ধারাবাহিক উপন্যাস সোলেমন (৭ কিস্তি)
—সেইসব দিনগুলো কি আর কখনো ফিরে আসবে?
যখন অতীত নিয়ে সোলেমন ভাবছিল তখন ওর কানে মহদং-এর মন্তব্য ওকে বর্তমানে ফিরিয়ে আনল।
—কোনসব দিনের কথা বলছ?
—স্বাধীন আরাকান আমলের কথা বলছি।
সোলেমন মন্তব্য করল না। মহদং এর পর নীরবে গাড়ি চালিয়ে যেতে থাকে। সোলেমনের মনে পুরোনো ইতিহাস। আর ওর চোখ পথের দুপাশে। সামনে বার্মিজ ভাষায় বাজার লেখা একটা ফলক চোখে পড়লে সোলেমন আগ্রহ নিয়ে সেদিকে তাকায়।
এই এলাকাটা ঘনবসতিপূর্ণ। অনেক পুরোনো বাড়িঘর গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে আছে। টিলার উপরও বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে। সর্পিল গলির মাথা এসে পথের পাশে মিশেছে। এসব গলিপথ টিলার ফাঁকে ফাঁকে বাঁক নিয়ে বসতিগুলোকে যুক্ত করেছে।
কিছুদূর যেতেই একটা নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার পড়ল। গাড়ির গতি কমাতে মহদং বাধ্য হচ্ছে। সে খুব সাবধানে, হর্ন না বাজিয়ে ধীরে ধীরে এগোতে থাকে। সোলেমন দেখছে সারিবদ্ধ চালার নিচে দোকানপাট। অনেকটা বাংলাদেশের বাজারের মতোই। এসব দোকানে লোকের ভিড়। হাঁকডাকও শোনা যাচ্ছে। সোলেমন বার্মিজ ছাড়াও রোহিঙ্গা কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছে।
সোলেমন নিজের অজান্তেই লোকজনের কথা শুনতে কান পেতে রেখেছে। ওর মনে হচ্ছে, বহুবছর পর সে যেন একটি পরিচিত বাজারে এসেছে। সে দেখছে, একটা বড় টিনের ছাউনির তলে কাচাবাজার বসেছে। পথের পাশে ফলমুল আর নানারকম কাচা সবজি। তারপর মাছের ডালায় বড় ছোটো নানারকম মাছ। সামুদ্রিক মাছই বেশি। সোলেমন শুটকির গন্ধও পাচ্ছে। একটু দূরেই বিশাল সব কোরাল, ভেটকি আর কাইন ছাড়াও লম্বা লম্বা ছুরি ঝুলানো রয়েছে। আবার ছোটো ছোটো মাছের শুটকিও ডালাভরতি। লোকজন কিনছেও। কেউ কেউ সওদা নিয়ে বাড়ি ফিরছে। পথের লোকজন, দোকানপাট দেখতে দেখতে এগিয়ে যেতে যেতে সোলেমনকে নিয়ে মহদং এক সময় পুরোনো অলিগলি ছাড়িয়ে প্রশস্ত সড়কে উঠে এলো।
এ দিকটায় কোলাহল নেই। ডানে পাশে নদী। আকাশের তলে সুনীল জলের উপর ভাসমান ছোটো-বড় নানারকম জলযান। আরো দূরে বিশাল বিশাল সব জাহাজ ভাসছে। কালাডনের ওপারে ঘন সবুজ উঁচু পাহাড়। সড়কটা সমতল থেকে বেশ উঁচু করে নির্মাণ করা হয়েছে। বাম পাশে গাছপালার মাথার উপর দিয়ে দূরে পাহাড়ের উপরে পুরোনো বৌদ্ধ মন্দিরের সূচালো চূঁড়া দেখা যাচ্ছে। আর একটু এগালে পুরোনো শহর এলাকা ছাড়িয়ে গিয়ে কিছুদূর যেতেই নতুন বসতি চোখে পড়ল। ঝকঝকে সব ভবন। দূর থেকে থেকে ইউরোপের কোনো বসতির মতোই মনে হচ্ছে। পেছনে পাহাড় আর গাছপালা। সোলেমন আন্দাজ করে, পাহাড় কেটে এই বসতি গড়ে তোলা হয়েছে। পেছনে অনেক উঁচু ঘনকালো পর্বতমালার সারি। সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে আছে। একটি পুরোনো শহরের পাশে এমন একটি আধুনিক বসতি দেখতে পাবে সোলেমন ভাবে নি। সে বুঝতে পারছে এটি একটি পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা।
