দোসর

ডিয়ার ডায়রি - ১

আজ প্রথম তোকে লিখছি। জন্মদিনের সেই সন্ধের পর আজ তোর মোড়ক খুললাম। রাগ করিস না, বন্ধু। স্পেশালদের কি যেখানে সেখানে যখন তখন বের করা যায়, বল? তোর মতো এমন স্পেশাল আমার যে আর একজনই আছে, বেছে বেছে তাই তোকেই আনল আমার একা সময়ের গল্প শোনার জন্য। তুই তো সবই জানিস, তাই না! সেই কবেকার কথা... ওরা যেদিন আমাদের পাড়ায় থাকতে এল, বিজয়া দশমীর বিকেলে, সেদিন সারা পাড়ায় ঢাকের করুণ সুর বাজলেও দাদুর ঘরের রেডিও আমার কানে ঠিক এসেছিল— ‘কোন সে আলোর স্বপ্ন নিয়ে গেল আমার / কে ডাকে আয় চলে আয়...’

সেই বিকেলে কনে-দেখা-আলো ফুটেছিল সারা আকাশ জুড়ে। ওর মনে নেই, কিন্তু আমি ভুলিনি।

আমাদের গলির একদম শেষে যে বাড়িটাকে আমরা ছোট থেকে ভূতুড়ে বলে জেনে এসেছি সে বাড়িটাই ওরা ভাড়া নিল। কী সাহস বাপ্স্!

প্রথম দিন খবরটা পেয়েই ওদের সঙ্গে ভাব করার দারুণ আগ্রহ হয়েছিল। তারপর তো জানা গেল আমার কলেজেই ও পড়ে, সেকেন্ড ইয়ারে। মা তো খুব খুশি হল, কর্নেল বাড়ির মেয়ের সঙ্গে আমি রোজ কলেজে যাব। ফার্স্ট ইয়ারের আমি তখন এক্কেবারে আনকোরা, স্কুলের বন্ধুরা সব কে কোথায় গেছে। কলেজের ডেস্কগুলো এত ফাঁকা ফাঁকা লাগত... বন্ধু ছাড়া ভালো লাগে নাকি বল! আর ফেরার পথে, সেই বাইকগুলোর শব্দ! উফ, আজও ভাবলে আমার হাত-পা কাঁপতে থাকে। তোর মনে আছে ডায়রি, সেদিন লাস্ট বাসটা ফেল করে যখন বৃষ্টিতে আটকে পড়ে হয়রান হচ্ছিলাম, সেদিনও ওই লাল ফেট্টিবাঁধা বাইকবাহিনী রাস্তা জুড়ে দাপাচ্ছিল। কী বিশ্রী অঙ্গভঙ্গি, সাথে শিস দিয়ে— ‘তু চিজ বড়ি হ্যায় মস্ত মস্ত...’ উফ! এখনও ভাবলে আমার...

মনে মনে যখন ভগবানকে ডাকছিলাম আর একটার পর একটা অটো হাত নাড়িয়ে চলে যাচ্ছিল, সেদিনের সন্ধেটার মত দীর্ঘ সন্ধে আমি আর একটাও পাইনি। ওদের মধ্যে একজন তো “হাই সেক্সি...”  বলে কী সব যেন ইশারাও করছিল, আমি ঘেমে যাচ্ছিলাম। একজন ধীরে ধীরে সামনে আসছিল, এই বুঝি কেউ হাত ধরল, আমি চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলাম। ঠিক সেই সময় একটা হাত কাঁধে এল। আমি শিউরে উঠে ওড়নাটা চেপে ধরেছিলাম শক্ত করে, কিছু একটা বলে চেঁচাতে যাব এমন সময় খলখল স্বরে কেউ ডাকল, “হেই, তুমি এখন এখানে! আজ কি বাস মিস করেছ?” চোখ খুলে দেখি একমুখ হাসি নিয়ে ও দাঁড়িয়ে পাশে। আমার শ্বাস দ্রুত পড়ছিল, আমার কপাল, ঘাড়, পায়ের নিচ ঘেমে জবজব করছিল, কিছু কথা সরছিল না মুখে।

“কী হয়েছে তোমার, আর ইউ ওকে?”

আমি কিছু বলতে পারিনি, শুধু আশপাশ তাকিয়ে দেখতে চাইছিলাম মস্তানগুলো কি আছে এখনও?

নাহ, একটাও চোখে পড়েনি। ঈশ্বর আছে কিনা জানি না, কিন্তু এমন বিপদের দিনে ও যে এভাবে এসে আমার প্রার্থনায় সাড়া দেবে ভাবতে পারিনি।

জানিস ডায়রি, ওকে ‘থ্যাঙ্কু’ বলা হয়নি সেদিন। অজান্তেই কখন যেন ওর হাতটা শক্ত করে ধরেছিলাম। বাড়ি পৌঁছানোর আগে অবধি ছাড়িনি একবারও।

ও কোনও প্রশ্ন করেনি, শুধু সারাটা রাস্তা আমায় আগলে আগলে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল। আচ্ছা বাবা কর্নেল হলে মেয়েদের বুঝি খুব সাহস হয়? নাকি ‘সাহস’-এর চেহারা ওর মতো হয়?

