মুঘল চিত্রকলার বিকাশে সম্রাট জাহাঙ্গীরের ভূমিকা : একটি ঐতিহাসিক সমীক্ষণ
ভারতবর্ষের চিত্রকলার ইতিহাস বহুমাত্রিক ও অত্যন্ত বর্ণিল। এই ইতিহাসের একটি বৃহৎ অংশ মুঘল চিত্রকলার দীপ্তিতে গৌরবোজ্জ্বল হয়ে আছে। বস্তুত রাজদরবারেই মুঘল চিত্রকলার জন্ম ও প্রতিষ্ঠা। সেই হিসেবে এই বিশেষ শৈলীর অন্তর্গত প্রতিটি চিত্রই নির্দিষ্ট সামাজিক সম্পর্ক ও ইতিহাসের নিদর্শন। প্রধানত পান্ডুলিপির চিত্রাঙ্কন ও প্রতিকৃতি অঙ্কনের মাধ্যমে মুঘল চিত্রকলার বিকাশ বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। মুঘল চিত্রকলাকে সাধারণত বলা হয় মিনিয়েচর (Miniature) বা অণুচিত্র। এর কারণ মুঘল চিত্রগুলি মূলত পুঁথিচিত্রণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। অবশ্য ভারতবর্ষে মুঘলরা প্রবেশের অনেক পূর্বেই পুঁথিচিত্রণ শুরু হয়। মুঘল চিত্রকলার ইতিহাসকে প্রধানত তিন পর্বে ভাগ করা যেতে পারে।
১. প্রাথমিক যুগ অর্থাৎ ইন্দো-পারস্য পর্যায়।
২. স্বর্ণযুগ অর্থাৎ স্বয়ংসম্পূর্ণ মুঘল চিত্রশিল্পের পর্যায় এবং
৩. অধ:পতনের যুগ।
ঐতিহাসিক পটভূমির বিচারে বলা যায় যে, প্রথম যুগের সূচনা করেন সম্রাট হুমায়ুন ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে যখন তিনি নির্বাসন জীবন অতিবাহিত করে পারস্য হতে খাজা আব্দুস সামাদ এবং মীর সৈয়দ আলীকে সাথে নিয়ে ভারতবর্ষে প্রত্যাবর্তন করেন। প্রকৃতপক্ষে মুঘল চিত্রকলার প্রথম পর্যায়ের সূচনা হুমায়ূনের রাজত্বে হলেও আকবরের দূরদর্শিতা এবং একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষকতায় মুঘল চিত্রশিল্পের উন্মেষ হয়। প্রসঙ্গত বলতে হয় যে, মুঘল চিত্রকলার প্রধান উৎস পারস্য চিত্রশিল্পের প্রকট প্রভাব থাকায় একে ইন্দো-পারস্য স্কুল বলা যেতে পারে। আকবরের রাজত্বের (১৫৫৬-১৬০৫) অবসানে তদীয় পুত্র নূর-উদ্-দ্বীন মুহম্মদ জাহাঙ্গীর দিল্লীর মসনদে উপবিষ্ট হলে চিত্রশিল্পে এক আমূল পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়।
শিল্পমনা জাহাঙ্গীর প্রকৃতপক্ষে একটি অত্যুৎকৃষ্ট এবং অসাধারণ শৈল্পিক বৈশিষ্ট্যের ছাপ বহনকারী চিত্রশালার প্রতিষ্ঠাতা এবং ভারতীয় ও পারস্য প্রভাব এবং উপাদানের সংমিশ্রণে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ চিত্ররীতি ও কৌশলের পৃষ্ঠপোষক। জাহাঙ্গীরের রাজত্বে (১৬০৫-১৬২৭) চিত্রকলার উন্মেষ এবং বিকাশ ঘটে বলে একে মুঘল চিত্রশিল্পের স্বর্ণযুগ বলা হয়। চিত্রকলা অপেক্ষা স্থাপত্যশিল্পে সম্রাট শাহজাহান অসামান্য কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন, এই কারণে তাঁর রাজত্বে মুঘল চিত্রকলার পতন হতে থাকে এবং আওরঙ্গজেবের প্রতিকৃতি অঙ্কনের প্রতি বৈরী মনোভাব মুঘল চিত্রশিল্পের অধঃপতনকে ত্বরান্বিত করে। অবশ্য মুঘল চিত্রকলার অধঃপতনের একাধিক কারণ রয়েছে।
