ক্ষিতিমোহন সেনের প্রাচীন ভারতে নারী : নারীর দ্বিধান্বিত গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য

তব স্বরূপা রমণী জগত্যাচ্ছন্নবিগ্রহা।
(মহানির্বাণ ১০.৮০)
পুরুষ ও নারী একই পরমপুরুষের দুই ভাগ। এককে বাদ দিয়া অন্যে অসম্পূর্ণ। যে সমাজ নারীকে জ্ঞানহীন করিয়া শুধু পুরুষকেই শক্তিশালী করিতে চায় বা পুরুষকে পঙ্গু করিয়া কেবল নারীকেই প্রবল করিতে চায় তাহারা পরমপুরুষের এক অর্ধেক পক্ষঘাতগ্রস্ত করিয়া তাঁহার অংশমাত্র লইয়া অগ্রসর হইতে চাহে। শাস্ত্রে আছে, রথের দুই চাকা, তাদের একটিকে বাদ দিয়া আর-একটিমাত্র চাকা লইয়া রথ চলিতে পারে না—
…
মহাভারতের যুগেও নারীদের এই সম্মানের কথা দেখিতে পাই।
…
নরনারী উভয়ের প্রাণশক্তিতেই ভারতের সাধনা দিনে-দিনে অগ্রসর হইতেছিল। যেদিন হইতে নারীর সাধনাকে পঙ্গু করিয়া ভারতীয় সাধনা পক্ষঘাতগ্রস্ত হইল সেইদিন হইতে ভারতের সাধনার ইতিহাস নানা শোচনীয় দুর্গতিতে ভরিয়া উঠিল।
কথাগুলো বহুভাষাবিধ শাস্ত্রজ্ঞ, গবেষক, সংগ্রাহক, শিক্ষক ক্ষিতিমোহন সেন (১৮৮০-১৯৬০)-এর। তাঁর প্রাচীন ভারতে নারী (১৩৫৭ বঙ্গাব্দ) গ্রন্থে ভারতীয় সমাজে আদিকালে নারীর যে উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল সে বিষয়ে তথ্যভিত্তিক আলোচনা আছে। বিষয়টি খুবই সুখকর। এই গ্রন্থ সম্পর্কে সম্পাদক প্রফেসর ড. সরিফা সালোয়া ডিনা ‘সম্পাদকের কথা’ অংশে বলেন :
জ্ঞানচর্চায় সন্ত নারী সমাজ-বিকাশে অবদান রাখেন প্রাচীন ভারতেই। ঘোষা, বিশ্ববারা, অপালা, অদিতি, লোপামুদ্রা, গার্গী, আত্রেয়ী, অরুন্ধতী প্রমুখ বিদুষী নারীর নাম উচ্চারণ করা যায় বৈদিক যুগের আদর্শিক ভাবধারা অনুযায়ী। সুতরাং নারী অপাঙ্ক্তেয় নয়, তার ছিল গৌরবের ইতিহাস। সেই ইতিহাস পুনরুদ্ধারের সফল চেষ্টা ক্ষিতিমোহন সেনের ‘প্রাচীন ভারতে নারী’ গ্রন্থটি।
গ্রন্থটি ১২টি অংশে বিভক্ত। অংশগুলোর শিরোনাম : ‘আদর্শ ও অধিকার’, সামাজিক অবস্থা (বিবাহ, বিবাহ-অনুষ্ঠান, সম্পত্তির অধিকার)’, ‘নারীদের স্থান’, ‘বিবাহবন্ধন’, ‘নারীর বিশুদ্ধি’, বিবাহবন্ধন-ছেদনে শাস্ত্রবিধি, ‘বিবাহবন্ধন-ছেদনে রাজবিধি’, ‘নানা সংস্কৃতির মিলন’, ‘স্ত্রীধন’, ‘দায়াধিকার’, ‘বরদরাজ-কৃত ব্যবহারনির্ণয় ও নারীদের অধিকার’ এবং ‘নারীদের উত্তরাধিকার বিষয়ে ব্যবহারনির্ণয়’।