সেই ঘটনার পর, কে জানে কেন সবসময় সাইকেল ঠেলে ঠেলে ও আমার পাশে পাশে চলত। আমি কোনোদিন কোনও হেল্প চাইনি, তাও কী করে বুঝে গেছিল আমি কী চাই! ওর মা যেদিন গৃহপ্রবেশের নেমন্তন্ন করতে এলেন সেদিন ও-কে নিয়ে আমাদের ছাদে উঠে ঘুড়ি ওড়ালাম কতক্ষণ।

ও তো কিছু জানতই না। আমার থেকে ঘুড়ি ওড়ানো শিখতে সে কী উৎসাহ! হাততালি দিয়ে ‘ভোঁ-কাট্টা’ র ঝড় তুলে কী খুশিই যে হয়েছিল ও। ওর মত এত অল্পে খুশি হতে কেউ সহজে পারে না রে।

ওর মতো এত মন দিয়ে কিছু শিখতেও আমি দেখিনি কাউকে। ঘুড়ির মাঞ্জা, রঙিন কাগজ, সুতো কোথায় পাওয়া যায়, কীভাবে লাগাতে হয়, হাওয়ার দিক বুঝে কিভাবে সুতোয় ঢিল দিতে হয়... সবটা অসীম আগ্রহে শুনেছিল ও। শুধু কী তাই, ওর বাড়িতে মা যেদিন পটলের দোরমা বানাল, সেদিনও কী আগ্রহে রান্নাটা শিখে নিল। শুধু শিখলই না, পরের দিন একটা টিফিনে একটুখানি নিয়েও এল, আমাদের বাড়ি। রুনুকে দিয়ে বলল, সবাই খেও।

তবে যাওয়ার সময় আমার কানে কানে বলল, “আমি বানিয়েছি। কেমন হয়েছে জানিও কিন্তু।” আমি জানি ওটা শুধু আমার জন্যই ছিল, শুধু আমার জন্য। শুধু আমার জন্য যদি নাই থাকে তবে একবার রিং হতেই কী করে রিসিভার তুলে বলল, “খেয়েছ? কেমন লাগল?”

শি ইজ রিয়ালি ভেরি স্পেশাল— শি ইজ রাইকিশোরী দত্ত।    

ডিয়ার ডায়রি - ২

আমাদের ছাদে সেদিন জমাটি অন্ত্যাক্ষরী চলছে। পাশের বাড়ির দাদু তাঁর গানের খাতা কিছুতেই কাছছাড়া করছেন না, দিদা কাঁপা-কাঁপা গলায় ধরলেন— ‘মাধবী–মধুপে হল মিতালি / এই বুঝি জীবনের মধু গীতালি...’ গ্রীষ্মের পড়ন্ত বিকেলের বুকে স্নিগ্ধতা ছড়ানো এই গান সেদিন আরও মধুর লাগছিল। কারণ ওরা সবাই আছে আমাদের ছাদে। দত্তবাড়ির গিন্নির সাথে আড্ডার অন্ত নেই মায়ের।

রুনুর সাথেও কাকুর বেশ ভাব জমেছে। ক্লাস সিক্সে পড়া রুনু কোল্ড ড্রিঙ্কের কুপ্রভাব নিয়ে কত কী জানে, সেটা শুনেই কাকু ফ্ল্যাট! মা, দত্তকাকিমা, দিদা আর আমি— একদল। আর অন্যদলে কর্নেলকাকু, রুনু, দাদু আর রাই। হঠাৎ দুম করে লোডশেডিং। রুনু দৌড়ে গেল লণ্ঠন আনতে। আমি রেলিঙে হেলান দিয়ে দাদু-দিদিমার খুনসুটি শুনছি, মা আর দত্ত কাকিমা রান্নার গল্প জুড়েছেন। এমন সময় ঘাড়ের কাছে শুনি— “অনেকক্ষণ তো ফিরেছ কলেজ থেকে। খাওয়া হয়নি কিচ্ছু নিশ্চয়, এটা নাও।”

চমকে ঘুরে দেখি পেপসির ক্যান হাতে ও দাঁড়িয়ে।

“তুমি কী করে জানলে, আমার তেষ্টা পেয়েছে?”

“ঠিক যেমন তুমি জানো, আমি এখানে আসব।”

রাইকে যত দেখি, তত ভাষা হারিয়ে যায়। ওর কথার জবাবে জিভ জড়িয়ে যায় বারবার। অথচ ওকে নিয়ে গল্পের শেষ নেই আমার। পুরনো বন্ধুদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যাকে আমি ওর কথা বলিনি। ও একদম আলাদা মানুষ। ওর সঙ্গে কথা বললে সবকিছু একদম ভালো হয়ে যায় হঠাৎই, চারপাশে সব সমস্যা যেন চুটকিতে সহজ হয়ে যায়। জীবন যেন বড্ড সোজা লাগে বাঁচতে। এটা কি শুধু আমারই লাগে? রাই কী ভাবে আমার কথা, বলেছে ওর বন্ধুদের? ওর তো অনেক বন্ধু। তবু খুব একটা কাউকে নিয়ে ওর কাছে গল্প শুনিনি। আমার থেকে মাত্র দেড় বছরের বড়, কিন্তু এখনই ওর জীবন সম্বন্ধে ধারণা কী ভীষণ অন্যরকম।

ও যখন মাঝেমাঝে দার্শনিক হয়ে কথা বলে আমি জাস্ট হাঁ হয়ে যাই। রাইয়ের অতীত নিয়ে পিছুটান নেই, ভবিষ্যত নিয়ে মাথাব্যথা নেই। সম্পূর্ণভাবে বর্তমানে বাঁচা একটা উচ্ছল মেয়ে। ওর সবকিছুই আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকে। এই বয়সে রাই একা-একা দিল্লি-চেন্নাই যায়, দু-তিনদিন এক্কেবারে হাওয়া হয়ে তারপর ফিরে আসে। কীসব নতুন নতুন বিষয়ের উপর লেকচার শোনে, এক্সট্রা ক্লাস, ওয়ার্কশপ করে রাত করে বাড়ি ফেরে। ভয়ডর কী জিনিস যেন জানেই না। একদিন নাকি রুনু আর মাকে নিয়ে লং ড্রাইভেও গিয়েছে। আমি পরে জেনেছি। এত সাহস যার, তার আমার খিদে পাওয়ার মতো এত ছোটখাটো জিনিসেও এত নজর! এমনি এমনি ও স্পেশাল না।

“জানো, আমি তোমার মতো হতে চাই।” পেপসির ক্যান নিয়ে বললাম।

“আমার মতো... মানে কী রকম?” ডালমুটের প্যাকেট খুলতে খুলতে বলল ও।

“মানে ফ্লাই-হাই টাইপ। একদম মুক্ত, বাঁধনছেঁড়া অথচ কেয়ারিং, জীবনটাকে ইচ্ছেমতো গড়েপিটে নেওয়ার মতো সাহসী, স্পষ্টবাদী, স্বাধীন...”