১৬০৫ হতে ১৬২৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালকে মুঘল চিত্রকলার স্বর্ণযুগ বা “মুঘল রেনেসাঁ” বলা যেতে পারে। প্রসঙ্গত বলা যায় যে, রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা ব্যতিরেকে মুঘল চিত্ররীতির উন্মেষ কখনোই হতে পারত না। হুমায়ূনের আমদানিকৃত পারস্যরীতি আকবরের রাজত্বে ভারতীয় পরিবেশে রূপান্তরিত হলেও বিভিন্ন কারণে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ, স্বয়ংসম্পূর্ণ, সংমিশ্রিত এবং অত্যুৎকৃষ্ট চিত্রশিল্পে পরিণত হতে পারেনি। একথা অনস্বীকার্য যে, আকবরের একনিষ্ঠ প্রচেষ্টায় মুঘল চিত্ররীতির উদ্ভব হয়, কিন্তু গুণগত দিক দিয়ে বিচার করে একে ইন্দো-পারস্য চিত্রকলা বলা হয়ে থাকে। ব্রাউন যথার্থই বলেছেন, “আকবর যে ডিম (মুঘল চিত্রকলার উন্মেষ) পাড়েন তাতে জাহাঙ্গীর তা দেন।”
আকবরের চিত্রশালায় যে শিল্পচর্চা হয়েছিল তাতে ভারতীয় এবং পারস্যরীতি ও কৌশলের সংমিশ্রণ ও সমন্বয় দেখা যায় না। তার কারণ বিবিধ- প্রথমত খাজা আব্দুস সামাদ এবং মীর সৈয়দ আলীর প্রভাবে মুঘল চিত্রশালার জন্ম এবং স্বভাবত এর প্রধান উৎস পারস্য চিত্রশিল্প। দ্বিতীয়ত আকবর এই চিত্রশালার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা লাভ করলেও জাহাঙ্গীরের মতো তাঁর দূরদর্শিতা ছিল না। তিনি মনে করতেন যে, সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল হতে এবং ভারতের বাইরে থেকে দক্ষ এবং অভিজ্ঞ শিল্পী সংগ্রহ করলেই উন্নতমানের শিল্প সৃষ্টি সম্ভব। উপরন্তু, চিত্রকরদের প্রয়োজনে তিনি রাজকীয় গ্রন্থাগারে অসংখ্য চিত্রিত ফারসী পান্ডুলিপি সংরক্ষণ করেন; সুতরাং স্বভাবত শিল্পীগণ অসংখ্য পারস্য চিত্ররীতি দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন।
অপরদিকে হিন্দু চিত্রকরদের সংখ্যাধিক্য থাকায় তাঁরা স্বাধীনভাবে ভারতীয় রাজপুতরীতিতে চিত্রাঙ্কন করতেন; এই কারণে ভারতীয় ও পারস্যরীতির সংমিশ্রণ সম্ভবপর হয়নি। তৃতীয়ত একটি চিত্রে একাধিক চিত্রশিল্পী নিয়োগের ফলে বিভিন্ন চিত্রধারায় অভিজ্ঞ শিল্পীদের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অভিব্যক্তিতে একটি বিরাট বৈষম্য দেখা যায়; অর্থাৎ একজন পারস্যরীতিতে স্কেচ, অপর একজন ভারতীয় রীতিতে প্রতিকৃতি অঙ্কন এবং তৃতীয়জন পারস্য কৌশলে রঙের প্রয়োগ করলে স্বভাবত শিল্পগত গুণাবলী ব্যাহত হয়। চতুর্থত আকবর তাঁর সুযোগ্য এবং শিল্পানুরাগী পুত্র জাহাঙ্গীরের মতো শিল্পচর্চায় ব্যক্তিগত প্রভাব প্রদর্শন করেননি।
