গুচ্ছ কবিতা ।। সুমন শামস
উপেন এক আদিবাসী পীরেন স্নাল
সন্ধ্যা যাই যাই করছিল। দুই বিঘা জমির উপেন
জমিদার বাবুর দর কষাকষিতে নাস্তানাবুদ তখন।
নাটকের পর্দায় সাম্রাজ্যবাদের মঞ্চায়ন।
পর্দার সামনে বসে আমরা তখন বিপ্লবের স্পন্দনে কেঁপে উঠছিলাম।
মুহূর্তে রঙ্গমঞ্চ ভেঙে পড়ছিল উপেনের দুই বিঘা জমি
বাঁচানোর লড়াইয়ে। ট্যাঁটা বল্লম হাতে নারী পুরুষ সকলে
দাঁড়িয়ে পড়ল দাস থেকে জেগে ওঠা উপেনের ভেতর।
ধীরে ধীরে আমি অনুভব করতে লাগলাম, দুই বিঘা জমির নাট্যরূপ
যখন বিরতিতে পৌঁছাল, আমি সম্পূর্ণ উপেনে রূপান্তরিত হয়ে গেলাম।
আমার চারপাশে সকল দর্শক বজ্রহাতে চেপে ধরেছে আমার হাত।
আমি তখন দশভুজা। আমি তখন সাম্রাজ্যবাদী জমিদার বাবুর সামনে দাঁড়ান
এক আদিবাসী পীরেন স্নাল।
মানুষ হয়ে বাঁচতে যে পীরেন জান দিয়েছে।
কবির কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই
কবির কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। কোনো ঈশ্বর কোনো রাজাই নন কবির প্রতিতুল্য। কারণ সকল ঈশ্বর ও সকল রাজাই নিজেদের স্বার্থে কেবল কথা বলেন। একমাত্র নিঃস্বার্থভাবে কবিই বলেন চিরসত্যের কথা। যে সত্যকে চিরদিন আড়াল করেন ঈশ্বর ও রাজারা। সত্য হলো কবির সন্তান; যার জন্য মৃত্যুকেও হাসিমুখে বরণ করেন কবি। সত্য প্রকাশের জন্য ঈশ্বর ও রাজারাই হত্যা করেন কবিকে। ফলে সত্যঈশ্বর আর সত্যরাজা একমাত্র কবিই। কবির চেয়ে বড় কোনো ঈশ্বর অথবা রাজা নেই। তবে বাস্তবতা হলো, এই ঈশ্বর কিংবা রাজাকে পুজো করে না কেউ। কারণ ক্ষমতা ও টাকা দুটোর কোনোটাই কবির নেই। সত্য প্রতিষ্ঠায় কবি জীবদ্দশায় প্রাণপণ লড়াই করে যান। কিন্তু সত্য কস্মিনকালেও প্রতিষ্ঠা পায় না। ঈশ্বর আর রাজারাই তার সামনে পা নাচিয়ে মিথ্যার মসনদে বসে থাকেন। একই অবস্থা বহাল থাকে মৃত্যুর পরেও কবির। সত্য খোঁজার মতো খুঁজে পাওয়া যায় না কবির সমাধি। বানোয়াট ঈশ্বর আর রাজারাই সমাধিসৌধ সাজিয়ে গোরস্থানেও তাদের রাজ্য বিস্তার করে বসে থাকেন।
সুতরাং কবি হলেন সেই ঈশ্বর অথবা রাজা, ঘর ও কবর কোনোটাই যার নেই।
নিয়তির নর্তকী ও প্রবঞ্চনার গোলাপ
হত্যা, স্বাভাবিক মৃত্যু নাকি অপমৃত্যু
সুরোতহালের আগে তা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না।
অপ্রকাশিত অনেক কথা ছিল তার,
গল্প ছিল, ঘৃণা ও প্রার্থনা ছিল।
নিয়তির নর্তকী দিয়েছে তাকে প্রবঞ্চনার গোলাপ।
পাপড়ির ভেতরে ছিল যার ঘাতক সৌরভ।
সম্ভবত ফুলের সুরভি তাকে হত্যা করেছে।
কাপড়
এখানে জীবিত মানুষের কাপড়ের বন্দোবস্ত নেই।
মৃতদের বিনামূল্যে কাফনের কাপড় দেয়া হয়।
কঙ্কর মুচি, দৈত্য ও শাকপোলাও
কঙ্কর মুচি প্রতিদিন চেরাগ ঘঁষে ঘঁষে বের করে আনে রূপকথার দৈত্য।
হু হু হা হা শব্দে বেরিয়ে আসে দৈত্য। তারপর বলে, হুকুম করুন মালিক।
কঙ্কর কী হুকুম করবে ভেবে পায় না।
কী রেখে কী চাইবে দৈত্যের কাছে, তালগোল পাকিয়ে ফেলে।
তারপর পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম বোকার মতো চেয়ে বসে সামান্য একটু শাকপোলাও!
দৈত্য বিরক্তি নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলে কঙ্কর দেখে চেরাগটি
ওর অভ্যস্ত হাতে জুতা হয়ে উঠেছে।
আর ব্রাশ দিয়ে সেটিকে দৈত্য বেরুবার মতো করে সে অনন্তকাল ধরে ঘঁষে চলেছে।
কিন্তু ওর শাক পোলাওর স্বপ্ন পূরণ করতে কোনো দৈত্যই আর কখনো আসেনি!