“ব্যস ব্যস! অনেক হয়েছে। আগে হাঁ করো... হাঁ করো দেখি।”

ওর হাত থেকে ডালমুট খেতে একটুও ঝাল লাগছিল না সেদিন। লোডশেডিং তখনও চলছিল, একটাই পেপসি ক্যানে আমরা একটু একটু করে চুমুক দিচ্ছিলাম। রাই অনেক কথাই বলছিল, কলেজের কোন স্যার কী কী করেছেন, কোন ম্যাডামের আজকের শাড়িটা কেমন ছিল... লণ্ঠনের আলোয় রুনুদের উচ্চস্বরে গান আর হৈ চৈ সবটা আমার কানে যাচ্ছিলও না ভালো করে। একসময় দেখি ওর ঠোঁটের কোনায় ডালমুটের হলদে এঁটো।

“এম্মা এটা কী.. দেখি দেখি।” বলে আমি যেই আঙুল দিয়ে দাগটা মুছে দিলাম, ও আলতো করে আমার কব্জিটা ধরল। তারপর ফিসফিস করে বলল, “আ-দিয়ে একটা গান আমি তখন ইচ্ছে করে স্কিপ করে গেছি। সেটা সবার জন্য নয়, শুধু তোমার জন্য... আও গে জব তুম হো সাজনা/ আঙ্গনা ফুল খিলেঙ্গে / বরষে গা সাওয়ান... ঝুম ঝুম কে / দো দিল এইসে মিলেঙ্গে...”

আমি চোখ বন্ধ করে শুনছিলাম, নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছিল ধীরে ধীরে। ঘাড়ের নিচেটা কেমন যেন সুড়সুড় করছিল। আমার কানে তখন ওর রিনরিনে সুর আর আমার আঙুলে তখন ওর ঠোঁটের ছোঁয়া। দু-ফোঁটা জল টপ টপ করে পড়ল হাতের উপর। আমি হাত সরাতে পারলাম না। তাহলে রাইও ভাবে আমার মতো। রাইও কাঁদে আমার মতো। রাইও...

হঠাৎ আলো চলে এল। তুমুল হাততালি আর ‘জ্যোতিবাবু এসে গেছে’ বলে রুনুর চিৎকারে চমকে উঠে আমি ঝটকা মেরে ওকে সরিয়ে দৌড়ে নিচে চলে গেলাম। প্রবল উত্তেজনায় আমার সারা শরীর কাঁপছিল। নিজের আঙুলের ডগাগুলো এত নরম আর উষ্ণ কোনোদিন অনুভব করিনি। টিভি অ্যান্টেনায় বসা দুটো পায়রা কেন যেন হঠাৎ বকবকুম করে ডেকে উঠল।

পরদিন আমি বাড়িতেই ছিলাম। দুপুরে ডোরবেল শুনে নিচে গিয়ে দেখি, দরজার ফাঁকে কে একটা খাতা গুঁজে দিয়ে গেছে। খুলে দেখি আমার ইংলিশ সেকেন্ড পেপারের নোটবুক। পরশু মাধব নিয়েছিল নোটস টুকবে বলে। এটা এখানে কীভাবে, ভাবতে ভাবতে পাতা খুলে ওলটাচ্ছি, শেষের দিকে একটা পাতায় চোখ আটকে গেল।

কী বলব, কীভাবে ক্ষমা চাইব কিচ্ছু বুঝতে না পেরে এই পাতাটা নিলাম। মাধব কি তোমার খুব বন্ধু? ওর কাছে তোমার খাতা দেখে আমি স্থির থাকতে পারিনি। আজ কলেজে দেখা হয়নি আমাদের।

আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না। ফোন করেছি কতবার, কিন্তু পাইনি। তোমাদের টেলিফোন কি খারাপ? ছাদেও আজ তুমি ওঠোনি সকালে। কলেজেও দেখি তুমি যাওনি। আমি আজ একটা ক্লাস করেই চলে এসেছি। যেখানে তুমি নেই, সেখানে সারাদিন আমি থাকি কী করে? আজ সারাদিন কথা হয়নি, দেখা হয়নি। কিন্তু তোমার এই খাতা মাধবের কাছে দেখে আমি চুপ থাকতে পারিনি, ওর থেকে জোর করে কেড়ে নিয়েছি। মাধব আমার ছোট ভাইয়ের মতো। কিন্তু তাও ওর সঙ্গে আজ ফাইট করেছি, ওরা সবাই অবাক হয়ে গেছিল সামান্য এই খাতাটা নিয়ে আমার এরকম অদ্ভুত আচরণ দেখে। কিন্তু এ খাতাটা তোমার। আর যা তোমার, তা আমার কাছে সামান্য নয়। আমি জানি না কেন এত ওভার-পজেসিভ হয়ে যাচ্ছি তোমার প্রতি। কিন্তু আমি জানি তুমি ভাববে আমি ভালো না। খুব বাজে। জানো, কেউ বন্ধু নেই আমার। এক তুমি ছাড়া...

কিন্তু তুমি কাল ওভাবে চলে গেলে, আমি কিছু বুঝতে পারছি না। তুমি কি খুব রাগ করেছ? আমি জানি হয়তো ওসব ঠিক হয়নি। প্লিজ ক্ষমা করে দাও। আমি আবেগের বশে যা করেছি, বলেছি সেগুলো ভুলে যাও প্লিজ। ধরে নাও কিচ্ছু হয়নি। কিন্তু প্লিজ রাগ করে থেকো না। আমার সত্যি কিচ্ছু ভালো লাগছে না। তুমি কি দূরে সরে যাবে? প্লিজ, আর যাই করো... আই ডোন্ট ওয়ান্না লুজ ইউ, ডিয়ার। যদি আমাদের বন্ধুত্ব সত্য হয় তবে নিশ্চয় তুমি বুঝবে আমি যা বলছি সত্য বলছি। ক্ষমা করবে নিশ্চয়। আর যদি মন থেকে ক্ষমা করো, যদি তুমি বিশ্বাস করো আমায়, তবে... তবে তুমি আমার ‘তুই’ হবে?