শিল্পকলা একাডেমীর অধ্যক্ষের উপর চিত্রকলার উৎকর্ষ নির্ভর করায় প্রকৃত মুঘলরীতির আবির্ভাব ব্যাহত হয়েছে। আব্দুস সামাদের নিকট চিত্রকলায় শিক্ষালাভ করলেও জাহাঙ্গীরের মতো তিনি শিল্পমনা ছিলেন না। জাহাঙ্গীরের নির্দেশে অসংখ্য চিত্র অঙ্কিত হয়েছিল এবং তিনি যুদ্ধাভিযানেও চিত্রকরদের সাথে নিয়ে যেতেন। পঞ্চমত পারস্যরীতিতে আকবরের আমলে পান্ডুলিপি চিত্রায়ণ হয় এবং এই কারণে বিচ্ছিন্ন মিনিয়েচরের মাধ্যমে মুঘলরীতির পরিস্ফুটন সম্ভবপর হয়নি। যুবরাজ দানিয়েল বলেন, “শিরিন এবং ফরহাদের প্রেমের উপাখ্যান পুরাতন হয়ে গেছে এবং যখন আমরা পড়ি তখন পূর্বে আমরা যা দেখেছি এবং শুনেছি তা অপেক্ষা কোনো নতুনত্ব নেই।” জাহাঙ্গীরের পৃষ্ঠপোষকতায় মিনিয়েচর অঙ্কন হ্রাস পায়, কারণ শিল্পী পান্ডুলিপির ঘটনাবলী অপেক্ষা জীবন্ত চাক্ষুষ ঘটনাকে কেন্দ্র করে একক ও বিচ্ছিন্ন চিত্র অঙ্কনে মনোনিবেশ করেন। এক্ষেত্রে বলা যায় যে, প্রতিকৃতি অঙ্কনের রীতি মুঘল চিত্রকলাকে পান্ডুলিপি-চিত্রাবলী হতে মুক্ত করেছে।
জাহাঙ্গীরের সিংহাসনারোহণ মুঘল চিত্রকলার ইতিহাসে এক নবযুগের সূচনা করে। জাহাঙ্গীর নিজেও শিল্পী ছিলেন এবং চিত্রকরেরা তাঁর ব্যক্তিগত প্রভাব, শিল্পানুরাগ এবং একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষকতায় উৎসাহিত এবং অনুপ্রাণিত হয়ে শিল্পচর্চা করতে থাকেন। ধীরে ধীরে ইন্দো-পারস্যরীতি বিলুপ্ত হয়ে পূর্ণাঙ্গ মুঘলরীতির রূপান্তর সম্ভবপর হয়েছিল প্রধানত দুটি কারণে। প্রথমত, জাহাঙ্গীরের শিল্পানুরাগ এবং শৈল্পিক ব্যক্তিত্ব এবং দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা।
আকবর যুদ্ধবিগ্রহে এত ব্যস্ত ছিলেন এবং বিশাল মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় তাঁকে এত ব্যস্ত থাকতে হয় যে ব্যক্তিগত প্রভাব, নির্দেশনা অথবা অভিব্যক্তির প্রকাশ শিল্পের মাধ্যমে সফলকাম হয়নি। তিনি অসংখ্য শিল্পী সংগ্রহ করেছিলেন কিন্তু তাঁদের শিল্পচর্চায় সুষ্ঠু সামঞ্জস্যবিধান করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না; কারণ জাহাঙ্গীরের মতো তাঁর দূরদর্শিতা, শিল্পানুভূতি এবং সংবেদনশীল মন ছিল না। জাহাঙ্গীরের রাজত্বে নিরবচ্ছিন্ন শান্তি এবং শৃঙ্খলা বজায় ছিল এবং এই কারণে অবিরাম ও উন্নতমানের শিল্পচর্চার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
