গুচ্ছ কবিতা ।। শিবলী মোকতাদির 

প্রবেশ

গৃহে আমার ঘর আছে সেই ঘরের নেইকো কোণা
গোপন তুমি তালার মাঝে ধাতুর চাবি সোনা
নিষেধ বলো সংবেদে কার সত্য হচ্ছে হারা
অধিক ফুলের স্তবক গেঁথে বিলম্বে যায় যারা।

তোমার খোঁজে জাত ভেসে যায়, টুকরো খণ্ড দিন
আদর রাখো উৎপাদনে, ঘৃণার সুরে বীণ
বাজাও তুমি বহুমুখী বসন্তে বাস্তবে
পদ্য রাখো হাতের কাছে পাঠের অনুভবে।

তোমার চোখে অস্থিরতা, শোষণ তোমার চুলে
বিনাশ হাসে, ক্ষরণ কাঁদে আমার একটি ভুলে
গুপ্ত ঘরে তপ্ত স্বরে দমকা হাওয়া ছাড়ে 
টানের পরে মানের ছোঁয়ায় চিড় ধরেছে হাড়ে।

হাড় ফেটে যায়, ধার কেটে যায় চতুর্থ সংঘাতে
প্রথমে হও ঊর্ধ্বপাতন, অন্য ধারা সাথে
বিবেক বেঁধে বিচার ঢালো দ্রব্যগুণ উদ্ধারে
তোমার ভেতর আমার ঢোকা বিভিন্ন প্রকারে। 

সোনা

খনির আয়তন তুলে ধরি, এসো হে খননকারী
গেঁথে রাখি কয়লায় কলরব।
দূরে গৃহপালিত সূর্যের রূপ দেখি অস্তগামী
দেখি আভায় উদ্ভাসিত জাতি সব।


এরা জিপসি, জেগে থাকে রাতের নিকটে দিন। 
কূট ধার্মিকের মতো হঠকারী। যেন ধূর্ত জলে মীন। 

এত যে প্রযুক্তি, এত বারুদ আর বিজ্ঞাপন
তবু এই ধাতু-সোনা, কলহপ্রবণ, 
যতটা তুমি হও খনি আর খননে হিংসাপরায়ণ।

রূপে তুমি একাকার 

তবে শূন্যশাসনে        ও রূপালি চিহ্নে
আজ তুমি পতনে        নিন্দিত 
পালিয়েছো একাধিক        আঁকা কাল্পনিক
যে শহরে পথিক        বিকশিত।

যদি মূল্য গ্রহণে        আসে ভরা-শ্রাবণে
বিপদে শুধু মনে        মুখরিত 
তুলনায় জাগে ভয়        সোনার জাতে ক্ষয়
এভাবে অতিশয়        বঞ্চিত।

ফলে তার যত দোষ        ভুলে-গড়া মুখোশ
করেছিলে আপস        লজ্জাতে 
সেহেতু যাতনাগুলি        সাথে ঘটনাবলী
আসে ফিরে গোধূলি        ও প্রভাতে।

অবশেষে বলি শোন্        রূপার বিকিরণ
যে-রূপে, সে ধারণ        পরিমিত 
সোনা-রূপা একাকার    এমন অধিকার 
ব্যাকুলে তুমি তার        পরিচিত।  

এক দেশে এক নিবারণচণ্ডী

গগন, তোমাকে গণনার প্রত্যয়ে আজ আমি খণ্ডিত রূপ ধরে
শুদ্ধ শরতের গ্রন্থিত কাশবনে দাঁড়িয়েছি
অলীক এক নিবারণচণ্ডীর প্রহসনে।

ভেবেছি পূর্ব হতে পশ্চিমে যাবো
অথচ ঝাট করে এত বিরামশূন্য দিক আর মহাদিকে
ছেয়ে যাবে এ-প্রান্তর, ভাবিনি!
তারা অতীতরুদ্ধ বর্ণ-ব্যাকরণহীন মহাযুগ, 
মহাশতাব্দীর ভাগ্নে ও ভগিনী।
তাদের তারা ও তামাশা, কুঞ্জ-নিকুঞ্জের নক্ষত্রবাটিকা
আর কী সব অনূঢ় অব্যাহত দর্শনের ঝকমারি;
প্যাঁচের ধারাপাতে পঞ্চায়িত দিনরাত্রি।

তবু আমি দুইতীরে জোনাকির আস্ফালনে 
সূর্যকে অহিংসার মন্ত্রে গেঁথে রাখি।
দক্ষিণে চাঁদ কিছুটা চঞ্চল;
আধলা রূপের মাঝে ফুটিয়ে তোলা এক আগারকাহিনি
বাঁধো তো আঁচল দিয়ে, ওহে কাম-আঁখিতে এক্ষণই।

আর সেই হতে অবিরাম উত্তরে তুমি
উত্তরবঙ্গীয় দেহ-ভাষা নিয়ে, আখ্যানে আগড়-বাগড় করা
বিজলী ও বজ্রের মহিমায় অমাকে ভয় দেখাও
ভূতে বিশ্বাস স্থাপিত কর, পরিত্যক্ত খেলার ময়দানে
আক্রান্ত আমাকে একত্র করে ফের যুক্ত হতে চাও;
দেহে, প্রাণে-আঙরা ও আতরের লোভে।

জাত-পাত-বর্ণ নির্বিশেষে 

জাতের প্রশ্ন চাপাও তুমি ক্ষেত্রে খেলার ছলে 
ধর্মে-কর্মে-ফলে
শ্রেণির মধ্যে শোষণ ছাড়ো পদাধিকারবলে।

