের ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের সূত্রপাত পুস্তক প্রকাশনার বাণিজ্যিকরণের মাধ্যমে। সীমিত আকারে হলেও পূর্ব-পশ্চিম আর উত্তর-দক্ষিণের ধ্রুপদী দর্শন ও সমসাময়িক সাহিত্য ভৌগোলিক সীমারেখা পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়।    

লেখালেখির প্রক্রিয়ায় পরবর্তী বিপ্লবটি সাধিত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ১৮৭২ সালে রেমিংটন টাইপ রাইটারের উদ্ভাবনের মাধ্যমে। ঘরে বসে নিজের কাজ ছাড়াও অফিস আদালতে দ্রুত টাইপ করে লেখা ছাপানোর এই ধারা অব্যাহত থাকে শতবর্ষ যাবত, কম্পিউটারের আগমন পর্যন্ত। অতঃপর আমরা প্রবেশ করি লেখালেখির বৈদ্যুতিক মাধ্যমে। এতে শুধু লেখার গতি ও শৈলীর পরিবর্তন ঘটেনি, মানুষের ভাবপ্রকাশের জন্য কাগজ কলমবিহীন এক নতুন মাধ্যমের সূত্রপাত ঘটে। প্রকৃত অর্থেই এ এক বিপ্লব যা অচিরেই গোটা বিশ্বকে সংবেশিত করে।  
 
ছাপাখানা থেকে সামাজিক মাধ্যম
শুরুটা আসলে হয়েছিল অনেক আগে, ১৮৪৪ সালে, যখন টেলিগ্রাফের আবিষ্কার হয়। সেম্যুয়েল মোর্স নামক এক ব্যক্তি আমেরিকার বাল্টিমোর শহর থেকে ওয়াশিংটন ডিসিতে টরেটক্কা শব্দ তুলে ডট আর ড্যাসের সংকেত পাঠালেন। কে জানতো এই দুই অক্ষরের সংকেতই ক্রমশ বিবর্তিত হয়ে আধুনিক ডিজিটাল সভ্যতার বাহন হয়ে উঠবে। 

আরও অনেক পরে, ২০০৬ সালের মার্চ মাসে, প্রায় একইভাবে জ্যাক ডরসি নামের একজন কলেজ ছাত্র তার এক লাইনের একটি ছোট্ট ম্যাসেজ পাঠিয়ে টুইটার যুগের সূত্রপাত করেন। ভুলে গেলে চলবে না যে কম্পিউটার আর সেলফোনে পড়া লিপিগুলো মানুষের হাতের লেখা নয় বরং ১ এবং ০ এর জড় করা নানামুখী বৈদ্যুতিক-সাংকেতিক সমাহার, টুইটারের এই প্রথম এই বার্তাটিও অক্ষরে নয় বরং গাণিতিক সংকেতে পাঠানো বার্তা।

মোর্স সংকেতের মাধ্যমে বার্তার আদান প্রদানের বিষয়টি তৎকালীন সামাজিক জীবনকে প্রভাবিত করেছিল ভীষণভাবে। ইকোনোমিস্ট পত্রিকার সহ সম্পাদক টম স্টেন্ডেইজ সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর লেখা তাঁর বইতে এর খানিক বর্ণনা দিয়েছেন। যারা টেলিগ্রাফ অফিসে কাজ করতেন তারা কাজের ফাঁকে ফাঁকে নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করতেন, একজনের পাঠানো বার্তা ওই টেলিগ্রাফ লাইনের সবার কাছেই পৌঁছাতো, অন্যরাও মন্তব্য করতেন। অর্থাৎ অনেকটা এখনকার টুইটার বা ফেসবুকের মতোই ছিল। উল্লেখ করেছেন একে অপরকে না দেখলেও টেলিগ্রাফ অপারেটরদের ভেতর বন্ধুত্ব হতো, ভাব বিনিময় হতো, এমন কী রোমান্সের উদাহরণও ছিল।

দ্রুত খবর আদান প্রদান সহজতর হয়ে উঠায় এর প্রভাব সংবাদ পরিবেশন ও সাংবাদিকতার ওপরও পড়ে। সাধারণ ডাক ব্যবস্থার পাশাপাশি টেলিগ্রাফের মাধ্যমে দ্রুত খবর পৌঁছানোর ব্যবস্থা চালু হয়। এসবই প্রগতির অংশ হিসাবে গ্রহণ করা হলেও কারও কারও আপত্তিও ছিল এতে। উদাহরণ স্বরূপ স্ট্যান্ডেইজ উল্লেখ করেছেন ১৮৯১ সালে Atlantic Monthly পত্রিকায় প্রকাশিত অভিযোগের একটি উদ্ধৃতি :  
‘America has in fact transformed journalism from what it once was, the periodical expression of the thought of the time, the opportune record of the questions and answers of contemporary life, into an agency for collecting, condensing and assimilating the trivialities of the entire human existence,’ ... ‘The effect is disastrous, and affects the whole range of our mental activities. We develop hurry into a deliberate system … the pursuit of novelties and sensations into the normal business of life.’