জাহাঙ্গীরের শিল্পানুরাগ এবং চিত্রকলায় অবদান সম্বন্ধে প্রধানত তাঁর আত্মচরিত হতে সঠিক তথ্য জানা যায়। মাত্র সাঁইত্রিশ বছর বয়সে সিংহাসনে আরোহণ করে উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি একটি সুসংঘবদ্ধ বিশাল সাম্রাজ্যই লাভ করেন নি বরং স্বীয় শিল্পানুভূতির বহিঃপ্রকাশস্বরূপ একটি সুপ্রতিষ্ঠিত এবং অত্যুৎকৃষ্ট চিত্রশালাও পিতার নিকট হতে পেয়েছিলেন। যুবরাজ হিসেবে তিনি প্রথম যুগের শিল্পচর্চায় আকৃষ্ট হন এবং আবুল ফজল রচিত ‘আকবরনামা’র চিত্রিত পান্ডুলিপিতে উল্লেখ আছে যে, ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দে জাহাঙ্গীর উক্ত গ্রন্থখানি রাজকীয় গ্রন্থাগারে অর্পণ করেন।
গ্যারেট সংগ্রহের ‘জাফরনামা’য় (১৪৬৭ খ্রিস্টাব্দ) জাহাঙ্গীরের স্বহস্ত লিখিত একটি নোট রয়েছে; “আল্লাহ মহান! মওলানা শির আলী লিখিত ‘জাফরনামা’ গ্রন্থখানিতে আট জোড়া (প্রকৃতপক্ষে ছয় জোড়া অর্থাৎ বারোটি) চিত্র রয়েছে এবং এগুলো অপ্রতিদ্বন্দ্বী রীতিকৌশল ওস্তাদ বিহযাদ প্রথম যুগে অঙ্কন করেন। আমার স্বর্গপ্রাপ্ত পিতার গ্রন্থাগার হতে আমার সিংহাসনারোহণের প্রথম বছরে (১০১৪ হিজরি/১৬০৫ খ্রিস্টাব্দ) এটি আমার গ্রন্থাগারে প্রদান করা হয়েছে। স্বাক্ষরকারী নূর-উদ্-দ্বীন মুহম্মদ জাহাঙ্গীর শাহ আকবর।”২ সুতরাং চিত্রিত পান্ডুলিপির প্রতি শুধু আগ্রহ এবং অনুরাগই নয়, বরং মিনিয়েচরগুলোর শিল্পগত গুণাবলী পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা জাহাঙ্গীরের যে ছিল তা অনস্বীকার্য।
সুকুমার প্রবৃত্তি জাহাঙ্গীর তাঁর প্রপিতামহ বাবুরের নিকট হতে লাভ করেছেন উত্তরাধিকারসূত্রে এবং এই দুজন অসামান্য ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সম্রাটের মধ্যে চরিত্রগত গুণাবলীর দিক দিয়ে অপূর্ব সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। উভয়েই আত্মচরিত লিখে খ্যাতি অর্জন করেন; উভয়ের অসাধারণ ব্যুৎপত্তিজ্ঞান এবং চারু ও কারুশিল্পের প্রতি অনুরাগ ছিল। উভয়ে উদ্যান, ফুল, প্রকৃতি, ভ্রমণ, মৃগয়া পছন্দ করতেন। উভয়ে যেমন মাত্রাসহকারে মদ্যপান করতেন তেমনি কাব্য, সঙ্গীত ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় ছিলেন ব্যাপক উৎসাহী।
উল্লেখ্য, জীবজন্তুর প্রতি সহানুভূতিশীল মন তাঁদের চরিত্রকে পূর্ণরূপে বিকশিত করেছিল। বংশগত দিক বিচার করলে দেখা যাবে জাহাঙ্গীরের মধ্যে মোঙ্গল-চাগতাই এবং ভারতীয় রক্তের সংমিশ্রণ হয়েছে; কারণ তিনি ছিলেন আকবরের রাজপুত মহিষী যোধবাঈ-এর পুত্র। কিন্তু বাবুর মোঙ্গল-চাগতাই বংশ সম্ভূত। ব্রাউন মনে করেন যে, মধ্য-এশিয়া এবং ভারতীয় রক্তের সংমিশ্রণের ফলে জাহাঙ্গীরের মানসিক দৃষ্টিভঙ্গিতে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গিকে অ-ভারতীয় বলা যায় না, কারণ জাহাঙ্গীরের চিন্তাধারায় যে অন্তর্মুখী প্রবাহ পরিলক্ষিত হয় তা-ই পরবর্তীকালে তাঁর চিত্রশিল্পকে জাতীয় চিত্রকলার প্রকৃত মুঘল চিত্রকলায় রূপান্তরিত করে। অনুভূতিশীল এবং আবেগপ্রবণ মন থাকায় জাহাঙ্গীর মুঘল চিত্রশিল্পকে বাস্তব এবং পূর্ণাঙ্গ রূপদান করতে সক্ষম হন। তাঁর ধমণীতে যেমন পারস্য-তুর্কী এবং রাজপুত রক্তের সংমিশ্রণ হয়েছিল তাঁর চিত্রকলাতেও পারস্য এবং রাজপুতরীতির মিলন হয়েছিল।