ক্ষিতিমোহন সেন ইতিহাস ও পুরাণের আলোকে প্রাচীন ভারতে নারীদের অবস্থাকে উপস্থাপন করেছেন। তিনি খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে রচিত উপনিষদ-এর বা বৈদিক সাহিত্যের উদাহরণ দিয়েছেন, দিয়েছেন আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব চারশো বছর পূর্বে রচিত রামায়ণ ও সাড়ে তিনশো বছর পূর্বে রচিত মহাভারত-এর উদাহরণ। এছাড়া স্মৃতি চন্দ্রিকা, বৃহদারণ্যক, অথর্ববেদ, তৈত্তিরীয়-আরণ্যক এবং শুক্ল যজুর্বেদ, দেবণ্ন ভট্ট, মনু, হারীত প্রমুখ শাস্ত্রকারদের নারীবিষয়ক বিভিন্ন বক্তব্য লেখায় উপস্থাপন করেছেন। আর আছে খ্রিষ্টপূর্ব ৩২১-৩০০ অব্দের মধ্যে লেখা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সমকালীন কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র-এর প্রসঙ্গ। প্রাচীন ভারতে নারীর অবস্থা ছিল গৌরবময় ও সুসংস্কৃত। এই প্রাচীনকাল বলতে লেখক বুঝিয়েছেন খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০০ বছর পূর্বের সময়কে। ভারতবর্ষে আর্যরা প্রাচীন জাতি হিসেবে পরিচিত হলেও তাদের আগে সিন্ধু-সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া যায়। সম্পাদক বলেন :
দ্রাবিড়গণ সিন্ধু-সভ্যতার পূর্বেই নিজেদের অস্তিত্ব সমৃদ্ধ করেছিল। দ্রাবিড়গণ শিল্প-বাণিজ্যে সমৃদ্ধ ছিল। তারা সমুদ্রপথে বাণিজ্য করত। দ্রাবিড়দের দেবালয় ছিল। তারা মাতৃদেবীর আরাধনা করত। দক্ষিণ ভারতের তামিল, তেলেগু, কানাড়ি, মালায়লাম প্রভৃতি ভাষাভাষীগোষ্ঠী দ্রাবিড় জাতির পরিচয় বহন করে চলেছে আজও। সিন্ধু সভ্যতার আত্মপ্রকাশ আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩০০ অব্দ হলে দ্রাবিড় সভ্যতা তারও আগে বর্তমান ছিল।
এই দ্রাবিড় যুগে নারীরা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারত। প্রায় সব কাজে তাদের অংশগ্রহণ করার সুযোগ ছিল। বলা যায় এই সামাজে নারীর ভূমিকা মুখ্য ছিল। কিন্তু আর্য সমাজে যেটাকে বৈদিক যুগ বলা যায় সেখানে নারীর অধিকার সংকুচিত হতে থাকে। এর কারণ হিসেবে ক্ষিতিমোহন সেন বলেন :
…সন্ততিলাভের জন্য বাধ্য হইয়া আর্যগণ শূদ্রকন্যাদের বিবাহ করিতেন। কন্যা কম ছিল বলিয়াই হউক, বা শীঘ্র শীঘ্র বংশবিস্তার করিবার জন্যই হউক, আর্যগণের মধ্যে শূদ্রকন্যাকে বিবাহ করার প্রথা বিলক্ষণ প্রচলিত হইল। তাই যেসব অধিকার আর্যকন্যাগণ পাইতেন সেইসব অধিকার পরে শূদ্রকন্যাদের হয়তো দেওয়া হইত না। ক্রমে এইসব কারণে ভারতে নারীদেরই অধিকার কমিয়া আসিতে লাগিল। এখন তো ব্রাহ্মণকন্যা ব্রাহ্মণের পত্নী হইয়াও শূদ্রারই সমতূল্যা। বেদাদিতে তাঁহাদের অধিকার নাই। বলা বাহুল্য, পূর্বকালে এইসব শূদ্রকন্যার গর্ভে ব্রাহ্মণের পুত্রেরা ব্রাহ্মণই হইতেন।