মহদং বলল, সেনাবাহিনীর উচ্চপদের কর্মকর্তাদের জন্য এই বসতি বানানো হয়েছে। আর ওপাশে যে বসতি দেখছ সেটা নতুন বসতি। ওটাও সরকারি কর্মচারীদের জন্য। সেনাবাহিনী আর সরকারি চাকুরেদের ছাড়া এমন বাড়ি আর কেউ পায় না। সে কথা বলতে এত কথা বলি নি। বলছি তুমি যে সেনাবসতি দেখছো এর নাম পুরোনো থাক্যাবিন। ১৯৯০ সালের আগে এলাকাটা পুরোটায় রোহিঙ্গা বসতি ছিল। সেনাক্যাম্প হবে বলে এখান থেকে সব রোহিঙ্গা উচ্ছেদ করে দিয়ে সেনাবাহিনী এই জায়গা দখল করে নেই।
সোলেমন কোনো মন্তব্য করল না। সে নদীর ওপারে তাকিয়ে আছে। কালাডনের নদীর অববাহিকায় ধান আর হরেক রকম শস্য উৎপন্ন হয়। প্রাচীন কালেই সেসব শস্য পৃথিবীর বহুস্থানে রপ্তানি হতো। এসব নদীর সমতলে কৃষি সভ্যতার সূচনা হয়েছিল। আর নদীকে কেন্দ্র করে ইতিহাসের ঊষা লগ্নে মানব বসতি গড়ে উঠেছিল। একসময় আকিয়াব ছিল দূর প্রাচ্যের নাভি। নানাজাতি আর ধর্মের মানুষ সুপ্রাচীনকাল থেকেই এখানে বাণিজ্য করতে এখানে আসত। চমৎকার জলবায়ু এখানে তাদের স্থায়ীভাবে বসবাস করতে সহায়তা করেছিল। কোনো স্থানের ভৌগলিক অবস্থান আর বহুযুগ ধরে বির্নিমিত সভ্যতার ভিতের উপরই এর মানব সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছে।
—আমরা এসে গেছি।
সোলেমন মনে মনে খুশি হলো আর ভাবে, মহদংকে পেয়ে ওর সুবিধাই হয়েছে। সে সহজেই আর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ওকে স্থানীয় অফিসে পৌঁছে দিতে পেরেছে।
অফিসটা পুরোনো শহর ছাড়িয়ে নিরিবিলি এলাকায়। চারপাশে নানাজাতের বৃক্ষের সমাহার। একটা উঁচু টিলার উপর একটা ডুপ্লেক্স ভবনের সামনে এসে গাড়ি থামল। অফিসের সাইনবোর্ড সোলেমনের নজরে পড়ল। বাড়িটাও পুরোনো। কৌণিক দ্বিপ্রস্থ ছাদের নকশা যেন স্থানীয় সভ্যতারই নিদর্শন বহন করছে।
অভ্যর্থনাকক্ষে গিয়ে সোলেমন একজনকে বসা দেখতে পেল। একজন বার্মিজ নারী ওকে দেখে বার্মিজ কায়দায় হাতজোড় করে মাথা সামনে ঝুঁকিয়ে অভ্যর্থনা জানাল।
ইংরেজিতে নিজের পরিচয় দিল, আমি সালিম খা। আমি প্রেগ্রাম কোঅর্ডিনেটরের সঙ্গে দেখা করব।
অভ্যর্থনাকারী ওকে বসার সিট দেখিয়ে দিল, দয়া করে বস।
সোলেমন বসে চারপাশ দেখতে লাগল। সব ইউএন অফিস যেন একই রকম করে সাজানো। সাদা দেয়ালে কয়েকটি ইউএন পোস্টার সাঁটানো থাকবে। সেই একই অসহায় মানুষের মুখ। সেই একই মানবিক শ্লোগান চোখে পড়ছে। দেখতে দেখতে ওর বাংলাদেশের কথা মনে পড়ল। ওর মনে হচ্ছে, যেন সে কক্সবাজারের সেই অফিসে এসে উপস্থিত হয়েছে। জাতিসংঘের সঙ্গে কাজ করে এমন সব সংস্থার অবয়ব আর সাজসজ্জায় একটা সাধারণ চিত্র সে সর্বত্র লক্ষ্য করেছে। ওকে আর বেশি ভাবতে সুযোগ না দিতেই বুঝি একজন এসে উপস্থিত হলো।
—হ্যালো, মিস্টার সালিম, দয়া করে আমার সঙ্গে আস।
