গুচ্ছ কবিতা ।। কায়সার হেলাল

উপশমের নিদান
অ.
জগৎ এক ভারসাম্য-অভিমুখী প্রকল্প। বৃহৎ ভারসাম্য রক্ষায় তার প্রয়োজন ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রের ভারসাম্যের দিকেও নজর রাখা। অতএব, সকলেই মরে। সকলেই ভুগে। সংকট কাটিয়ে বা সংকটে দ্রবীভূত হয়ে সকলেই হয়তো জাগে এপিঠে অথবা ওপিঠে। বৃহৎ ভারসাম্য টিকে থাকে। একদিন তাও ভেঙে পড়বে। আরও আরও বৃহৎ ভারসাম্য রক্ষার প্রয়োজনে। অর্থাৎ, এই কসমিক জার্নিও মূলত আরেক বিরাট ভারসাম্য রক্ষা প্রকল্পের অধীন।
আ.
মানুষের সুবিধার জন্য গাছ কেটে ফেলা হয়। কখনো কি কেউ শুনেছেন গাছের সুবিধার জন্য মানুষ উচ্ছেদ হয়েছে? ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে? না। কারণ আমরা ওভাবে ভাবতে শিখিনি।
ই.
মায়াকুঞ্জে নিরলে বসে করি পারায় পারায় বিরহগীত খতম। ফের দেখা হবে এই আশে রচি আত্মদাফন। তোমার কাছে পৌঁছাবার আর কত পথ? কার ভিটায় কর বাস্তুসংস্থান? ক্রমশ মৃত্যুর দিকে যেতে যেতে দেখি এ কেবলই তোমার দিকে ছুটে যাওয়া। এত বিলাপ এত আগর ঘ্রাণ—কেবল তোমার পানে ছুটে যাওয়া বিদেহী প্রাণ। ধাওয়ার পর ছত্রভঙ্গ মিছিলের মতো ছুটছি তো ছুটছি। অনন্ত এই ছুটোছুটির ছুটি নেই জেনেও এসেছি। কাফন বিছিয়ে বারংবার প্রণতির ভান করেছি। ভাবি মায়াকুঞ্জে বিরহ-মাতম খতম হলে ফের তোমার দেখা পাবো। হয়তো ফের কথা হবে। তাই এসেছি হে সখা।
ঈ.
জগতে মুত্তাকির বড়দাগে তিন কাজ। এক. কোনকিছুই চূড়ান্ত নয়—এই বাক্য আত্মস্থ করা। দুই. সকল ঘটনা-অনুষঙ্গ-সম্পর্ককে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবতে শেখা। তিন. জগতের সকল প্রাণ-বস্তু-ক্লীবসমূহকে একসঙ্গে মহাপ্রাণ জ্ঞান করা এবং ইত্যকার বিষয়-আশয় সহ ভূমণ্ডল-নভোমণ্ডল-বায়ুমণ্ডল-জলমণ্ডল একপ্রকার অদৃশ্য মহাজাগতিক রশ্মি দ্বারা সংযুক্ত—এই মহৎক্রিয়া আবিষ্কার করা।
উ.
তাকে কতকিছুই না বলেছি! তাকে বলেছি কূর্ম্মস্বভাব ভালো। সে জবাবে বলেছে এইসব অন্তর্মুখীনতা ছাড়া আর কিছু না। এসব বাতচিত চলতে থাকে। আমার যা কিছু মহৎ জ্ঞান করে এসেছি তার সবকিছু সে তাচ্ছিল্যভরে উড়িয়ে দিচ্ছে। ‘বাস্তবতা থেকে পালিয়ে বেড়ানো যাদের স্বভাব তারাই বদস্বভাবকে মহৎ দাবি করে’—সে ফড়ফড় করে বলতেই থাকে। ভেতরে ভেতরে তালাশের কথা বলি আমি, সে বলে ‘স্বার্থপর।’ মায়ার কথা বলি, বলি সিমুল্যাক্রার কথা, বলি যা কিছু দেখো তা হতে পারে নিখুঁত বিভ্রম। হতে পারে সিমুলেশনের অন্তরালের নিপুণ কোডিং তোমাকে এসব দেখাতে চাচ্ছে বলেই তোমার দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। ‘বদ্ধ উন্মাদ তুমি’—সশব্দে উচ্চারণ করে সে। তার সাথে কথায় পারি না। হেরে যাই। ভালো থেকো কায়সার।
কায়সার হেলাল কবি, কথাসাহিত্যিক এবং চিন্তক। বর্তমানে চীনের হেনান প্রদেশের রাজধানী জেংজু শহরে সাময়িক বসবাস করছেন।