তাহলে বিষয়টা একদিক থেকে দেখলে শ্রেণিদ্বন্দ্বের। আগস্ট বেবেল যে বলেন নারী ও সর্বহারাদের মধ্যে মিল রয়েছে, সিমোনো দ্য বোভেয়ার যে বলেন নারী সমাজের দ্বিতীয় লিঙ্গ বা অপর—এই বিষয়গুলোই একটু ভিন্নরূপে এখানে দেখা যায়। অর্থাৎ সমাজের নিম্নবর্ণের মানুষেরা চিরকালই অবহেলিত। সেই নিম্নবর্ণের তথা শূদ্রদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ল নারীরা। আর পুরুষ নিজের প্রয়োজনে ক্রমান্বয়ে নারীকে সেই স্তরে নামিয়ে আনলো কিংবা বলা যায় নারীর অবস্থানকে নিচে ঠেলে দিল। এটাও শোষণের একটা প্রক্রিয়া। আমরা সভ্য হয়েছি বাইরে থেকেই। ভেতরের বর্বরতাকে পরিহার করতে পারিনি। এমনকি সভ্য হয়ে আরও কৌশলী হয়েছি নিজের আধিপত্য বিস্তারে। আর এই মনোভাবই নারীকে আজ আলো ঝলমলে পৃথিবীতে ‘অপর’ করে রেখেছে। অথচ ঋগ্বেদে নববধূকে আশীর্বাদ করা হয়েছে এই বলে :
সম্রাজ্ঞী শ্বশুরে ভর সম্রাজ্ঞী ভব।
ননান্দরি সম্রাজ্ঞী সম্রাজ্ঞী অধি দেবৃষু \ ঋগ্বেদ ১০.৮৫.৪৬
এবং সম্রাজ্ঞী হওয়ার উপায়ও বলা হয়েছে। অর্থাৎ এটা স্পষ্ট নারীকে শিক্ষা অর্জনের জন্য সমাজ পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। মহাভারত-এ এও বলা হয় :
নারীগণ পূজনীয়া, মহাভাগা, পুণ্যা ও সংসারের দীপ্তিস্বরূপা। তাঁহারাই সংসারের শ্রী, তাই যত্নপূর্বক তাঁহারা রক্ষণীয়া—
…
কেহ কেহ বলিবেন, নারীদের প্রতি এইসব কথা ভাবুকতা মাত্র। আসলে নারীরা দাসী মাত্র। কিন্তু তাঁহাদের মনে রাখা উচিত, তাহা হইলে তাঁহারাই হইলেন দাসীপুত্র। সংষ্কৃতে ইহার চেয়ে ঘৃণ্য গালি আর নাই। সংস্কৃত নাটকগুলিতে অতি ইতরজনের প্রতি ইতরজনোজিত চরম গালাগালি হইল ‘দাস্যাঃ পুত্রঃ’।
লেখক যথার্থই বলেছেন। নারীকে যারা দাসী বলে তারা তাহলে দাসীপুত্র। একটু বিবেকবান হলেই পুরুষতন্ত্র এমন হীন চিন্তা থেকে সরে আসত। নারীকে নিয়ম আর রীতির অদৃশ্য কারাগারে বন্দী করে রেখে নিজেদের পৌরুষত্ব প্রকাশ করে তারা। অথচ প্রাচীন ভারতে নারীরা ব্রহ্মচর্য পালন করতো, উপনয়ন হতো, মন্ত্রপাঠে, হোমে, আহুতিতে স্ত্রী সমানভাবে স্বামীর সঙ্গে যোগ দিতে পারত। থেরীগাথা গ্রন্থে আছে জৈন ও বৌদ্ধ সাধনায় নারী তপস্যায় উচ্চতম সিদ্ধি অর্জন করেছে। আর ঋগ্বেদ-এ দেখা যায় বহু নারী মন্ত্র রচনা করেছে। অথচ ভাগ্যের কী নিষ্ঠুর পরিহাস! আজ নারীর রচনা করা বেদেই নারীর অধিকার নেই। সিমোন দ্য বোভেয়ার তাঁর দ্য সেকেন্ড সেক্স গ্রন্থে দেখিয়েছেন খ্রিষ্টান ধর্মের জন্য নারীর আত্মাহুতি অথচ সেই ধর্ম নারীর প্রতি করেছে অবিচার। পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে গড়পরতা নারীর অবস্থা একইরকম।
তবে প্রাচীন ভারতে নারীর উজ্জ্বল উপস্থিতির কথা উল্লেখ করে লেখক বলেন :
নারীগণ জ্ঞানে ধর্মে ও তপস্যায় অধিকারিণী ছিলেন বলিয়া যে সংসারের কাজে তাঁহারা মনোযোগ দিতেন না তাহাও নয়। দ্রৌপদী ধর্মজ্ঞা ও ধর্মদর্শিনী ছিলেন (মহাভারত, শান্তিপর্ব, ১৪-৪)। নীতিশাস্ত্রেও তাঁহার গভীর জ্ঞান ছিল।