সোলেমন লোকটাকে নীরবে অনুসরণ করছে। অলিন্দ দিয়ে হাঁটবার সময় স্থানীয় ঐতিহ্যের বৈশিষ্ট্য সম্বলিত কিছু প্রত্ননিদর্শন ওর চোখে পড়ল। আর লম্বা করিডোর পেরিয়ে শেষ প্রান্তে মহান বুদ্ধের ধ্যানমগ্ন মূর্তি স্থাপিত দেখতে পেল। মহান বুদ্ধের সন্নিকটে পৌঁছানোর আগেই ওর কাঙ্ক্ষিত প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটরের নাম ফলক দেখতে পেল সে। সোলেমন কক্ষে প্রবেশ করলে কো-অর্ডিনেটর ওকে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন।
—ওয়েলকাম, মি. সালিম খা। উই আ ইগারলি ওয়েটিং ফ য়্যু। ওয়েল। লেট মি ইনট্রুডিউস ফার্স্ট। আ’ম চ্যাং। চ্যাং সাইন লি। দ্য রিজিওনাল কোঅর্ডিনেটর অব সিটোয়ে অফিস।
—থ্যাংকস, মিস্টার লি, নাইস টু মিট য়্যু।
—ইজ ইউর ফাস্ট টাইম ইন সিটুয়ে, এম আই রাইট?
—ইয়েস, ইউ আর রাইট।
—হাউ ডিড য়্যু ফাইন্ড সিটোয়ে?
—ইয়াহ, ইটস হিস্টরিক্যাল প্লেস। বাট ইটস ব্লেসড বাই নেচার।
—ইয়েস। আই ডু এগ্রি উইথ য়্যু। ইটস বিউটি ইজ নেচার। নেচার মেড ইট দ্য প্রিন্সেস অব দ্য বে অব বেঙ্গল। ডু য়্যু এগ্রি উউথ মি?
—আই ডু এগ্রি।
—ভিজিট এন্ড এনজয় দ্য সিটি। ওয়েল, উইথ এ কাপ অফ টি লেট মি ব্রিফ সামথিং এবাউট ইয়ুর জব।
—ওকে, স্যার।
—উই আ ওয়ার্কিং ফ দ্য ইমপ্রোভমেন্ট অব মদার্ন এডুকেশন, পার্তিকুলার্লি ইন দ্য রুরাল এরিয়া, হোয়ার রেট অব ইডুকেশন স্টিল ইজ ভেরি পুওর।
—আমাকে কী দায়িত্ব পালন করতে হবে?
—বুথিদং রাথিদং এবং মংদু উপশহরের অধীন নতুন গড়ে তোলা গ্রামগুলোতে শিক্ষার সুযোগ বাড়াতে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। আসলে আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় ওসব এলাকায় নতুন নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হচ্ছে। আসলে মায়ানমারে যে উদার রাজনৈতিক আবহ সৃষ্টি হয়ে তারই পুরস্কার হিসেবে দাতা দেশগুলোর তহবিল থেকে এই উন্নয়নের অর্থ আসছে। মায়ানমারে শিক্ষার হার এখনো খুই কম। এখনো এখানে আধুনিক শিক্ষার প্রসার ঘটে নি। শিক্ষা বলতে এখনো বৌদ্ধ শিক্ষাই লোকে বোঝে। বৌদ্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সনাতন পদ্ধতিতেই পাঠদান করা হয়। এখানকার প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা বৌদ্ধমন্দির কেন্দ্রিক। মহান বুদ্ধের আদর্শ অনুসরণে জীবন গড়ে তোলাই প্রচলিত শিক্ষার লক্ষ্য। এখানে এখানে প্রযুক্তির কোনো প্রসার ঘটেনি, জনসাধারণ এখনো বিজ্ঞান মনষ্ক হয়ে ওঠে নি। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা মায়ানমারের শিক্ষার কাঠামোগত ও গুণগত উন্নয়নে সহযোগিতা করতে এগিয়ে এসেছে। আমাদের এ কাজে আমাদেরসহযোগিতা করতে হবে। আমি কী বলতে চাইছি, তুমি বুঝতে পারছো?
—পারছি।
—সপ্তাহ খানেক এখানে থাক। প্রকল্পের কাগজপত্র দেখো। সবকিছু বুঝে নিয়ে তারপর কর্মস্থলে যাও।
—আসলে আমাকে কী কাজ করতে হবে?