ইঁদুরের পেছন সেলাই করা হয়
এ...ই...
ইঁদুরের পেছন সেলাই করা হয়...
হকারের এমন ডাকে প্রতিদিন হকচকিয়ে ওঠি।
পেছন সেলাই এ আবার কেমন কথা।
সেও আবার ইঁদুরের। কেন?
নানা প্রশ্নের জট বেঁধে যায় মাথার ভেতর।
ইতোমধ্যে আবারও ডাকটি কানে আসতে থাকে—
এ...ই...
ইঁদুরের পেছন সেলাই করা হয়...
তখন হঠাৎ আমার মনে হয়, পেছন সেলাই ইঁদুরের কেন?
সে তো ছুঁচোর হওয়ার কথা।
কোত্থেকে যে এই প্রাণীটা এত হাগে বুঝি না।
খাওয়ার চেয়ে ওর হাগাই বেশি।
ভাবনার অবসরে আবারও সেই ডাক—
এ...ই...
ইঁদুরের পেছন সেলাই করা হয়...
দৌড়ে গিয়ে হকার লোকটাকে ধরে ফেললাম।
জিজ্ঞেস করতেই সে বললো,
সেলাই থেরাপি দিলে ইঁদুর নিধনে আর ফাঁদ পাততে হয় না!
পেছন সেলাই হওয়া ইঁদুরটিই অন্য সব ইঁদুরের ফাঁদ হয়ে যায়।
হাগতে না পেরে সে অন্যসব ইঁদুরকে জখম করে মেরে ফেলে।
বাহ্, আইডিয়াটা দারুণ তো! আমার পছন্দ হয়েছে।
তারপর সাথেসাথেই মনে হয়েছে,
ইস্ যদি মানুষের পেছন সেলাই করা যেত!
আর মনের আনন্দে হাঁক ছেড়ে বলা যেত—
এ...ই...
মানুষের পেছন সেলাই করা হয়...
এ...ই...
মানুষের পেছন সেলাই করা হয়...
ডোম সংক্রান্ত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি
ডোম আবশ্যক। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে এ সংক্রান্ত যোগ্যতাবিধি উল্লেখ করা হয়েছে :
১. প্রার্থীকে অবশ্যই প্রাপ্তবয়স্ক হতে হবে।
২. নিরস্ত্র সন্ত্রাসে ফুলের সতীত্ব ছেঁড়া জানতে হবে।
৩. চেরাই ফাঁড়াই শেষে মৃত্যুর বুকে প্রেম রেখে আসার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
৪. মোমের সম্পর্ক জোনাকির আগুনে গলিয়ে নিঃসঙ্গ হওয়া জানতে হবে।
যোগ্যতার এসব বিচারে প্রত্যেক মানুষই মূলত ডোম।
আমরাও কি তাহলে মানুষের গু-ই পরিষ্কার করি
রাজারামের কথা মনে পড়ে। অনেকটা রবীন্দ্রনাথের মতো দাড়িগোঁফে
আচ্ছন্ন ছিল তার ফ্যাকাসে মুখ। হাত ও পায়ের নখে ছিল
কত জীবনের ক্লান্তিকর বেড়ে ওঠার ছাপ।
রাজারাম মানুষের গু পরিষ্কার করত।
টয়লেটের প্যানের ভেতর তাজা হাত ভরে দিয়ে ধাত্রীর মতো
বের করে আনত সব জঞ্জাল।
আমরা ঘেন্না করতাম রাজারামকে। ওর হাতে ঝোলান ঘটি আর ঝাড়ু
আমাদের মনে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে দিত।
আমরা থুতু ছিটাতাম রাজারামের ফিরে যাওয়ার সারাপথে।
আজকাল পুরনো সেই থুতু আমাদেরই দিকে রাজারাম রাজারাম বলে ছুটে আসে।
প্রকৃতপক্ষে আমরাও কি তাহলে মানুষের গু-ই পরিষ্কার করি!
মা ও মেশিনের গল্প
একদিন বাজার থেকে আনা হলো মাকে।
বাজার দরে মায়ের নেই মূল্য কানাকড়ি।
একটা বাইসাকেল আর রেডিওর মূল্যে কেনা যায় তাকে।
একদিন বাজার থেকে আনা হলো মাকে।
মায়ের পণ্যনাম মেশিন অথবা অন্যনাম।
মেশিনটার কোনো শব্দ নেই। চুপচাপ শুধু চলে অবিরাম।
এমন মেশিন মেলে না সচরাচর। আমরা তাই আত্মহারা বিভোর।
বেদম চালিয়ে ওঁর সুই ভাঙি, হৃৎপি- হাতিয়ে ববিন খুলে আনি,
ওঁর গলায় ফাঁস টানা দড়িটা উৎসাহে এঁটে দেই,
আবার কখনো ছিঁড়ে ফেলি। মেশিনটা আমাদের খেলার সামগ্রী।
অথচ মাকড়সার মমতায় এ মেশিনটাই
সেলাই করে যায় আমাদের সুখটুকু প্রতিদিন।
সুমন শামস। কবি, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক। পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে শিক্ষকতা করছেন। সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই তার স্বচ্ছন্দ বিচরণ। গান, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ও ছড়া মিলিয়ে এ যাবৎ তার প্রকাশিত গ্রন্থ ১৫টি।