মধ্যযুগের সাধক-সন্তদের মধ্যেও অনেক নারী ছিলেন। ক্ষেমা পদ্মাবতী দাদুর কন্যা নানীবাঈ ও মাতাবাঈ সাধনার রাজ্যে প্রখ্যাত। ভক্তিমতি করমা ও মীরাবাঈর কথা তো সর্বজনবিদিত।
কিন্তু এরপরেও ছোট্ট একটা কথা থেকে যায়। ধর্মজ্ঞা দ্রৌপদীকেও অপমানিত হতে হয়েছিল। সেদিন হস্তিনাপুরের রাজসভা দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ পালা দেখে আমোদিত হয়েছিল। পাশাখেলায় হেরে যায় যুধিষ্ঠির। আর এই খেলায় বাজি রেখেছিল স্ত্রী দ্রৌপদীকে। হয়তো এটা তৎকালীন সমাজের রীতি ছিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সেই রীতিতেও নারীকেই বলি হতে হবে কেন? তারপরেও বর্তমানকালের চেয়ে সেই আদিম সমাজ নারীর অনেক অনুকূলে ছিল। সে চাইলে বিদ্যাশিক্ষা থেকে শুরু করে পাত্র নির্বাচন পর্যন্ত করতে পারত। আরেকটি বিষয় আমাদের বিস্ময়ের উদ্রেক করে। লেখক বলেন :
…তখনকার দিনে নারীরা ধর্ষিতা হইলে এখনকার নারীদের মতো সমাজে পরিত্যক্তা হইতেন না। ধর্ষণকারী পুরুষই অপরাধী বলিয়া গণ্য হইত। ইহাই মহাভারতের যুক্তিসংগত মত—
এবং স্ত্রী নাপরাধ্নোতি নর এবাপরাধ্যতি।
নাপরাধোহস্তি নারীণাং এর এবাপরাধ্যতি \ শান্তি ২৬৫.৩৮
আজকের আধুনিক সমাজে এর বিপরীত চিত্র দেখা যায়। তাহলে আদৌ কি আমরা এগিয়েছি নাকি আলোর নামে এক চির অন্ধকারেই আমাদের চলছে নিত্য বসবাস?
যা-ই হোক, ক্ষিতিমোহন সেন অনেক বিদুষী নারীদের প্রসঙ্গ এনেছেন। তাঁর মতে ‘থেরীগাথায় বহু নারীর নানা বিষয়ে গভীর সাধনা ও বিদ্যার পরিচয় মেলে।’ যেমন : বৌদ্ধযুগের সংঘমিত্তা হেমা, অগ্গিমিত্তা ত্রিবিধবিজ্ঞা-পারদর্শিনী ছিলেন। সীবলা ও মহারুহা বিনয় সুত্তপিটক ও অভিধান পড়াতেন। অঞ্জলি শাস্ত্র ও দৈবশক্তির অধিকারিণী ছিলেন। খ্রিষ্টীয় ১১৮৩ সালে কাকতীয় রাজকন্যা রুদ্রদেবী প্রবল প্রতাপে রাজ্য শাসন করতেন এবং জ্ঞান ও কলার দিকেও তাঁর দৃষ্টি ছিল। এর এক শতাব্দী পরের মানুষ গঙ্গাদেবী। যিনি জ্ঞানে ও কাব্যরচনায় বিখ্যাত ছিলেন। তাঞ্জোরপতি রঘুনাথভুপের সভাকবি স্ত্রীকবি মধুরবাণী। মালাবারের প্রধান সাতকবির চারজনই নারী। লীলাবতী, খনা, বিশ্বাসদেবী, চাঁদবিবি, ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ, হঠী বিদ্যালংকার—এমন বহু প্রজ্ঞাবান নারীর কথা ইতিহাসে, পুরাণে লেখা আছে। তবে যেটা বলার এই সকল নারীরা বেশিরভাগই ছিলেন সমাজের উঁচুতলার। এখানে এটা প্রতীয়মান হয় সমাজের উচ্চবর্ণের এবং সচ্ছল অর্থনৈতিক অবস্থার ব্যক্তিগণের মধ্যে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধের ব্যাপারটি প্রচলিত ছিল। যা পরিশীলিত মননের একটা জাতিকে নির্দেশ করে। লেখক আরেকটি বিষয় সামনে এনেছেন :
