নিদা ফাযলী-র এক গুচ্ছ কবিতা
[পিতৃপ্রদত্ত নাম মুকতদা হাসান ফাযলী (১৯৩৮-২০১৬)।বোম্বাইয়ের সিনেমার গীত রচনার জন্য বিখ্যাত। কিন্তু কবি হিসেবেও তিনি অর্জন করেছেন অপরিসীম সাফল্য। জীবনের ছোট ছোট অনুভূতিকে কাব্যরূপ দিতে সিদ্ধহস্ত এই কবি। মানবজীবনের অপূর্ণতার বেদনা প্রকাশ করেছেন অতুলনীয় ভাষায়। এক গজলে লিখেছেন : ‘কভী কিসী কো মুকম্মল জহাঁ নহীঁ মিলতা/ কহীঁ যমীন কহীঁ আসমাঁ নহীঁ মিলতা’ (কখনো কেউ পরিপূর্ণ জীবন পায় না/ কোথাও জমিন পায়না কোথাও আকাশ পায় না)। সমকাল সম্পর্কে সচেতন এই কবি আজীবন কাব্যসাধনা করেছেন মানবতার পক্ষে। অনূদিত কবিতাগুলোর পাঠ গ্রহণ করা হয়েছে ‘রেখতা’র (www.rekhta.org) ওয়েবসাইট থেকে।]
পিতার মৃত্যুতে
তোমার কবরে
আমি ফাতেহা পড়তে আসিনি
আমি জানতাম
তুমি মরতে পার না
তোমার মৃত্যুর সত্য খবর যে উড়িয়েছিল
সে মিথ্যাচারী
সে তো তুমি ছিলে না
কোনো শুকনো পাতা হাওয়ার সাথে মিশে ভেঙে পড়েছিল
আমার চোখ
তোমার দৃশ্যে বন্দী এখনো
আমি যা কিছুই দেখি
চিন্তা করি
সে তো তা-ই
তোমার যে সুনাম আর দুর্নামের দুনিয়া ছিল
কোথাও কিছু বদলায়নি
তোমার হাত নিঃশ্বাস নেয় আমার আঙুলে
আমি লেখার জন্য
যখনই কাগজ-কলম তুলে নিই
তোমাকে দেখি বসে রয়েছ আমারই চেয়ারে
যতটুকু রক্ত রয়েছে আমার শরীরে
সে তো তোমারই
ভ্রান্তি আর ব্যর্থতার সাথে বয়ে চলে
আমার আওয়াজে লুকিয়ে থাকে তোমার মন
আমার অসুখে তুমি
আমার অসহায়ত্বে তুমি
তোমার কবরের ওপর যে তোমার নাম লিখেছে
সে মিথ্যাচারী
তোমার কবরে শুয়ে আছি আমি
তুমি জীবিত রয়েছ আমার মাঝে
কখনো অবসর পেলে ফাতেহা পড়তে এসো
মানুষের সন্ধান
এখনো মরেনি, জীবিত রয়েছে মানুষ সম্ভবত
এখানে কোথাও ওকে খোঁজো, এখানেই হবে কোথাও
শরীরের অন্ধ গুহায় লুকিয়ে রয়েছে হয়তো
বাড়িয়ে হাত
প্রতিটি আলোকে গোলাপ করে দাও
হাওয়া বইছে দ্রুতবেগে, ঝাণ্ডা গুটিয়ে রেখে দাও
সম্ভব হলে ওই চোখে কাপড় বেঁধে দাও
না কোনো পদশব্দ
না নিঃশ্বাসের আওয়াজ
ভয়ার্ত সে
না জানি আরো ভয় পেয়ে যায়
শরীরের অন্ধ গুহা থেকে না কিছু করে বসে সে
এখানেই কোথাও খোঁজো তাকে
বহু শতাব্দীর পর সে আজ
উদাস উদাস
নীরব
একাকী
না জানি কখন কোন পাঁজর যায় বেঁকে তার
এখানে কোথাও ওকে খোঁজো, এখানেই হবে কোথাও
উলঙ্গ হলে তাকে পোশাক পরিয়ে দাও
অন্ধকার চোখ সূর্যের আগুনে তাতিয়ে দাও
অনেক বড় এই বসতি, যেকোনো জায়গায় কবর দিয়ে দাও
এখনো মরেনি
জীবিত রয়েছে মানুষ সম্ভবত
কাকতালীয়
আমরা সবাই
এক কাকতালীয় ঘটনার
ভিন্ন ভিন্ন নাম
ধর্ম
দেশ
ভাষা
এই কাকতালীয় ঘটনা অগণন বলয়
যদি জন্মের পূর্বে
নির্বাচনের অনুমতি থাকত
তবে কোনো পুত্র
তার পিতার ঘরে জন্ম নিতে চাইত না
প্রতীক্ষা
কতকাল কেটে গেছে
তুমি আসোনি এখনো
রোজ সূর্যের বনে
ঘুরে বেড়ায় জীবন
চাঁদের গুহায়
ঘুমিয়ে পড়ে ক্লান্ত পরাজিত রাত
ফুল কিছুক্ষণ সুগন্ধ ছড়ায়
ছড়িয়ে পড়ে
প্রতিটি নেশা
ঢেউ বানাতে নেমে পড়ে
সময়!