বুথিদং, রাথেদং আর মংদু এলাকাতে নতুন বসতি গড়ে তোলা হচ্ছে। এসব বসতি এক ধরনের স্যাটেলাইট পাড়া, যা অনেকটা শহুরে কলোনির মতোই। এসব গড়ে তোলা হচ্ছে শহর এলাকায় চাপ কমানোর জন্য। স্থায়ী আবাসন দেয়া হবে তাদের, সেখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হবে, সরকার মনে করছে তাছাড়া লোকজনকে ধরে রাখা যাবে না। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাঠামো মানসম্মত করে তৈরি করার বিষয়ে তোমাকে তদারকি করতে হবে। রাখাইনের গ্রামগুলো খুবই দুর্গম, সবখানে যাতায়াত করাও যাবে না। তোমার ওখানে কাজ করতে কষ্ট হবে। তবে আমার বিশ্বাস, তুমি পারবে। তোমার কাজের অভিজ্ঞতার ফিরিস্তি আমি দেখেছি।
—আমার কাজের বিষয়ে তুমি কীভাবে জানলে?
—মাঠ সমন্বয়কের পদে একজন দক্ষ ও যোগ্য লোক নিয়োগ দেয়ার প্রস্তাব আমি জেনেভায় পাঠিয়েছিলাম। যোগ্যতা আর অভিজ্ঞতার মানদ-ও আমি প্রস্তাব করেছিলাম। আমি যা চেয়েছিলাম তোমার সে যোগ্যতা আর অভিজ্ঞতা আছে দেখে আমি খুশি হয়েছি। তোমার পূর্বপুরুষ যে ইউরোপীয় নয়, সেটা তোমার চেহারা আর কথাবার্তায় বোঝা যায়। বরং তুমি যে প্রাচ্যদেশীয় এটা যে কেউ বুঝতে পারবে। এতে এখানে কাজ করতে তোমার সুবিধা হবে।
—এতে কী সুবিধে হবে বলে তোমার ধারণা?
—এদেশের প্রশাসন ইউরোপীয় বা আমেরিকানদের পছন্দ করে না। এর ঐতিহাসিক কারণ আছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত নাই বা জানলে। আমি মনে করি, তুমি বার্মিজদের মনস্তত্ত্বের ঐতিহাসিক কারণ তুমি জানো। তুমিও একজন ইউরোপীয় বলে তুমি কি আমার কথায় কষ্ট পেয়েছো?
—মোটেই না। আমি বরং তোমার কথা উপভোগ করছি। আমি আরো জানতেই চাই, তাতে ওদের সঙ্গে আমার কাজ করতে সুবিধা হবে।
—ঠিক বলেছ। আজ এটুকুই থাক। ভবিষ্যতে তোমাকে আরো এমন বিরক্তকর কথা বাধ্য হয়ে উপভোগ করতে হবে। আর অচিরেই সরকারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমাদের বৈঠকও হবে। তখন তুমি সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা লাভ করতে পারবে। তবে মনে রেখ, তোমাকে মাঠেই বেশি ঘোরাফেরা করতে হবে। তদারকিটাই হবে তোমার প্রধান কাজ। এদেশের আমলাদের ওপর মোটেই ভরসা করতে পারি না।
মি. লি থামল এবং আবার কিছু কথা বাকিও ছিল তার, ভালো কথা, তোমার ব্যবহারের জন্য একটি গাড়ি আছে। কিন্তু মুশকিল হয়েছে, ড্রাইভার চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। আরেক জন ড্রাইভার পাওয়া গেলেই তুমি সেটা ব্যবহার করতে পারবে। আপাতত একটা ভাড়া করা গাড়িতে চালিয়ে নাও।
—কিন্তু তুমি বলছিলে, আরাকানের গ্রামগুলো দুর্গম। সেখানে কি গাড়ি কাজ দেবে?