যদি আবার আমাদের দেখা হয়, সাজিয়া হাসান, তুমি আমার ‘সাঁজ’ হবে?

পুনশ্চ : কাল কলেজে ১১টায় ওই সেকেন্ড কৃষ্ণচুড়াটার নিচে যদি দাঁড়াও, আমি বুঝে নেব আজ থেকে তুই আমার ‘সাঁজ’ হলি। 
- রাই (শুধুই তোর)

আমি দরজা বন্ধ করে ওই পাতাটাকে বুকে চেপে ধরে টেনে টেনে শ্বাস নিলাম। পাতাজোড়া কেবল ওর গন্ধ। গন্ধটাকে জড়িয়ে ধরে আমার কান্না পেল খুব।

ওপাশে মায়ের রেডিওতে তখন রফিসাহেব গাইছেন— ‘তুম নে মুঝকো হাসনা শিখায়া/ রোনে কাহোগে রোঁ লেঙ্গে আব / আঁশু কা হামারে গম না কারো/ ওয় বহতে হ্যায় তো বহনে দো/ মুঝে তুমসে মোহব্বাত হো গ্যায়ি হ্যায়/ মুঝে পলকো কি ছাঁও মে রহনে দো / এহসান তেরা হোগা মুঝ পর...”

ইয়েস, শি ইজ মাইন। আর আমি সাজিয়া হাসান, জীবনের শেষ দিন অবধি রাইয়ের সাঁজ হয়ে থাকব। ফিসফিস করে নিজেকেই যেন বললাম “কথা দিলাম।”

ডিয়ার ডায়রি - ৩

সেদিনটা ছিল ওর জন্মদিনের আগের দিন। আমাদের একসঙ্গে এখন সবাই দেখে, রাস্তায়, কলেজে, দোকান বাজারে। আমার এখন থার্ড ইয়ার। ও মাস্টার্সে। জানি এই বন্ধুত্ব, সম্পর্ক আপাতদৃষ্টিতে অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু আমাদের ভবিষ্যত আর পাঁচটার মতো সমাজের চোখে ‘স্বাভাবিক’ হবে না, তবু আমার মনে এই নিয়ে কোনও গ্লানি নেই। ওর কাছ থেকে আমি বর্তমানে বাঁচতে শিখেছি। ওর সঙ্গে থাকলে জীবনটা বড্ড সরল লাগে, হালকা লাগে। এই অনুভুতিটুকু তো মিথ্যে নয়। আমাদের খাতার পাতায়, বইয়ের ভাঁজে প্রায়ই নানা কথা চালাচালি হয়। তো রাইয়ের ২৩তম জন্মদিনের আগের দিন হঠাৎ ও একটা চিরকুট হাতে দিল— “বাড়ি গিয়ে পড়িস, সাঁঝ। আমি আসি।” ও দাঁড়াল না, চোখ নামিয়ে চলে গেল মাথা নিচু করে। এভাবে ওর চলে যাওয়া দেখে আমার বেশ একটু রাগ হল। এভাবে কথা না বলে দুম করে কেউ একলা রেখে চলে যায় বুঝি?

সেদিন সারাদিন আমি ওকে ফোন করিনি, দেখাও করিনি। জানি, আজ ওর জন্মদিন। ও নিশ্চয় খুব আঘাত পেয়েছে। ছাদ থেকে একবার দেখার চেষ্টা করেছিলাম, কিছু গাড়ি দেখলাম। অনেক লোকজন এসেছে। পার্টি হচ্ছে নাকি? কাকিমা অবশ্য আমাদের নেমন্তন্ন করেছিল, মা বলল। কিন্তু রুনুর সেদিন পেটব্যথা। তাই কারুর যাওয়া হল না। আমি সারাদিন ছাদ আর ঘর করেছি। ওকে দেখতে পাইনি। রুনু দুপুরে একবার বলল, বেশ কয়েকবার ফোন বেজে কেটে গেছে। ল্যান্ডলাইনে এই মিসড কল আমার জন্যই এসেছিল জানি। কিন্তু তবু আমি চুপ থেকেছি সারাদিন।

রাত বাড়লে, ঠিক বারোটা বাজার মিনিট পনেরো আগে আমি বেরোলাম। ওদের বাড়ির পেছনের সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠে দেখি ছাদের দরজা খোলা। সারাদিন হৈচৈ-এর পর সবাই কি ভুলে গেছে দরজা বন্ধ করতে? যাক গে, ভাগ্য আজ আমার সঙ্গে। ছাদ থেকে বারান্দায় নেমে সোজা ওর দরজায় টোকা দিলাম। কোনও সাড়া নেই। ঘুমিয়ে পড়ল নাকি! না, আজ তো ঘুমালে চলবে না ডার্লিং। বার তিনেক টোকা দিতে দরজা খুলল। আমাকে দেখে চোখ কপালে তুলে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আমি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। এরকম দুঃসাহসিক ব্যাপার জীবনে প্রথম ঘটছে আমার। বাড়িতে কেউ জানেই না, আমি মাঝরাত্তিরে এমনিভাবে দত্তভিলায় এসেছি।

- সাঁজ? তুই... এখন, এখানে?    

- শশসসহহ... হ্যাপি বার্থডে সুইটি। এটা ধর। 
প্যাকেটটা ওর হাতে দিলাম।

- থ্যাংক্স, বাহ, আর্চিস কার্ড! আর এটা কী? 

তখনও ঘোর কাটেনি ওর। চোখের চাহনি বলছে ভীষণ অভিমানে লাল হয়ে আছে ও।

- কী আছে, সেটা খুলেই দেখ।

- নাহ, থাক। জন্মদিন কাল ছিল। এখন দেখে কী করব? তুই বাড়ি যা, সবাই খুঁজবে নইলে। 

মুখ নিচু করে পার্পল শার্টের বোতাম খুঁটছে ও।

- খুব রাগ হয়েছে তাই না? আচ্ছা তাকাও আমার দিকে। এই প্লিজ তাকাও না। আচ্ছা তুমিই বলো, তোমার জন্মদিনে অন্যদের মতো আমিও হৈচৈ-এর আসরে এলে ভালো লাগত? আমাদের স্পেশাল টাইম আছে না? 

