অবাঙালি দুই কবির কবিতায় বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা
নওশাদ নূরী
[নওশাদ নূরী (১৯২৬-২০০০) বাংলাদেশের প্রখ্যাত উর্দু কবি। তাঁর জন্ম বিহারের দারভাঙ্গায়। ঢাকায় আসার পর ১৯৪৮ সাল থেকেই তিনি বাংলাদেশের জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের সমর্থনে তিনি রচনা করেন বিখ্যাত ‘মহেঞ্জোদারো’ কবিতা। তিনি সম্পাদনা করেছেন দুটি উর্দু সাপ্তাহিক ‘রূদাদ’ এবং ‘জারিদা’। এই দুটো পত্রিকাই বাংলাদেশের জাতীয় আন্দোলনের পক্ষে কাজ করেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করার কারণে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালে তাঁকে গ্রেফতার করেছিল।]
জাগরণের উৎস
[১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাতের পটভূমিতে]
সন্ধ্যাকাশে লালিমা পুষ্পিত হলে হৃদয় চুপিসারে
কল্পনাকে বলে দুই পৃথিবীর কোষাগার
যখন ভোরের হাওয়া বয়, হাওয়ার মনোরম তরঙ্গকে
চিরন্তন আনন্দ বলে অনুভবের জলযান
প্রকৃতির মাঝ থেকে চাঁদ উঠে মাঝপথে ডুবে গেলে
জোছনাকে বলে আকাশ-প্রাসাদের সোপান
বেদনার দেশে লাগাতার চলে শিকার-সন্ধানী বাণ
আদিকাল থেকে, এমন হৃদয় কি আছে যে নয় চূর্ণ-বিচূর্ণ
নিকট বন্ধুদের ওষ্ঠে না আছে শিশির না ধুলো
কার নিঃশ্বাসে নেই মৃদু হলেও প্রকম্পন
অনুভব কেটে কেটে রেখেছি আমি
ভাস্কর্য করে, এখানে তো নেই আর কোনো ভাস্কর
কেবল তাঁর স্মৃতি আমার হৃদয়ে থাকে ছেয়ে
এখনো, এক অস্পষ্ট আকাঙ্ক্ষার মতো
কেবল তাঁর স্মৃতি আমার ওষ্ঠে বিড়বিড় করে চলে
এখনো, এক অসমাপ্ত বার্তালাপের মতো
কেবল তার স্মৃতি আমার ভেজা চোখে অস্পষ্ট
এখনো এক পেরেশান তালাশের মতো
কেবল তার স্মৃতি ইতিহাসের কলিজাতে
কম্পিত হচ্ছে জাগরণের সামর্থ্যের মতো
তিনিই জাগরণ, জাগরণের উপমাও তিনি
তিনিই জাগরণ, চোখ ধাঁধানো উল্লাসও তিনি
প্রতিটি জাগরণের মতো অবিনাশীও তিনি
টুঙ্গিপাড়া
[১৭ই আগস্ট ১৯৭৫ স্বাধীনতার আন্দোলনের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মভূমি ও সমাধিক্ষেত্র]
খবর রাখো কি গ্রামের জাগ্রত জনতা
প্রতিটি ষড়যন্ত্রে চৌকস লোকেরা
তোমাদের কোনো আছে কি ধারণা বস্তিবাসী
রাজনীতির সূক্ষ্ম চালে অভ্যস্ত নেতাগণ
এখান থেকেই শুরু হয়েছিল সেই পথ
যেখানে এসে হারিয়ে গেলো পথ
তোমরা জানো কি কিছু হে শিশুগণ
যুদ্ধের ময়দানের লড়াকু সৈনিকগণ
তোমরা জানো কি হে নৌকার মাঝিগণ
উন্মুক্ত গ্রামের সাহসী নবযুবকগণ
এখানে রোপিত হলো ভূমিকম্পের চারা
এখানে বপিত হল আগ্নেয়গিরির বীজ
মীর গুল খান নাসির
[মীর গুল খান নাসির (১৯১৪-১৯৮৩) ছিলেন বেলুচিস্তানের বিখ্যাত রাজনীতিবিদ, কবি, ইতিহাসবিদ এবং সাংবাদিক। বালোচ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সম্মুখযোদ্ধা ছিলেন তিনি । তাই তাকে কারাবরণ করতে হয়েছে বারবার। ৬৯ বছরের জীবনে কারাগারে কাটিয়েছেন প্রায় ১৫ বছর। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার সময়ও তিনি ছিলেন কারাগারে। কারাগারে বসেই বঙ্গবন্ধুকে নৃশংস ভাবে হত্যা করার ঘটনা শুনে ২৯শে আগস্ট তিনি রচনা করেন এই কবিতাটি। কবিতাটি ইংরেজি অনুবাদ থেকে বাংলায় অনূদিত হয়েছে।]
কোথায় সকাল?