এই অভিযোগটির ভাষা বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়ার বিরূপ প্রভাব নিয়ে কথা বলার মতোই।

ভার্চুয়াল জগতের কৃষ্ণগহ্বর
সামাজিক মাধ্যম বা সোস্যাল মিডিয়া আমাদের সমকালীন আধুনিক জীবনযাত্রার সঙ্গে একাকার হয়ে আছে। হাতে হাতে ধরা স্মার্ট ফোন শুধু দূরালাপনি নয় বরং পত্রপত্রিকা আর বই পুস্তকের বিকল্প মাধ্যম। 

কম্পিউটারের আবির্ভাবের সঙ্গে পাহাড়ের গায়ে ছবি এঁকে ভাব প্রকাশের প্রাচীন পদ্ধতিটি বহু বিবর্তনের মাধ্যমে এখন বৈদ্যুতিক সংকেত আদান প্রদানের রূপ নিল। নব আবিষ্কৃত এই প্রযুক্তিটির উন্নতি ঘটে বিদ্যুৎ গতিতে, যা মানব ইতিহাসে আগে দেখা যায়নি। ঘরের ভেতর গাদা করে রাখা নথিপত্র কিংবা পুস্তিকার দিন শেষ হয়ে আসছে ক্রমে, আমাদের কথাগুলো এখন আমরা বৈদ্যুতিক উপায়ে ‘মেঘ’ এর মাঝেই ভাসিয়ে রাখি। 

অর্থাৎ আমরা এখন ডিজিটাল যুগে। ২০১৮ সালের এক জরিপে অনুমিত হয় আমরা মিনিটে ১৮৭ মিলিয়ন ই-মেইল, ১৮ মিলিয়ন টেক্সট ম্যাসেজ, ৩৮ মিলিয়ন হোয়াটসএ্যাপ ম্যাসেজ এবং ৩.৭ মিলিয়ন গুগুল অনুসন্ধান করি। ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক ইত্যাদি মাধ্যমগুলোই এখন আমাদের প্রধান বিনোদন বিচরণ। ‘স্ট্যাটিস্টা’র ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারী ২.৫ বিলিয়ন মানুষের প্রত্যেকে গড়ে দুই ঘণ্টা সাতাশ মিনিট করে সময় কাটাচ্ছেন ডিজিটাল জগতে।

যুগান্তকারী সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচিত করা এই প্রযুক্তি আধুনিক জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে এখন। এবং একই সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে, ব্যক্তিমানস ও সামাজিক মনস্তত্ত্বকে প্রভাবিত করে চলেছে এই ডিজিটাল জগত। বাস্তব সমাজের বাইরে এক ভার্চুয়াল সমাজের সৃষ্টি হয়েছে, যার প্রভাব-বিস্তৃতি সমগ্র মানবজাতিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে কৃষ্ণ গহ্বরীয় শক্তি দিয়ে। 

আন্তর্জালের বাণিজ্যিক বাস্তবতা প্রিন্ট মিডিয়া বনাম ইলেকট্রনিক মিডিয়া
বর্তমান আলোচনায় এর সংজ্ঞা নির্ধারণের প্রয়োজন নেই, কারণ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে এই অভিজ্ঞতা। যেটা নিয়ে আলোচনা হতে পারে তা হলো সামাজিক জীবনে এই ছাপা মাধ্যম থেকে বৈদ্যুতিক মাধ্যমে উত্তরণের প্রভাব। বাজার অর্থনীতির ভেতরে ডুবে থাকা বর্তমান সভ্যতায় সব প্রভাবই পণ্য, ভোক্তা আর বিনিয়োগকারীর আপেক্ষিক অবস্থানের গাণিতিক হিসাব। এখানে ইচ্ছা অনিচ্ছার চেয়ে অর্থনৈতিক বাস্তবতাই প্রধান হয়ে উঠে। আমরা যখন দেখি দীর্ঘদিন ধরে চলমান লাইফ ম্যাগাজিন কিংবা নিউজউইকের মতো বিখ্যাত সাময়িকী বন্ধ হয়ে যায় তখন শুধু চমকে উঠাই যথেষ্ট নয় বরং এর অনিবার্যতা নিয়েও ভাবা আবশ্যক। 

