গুচ্ছ কবিতা ।। হৃদয় পান্ডে

মৃত সময়ের সঙ্গম
শেষ কবে
ঘুমিয়েছিলাম, মনে নেই—
বোধহয় সোমবার, খুব সকালে,
তারপর সময় থেমে যায়,
ঘড়ির কাঁটা নিজেই নিজেকে গিলে ফেলে
আমি জেগে থাকি, ক্রমাগত, চুপচাপ।
অতঃপর কেটে গেছে বহু বছর,
ঘুম আসেনি,
চোখে জমে আছে ধুলোর স্তর,
পাপড়ির ভাঁজে জমে আছে অতীত,
আর কর্ণকুহরে বাজে খবরের কোলাহল।
আমি জেগে থাকি
যেন ঘুম মানেই অপরাধ,
যেন স্বপ্ন দেখার দায়ে
আমাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে—
চোখ খুলে ঘুমের ভান করে বাঁচার শাস্তি।
এই জেগে থাকা এক মৃত সময়ের সঙ্গম,
চারপাশে সবাই ঘুমোচ্ছে,
আমি শুধু শুনি, কীভাবে নিঃশ্বাসের শব্দে
জন্ম নেয় আরেকটি দিন,
যা আমি ঘুমিয়ে কাটাতে পারিনি।
হয়তো একদিন,
আবার ঘুম আসবে,
ততদিন অবধি আমি জেগে থাকবো—
বুকে এক নিঃশব্দ অনিদ্রার কফিন নিয়ে।
এক কফিন তৃষ্ণা
এক কফিন তৃষ্ণা নিয়ে
তোমার কাছে এসেছিলাম—
জানি, তুমি জল দেবে না,
তবু ঠোঁটভর্তি মরুভূমি নিয়ে দাঁড়ালাম
তোমার দরজায়।
আমার জিহ্বা এখন চামড়ার মতো শুকনো,
তবু কিছু শব্দ জমেছে,
মৃত্যুবরণ পাখির মতো,
গলার ভেতর ঘুরছে, ফড়ফড় করে।
তৃষ্ণা এখন ধর্ম হয়ে গেছে,
তুমি জানো,
আমার পিপাসা শুধু জলের জন্য নয়—
সত্যের জন্য, স্পর্শের জন্য,
একটা মৃদু ‘আছি’-র জন্যও।
তুমি মুখ ফিরিয়ে নাও,
আমি মরুভূমির দিকে হাঁটি।
কফিনটা আর বহন করি না,
আমি নিজেই এখন কফিন,
তৃষ্ণায় পূর্ণ, শুষ্ক, নিঃসঙ্গ, নীরব।
যুদ্ধের বীজ
লোহা যুদ্ধের বীজ,
আগ্নেয়গর্ভে জন্ম, শাসকের হাতে লালন,
যখনই প্রয়োজন হয়, সে গড়ে ওঠে—
তলোয়ার হয়ে, বন্দুক হয়ে, শৃঙ্খল হয়ে।
লোহা গলে হয় বুলেট,
নিপুণ হাতে কাটা হয় ধারালো ছুরি,
শক্তির প্রতীক হয়ে ঝুলে থাকে পতাকার ডাঁটায়,
আর একদিন, ঠিক একদিন—
সে ফিরে আসে কবরে, ছাইয়ে,
বুলেটবিদ্ধ শরীরের মাঝে।
যুদ্ধ শেষ হয়, শুধু লোহা থেকে যায়,
নতুন ছাঁচে, নতুন নামে, নতুন শাসকের হাতে।
আগুন ও ইতিহাস
লোহার গন্ধে মেশে মানুষের ঘাম,
জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের শ্বাসে কাঁপে পৃথিবী।
যেখানে হাতুড়ির আঘাতে
স্বপ্ন গড়ে ওঠে, আবার
ধ্বংস হয়ে যায় মুহূর্তে।
লোহা, শক্তি আর শাসনের প্রতীক,
যার ধারাল প্রান্তে লেখা আছে ইতিহাস।
কখনো বর্ম, কখনো বন্দুক,
কখনো কৃষকের হাল।
তার শীতল শরীরে বন্দী আগুনের গল্প,
যা মুছে দিতে পারে জীবনের রং,
অথবা গড়ে তুলতে পারে একটি নতুন ভোর।
আমার শরীর এখন পরিসংখ্যান
চামড়ার নিচে জমাট বাঁধা নীরবতা,
রক্তের দাগ মুছে ফেলেছে শীতল ইস্পাত,
আমার শরীর এখন—
একটি সংখ্যা, নিরুত্তাপ,
পরিসংখ্যানের ঠান্ডা কোলাহলে হারিয়ে যাওয়া
আরেকটি অনামা মৃত্যু।
টেবিলের ওপরে শুয়ে থাকা শরীরের হিসেব হয়,
বয়স, উচ্চতা, ওজন, ক্ষতচিহ্নের বিন্যাস,
আমি কি হত্যা নাকি আত্মহত্যা?
নাকি নিছক দুর্ঘটনা?
ময়নাতদন্তের খাতায় আমার পরিচয়
কেবল ‘অজ্ঞাতপরিচয় পুরুষ/নারী’।
আমি এখন আর আমি নই,
আমি এখন রাষ্ট্রের নথি,
একটি রিপোর্ট,
পরিসংখ্যান।
কবিতা বেঁচে রইলো
কবির ফাঁসি হলো, শব্দের অপরাধে,
বেঁচে থাকার দায়ে, স্বপ্ন দেখার দোষে।
কাঠের মঞ্চ নড়ে উঠলো,
গলায় দড়ি শক্ত হলো,
তবুও কিছু শব্দ বাতাসে দুলে রইলো,
কিছু পঙক্তি উড়ে গেল মানুষের হৃদয়ে।
যারা কবিকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল,
তারা দেখলো—
গোলাপের পাপড়িতে লেগে আছে তার কবিতা,
শিশুর হাসির মাঝে বাজছে তার ছন্দ,
শহরের দেয়ালে, কারো মুঠোয়, কারো কণ্ঠে
জেগে আছে সেই বিপ্লবী শব্দ।
অতঃপর কবি হারিয়ে গেল,
কিন্তু তার কবিতা বেঁচে রইলো—
প্রতিটি অক্ষরে, প্রতিটি বিদ্রোহে,
প্রতিটি বিপ্লবে, প্রতিটি জাগরণে।
হৃদয় পান্ডে কবি। তিনি ঢাকায় বসবাস করেন।