অবয়বহীন হাওয়ার মতো পার হয়ে যায়
কোনো আওয়াজের সবুজের মাঝে আগুনের হলকার মতো তুমি
কোনো নিঃশব্দ হাসির মাঝে চমকের মতো তুমি
কোনো চেহারার মাঝে সুগন্ধ ছড়ানো চোখের মতো
কোথাও চোখের ভুরু কোথাও কেশগুচ্ছ কোথাও বাহুর মতো
চাঁদ থেকে
ফুল অব্দি
এমনিতে তো কেবল তুমিই তুমি কিন্তু
তুমি কোনো চেহারা কোনো শরীর কোনো নাম নও
তুমি যেখানেই থাক
অসমাপ্ত তুমি বাস্তবের মতো
তুমি কোনো স্বপ্ন নও
যে সম্পূর্ণ হবে
দূরত্ব
এই দূরত্ব
যা রয়েছে তোমার আর আমার মাঝখানে
প্রতিটি যুগের গল্প
না আছে শুরু
না আছে শেষ
যাত্রাপথের আজাব, নিঃশ্বাসের বৃত্ত
না আছ তুমি কোথাও
না আছি আমি কোথাও
তালাশ এক রঙিন কল্পনা
যাত্রাপথে মুহূর্তদের কাফেলা
এই দূরত্ব!
যা রয়েছে তোমার আর আমার মাঝখানে
এইতো আকাঙ্ক্ষা, এইতো পুরস্কার
এইতো ঈশ্বর
ব্যাস, এভাবেই বেঁচে থাকো
ব্যাস, এভাবেই বেঁচে থাকো
কিছু বলো না
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে
ঘরের মানুষদের গুণে নাও
পায়ের ওপর পা রেখে প্রতিদিনের পত্রিকা পড়ো
ওখানে দুর্ভিক্ষ হয়েছে
যুদ্ধ বেধেছে ওখানে
কতটা সুরক্ষিত তুমি, শুকুর করো
রেডিও খুলে সিনেমার নতুন গান শোনো
ঘর থেকে যখন বের হও
সন্ধ্যা অব্দি হাসির রেখা ফুটিয়ে রাখো
দুই হাতে মুসাফা করো
মুখে কিছু ফাঁপা অর্থহীন বাক্য পুরে নাও
বিভিন্ন হাতে মুদ্রার মতো ঘষা খেতে থাকো
কিছু বলো না
উজ্জ্বল পোশাক
সামাজিক সম্মান
আর কী চাই বাঁচবার জন্য
রোজ পাওয়া যায় পানীয়
ব্যাস, এভাবেই বেঁচে থাকো
কিছু বলো না
জাতীয় ঐক্য
ওই পতিতা
চেনে অনেক পুরুষকে
সম্ভবত এজন্যই
দুনিয়াকে চেনে অনেক বেশি
তার ঘরে
সকল ধর্মের ঈশ্বরের ছবি থাকে ঝোলানো একটি ঘরে
এইসব ছবি
নেতাদের বক্তৃতার মত প্রদর্শনী নয়
তার দরোজা
গভীর রাত অবধি
হিন্দু
মুসলিম
শিখ
খ্রিষ্টান
সকল ধর্মের লোকের জন্য থাকে উন্মুক্ত
ঈশ্বর জানেন
তার ঘরের মতো বিস্তার
মসজিদ এবং মন্দিরের আঙিনায় কবে সৃষ্টি হবে
কবিতা অনেক সহজ ছিল আগে
কবিতা অনেক সহজ ছিল আগে
ঘরের সামনের
অশ্বত্থ গাছের শাখা থেকে লাফিয়ে
যেতে যেতে
শিশুদের থলে থেকে বেরিয়ে
রঙবেরঙের
পাখিদের কলকাকলিতে মিলেমিশে