জাহাঙ্গীরের চিত্রশালায় প্রধানত তিন ধরনের চিত্র অঙ্কিত হত যথা- ১. পান্ডুলিপি-চিত্রাবলী অর্থাৎ মিনিয়েচর ২. পোর্ট্রেট অর্থাৎ প্রতিকৃতি এবং ৩. ফুল- লতাপাতা ও প্রকৃতি। জাহাঙ্গীরের দরবারে হিরাত হতে একজন চিত্রকর আগমন করেন। তিনি আগা রিজা নামে পরিচিত। যুবরাজ সেলিম আগা রিজার পৃষ্ঠপোষকতা করেন এবং শিল্পচর্চায় তাঁর পুত্র আবুল হাসান অসামান্য কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন। সিংহাসনে আরোহণ করে জাহাঙ্গীর পিতার পদক্ষেপ অনুসরণ করেন এবং রাজকীয় গ্রন্থাগারে অসংখ্য মূল্যবান চিত্রিত পান্ডুলিপি সংগ্রহে মনোনিবেশ করেন। সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে তিনি প্রতিনিধি প্রেরণ করে মূল্যবান প্রাচীন চিত্রিত গ্রন্থাবলী এবং একক চিত্রাবলী সংগ্রহ করেন। তাঁর রাজকীয় আর্ট গ্যালারিতে বিভিন্ন স্কুলের শিল্পনিদর্শনগুলো পর্যবেক্ষন এবং উপভোগ করবার যথেষ্ট সুযোগ ছিল এবং চিত্রকরেরা স্বভাবত এগুলো দ্বারা প্রভাবান্বিত হতেন। রামপুর স্টেট লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত ও ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দে চিত্রিত জাহাঙ্গীরের চিত্রশালার অন্যতম প্রধান প্রথম মিনিয়েচার হচ্ছে “প্রেমিকের সঙ্গে রাজকুমারীর পলায়ন”।
দৃশ্যটি রাত্রিকালের এবং এর প্রমাণ পাওয়া যায় চিত্রের উপর বাম কোণায় একফালি চাঁদের অবস্থানে এবং অন্তঃপুরিকা ও দ্বাররক্ষীদের নিদ্রামগ্ন অবস্থায়। একটি অতি চমৎকার বাগান-প্রাসাদের দৃশ্য অঙ্কন করা হয়েছে যার স্থাপত্যকীর্তি পারস্য, কিন্তু গাছপালা, বিশেষভাবে কলা গাছ, ছাদে ময়ূর, মহিলাদের মুখাবয়ব ও পোশাক-পরিচ্ছদ সম্পূর্ণরূপে ভারতীয়। শিল্পীর রঙের প্রতি মোহ, বিষয়বস্তুর সুষ্ঠু বিন্যাস ও রোমাঞ্চকর পরিবেশ খুবই আকর্ষণীয়। চিত্রটিতে পারস্য মুঘল চিত্ররীতির সংমিশ্রণ দেখা যায়। জাহাঙ্গীর যে সমস্ত পারস্য চিত্র সংগ্রহের জন্য গর্ববোধ করতেন সেসবের মধ্যে বিহযাদের স্কুলে ১৪৯৯খ্রিস্টাব্দের অঙ্কিত চারটি মিনিয়েচার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