চিৎকার কান্না আর দ্রুত ডাকাডাকির মাঝে
উৎসব করছে রঙান্ধ জনতা
তারা বলছে ‘সকাল হয়েছে’, কিন্তু যখন তাকাই জীবনের দিকে
আমি দেখি অন্ধকার রাত, গভীর অমাবস্যার রাত
বিজলীর চমক আর নিঃশব্দ বজ্রে
মনে হয় মেঘ বর্ষণ করছে দূরে কোথাও
কিন্তু বৃষ্টির গন্ধ আকুল করে হাওয়াকে
তার বদলে রক্ত উপচে পড়ে ভরে তুলছে পরিখা
হে মূর্খের দল! কোথায় আলোকিত সকাল?
এখানে এখনো ভয়ানক অন্ধকার রাত
এজিদের মত সাম্রাজ্যবাদীরা এখনো
চূর্ণ করছে সাহসী দেশপ্রেমিকদের হাড়
অজস্র মানুষের ভরা ছবির মতো বাংলাদেশে
আরো একবার উঠছে রক্তের তুফান
সাম্রাজ্যবাদের দালালেরা আবার
জ্বালাচ্ছে আগুন শহরে-গ্রামে
মহান দেশপ্রেমিক মুজিব
শুয়ে আছেন নিজের রক্তে ভরা ময়দানে
সাম্রাজ্যবাদের দাসেরা তাঁকে পরিয়েছে
পদকের মতো বুলেটে সাজানো লাল জামা
বিদেশিদের ঘৃণিত দালালেরা করেছে গণহত্যা
পুনরায় এজিদের বিরুদ্ধে হোসেনের যুদ্ধের কাহিনী
হে সাহসী বন্ধুগণ! এজিদের স্বভাব বিষয়ে থাকো হুশিয়ার
তোমাদের ঐক্য ও সমৃদ্ধিতে পরাজয় তাদের
যে মুখে তারা বলে কথা তা হতে পারে তাদের
কিন্তু তাতে যে ভাষা তা সাম্রাজ্যবাদীদের
তারা হয়েছে ব্যর্থ কিন্তু তাদের পকেটভরা অর্থ
আর তাদের সহায় সাম্রাজ্যবাদ এবং ফৌজ
ধ্বংস করতে সাহসী দেশপ্রেমিকদের
তারা পাচ্ছেন অগণন হাতিয়ার এবং ফৌজ
দয়ার নামগন্ধ নেই ওই কাপুরুষদের হৃদয়ে
কেবল তাদের কারণে দুনিয়া আজ অন্ধকারে
তারা চায়না স্বাধীনতার প্রদীপ জ্বলুক কোথাও
যেখানেই জ্বলতে দেখে প্রদীপ দেয় তা নিভিয়ে
মুজিব, বাংলাদেশের সাহসী নেতা বঙ্গবন্ধু
পরিবারসমেত নিহত তাদের হাতে
পুনরায় স্বাধীনতার পতাকা অর্ধনমিত
সম্রাজ্যবাদীরা ফিরে এসেছে আবার তাদের ষড়যন্ত্র আর ধোঁকাবাজী নিয়ে
আবার মতভেদ দূর করা হচ্ছে বন্দুক দিয়ে
আবার সোনার বাংলায় জ্বলছে আগুন
হে সাহসী বন্ধুগণ! এমনি করেই সময় ঝাঁকুনি দেয় আমাদের
একই ভাবে জ্বলছে আমার জন্মভূমি বেলুচিস্তানও
হে যোদ্ধাগণ! তোমরা ভয় পেয়ো না, থেমে যেও না
যদিও পথ বন্ধুর এবং কাঁটায় ভরপুর
মুজিবের রক্ত বিফল হতে পারে না কিছুতেই
এ কেবল পরীক্ষা দেশপ্রেমিকের মনোবলের
এসব থাকবে না, ভয়ার্ত রাত হবে না দীর্ঘ
যদিও এখন সময় অন্ধকার আর কুয়াশাচ্ছন্ন
পরিষ্কার দেখছে নাসির হৃদয়ের চোখে
তোমাদের বিজয়ের পতাকা উড়ছে আকাশে
• রাজশাহী