কবিতা যখন আসত আমার ঘরে
আমার কলম দিয়ে, জলদি জলদি
নিজেকে লিখে যেত পুরো
এখন সকল দৃশ্য
বদলে গেছে
ছোট ছোট চৌরাস্তা থেকে
চওড়া রাস্তা গেছে বেরিয়ে
নতুন নতুন বাজার
পুরনো গলি-মহল্লাকে খেয়েছে গিলে
কবিতা থেকে আমার
এখন যোজন যোজন দীর্ঘ দূরত্ব
এই যোজন যোজন দীর্ঘ দূরত্বে
কোথাও আচানক
বোমা ফাটে
মায়েদের কোলে
ঘুমন্ত শিশু কাটা পড়ে
ধর্ম এবং রাজনীতি
দুই-ই
রটায় নতুন নতুন স্লোগান
অনেক শহর
বহু দেশ হয়ে
এখন হাঁটতে হাঁটতে
কবিতা যখন আসে আমার ঘরে
এত বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়ে যে
আমার লেখার টেবিলে
খালি কাগজ
খালি রেখে যায় চলে
আর কোনো ফুটপাতে গিয়ে
শহরের সবচেয়ে বৃদ্ধ নাগরিকের
চোখের পাতায়
অশ্রু হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে
সত্য
সে কোনো এক পুরুষের সাথে
বেশিদিন থাকতে পারে না
এটা তার দুর্বলতা নয়
সত্য
কিন্তু যতদিন সে যার সাথে থাকে
তার সাথে বিশ্বাসভঙ্গ করে না
তাকে লোকে যাই বলুক না কেন
কিন্তু
কোনো এক ঘরে
জীবনভর মিথ্যে বলার চেয়ে
আলাদা আলাদা ঘরে সত্য ছড়ানো
অনেক ভালো
একটি গল্প
তুমি
সম্ভবত কোনো সাময়িকীতে
কোনো কাহিনি পড়েছ হয়তো
হারিয়ে গেছে হয়ত রূপের রাণী
বিষপান করেছে হয়তো প্রেম
তুমি হয়তো একা দাঁড়িয়ে
মাথা থেকে আঁচল গড়িয়ে পড়ছে হয়তো
অথবা প্রতিবেশিনীর ফুলের মতো মুখে
কোনো দাগ চমকাচ্ছে হয়তো
হয়তো কাজে-কর্মে ব্যস্ত ঘরের সকল মানুষ
রেডিওটা গুনগুন করছে হয়তো
হয়তো নেশা ছেয়ে আছে তোমাকে
আমার বিশ্বাস, এখন তুমিও
সন্ধ্যাবেলা জানালা খুলে দিতে
বারণ করো তোমার মেয়েকে
নিষেধ কর তাকে গান গাইতে
ঈশ্বর নীরব
অনেক কাজ রয়েছে
লেপ্টে থাকা পৃথিবীকে ছড়িয়ে দেয়া
বৃক্ষদের বাড়িয়ে তোলা
ডালে ডালে ফুলের গন্ধ ছড়িয়ে দেয়া
পাহাড়দের সাজিয়ে তোলা
চাঁদটাকে টাঙিয়ে দেয়া
শূন্যতার মাথায় ঘন নীল আকাশ ছড়িয়ে দেয়া
নক্ষত্রদের আলোকিত করা
হাওয়াদের গতি দেয়া
লাফিয়ে চলা পাথরদের গায়ে পাখনা লাগিয়ে কবিত্ব দেয়া
ওষ্ঠদের হাসি
চোখেদের রোশনি দেয়া
সড়কের ওপর দোদুল্যমান ছায়াদের
জীবন দেয়া
ঈশ্বর নীরব !