রাই তখনও মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে।

- এত দূরে কেন দাঁড়িয়ে আছ? এদিকে এসো। 

ওকে জোর করে কাছে টেনে নিলাম। কপালের চুলদুটো সরিয়ে দিতেই এবার মুখ তুলে তাকাল রাই; আয়ত চোখের ভেজা দৃষ্টি আর বুজে আসা গলায় থেমে থেমে বলল, “কিন্তু তাই বলে,আজ সারাদিন... একবারও...” ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই আমি জড়িয়ে ধরলাম ওকে।

তারপর প্রথমে কপালে, তারপর গালে, নাকে আর শেষে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে ফিসফিসিয়ে বললাম, “মিস ইউ টু সুইটহার্ট। বাট দিস ইস ইয়োর ড্রিমগিফট, নো?”

হ্যাঁ, এটাই ছিল আমাদের প্রথম চুম্বন। দীর্ঘ দাবদাহের পর প্রথম বৃষ্টির জল যেমন ভাবে মাটি শুষে নেয়, আমাদের অধরের আর্দ্রতা যেন সেভাবেই জীবনজ্বালা জুড়িয়ে দিচ্ছিল। ঠিক কতক্ষণ এভাবে লিপ-লকড ছিলাম জানি না। যখন চোখ খুলল, দেখলাম দুজনেরই চোখের কোনায় জল। দুজনের শ্বাস ঘন, দুজনেই টের পাচ্ছি দুজনের ধুকপুক। আমাদের প্রতি রোমকূপে ধ্বনিত হচ্ছিল অনুচ্চারিত শব্দঋণ— আরও একটু, আরও খানিকক্ষণ...

হ্যাঁ, সেদিন চিঠিতে রাই অনেক দ্বিধার সাথে জানিয়েছিল ওর স্বপ্নে দেখা একটা স্পেশাল মুহূর্তের কথা, চিঠিতে বারবার ছিল ওর কুণ্ঠা, ওর ভয়, আমাকে হারানোর ভয়। তাই আমি মনে মনে ঠিক করেই রেখেছিলাম ওর স্বপ্নটাকে সত্যি করব বলে। এই চুম্বন, এই ঘনিষ্ঠতাই সেই জন্মদিনের স্পেশাল গিফট। কত কী মনে করে এদিনটাকে সাজিয়েছিলাম আমি। আজ ওর তৃপ্ত মুখ দেখে আমার মনে হয়েছিল এই মুহূর্তটা এখানেই থেমে যাক। ওই রাতে আমাদের আঙুলের বাঁধন নিঃশব্দে জানিয়েছিল যত ঝড় ঝাপটাই আসুক না কেন, সারাজীবনে আমাদের কেউ আলাদা করতে পারবে না।

সেদিন চিঠিতে রাই আরও একটা সংবাদ জানিয়েছিল। কর্নেল দত্ত তার লাডলি বেটির বিয়ের ঠিক করছেন। মাস্টার্সের পরেই ফাইনাল হবে। ‘আমার রাই’-এর বিয়ে! অতএব আরেকটা মিশন ইমপসিব্যল! সে রাতে রাইয়ের কাছ থেকে ছেলের বাড়ির নাম্বার নিয়ে একটা প্ল্যান ঠিক হল। ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে পরদিন আমি প্ল্যান মোতাবেক কাজে নেমে পড়লাম। কলেজের তিনজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে টানা দশদিন নানা উপায়ে ছেলের বাড়িতে ফোন করে উত্যক্ত করে মোটামুটি এটা বিশ্বাস করানো গেল যে রাই এখন মোটেই বিয়েতে রাজি না। বিয়ে তার প্রধান লক্ষ্য নয়। সে আগে কেরিয়ার বানাবে। স্বাধীনভাবে একটা চাকরি করবে তারপর নিজের পছন্দে বিয়ে করবে। প্রাথমিক ধাক্কাটা দুই বাড়ি সামলে উঠলে পরে বিয়ের আয়োজন পণ্ড হল। আমরাও ফিরে গেলাম চেনা ছন্দে।

এমনই ছিল আমাদের সম্পর্ক। প্রতিদিন দেখা হলেও কথা শেষ হত না, প্রতিদিন একসাথে বাড়ি ফিরতে ফিরতে মনে হত বাড়ির রাস্তাটা আর একটু দূরে হল না কেন? আমাদের কড়ে আঙুলে আঙুলে জড়াজড়ি বেঁধে থাকত। ‘বাই’ বলার আগে বলতাম, “কাল দেখা হচ্ছে তো? দেরি যেন না হয়।”

রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে বাথরুমের পাশে রাখা ফোনে একবার ঠিক প্রশ্ন হত— “আজ কী খেলে? আর আমার ভাগেরটা দেবে কখন?”

প্রতিটা সকাল রাইকে মনে করাত তার সাঁজ আজ তাড়াতাড়ি আসবে তার কাছে। রাই যদিও বলেনি, তবু সাঁজ জানে জন্মদিনের কার্ডের সঙ্গে পাঠানো ছোট্ট এম পি থ্রি প্লেয়ারে তার নিজের গলায় গাওয়া— “আপ কি মঞ্জিল হুঁ ম্যায়, মেরি মঞ্জিল আপ হ্যায়/ কিঁউ ম্যায় তুঁফা সে ডরু, মেরে সাহিল আপ হ্যায়।/ কোয়ি তুফানো সে কহে দে মিল গ্যয়া সাহিল মুঝে/ দিল কি অ্যায় ধড়কন ঠ্যেহর যা/ মিল গয়ি মঞ্জিল মুঝে/ আপ কি নজরোঁ নে সামঝা প্যার কে কাবিল মুঝে...” রাইকে সেই রাতে গভীর নিশ্চিন্তের ঘুম পাড়িয়েছিল।