হাজার বছর আগে মানুষ যখন ভাব প্রকাশের জন্য পাহাড়ে, গুহায়, পোড়ামাটির ফলকে, প্যাপিরাসে আঁকা কষত তখন তাঁর মনে কোন বাণিজ্যিক উপাদান থাকতো না। অন্যদিকে সভ্যতার অগ্রগতির সাথে ছাপাখানা, কম্পিউটার কিংবা স্মার্ট ফোনের পেছনে আছে সরাসরি বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের বিষয়। আবার এও মনে রাখতে হবে যে বর্তমান বাজার সভ্যতায় ভোক্তাদের অবাধ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টিকে সূক্ষ্মভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে নানাবিধ উদ্ভাবনী উপায়ে; প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বিজ্ঞাপন এবং সেই সাথে কর্পোরেট প্রণোদনা ও আইন সিদ্ধ লবিং এর মাধ্যমে। এই পরিস্থিতিতে মিডিয়া নিজেই যখন একটা পণ্য বাজার, তখন এর স্বল্প মেয়াদী পরিবর্তন এবং দীর্ঘমেয়াদী বিবর্তন বাজার অর্থনীতির নিয়মেই হবে। এখানে স্মর্তব্য, ২০২০ সালের তথ্য অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী মিডিয়া বাজার প্রায় ২ ট্রিলিয়ন ডলার, এর মধ্যে মার্কিন মিডিয়া বাজার একাই প্রায় ৬০০ বিলিয়ন ডলার। 

এই বিশাল বাজার দখল এবং নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আছে তীব্র প্রতিযোগিতা, আছে ছলাকলা, কৌশল। নতুন নতুন প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনা আর ব্যক্তি মানস কিংবা সামাজিক মনস্তত্ত্বের বিবর্তনের সঙ্গে ক্রমাগতই খাপ খাইয়ে নেয় বিনিয়োগ ও বিপণন ব্যবস্থা। বহুদিন যাবৎ চলে আসা দাপুটে প্রিন্ট মিডিয়ার ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই। টেলিভিশনের চব্বিশ ঘণ্টার সংবাদ চ্যানেল ছাপা পত্রিকার পাঠক কমিয়ে দিলেও ইন্টারনেট আর সোশ্যাল মিডিয়ার আবির্ভাব এবং টর্নেডোর মতো এর দ্রুত বিস্তার প্রিন্ট মিডিয়ার জন্য বয়ে আনে অশনি সংকেত। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্যই ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বর্ধিষ্ণু বাজার দখলে এগিয়ে আসে প্রিন্ট মিডিয়ার মালিক পক্ষ। ফলশ্রুতিতে দেখা যায় প্রায় সব বড় বড় পত্রিকাগুলোর ইলেকট্রনিক সংস্করণ। পুস্তক প্রস্তুত ও বিপণনের ক্ষেত্রেও এর ছাপ পড়ে অনিবার্যভাবেই। বিশ্ববাজারের বড় বড় প্রকাশনা সংস্থাগুলো ছাপা বইয়ের পাশাপাশি এর ইলেকট্রনিক কপি বাজারজাত করা শুরু করে। বিগত কয়েক বছরে বেশ কিছু পত্রিকা বন্ধ হয়েছে, মূলত অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে। ইউনিভার্সিটি অফ নর্থ কেরোলিনার হাসমেন স্কুল অফ জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়ার একটি রিপোর্টে উল্লেখ করা ২০২০ সালের জরিপে দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রে ১২৬০টি দৈনিক পত্রিকা বের হয়, এবং শুধু ২০২০ সালেই প্রায় ৩০০টি দৈনিক পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে ছাপা দৈনিক পত্রিকার সার্কুলেশন গত প্রায় একশো বছরের ভিতরে সর্বনিম্ন। এর পাশাপাশি ইলেকট্রনিক পত্রিকার গ্রাহক সংখ্যা বাড়ছে। যারা ছাপা পত্রিকা রাখেন তাদের ২০% পাশাপাশি ইলেকট্রনিক সংখ্যারও গ্রাহক হচ্ছেন। আমেরিকান প্রেস ইন্সটিটিউটের পরিসংখ্যানে দেখা যায় বেশিরভাগ পত্রিকার গ্রাহকই চান ছাপা পত্রিকা (৫৮%), কিন্তু ব্যবসা সফল প্রতিষ্ঠান হিসেবে টিকে থাকার জন্য এই সংখ্যা যথেষ্ট নয়। অর্থাৎ ইলেকট্রনিক মিডিয়ার দিকে হাত না বাড়ালে ছাপা পত্রিকার এককভাবে টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব। 