তুমি এলে সৃষ্টি হবে দুনিয়া
এত কাজ আমি একা করতে পারব না
বৃদ্ধ
প্রত্যেক মা নিজের পেট থেকে
জন্ম দেয় নিজের স্বামীকেই
আমিও যখন
নিজের কাঁধে
বৃদ্ধ ধ্বংসস্তূপ বহন করতে করতে
ক্লান্ত হয়ে যাব
আমার প্রেমিকার
কুমারী গর্ভে
লুকিয়ে ঘুমিয়ে পড়ব
প্রত্যেক মা নিজের পেট থেকে
জন্ম দেয় নিজের স্বামীকেই
ছোট্ট হাসি
শূন্য শূন্য ছিল বাতাবরণ
আমি এমনিতেই
স্পর্শ করি তার চুলে গাঁথা নীরবতাকে
ঘুরে দাঁড়ায় সে
একটু হাসে
আমিও হাসি
তারপর আমাদের সাথে সাথে
নদী উপত্যকা
পাহাড় বাদল
ফুল কলি
শহর বনস্থলী
সকলেই হাসতে শুরু করে
এক মহল্লায়
কোনো এক ঘরের
কোনো এক কোণের
ছোট্ট এক হাসি
দূর অব্দি বিস্তৃত দুনিয়াকে
করে দেয় আলোকময়
জীবনে
জীবনের রঙ ধরিয়ে দেয় আবার
খোদার ঘর নেই কোনো
খোদার ঘর নেই কোনো
অনেক আগে আমাদের গ্রামের মুরুব্বীরা প্রায়ই
তাকে দেখেছে
পূজা ছিল
এখানেই ছিল সে
এখানেই শিশুদের চোখে
লকলকে সবুজ বৃক্ষে
থাকত সে
গন্ধ ছড়াত হাওয়ায়
বয়ে চলত নদীর সাথে
সেই চোখ কি আছে আমাদের
যে পাহাড়ে
চমকায়
কথা বলে
আওয়াজকে দেখব যে
আমাদের কান বধির
আমাদের আত্মা অন্ধ
আমাদের জন্য
এখন না ফুল ফোটে
না কলি গুনগুন করে
না নীরবতা একা একা মনোহর গান করে
আমাদের সময়!
মাতৃগর্ভ থেকে অন্ধ বধির
আমাদের সামনে পেছনে
মৃত্যুর অন্ধকার পাহারা
জন্ম
বন্ধ ঘর
তড়পানো অন্ধকার
আর
দেয়ালের সাথে ধাক্কা খাওয়া
আমি!!
প্রতীক্ষা করছি বহু যুগ ধরে নিজের জন্মের দিনের
মাতৃগর্ভ থেকে
বেরিয়ে এসেই
আমি!!
পড়ে রয়েছি নিজেই নিজের গর্ভের ভেতর
ফাতিহা
যদি কবরস্থানে
আলাদা আলাদা এপিটাফ না থাকে
তবে সকল কবরে
একই বেদনা থাকে ঘুমিয়ে
কোনো মায়ের পুত্র
কোনো ভ্রাতার ভগ্নি
কোনো প্রেমিকের প্রিয়তমা
তুমি!
যে কোনো কবরে ফাতিহা পড়ে চলে যাও
খেলা
এসো
কোথাও থেকে সামান্য মাটি ভরে নিয়ে আসি
মাটিকে মেঘে মাখাই
নতুন নতুন আকার বানাই
কারো মাথায় টিকি দিয়ে দিই
কপালে তিলক সাজাই
কারো ছোট চেহারায়
ঘন দাড়ি লাগিয়ে দিই
কিছুদিন এদের নিয়ে মনোরঞ্জন করি
আর এরা যখন ময়লা হয়ে যাবে
দাড়ি টিকি তিলক সবকিছুকে
ভেঙেচুরে এলোমেলো করে দিই
মেলানো-মেশানো এই মাটি আবার
আলাদা আলাদা ছাঁচে ঢেলে দিই
নতুন নতুন আকার বানাই
দাড়িতে টিকি উড়িয়ে দিই
টিকিতে দাড়ি লুকিয়ে যাক
সফিকুন্নবী সামাদী, অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক এবং অনুবাদক, বাংলাদেশ