—তুমি ভালো বলেছ। বুথিডং থেকে মংডু টাউনশিপের কিছু এলাকায় গাড়ি চালাতে পারবে। মংডু থেকে বুথিডং আর উত্তর দিকে তমরু সীমান্ত পর্যন্ত পাকা রাস্তা আছে। ওসব জায়গায় যেতে পারবে। কিন্তু গ্রামগুলোয় গাড়িতে যেতে পারবে না। বরং সেসব গ্রামে বর্ষাকালে নৌকা আর অন্যসময় মোটরবাইকে যাওয়া অনেকটা সহজ। তুমি আরাকানের প্রাকৃতিক মানচিত্র দেখলে বুঝতে পারবে গোটা আরাকান অঞ্চলের ভূমি সমরূপ নয়। এর পূর্বভাগ মায়ু পর্বতমালার ক্ষয়প্রাপ্ত উন্নীত মালভূমি যার নিম্নভূমি মায়ু অববাহিকা বিধৌত পলিগঠিত উর্বর সমভূমি। মায়ু পর্বতমালার পাদদেশের ছোটো পাহাড় আর মালভূমি এলাকায় প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। ফলে সেখানে গড়ে উঠেছে চিরহরিৎ অরণ্য আর সমভূমি যেন শস্যভান্ডার। যাক, যা বলছিলাম, আমার মনে হয়, একটা মোটরবাইক হলে তোমার জন্য ভালো হতো।
—আচ্ছা। একটা মোটরবাইক যদি আমি কিনে নিই কেমন হয়?
—সে না হয় কিনলে। কিন্তু তুমি তো পথঘাট কিছু চেন না, চালাতে গিয়ে পথ না হারিয়ে বসো। তখন তোমাকে খুঁজে পাওয়ার জন্য আমাকেই না আবার মোটরবাইক নিয়ে বের হতে হয়। আচ্ছা, দেখা যাক, তুমিও ভাবো।
—তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আই হোপ, ইট উইল বি প্লেজা টু ওয়ার্ক উইথ য়্যু।
—থ্যাংকস। ভালো থেকো সালিম।
—গুডবাই, দেখা হবে, লি।
সোলেমন বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এল।
কাজটা পাওয়ায় মহদং খুব খুশি হলো। সে সোলেমনকে অতিরিক্ত খাতির কীভাবে করা যায় সম্ভবত সেটাই ভাবছিল। গাড়িতে উঠার পর সে বলল, তুমি কী আর কিছু দেখতে চাও?
—তুমি কী কী দেখাতে পার?
মহদং সহসা উত্তর দিল না। সে গাড়ি চালাতে শুরু করল। কিছুদূর এগুনোর পর মুখ খুলল।
—এখন আর তেমন কিছু দেখাবার নেই। যা ছিল সব তো বদলে দিয়েছে, জবর দখল করে নিয়েছে। কী দেখবে তুমি? মহদং হতাশার স্বরে বলল।
—সোলেমন খেয়াল করছে, রাস্তা বেশ প্রশস্ত। দুপাশের কোনাপাটও যেন এর সঙ্গে মিলিয়ে নতুন করে সাজানো হয়েছে। আরো একটু গেলে —কী কী বদলে ফেলেছে?
—যেখানে মসজিদ ছিল সেখানে জাদুঘর বানিয়েছে। এমন কি মসজিদ ভেঙে দিয়ে প্যাগোডাও বানিয়েছে। তুমি আর কী দেখবে!
—তুমি এক কাজ করো, জনবসতির ভেতর দিয়ে যাও। আমি গাড়ি থেকে যতটা সম্ভব মানুষের জীবনাচার দেখতে দেখতে যাবো। ঠিক আছে?
মহদং কথা বলছে না। হঠাৎ কী কারণে ওর মন থেকে যে খুশিটা একটু আগেই দেখতে পেয়েছিল সেটা উবে গেছে সোলেমন বুঝতে পারছে না।
গাড়িটার গতি কমে গেল। সোলেমন মসজিদের মিনার দেখতে পেল। আর পথের পাশে নির্দেশক সাইনবোর্ড সিটোয়ে সাংস্কৃতিক জাদুঘর। মহদং গাড়ি নিয়ে ফটকের ভেতর ঢুকে পার্কি এরিয়ায় গিয়ে থামাল।
সোলেমন নেমে কাউন্টারের দিকে যেতে থাকলে মহদং বলল, তুমি অপেক্ষা করো। আমি তোমার টিকেট কিনে এনে দিচ্ছি।
—তুমি কি ভেতরে যাবে, যেতে চাও?