ভীমসিংহপত্নী পদ্মিনীর বীরত্ব আর-এক রকমের। এই সব মহীয়সী মহিলা যেভাবে প্রাণ দিয়াছেন তেমন করিয়া প্রাণ দিতে বীরপুরুষরাও পারেন নাই। স্বামীর সঙ্গে অনুমৃতা সতীদের আত্মত্যাগের মধ্যে যে শান্ত বীরত্ব আছে তাহার মহত্ত্ব কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিয়াছেন।
সহমরণ প্রথা আর্যেতর জাতির মধ্যে প্রচলিত ছিল। খ্রিষ্টের জন্মের তিন/চারশো বছর পূর্বে পঞ্চনদ প্রদেশের তক্ষশিলাদি ভূভাগে যেখানে গ্রিকদের প্রভাব খুব বেশি ছিল সেখানে সতীদাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ যে শান্ত বীরত্ব ভাব দেখেছেন সেটা শ্রদ্ধার চোখে দেখা। কিন্তু বাস্তবতা কি এটা বলে? স্বামীর সঙ্গে অনুমৃতা যারা হয়েছেন বা হন কতটা ত্যাগ থেকে আর কতটা প্রথার বলি হয়ে সেটা ভেবে দেখবার বিষয় অবশ্যই। যদি ত্যাগের প্রশ্নই ওঠে তবে স্বামীও তো স্ত্রীর সঙ্গে চিতায় আরোহন করতে পারত। কিন্তু এমন উদাহরণ বা প্রথা তো দেখা যায় না। তাহলে ত্যাগের পরীক্ষা কেবল নারীকেই দিতে হবে? দিয়ে মহান হওয়ার উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে? এখানেও কি পুরুষের এক ধরনের আধিপত্যবাদী মনোভাব মিশে নেই?
দ্রাবিড় সমাজের মেয়েরা স্বাধীন জীবন যাপন করত। কখনো সেটা শৃঙ্খলার পরিপন্থীও হয়ে যেত। লেখক বলেন সৃষ্টিলগ্নে পৃথিবী যেমন অগ্নিময় ছিল পরে শীতল হয় ঠিক তেমন সমাজেও শৃঙ্খলা ফিরে আসে। কিন্তু এই শৃঙ্খলা কেবল নারীর জীবনকেই শৃঙ্খলিত করেছে কেন? পুরুষের স্বেচ্ছাচার অতি সভ্য আধুনিক সমাজেও বিরাজমান। মহর্ষি উদ্দালকপুত্র শ্বেতকেতু বিবাহ প্রথার প্রচলন করে নারী-পুরুষের যৌনজীবনকে নিয়মের মধ্যে আনেন। যদিও সনাতন প্রথায় বিয়ের ব্যাপারটি ছিল না। বিবাহ প্রথা নারীর যৌনজীবনকে যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করে পুরুষের কি সেভাবে করে? আদিভারতীয় সমাজে নারী ও পুরুষের বহুগমনকে নেতির চোখে দেখা হতো না। কিন্তু আধুনিক সমাজে পুরুষের জায়গাটা একইরকম রইল। কেবল নারীকেই সতীত্ব রক্ষার মহান দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে সমাজে শৃঙ্খলা রক্ষার রক্ষক হতে হলো। এভাবে ক্রমান্বয়ে খর্ব হতে লাগল নারীর স্বাধীনভাবে বিচরণের অধিকার। অথচ বৈদিক সমাজেও নারীরা সহজ, স্বাধীন জীবন যাপন করতে পারত, যজ্ঞে দেখা দিতে পারত, শিক্ষার অধিকার ছিল। ফলে তারা নিজেদের যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে সমাজে সম্মান ও শ্রদ্ধা আদায় করে নিতে পারত সহজেই। আর এই অধিকারটুকু পেতে আজকের নারী কী লড়াইটাই না করে!
