তিনটি কবিতা ♦ রেজা রাজা
লেন্সে আদিম আগুন
তার রসালো ঠোঁটের মানচিত্রে কতোদিন নিজ মৃত্যুকে খুঁজে বেড়িয়েছি একা; দ্ব›দ্বদীর্ণ দ্বিধায় বিহ্বল থাকে গাণ্ডিবের তান।
কাঁপা চিত্তের মিহি বাতাসে সোনালি শিশির যেন স্বপ্নীল গিরিবাজের আহ্লাদি উড়াল। প্রজাপতির রঙ কামনার গড়িয়ে পড়া জল। প্রকাশে অক্ষম শব্দের অদৃশ্য খেদ মাথা কুটে মরে স্থবির জলাঙ্গীর আসমানি জলে। রস ঝরে আদিম চোরাবালির মুখে। লুটিয়ে পড়া উদ্বেল হাওয়ার যৌবন মাথা কুটে প্রমিলার উদ্ভিন্ন আগুনে। করোটি তাপিত হয় আজিজিয়ার প্রবল প্রতাপে।
অতঃপর ঢেউ জাগে লালসার গনগনে অগ্নির পালকে, অবগুণ্ঠন ছিঁড়ে ফেঁড়ে অবমুক্ত স্তনের সুবাসে। রতিদেবীর ঊরুর পিছল জ্যোৎস্নায় বাণ ডাকা মেঘে চোখ যায় উত্থিত সময়ের কার্নিভাল চ‚ড়ায়। জমে যাওয়া মেঘে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায় কাল ঘড়ির চলমান কাঁটা। ঘুরে দেখে প্রিয়তমার গ্রীবার সুনিবিড় তিল। তিরতির জলধারার বুনো সঙ্গীত গড়িয়ে চলে ফিরফিরে লোম ও মোহন ভ্যালির নৈঃশব্দ্যে।
রতির ঘুটি বায়ু—ভায়োলিনে চঞ্চল বাজে—যোনিদ্বারের গোলাপ পাঁপড়িতে। বুনো উল্লাস হাহা হিহি তালিয়া বাজায় রমনসিক্ত কাঁথার শৈলীতে। বাসনার ঘাস স্বমেহনে কাতর; বিপন্ন কামনার উরোজ এলিয়ে থাকে কালের ভেলায়। তোমাদের এইসব দিন রাত্রির মাদকতায় জড়ানো সময় আটকে রাখে মোহন কারুকাজের চাকা—সরু সরীসৃপ উৎপেতে থাকে।
নিস্তার নেই তার-বল্লমে গাথা হৃদয় শোণিতে আঁকে শ্বাশ্বত প্রণয়ের নিবিড় জলছবি অলিন্দ ও নিলয়ে।
নিঃসঙ্গতার চল্লিশ বছর
যাপিত জীবনে এই এক ফণিমনসা হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছি বিরান মরুতে। অগভীর প্রোথিত শিকড়। সারভাইভ অসম্ভব জেনে দেহে ভরে নিয়েছি সরল ক্লোরোফিলের অনন্ত সম্ভার। কাঁটার স্বর্গে বিবিক্ত আমি রোপণ করি পরমহংসের গান চরম শিল্পলোকে
দৃশ্যমান গ্রাম, নগর, হাট, বাজার ও বিরামহীন কথার শব্দিত সহস্র জনতার ভিড়ে আসলে একাকী। একার সন্ন্যাসে থাকি, থাকবো চিরকাল। চাঁদের গোপন অশ্রু গড়িয়ে নামে মেঘের আড়ালে; যেন দুঃখী বঁধুর প্রবল বর্ষণ গড়িয়ে নামে মলিন আঁচলে। ডুমুরের অদৃশ্য আত্মা ফেটে বের হয় নক্ষত্রের গান; বিস্ফোরিত লুব্ধকের দেহ।
আদি সবুজের দেহ গলে নেমেছে যে জলের কবিতা তাঁর পঙক্তি উড়ে দুর্বিনীত বালুকার ঝড়ে। নিমজ্জিত জীবনের গান পাঁড় মাতালের চোখে আনে দারুন পিপাসা। তোমাদের এইসব দিনের ফোয়ারা ঝরে পড়ে গনগনে রোদের সকাশে—জমিনের বুক শুষ্কতায় মরে।
আপ্ত বাক্যের ঘ্রাণ আনে দিবারাত্রির অমর কবিতা। দু’বেলা রৌদ্রের উঠোনে জমা হয় কাঠগোলাপের ঘ্রাণ—অন্তহীন কামনার ঘোরে।
নস্টালজিক সরল কবিতা
তাগো বেবাক অলীক স্বর আমারে নানান রঙিলা বাইস্কোপ দেখায় নিরন্তর। তালকানা আমার মনের অন্দরের জলের উপরে তারা নিগুম মাথা তুইল্যা পুরাই চমকাই দ্যায়। আর কী তাইজ্জব, হ্যার পরেই ভুস কইর্যা ডুব দ্যায় গহিন পাতালের জলে।
প্রয়াত দাদুর স্বর ও তার খনখনে কাশির শব্দ এই ক্ষণে কী আচানক বাজি ওঠে রাইতের গভীরে। আর প্রয়াত মামু য্যান আসমানের চাঁন; হঠাৎ দেখা দিয়্যা হ্যার হেই পরিচিত স্বরে কথা কয়; কালো হুঁকায় দেয় টান—গুড় গুড় শব্দের সঙ্গমে ভরে যায় আমার উঠান। কাল রাইতের দোহাই সইত্য কইছি, এতোটুকু কই নাই মিছা।
অতীত, দূর অতীত ও বর্তমানের সকল স্বর বিষ্টির ধারার লাহান নাইম্যা আইস্যা সকল ভাসায়। পুন্নিমার চান্দের আলোয় সকল অতীত ও বর্তমান মুখ নিবিড় নিরঞ্জন থাইক্যা আমার মুহি থাহে চাই য্যান চোক্ষের পলক পড়েনা। এতো চোহের ভিড়ে নেতান্ত লাজরাঙা হই আর য্যান আজিব আজিব লাগে।
অখন প্রয়াত পিতার মুখ য্যান ভরা পুন্নিমার চান্দের লাহান উদয় হয় চোক্ষের সমুখে। তার মুখ বেহেশতি বাগান থিক্যা অপরুপ জ্যোৎস্নার আলোয় সদা উদ্ভাসিত থাকে। আসমানের তারা জ্বলা আলোয় সে মুখ অপলক চোখে নির্বাক থাকে য্যান অনন্তকাল ধরি দেখি যাবি তার চির শিশু পুলাডারে। জন্মান্তরে ফিরি আসবি বাপ আমার ঘর আলোকিত করি আবার।
তার মিঠি বুলি, ব্যাপক আদর আহ্লাদের কথা আমার বুকের মধ্যখানি অনন্ত বাজি যায়; বাজি যাবি অনন্ত কাল ধরি আমি তা নিশ্চিত। তোমার নিত্য ভালোবাসার প্রদীপ খানি জ্বালি রাখি বাপু, অণির্বান শিখা জ্বালি রাখি।
সকল অতীত ও বর্তমান মুখ, তাগো গলার স্বর অদৃশ্য বাজি যায়, বাজি যায় চির চেনা মুখ ও স্বরের বিভাসে।