—তুমি সঙ্গে নিতে চাইলে যেতে পারি। তুমি তো আর বার্মিজ বোঝো না, আমি গেলে হয়তো তোমার সুবিধা হবে।
—ঠিক আছে, দুটো টিকেট নাও। এই নাও কিয়াট।
সোলেমন জাদুঘর প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে আশপাশ দেখতে থাকে। রাস্তা থেকে যে মসজিদের মিনার দেখতে পেয়েছিল এই মসজিদটা জাদুঘর সংলগ্ন। যেন মসজিদটাকে কোনোরকম বাঁচিয়ে জাদুঘর তৈরি করা হয়েছে। অথবা মসজিদ একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হওয়াতে এর ক্ষতি করা হয় নি। মসজিদটা যে অনেক পুরোনো সেটা এর স্থাপত্যকলা দেখেই সোলেমন বুঝতে পারছে। সাধারণত মধ্যযুগে এরকম তিনগুম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ নির্মাণ করা হতো। খিলান আর দেয়াল কালো পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছে এবং খাঁজে খাঁজে বসানো হয়েছে। সে কাছে এগিয়ে গিয়ে দেয়ালের এপাশ থেকে মসজিদটা খুঁতিয়ে খুঁতিয়ে দেখতে তাকে। এর প্রবেশ ফটকের উপরে ক্যালিওগ্রাফি করে আরবিতে লেখা রয়েছে আল্লাহু আকবর। এর নিচে মসজিদটি নির্মাণ সাল হিজরি ১০০০।
মহদং টিকেট সংগ্রহ করে ফিরে এল। সে এসে সোলেমনের কাছে দাঁড়াল। এখনো ওর মুখ ভার। সোলেমন বলল, এই মসজিদটা একহাজার বছরেরও বেশি আগে তৈরি। কিন্তু এমন সুন্দর একটা মসজিদ অত কম জায়গায় কেন করা হয়েছিল বুঝতে পারছি না।
—তুমি এখন বুঝবে কী করে? তুমি তো আর যখন এটা তৈরি হয়, এমন কি জাদুঘরটা তৈরির আগেও দেখ নি। কিন্তু আমি দেখেছি। আমার চোখ সাক্ষী হয়ে আছে।
—কী দেখেছিলে তুমি?
এই যে জাদুঘর দেখছো, এর প্রাঙ্গণ দেখছো সবই মসজিদের জায়গা ছিল। এখানে ঈদের জামাত হতো। মাহফিল হতো। আজ কি তুমি বুঝতে পারবে এর চারপাশে মুসলিমদের বসতি ছিল? বুঝতে পারবে না, কারণ সবাইকে এখান থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে।
—এখানকার বাসিন্দারা তাহলে গেছে কোথায়?
—যে যেখানে পারে চলে গেছে। যাদের কৃষিজমি ছিল, চাষাবাদ করে বাঁচত তাদের জমি কেড়ে নেবার পর এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। আরো বেশি দূরে যেখানে এখনো কোনো বসতি গড়ে উঠে নি। কোথাও অনাবাদী জমি পেলে হয়তো আবার সেখানে তারা চাষাবাদ শুরু করেছে। যাদের অর্থ ছিল তারা সম্ভব হলে বিদেশেও চলে গেছে। মক্কা, মদিনা, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আমেরিকা, কেউ হয়তো ইউরোপেও গেছে। জান বাঁচাতে কোথায় না গেছে এদেশের মুসলমান? শুধু আরাকান এলাকার মানুষ তো নয়, তামাম বার্মামূলুকের মুসলমানদেরই বাঁচামরার প্রশ্ন।
সোলেমন মন দিয়ে শুনছিল আর ভাবছিল।
মহদং বলল, তোমার এসব কথা বিশ্বাস হচ্ছে না তো, তাই না? তোমার মতো বিদেশিদের বিশ্বাস করার কথাও নয়, কারণও নেই। এমন কি কেউ যদি বিশ বছর আগে আকিয়াব এসে থাকে আর তার পর এখন আসে তবে সে সরকারের প্রশংসাই করবে। কারণ, আগে যা ছিল বস্তির মতো ঘিঞ্জি এখন সেসব নেই, সেখানে বহু উঁচু আবাসিক ভবন গড়ে উঠেছে, অথবা কলেজ বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। আগে যে রাস্তাটা ছিল একটা গলির এখন সেটা অনেক বড়, ঝকঝকে। সে তো এসে দেশের উন্নতি দেখে প্রশংসাই করবে, তাই না? এই তো কাছেই, যেতে যেতে একটা কলেজ পড়বে। ক’বছর আগেই এ জমি রোহিঙ্গারা চাষ করত। তাদের জমি কেড়ে নিয়ে কলেজ করা হয়েছে, কিন্তু পড়বে মগের বাচ্চার। কোনো রোহিঙ্গা তো সে কলেজে পড়তে পারবে না। (চলবে)