প্রাচীন ভারতীয় সমাজে ‘স্ত্রীধন’ বলে একটা ব্যাপার ছিল। অর্থাৎ নারীর সম্পত্তিতে কিছুটা অধিকার ছিল। তবে এটা নিয়ে প্রচুর স্ববিরোধ মতবাদ রয়েছে। মনুর সিদ্ধান্ত ছিল পুত্রের চারভাগের এক ভাগ কন্যা পাবে পিতার সম্পত্তির। এটা যাজ্ঞবল্ক্যেরও মত। এই স্ত্রীধন আবার স্বামী ক্ষেত্রবিশেষে ব্যবহার করার অধিকারও রাখেন। যা-ই হোক, এই সম্পত্তির সামান্য অধিকার আজ অবধি বিদ্যমান। এর মধ্যে এক অর্থে লুকিয়ে আছে নারীকে পরনির্ভরশীল করার প্রবণতা। মনু বলেন, ‘আত্মার সমান পুত্র, পুত্রের সমান কন্যা।’ বলেন না—আত্মার সমান পুত্র ও কন্যা। ফাঁকটা এখানেই। বোধের এই ব্যাপারটি সমাজে বলা যায় সৃষ্টির আদিলগ্ন থেকেই চলে আসছে। কোনো-না-কোনোভাবে নারী বঞ্চিত হচ্ছে। লেখক বলেন:
মনু বলিলেন, যে গৃহে নারীরা সুখী সে গৃহে দেবতারা প্রসন্ন; স্ত্রীদের তিনি ‘রত্ন’ও বলিলেন (২.২৩৮), স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে প্রীতি থাকিলেও কল্যাণ (৩.৬০)। তথাপি তিনি সামাজিকভাবে (২.২৩৮) স্বামী ও স্ত্রীর অধিকারে সমতা দিতে রাজি ছিলেন না (৫.১৪৭-১৪৯; ৯.৩ ইত্যাদি)।
এভাবে নারীর অধিকার, অবস্থা, মর্যাদাকে খর্ব করা হয়েছে। বোধায়ণধর্মসূত্র মতে, ‘নারী পিতা স্বামী বা পুত্রের অধীনে থাকিবে, স্বাধীনতা পাইবে না। তাহারা শক্তিহীনা…।’ তবে এই শক্তিহীনা নারীরা প্রাচীন ভারতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেশ স্বাধীনতা ভোগ করত। ন্যায়শাস্ত্রে পণ্ডিত বরদাজ-এর ব্যবহারনির্ণয়-এ এমনকিছু প্রসঙ্গ এসেছে। পূর্বে নারীরা অবীর্যবান স্বামী পরিত্যাগ করার অধিকার রাখত। দ্বিতীয় বিয়ের অধিকারও ছিল। ‘দাসী ক্রীতদাসী বা বেশ্যারও ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাহাতে গমন করিলে পুরুষ দণ্ডনীয় (ব্যবহারনির্ণয়, পৃ. ৪০৩)।’ অন্তত এই ক্ষেত্রে প্রাচীন ভারতীয় সমাজের প্রাচীনত্ব আধুনিকত্বকে দাবি করতেই পারে। কেননা আজকের সমাজেও নারীকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। দণ্ডবিধি আছে কিন্তু তার প্রয়োগ ঘটাতে গেলে আস্ত একটা মহাভারত তৈরি হয়ে যায়।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র-এ বলা হয়েছে ‘পুত্রার্থে হি স্ত্রিয়ঃ’। পৃথিবীতে এভাবেই নারীকে ব্যবহার করা হয়েছে। ইউরোপের সমাজেও সন্তান জন্মদানকে স্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে বিশ্বাস করা হতো। নারীর মাতৃরূপের প্রশংসা করে নারীকে গার্হস্থ্যজীবনে শৃঙ্খলিত করার প্রয়াসে সফল হয়েছে পুরুষতন্ত্র। যোগতত্ত্ব উপনিষদ-এ বলা হয়েছে, ‘এই নারীরাই একদিকে প্রেয়সী-ভার্যা, অন্য দিকে তিনিই কল্যাণময়ী মাতৃস্বরূপা—’। মাতৃরূপে নারী তার মর্ষকামিতার চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। আর নারীর এই অসীম নিষ্ঠা ও ত্যাগকে সমাজ দুর্বলতা ভাবে। যদি এটাকে সম্মান দেখাতো তাহলে নারীর প্রতি সকল অবমাননার অবসান ঘটত। ঐতরেয়-ব্রাহ্মণ-এ বলা হয়েছে, ‘যে নারী মুখে মুখে কথার জবাব দেয় না সেই অপ্রবাদিনী নারীই ভালো।’ এভাবে ক্রমশ পুরুষতন্ত্র নারীকে অবলা বানিয়ে নিঃশব্দে এক অন্ধকার পৃথিবীতে ঠেলে দিয়েছে।