একটা চিঠি

ডিয়ার লাভ,

তোমার দেওয়া ডায়রির পাতা থেকে তোমাকেই লিখছি। জানি না পাবে কিনা। জানি দীর্ঘ দীর্ঘ দিন আমাদের দেখা নেই। তুমি কি হিসেব করেছ? আমি করেছি। এখন বিকেল ৫টা। মানে টানা ২৮ দিন ১২ ঘণ্টা ১৫ মিনিট আমাদের কথা হয়নি। তুমি কি খুব রাগ করেছ আমার উপর? আচ্ছা, রাগ করলে কি এখনও তোমার কপালের মাঝে ঠিক তিনটে ভাঁজ জেগে ওঠে? কতদিন তোমার সেই ভাঁজগুলো স্পর্শ করিনি। রাস্তার পাশে ফোটা কৃষ্ণচূড়া দেখছি আর কলেজের সেই গাছটার কথা ভাবছি। আমাদের অপেক্ষায় কতদিন সে দাঁড়িয়ে আছে, রাই। অপেক্ষায় তো তুমিও আছ, আমি জানি। কিন্তু সেদিন বীণাদের বাড়িতে তোমাকে দেখেও এড়িয়ে যাওয়ার কারণ কি জানতে চেয়েছ তুমি?

কেন তোমার সাঁজ তোমার ওইরকম শুকনো চেহারা দেখেও চোখ নামিয়ে পালিয়ে গেল, জানতে চেয়েছ কারুর কাছে?
তুমি জানো না রাই, তোমার সাঁজ ভালো নেই। তাকে মামার বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছে মা। আমি কাল চলে যাচ্ছি রাই। আমাদের চিঠিগুলো, কার্ডগুলো আর গিফটগুলো মা-র জিম্মায়। রুনুর দোষ দেব না, বেচারি খেলতে খেলতে টেনে বের করেছিল ওগুলো। তারপর থেকে মা, মামা সবাই মিলে আমায় নজরবন্দি করে রেখেছে। ওরা সবাই তোমাকে যা-তা বলেছে, আমাদের ভালোবাসাকে অপমান করেছে। আমি চিৎকার করেছি, কিন্তু বন্ধ ঘরের বাইরে সে আওয়াজ যায়নি। তুমি শুনবে কী করে! কতবার লুকিয়ে টেলিফোনে হাত দিয়েছি, মা ছ্যাঁকা দিয়েছে হাতে। জানো, তবু সেই আঙুলটা এখনও পোড়েনি, যেটায় তোমার ঠোঁটের ছোঁয়া আছে। আজ চারদিন হল আমি বন্দি। বাইরে ওরা মিটিং করছে। সবাই আমার দিকে কেমন একটা চোখে তাকায়, এমনকী রুনুও! আমি জানি আমাদের কেউ মেনে নেবে না। কিন্তু তাই বলে আমি মামাবাড়ির এক অজ গ্রামে অন্য কাউকে বিয়ে করতেও পারব না রাই।

আমি শুনেছি মামা আর মা মিলে আমায় জোর করে বিয়ে দিয়ে দেবার প্ল্যান করেছে। কিন্তু আমি যে কথা দিয়েছি নিজের কাছে, সাঁজ শুধু রাইয়ের। তার কী হবে? এ ঘরের দেওয়ালগুলো যেন চেপে ধরতে আসছে আমায়, আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে খুব। একটু আগে মা বাজারে গেল, মামা গেছে টিকিট কাটতে। তাই চিঠি লিখছি। রুনুর নজর এড়িয়ে কোনোমতে দরজা খুলে আমি ডায়রির ভাঁজেই চিঠিটা রেখে দেব আমাদের চেনা সেই টবের নিচে। জানি না, তুমি সময় মতো পাবে কিনা হাতে! এই ডায়রি আমাদের ভালবাসার একমাত্র নীরব সাক্ষী। তাই তোমার কাছেই এটা নিরাপদে থাকবে জানি। আমার জীবনে কী হবে তার কণামাত্র ধারণা আমার নেই। যদি বেঁচে থাকি তবে এটুকু জেনো, আমি তোমার থাকব। আর যদি না থাকি, তবে তোমার কাছে এটা তো থাকল। তোমায় দেওয়ার মতো আজ সত্যিই কিছু নেই আমার কাছে। এত অসহায় কখনও লাগেনি আগে, জানো।

জানো, প্রতিদিনের মতো আজও একটাই কথা জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করছে, তুমি কি কাল আসবে, রাই? একদম সময় নেই আমার হাতে। কাল আমি পূর্বা এক্সপ্রেসে স্লিপার কোচে থাকব। সাথে থাকবে শুধু মামা। আমি জানি না কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমায়। কিন্তু তুমি যদি আসো, তবে আমরা কোনও একটা স্টেশানে নেমে হারিয়ে যাব, কেমন? আমরা একসাথে থাকব। যেভাবে হোক কিছু নিশ্চয় ব্যবস্থা করে নেব। তুমি সাথে থাকলে আমি কাউকে পরোয়া করি না। প্লিজ রাই, একটা তো মাত্র জীবন। যদি হারাতেই হয়, তবে চল একসাথে হারাই। হেরে তো যাব না, বলো! আমাদের যে অনেক কথা বলার আছে, অনেকটা জীবন বাঁচার আছে। 

কাল রাতে হঠাৎ আবিষ্কার করলাম জানো, সাঁজ তো এখনও রাইকে বলেইনি— “ভালোবাসি”। রাইয়ের মুখ থেকেও তো শোনা হয়নি “লাভ ইউ সাঁজ”। কত সহজে একথা বলা যেত, তবু আমরা বলিনি। বিশ্বাসে বিশ্বাস জড়িয়ে যে আঙুল ধরেছিলাম, জানতাম তার কোনও সাবটাইটেল লাগে না। কিন্তু আজ যখন তোমার বাড়ি থেকে, পাড়া থেকে, তোমার ছোঁয়া থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছি, তখন যে বড় বলতে ইচ্ছে করছে...ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি। বড় ইচ্ছে করছে তোমার মুখে থেকেও একই কথা শুনতে। কাল তবে এসো, এই রংচঙে মিথ্যে কথার শহরে আমাদের সাদা কালো সাধারণ জীবন ডাকছে। তুমি আসবে তো?