দূষণে হয় সুদৃঢ় সব বাক্যে বিস্তারিত
গোষ্ঠী-গোত্র প্রীত
আদির অন্তে সমস্ত ভুল কেন্দ্রে সঞ্চালিত।

সাম্যজ্ঞানে সুফি তুমি হিন্দু মুসলমান
সাধক-অন্ত প্রাণ
গানেই মারো চিন্তা-চেতন সুর-বাণীতে টান।

তুষ্ট করো উদ্ধৃতিকার ধীবর, চর্মকার 
চণ্ডালিনী তার
মাধুকরীর রূপ সে গলে কাপালিকের হাড়।
এই আমাদের পাল-চন্দ্র, দেব-সেন-বর্মণ
উদ্ভাসিত মন
জীবন হাতে যুদ্ধ করা সহিষ্ণু কোন জন।

শূদ্র আমি অন্ত্যজে হই শঙ্করে সঙ্করা
বর্ণাশ্রমে যারা
উচ্চ থাকে ভোগের ভিড়ে, নিম্নে বসুন্ধরা।

যুগে যুগে পাট ও পাটের রচনা এভাবেই ইফেক্ট করে 

কৈশোর টপকে যাওয়া দুর্যোগময় সেই বয়সে দেখেছিলাম—সামান্য মুদ্রামোহে  নিপতিত কোনো এক সরল যুবতীকে, গ্রামের জনৈক বিদঘুটে ফরিয়া মাস্তান—কীভাবে অঙ্গ ও আগুনের লোভে, মুহূর্তে বশ করে শুইয়ে দিয়েছিলো বাংলার  নির্বাচিত পাটখেতে। 

বালকের ব্রেনে, আদি অলংকারে ফুটিয়ে ওঠা, সেদিনের সেই দৃশ্য—বেশ পরিচিত  দূরত্ব থেকে দেখা, অমীমাংসিত সেই ইনিংস—যেন রহস্যের জট খুলে ধীরে ধীরে  বেরিয়ে আসা একগুচ্ছ ভৌতিক আর ভয়ানক মানব-মানবী।

এর বহু বছর পর, শহুরে-শিক্ষিত আর সাবালক হয়ে গেছি। তবু ইতিহাসের পাতায় লেপ্টে থাকা সেদিনের যৌন ও জীবনের লজ্জিত সেই ছবির যাতনায়—মাঝে, যতবার পরীক্ষা ও পত্রে পাটের রচনা পেয়েছি ততবার সবিনয়ে পাশ কেটে  গেছি আমি।

এভাবে আরও বহু বছর পর আজ দেখছি—নিশ্চিত কমনের আশায় ছেলেকে তার  মা, সেই পাটের রচনাটিই পড়তে বলছে বারবার। দেখলাম অদ্ভুত এক অনিহার মাঝেও কিছুটা বাধ্য হয়ে, ছেলে তরতর করে এক সময় পুরো রচনাটিই প্রায় না দেখে মুখস্থ বলে দিলো তার মা-কে। বিনিময়ে মা-ও প্রসন্ন এক মৌলিক হাসি উপহার দিলো ছেলেকে।

ঘটনার পরবর্তী দিবসে, যথারীতি পরীক্ষা শেষে বাড়ি ফিরে ছেলে আমার—দেখি, রাজ্যের যাবতীয় গণ্ডগোলময় তথা গম্ভীর মুখে বসে আছে, ঘরের চারিদিকে থমকে থাকা বিবিধ অন্ধকারের আড়ালে। আর পাশে, প্রশ্ন হাতে দাঁড়িয়ে থাকা অতি উৎসাহী মা তার ছেলেকে বলছে, ‘কী রে! সবই তো কমন পেয়েছিস আর পাটের রচনা, জুট তো অবশ্যই লিখেছিস?’

দেখলাম শীতের এই পড়ন্ত বেলায়, হঠাৎ একথা শুনেই; ঘামতে ঘামতে ছেলের সমস্ত মুখ কেমন লাবণ্যহীন আর রক্তাক্ত হয়ে গেলো নিমিষেই। যেন পুনর্মুদ্রণে ভর করে, ফের বহু দিন পর ফিরে আসা ইতিহাসের অভিনব আর অবাঞ্ছিত সেই লজ্জার ছায়াছবি। আজ ফের তুমুল আগ্রহে অবলোকন করছে—সমবাহু ত্রিভুজের ন্যায় তিনটি বিন্দু হয়ে ফুটে থাকা; এ ঘরের নির্বাক তিনটি প্রাণী।

পরিশেষে কিছুক্ষণ পর কিছুটা অচেনা অন্যের মতো অসম্ভব নত হয়ে, যেন গুপ্ত গানের গোপনীয় সুরে, ফিস্ফিস্ করে—উত্তরে ছেলের বিন্দুটি আহত উচ্চারণে বলে  ওঠে—‘প্লিজ! মুখস্থ ছিল না মা-মণি!’    

রাশিচক্র

রাশিতে লেখা ছিলো—রক্ত ঝরতে পারে। 
জ্যোতিষী বলেনি কোথায়, শরীর অথবা মনে?

হাজারো সমস্যা সরিয়ে ভাবি পুনঃপুনঃ অনুবর্তনে
গ্রহের কোন গণ্ডগোলে
ওগো প্রতিভা এসো তবে ব্যাখ্যার হাত ধরে
আমাকে বোঝাও অতিথিনী।

এ-যাত্রায় নিরুপায়
নো-ম্যান্স ল্যান্ডের মতো আমি যথার্থ অসহায়।


শিবলী মোকতাদির, কবি ও প্রাবন্ধিক, বাংলাদেশ

menu
menu