ক্ষিতিমোহন সেন মনে করেন আদিতে নারী যে কিছুটা উচ্ছৃঙ্খল ছিল সেখান থেকে সে নিজেই বের হয়ে এসেছে। সামাজিক অনুশাসন তাকে স্বেচ্ছাচার সংযত করতে অনুপ্রাণিত বা বাধ্য করেনি সেভাবে। তার মাতৃত্ব, লক্ষ্মী-স্বরূপা মূর্তি তার উর্বশী সত্তাকে পরাজিত করেছে। নারীর মধ্যেকার অন্তর্নিহিত কল্যাণের আদর্শ তাকে সংযত করেছে। এই ধারণার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেও বলা যায় নারী নিজেকে সংযত করেছে যতটা তার চেয়ে বেশি তাকে সংযত হওয়ানো হয়েছে। আদর্শবাদের দোহাই দিয়ে নারীকেই সকল বিধি-নিষেধ মানতে কখনো বাধ্য কখনো অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। আর নারীর প্রতি এই মনোভাবই এক পর্যায়ে তাকে অবমাননা করতে পুরুষকে প্রভাবিত করেছে। ঘর-সংসার, সন্তান লালন-পালন এমনসব কোমল অনুভবের আচ্ছাদনে নারীকে আবৃত রেখে তার সৃজনশীলতা, মননশীলতার চর্চাকে খর্ব করে দিয়ে আবার তাকেই অল্পজ্ঞানী বলে পুরুষতন্ত্র তাচ্ছিল্য করার সুযোগ তৈরি করেছে। বারবার বলে এসেছে নারীকে দিয়ে বড় কোনো কাজ হবে না। সন্তানের জন্মদানকে সমাজ কখনোই বড় কাজ হিসেবে দেখেনি। অথচ পৃথিবীতে প্রাণের প্রবাহকে অক্ষণ্ন রাখার এই মহান দায়িত্ব নারী বহন না-করলে সবকিছুই থেমে যেত। গর্ভের অন্ধকার কুঠুরি থেকে রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়ে যে নারী পুরুষকে আলোর মুখ দেখায় সেই বড় হয়ে নারীকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়। কী অদ্ভুত এক বিষাদময়তায় ভরা নারীর জীবন!
ক্ষিতিমোহন সেনের প্রাচীন ভারতে নারী গ্রন্থে আমরা দেখেছি আজ থেকে ছয় হাজার বছর আগে নারী যে সাবলীল ও স্বাধীন জীবন যাপন করত তা আজকের দিনে অভাবিত। সেই সমাজে কিছুটা স্ববিরোধিতা ছিল। হয়তো চিন্তার ক্ষেত্রে আধুনিকতার অভাবের জন্য এমনটা ছিল। কিন্তু আজ শিক্ষার আলোয় আমাদের অনেক কিছু পাল্টেছে অথচ নারীর জীবনযাত্রাকে আলোকিত সমাজ অন্ধকারে নিপতিত করেছে। প্রাচীন ভারতীয় সমাজের নারীদের গৌরবময় ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন আমাদের বর্তমান সময়কে আমাদের ভাবনাকে প্রভাবিত করুক। সমকালীন নারীদের জীবনকে এগিয়ে নিতে পেছনের দিকে ফিরে দেখা যেতেই পারে। এতে দূরীভূত হবে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার অনেককিছুই। নারীর ব্যক্তি হয়ে ওঠার পথের প্রতিবন্ধকতা দূর হবে। নারী আবার ফিরে পাবে তার অতীত ঐতিহ্য। সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে তার আত্মমর্যাদা। নারীর অমর্যাদা আসলে মানুষেরই অমর্যাদা। এসব অকল্যাণ হাত ধরে এসে জীবনকে ঘোর অমানিশায় ঢেকে দেয়।
স্ত্রিয়ো যত্র চ পূজ্যন্তে রম্যন্তে তত্র দেবতাঃ।
অপূজিতাশ্চ যত্রৈতাঃ সর্বাস্তত্রাফলাঃ ক্রিয়া \ অনুশাসন ৪৫.৫.৬
নূর সালমা জুলি প্রাবন্ধিক এবং গল্পকার। প্রকাশিত গ্রন্থ : কথাশিল্পে মুক্তিযুদ্ধ, যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের । তিনি রাজশাহীতে বসবাস করেন।