তোমার সাঁজ বিশ্বাস করে তুমি নিশ্চয় আসবে! আর আমি জানি, রাই তার সাঁজের বিশ্বাস কখনও ভাঙবে না। আমি প্রতীক্ষায় থাকলাম। ও হ্যাঁ, তোমার দেওয়া পার্পল ড্রেসেই তুমি কাল পাবে আমায়।
- তোমার সাঁজ।


৮ মার্চ, ২০১৯
রাত ৯টা
স্থান - লাইফলাইন হসপিটাল, পাটনা।

আমি এই হসপিটালের এক সামান্য ওয়ার্ড বয়। ১২ নাম্বার কেবিনের দায়িত্বে আছি। ঘণ্টাচারেক হল, মুখোমুখি বসে আছি মিসেস রত্না গুপ্তার সঙ্গে। সামনে খোলা এই ডায়রি ও চিঠি। মিসেস গুপ্তা ‘সেকেন্ড ইনিংস’ নামের এক NGO–র সেক্রেটারি। দুদিন থেকে উনিও এখানেই। আমাদের ক্রিটিকাল ইউনিটের ১২ নাম্বার কেবিনে আজ প্রায় দু-মাস হল ‘মিস দত্ত’ নামের পেশেন্ট ভর্তি, সেরিব্রাল অ্যাটাকে হেমিপ্লেজিয়ায় আক্রান্ত। তিনি মিসেস গুপ্তারই পেশেণ্ট। এটা তাঁর ডায়রি। মিসেস গুপ্তার কাছে ডায়রির এতটা পাতা শোনার পর আমার বুঝতে অসুবিধা হয় না যে ‘মিস দত্ত’ আসলে কে। উনি যখন চিঠি পড়া শেষ করলেন তখন আমি স্থাণুবৎ বসে রইলাম। অজস্র প্রশ্ন আমায় ঘিরে ধরেছে। কিন্তু কথা সরছে না। জানিও না কখন ঝাপসা হয়ে গেছে দৃষ্টি। কোনোক্রমে শুধু জিজ্ঞাসা করলাম, “তারপর, রাইকিশোরীর কী হল? আপনি কীভাবে পেলেন ওনাকে, এভাবে?”

মিসেস গুপ্তার কাছে জানা গেল, সাঁজের ডায়রি ও চিঠি রাইয়ের হাতে আসে দুদিন বাদে। এই দীর্ঘদিনের ব্যবধানে রাইয়ের ওপরও কম ঝড় যায়নি। তার বিয়ে ভাঙার প্ল্যান থেকে সাঁজের সাথে তার সম্পর্ক সবটাই জেনে ফেলেন কর্নেল দত্ত। মেয়েকে বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় মন দেন তিনি। বাড়ির পরিবেশ হয়ে ওঠে গুরুগম্ভীর। সাঁজের চলে যাওয়ার দুদিন বাদে বাজার যাওয়ার পথে রাই জানতে পারে সাঁজ নেই। কী মনে করে তাদের চেনা সেই টব সরাতেই হাতে আসে এই দুই স্মৃতিচিহ্ন। সেই রাতেই সে মনস্থির করে এখানে থাকবে না আর।

একসময় বাবাকে জানায়, সে পণ্ডিচেরী ইউনিভার্সিটির অফারটা গ্রহণ করবে। বেশ কিছুদিন আগে সে সোশাল ওয়ার্কের উপর রিসার্চের জন্য নানা ইউনিভার্সিটিতে আবেদন জানিয়েছিল। তার কোয়ালিফিকেশান অনুযায়ী দুটো ইউনিভার্সিটি তাকে ডেকে পাঠায়। পণ্ডিচেরীর পি এইচ ডি অফারটা বেশ লোভনীয়। কর্নেল দত্ত তাতে রাজি হন এবং রাই এক নতুন জীবনের উদ্দেশ্যে ঘর ছাড়ে।

পণ্ডিচেরীতে পড়াকালীন মিসেস গুপ্তার সাথে রাইয়ের পরিচয়। নানা ধরনের সামাজিক কাজে তারা ডুবে যায় ‘সেকেন্ড ইনিংসে’র হাত ধরে। তার স্কলারশিপের টাকা এবং ‘সেকেন্ড ইনিংস’-এর চাকরি— এই দুই নিয়েই রাই থেকে যায় নিজের মতো। সে আর বাড়ি ফেরেনি। ‘সেকেন্ড ইনিংস’-এর যেখানে যেখানে ক্যাম্পেইন হয়েছে, রাই সেখানেই খুঁজে বেরিয়েছে তার সাঁজকে। রিসার্চের ছাড়পত্রের বাড়তি সুবিধা নিয়ে সে নানা অকুস্থলে ঢুকে পড়েছে— কখনও নোংরা বস্তিতে, কখনও রিলিফ ক্যাম্পে, এমনকী রেড লাইট এরিয়াতে যেতেও সে ছাড়েনি। মিসেস গুপ্ত বড় স্নেহ করেন রাইকে। তার গল্পের আগাগোড়া তিনি জানেন। তাই তিনিও ভারতের সব সম্ভাব্য স্থানে সাঁজের খোঁজ চালু রাখেন।

কেটে যায় দীর্ঘ পনেরোটা বছর। কিন্তু আজো সাঁজের খোঁজ মেলেনি।

দু’মাস আগে এমনই এক কাজে বেরিয়ে হঠাৎ পাটনা স্টেশানে সেরিব্রাল অ্যাটাক হয় রাইয়ের। তখন তাদের পুরো দল এখানেই স্লাম এরিয়ায় কাজ করছিল। তাই মিসেস গুপ্তই এই হসপিটালে নিজের দায়িত্বে ভর্তি করেন রাইকিশোরী দত্তকে। দলের বাকিরা কাজ শেষে ফিরে গেছে। কিন্তু তিনি রয়ে গেছেন রাইয়ের পাশে, আর থেকে গেছে এই ডায়রি ও চিঠি।