সামাজিক মাধ্যম ও সাহিত্যচর্চার মাধ্যম
এ বিষয়টি এখন একটি বহুল আলোচিত বিষয়। লেখাটি বড় হয়ে যাচ্ছে, তাই এই প্রসঙ্গটি দিয়েই শেষ করা যাক। সাহিত্য কর্ম মানুষের ভাব প্রকাশেরই একটা উপায়, এবং এই প্রকাশের জন্য একটি মাধ্যমের প্রয়োজন। ওপরের আলোচনায় উঠে এসেছে, চলমান সভ্যতায় মানুষের ইচ্ছা অনিচ্ছার চেয়ে সমষ্ঠিগত অর্থনৈতিক গুণকগুলোই এর সামাজিক বিবর্তনের অনুঘটক। এই ধারায় প্রিন্ট মিডিয়া থেকে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় উত্তরণের বিষয়টি এখন অনিবার্যতা। তবে প্রশ্ন হলো সাহিত্য প্রকাশে এর প্রভাব কী?  

আন্তর্জালের জগতে আমাদের বিচরণকালীন বয়স যতোই বাড়বে, ততই এর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে গাঢ়তর হবে। এই মুহূর্তে যা অগ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই বিষয়গুলোও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে। অতীতে কোনো সাহিত্যকর্ম প্রকাশ করা মানেই এক ধরনের সম্পাদকীয় বিবেচনার ভিতর দিয়ে যাওয়া। এর কম বেশি ছিল, কিন্তু অন্যথা ছিল না। এখন, বিশেষ করে ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যম এবং ব্যক্তিগত ব্লগ এর মতো মাধ্যমগুলোতে একজন লেখক সরাসরি লেখা প্রকাশ করছেন, কোনো প্রকার সম্পাদকীয় তদারকি ছাড়াই। বহু সমালোচক আছেন যারা এর ঘোরতর বিরোধী, এঁরা মূলত মানের প্রশ্ন উত্থাপন করেন। কিন্তু সামান্য চিন্তা করলেই বুঝা যায়, এটা এখন একটি নতুন বাস্তবতা যাকে বন্ধ করা সম্ভব নয়। অসম্পাদিত পোর্টালের পাশাপাশি, ছোট বড় সাহিত্য পত্রিকাগুলোর ইলেকট্রনিক সংস্করণ প্রকাশিত হচ্ছে দেদার, মানের ব্যপারে সচেষ্টজন সেদিকেই ঝুঁকবেন ক্রমশ, এটাই স্বাভাবিক, এবং এটাই আশা করা যায়। 

সবশেষে বলা চলে, সংবাদপত্র ও সাময়িকীগুলোর পাশাপাশি ছোট কাগজগুলোও একে একে বিলীন হবে ইলেকট্রনিক জগতে। ঘুংঘুর-এর মতো ছোট কাগজগুলোর সমস্যা শুধু অর্থনৈতিক নয়, বরং বিশ্বব্যাপী এর পাঠক-শুভানুধ্যায়ীদের হাতে দ্রুত পত্রিকাটি পৌঁছে দেয়াটাও একটা বিশেষ চ্যালেঞ্জ। বস্তুত এই প্রয়োজনেই গত কয়েক বছর যাবৎ ঘুংঘুর-এর ইলেকট্রনিক সংস্করণ প্রকাশিত হচ্ছে। তবে আমরা মনে করি, ছাপা সংস্করণটিই আমাদের মূল কাগজ। একে ঘিরেই বাকি সব আয়োজন। যে কাগজ হাতে নেয়া যায় না, তাকে ছোট কাগজ বলি কীভাবে? 

হুমায়ূন কবির
১১৫ কবির লেন, জেলিকো, টেনেসি, যুক্তরাষ্ট্র।
জুলাই ১৫, ২০২২।


তথ্যসূত্র

1.    Schmandt-Besserat, D. BEFORE WRITING, Vol. 1. University of Texas Press, 1992. 
2.    Ewan Clayton, where did writing begin, British Library, History of writing
3.    Mesoamerican writing system, Encyclopedia Britanica
4.    Brngall, Roger S. The Oxford Handbook of Papyrology. Oxford: Oxford University Press, 2009.
5.    Theodore Low De Vinne. The invention of Printing. Ebook-No 51031, public Domain in U.S. 
6.    Joseph Needham, Tsien Tsuen-Hsuin. Science and civilization of China: Vol 5, Chemistry and chemical technology, Paper and printing. Chembridge University Press 1985
7.    Michael S. Rosenwald, Before Twitter and Facebook, there was Morse code: Remembering social media’s true inventor. The Washington Post, May 24, 2017
8.    Tom Standage, Writing on the wall: Social Media - The First 2000 Years. Bloomsbury, U.S.A
9.    Official Website, International Trade Administration, U.S Department of Commerce. Public domain.
10.    Katharina Buchholz, which countries spend the most time on social media, World Economic Forum, Apr 29, 2022      

menu
menu