ভোর হয়ে আসছে। সামনে টেবিলের উপর বেশ ক-টা কফি কাপ জমে আছে।

“একটু টয়লেট হয়ে আসছি”— চেয়ার ছেড়ে মিসেস গুপ্তা উঠে দাঁড়াতেই কী একটা যেন সেই ডায়রি থেকে খসে পড়ল। উনি খেয়াল করলেন না, তবে আমি তুলে দেখি একটা পুরনো ছবি। সালোয়ার কামিজ পরা ফুটফুটে বছর কুড়ির এক তরুণী।

ছবিটা দেখে চমকে উঠলাম, এ মুখ তো আমার বেশ চেনা লাগছে। কিন্তু ভালো করে খুঁটিয়ে দেখেও কিছুতেই মনে করতে পারলাম না, কার ছবি।

আকাশ একটু ফরসা হতেই ডিউটি অফ করে আমি বাড়ি ফিরে পুরনো ট্রাঙ্কটা খুললাম। একেবারে তলার পুরোনো অ্যালবাম খুলে একটু খুঁজতেই পেয়ে গেলাম তাকে। অবিকল সেই চেহারা। এ তো আমাদের বাদশার বোন! গ্রামের মেলায় একবার তুলেছিলাম গ্রুপফটো। এই নীল জামার মেয়েটাই তাহলে সাজিয়া হাসান! পুরো নাম তো আমি জানতাম না। কিন্তু আমাদের গ্রামে ওর মামাবাড়ি থাকার সুবাদে বেশ ক-বার ও এসেছে। গ্রাম ছেড়ে পাটনায় চলে আসার পর অনেক বছর আর বাদশাদের সঙ্গে কোনও সাক্ষাত নেই আমার। তবে মনে আছে ওর বোন ছুটকি ওরফে সাজিয়াকে শেষ দেখেছি দু-বছর আগে, মধুপুরে। একটা মেডিক্যাল ক্যাম্প নিয়ে আমরা গিয়েছিলাম ডেঙ্গু আক্রান্ত এলাকায়। তখন আমাদের ছুটকিকে দেখি একটা অনাথ আশ্রমে গানের দিদিমণি হয়েছে। এই তবে রাইয়ের সাঁজ? হাতের ছবিটা ধরে মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিলাম। আজকের ট্রেনেই মধুপুর যেতে হবে।

গত দুদিন কাজের চাপে আমার চোখে ঘুম নেই। ডায়রিটা পড়ে আরও জ্বলছে চোখ। ট্রেনের খোলা জানলা দিয়ে হু হু হাওয়ায় কখন কে জানে তন্দ্রা এসে গিয়েছিল।

“লিট্টি-চোখা লে লো রে”— হকারের তুমুল চিৎকারে জেগে উঠে দেখি মধুপুর এসে গেছে। আজকের দিনটা এতটা ক্লান্তি দিয়ে শুরু হয়েছিল, কিন্তু যখন তাকে খুঁজে পেলাম তখন শরীর মনের সমস্ত ক্লান্তির মেঘ কেটে গেল। মধুপুর শহর থেকে অনেকটা দূরে এক অনাথ আশ্রমে সাজিয়া এখন গানের দিদিমণি— তার জীবনের সেকেন্ড ইনিংস চলছে এভাবেই। তবু ডায়রির পাতায় জলছবি হয়ে থাকা কলেজপড়ুয়া সাঁজকে চিনতে ভুল হয় না মোটে।

পরিচয় দেওয়ার পর অনেক কষ্টে আমায় চিনতে পারলেও আমার এখানে আসার কারণ শুনে কিছুতেই বিশ্বাস করেনি সে। শেষে সারা দুপুর আশ্রমের ফাদারের ঘরে বসে অনেক বুঝিয়ে, ভরসা দিয়ে তবে ছাড়পত্র পেলাম সাঁজকে এই হসপিটালে আনার। তাকে একজনের যে খুব দরকার।

লাইফ লাইন হসপিটালের ১২ নাম্বার কেবিনে একটা মানুষ জেগে আছে। শরীরের অর্ধেক অবশ, তবু সজাগ মস্তিষ্কে, চোখভরা প্রতীক্ষায় সে শুয়ে আছে। কেউ না জানুক আমি জানি এই প্রতীক্ষা কার।

আমি সামান্য ওয়ার্ড বয়, ক্ষুদ্র বুদ্ধি আর হৃদয়ের কথা শুনে যেটুকু পেরেছি করেছি। বাকিটা সাঁজ করে দেবে জানি। মিসেস গুপ্তার কাল থেকে ছুটি, ছুটি হয়তো আমারও। এতদিনের অনুসন্ধান আজ শেষ হল। শেষ হল দুটো মানুষের অন্তহীন অপেক্ষাও। মনটা খুব হালকা লাগছে আজ।

রাত দুটো।

এই গল্প যখন লিখছি তখন সারা হাসপাতাল ঘুমন্ত পুরী। শুধু ওপাশের কেবিনে জেগে আছে একজন। উঁহু দুজন। সাঁজের রাই আর রাইয়ের সাঁজ।

আমি নিশ্চিত রাইয়ের শরীর প্যারালাইজড হলেও, তার দৃষ্টি আজ আর বোবা নেই। কারণ তার কানে এখন সাঁজের সুর “পড় গ্যয়ি দিল পর মেরে আপকি পরছাঁইয়া/ হরতরফ বাজনে লাগি স্যায়কাঁড়ো শেহনাইয়া/ দো জাঁহা কি আজ খুঁশিয়া হো গয়ি হাসিল মুঝে/ আপ কি নজরোঁ নে সামঝা প্যার কে কাবিল মুঝে...”

শুধু ১২ নাম্বার কেবিনেই নয়, আমি টের পেলাম, গোটা ওয়ার্ড ভেসে যাচ্ছে এই মায়াবী সুরে। বাইরে তখন বৃষ্টি নেমেছে ঝেঁপে।


• পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

menu
menu