সম্রাট এগুলো পনেরো শত টাকায় ক্রয় করেন। তিনি স্বীকার করেন যে, পারস্য চিত্রকরদের মূল মিনিয়েচারগুলো সংগ্রহ খুবই কষ্টসাধ্য এবং সে কারণে বিহযাদের প্রকৃত চিত্রাবলীর পরিবর্তে তাঁর শিষ্যদের অঙ্কিত মিনিয়েচারগুলো নিয়েই সম্রাটকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। অপর একটি মূল্যবান সংগ্রহ ছিল মোল্লা পীর আলী লিখিত ‘ইউসুফ এবং জুলেখা’র চিত্রিত পান্ডুলিপি। অপূর্ব সুন্দররূপে বাঁধানো এ পান্ডুলিপির মূল্য এক হাজার মোহর। জাহাঙ্গীর তাঁর আত্মচরিতে দু‘শত বছরের পুরাতন অর্থাৎ পঞ্চদশ শতাব্দীতে অঙ্কিত প্রখ্যাত চিত্রকর খলিল মির্জার স্বাক্ষরিত একটি মিনিয়েচার সংগ্রহের কথা উল্লেখ করেন। তাঁর বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, শাহ আব্বাসের গ্রন্থাগারের পরিচালক সাদেকী এই পারস্য চিত্রটি বিক্রয় করেন। কিন্তু ঘটনাচক্রে এটি ইসফাহানে অবস্থানরত খান আলমের হস্তগত হয়। শাহ আব্বাস তা জানতে পেরে আলমের নিকট থেকে দেখবার উদ্দেশ্যে তা চেয়ে পাঠান এবং নিজ সংগ্রহে রাখেন। পরে জাহাঙ্গীরের আগ্রহের কথা শ্রবণ করে শাহ আব্বাস তা পারস্যের রাজধানী ইসফাহানে অবস্থানকারী সম্রাটের প্রতিনিধিকে অর্পণ করেন।
পারস্য দেশ থেকে খলিল মির্জার চিত্রটি জাহাঙ্গীর লাভ করে সমঝদারের মতো বলেন-- “এটি খুবই উচ্চমানের শিল্পকর্ম এবং ওস্তাদ বিহযাদের সমতুল্য। এতে যদি স্বাক্ষর না থাকত তা হলে এটি বিহযাদের চিত্র বলে ভ্রম হত। যেহেতু এটি বিহযাদের আবির্ভাবের পূর্বে অঙ্কিত হয়, সেহেতু তিনি খলিল মির্জার অন্যতম শিষ্য হতে পারেন এবং ওস্তাদের রীতিকৌশল গ্রহণ করেন।” এ ধরনের মন্তব্য কেবল দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, ধীশক্তির অধিকারী ও শিল্পমনা কোনো রসজ্ঞ সম্রাটের পক্ষেই সম্ভব।
১৬০৫ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করে জাহাঙ্গীর পিতার সুপ্রতিষ্ঠিত চিত্রশালার স্বত্বাধিকারী হয়েছিলেন সত্য কিন্তু আকবরের রীতি পদ্ধতিকে তিনি বর্জন করে স্বীয় অভিব্যক্তির প্রতিফলন ঘটিয়ে চিত্রশিল্পে নতুন প্রেরণা দান করেন। মুঘল চিত্রশালার প্রতিষ্ঠাতা মীর সৈয়দ আলী এবং খাজা আব্দুস সামাদ মৃত্যুবরণ করলে মধ্য-এশিয়ার অধিবাসী ফারুখ বেগ কামাল অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। উপরন্তু, মধ্য-এশিয়া থেকে মুহম্মদ নাদির এবং মুহম্মদ মুরাদ নামে দুজন প্রতিভাশালী চিত্রকর মুঘল দরবারে আগমন করেন। শাহজাহানের আমলে আগত অপর একজন শিল্পী ব্যতীত মুঘল চিত্রশালায় অপর কোন অভারতীয় চিত্রকর ছিলেন না এবং ভারতীয় মুসলিম ও হিন্দু চিত্রকরদের প্রাধান্য ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে।
জাহাঙ্গীরের চিত্রশালায় দুজন ক্ষণজন্মা মুসলিম চিত্রশিল্পীর সৃজনশীল শিল্পচর্চায় মুঘল চিত্রকলার প্রকৃত বিকাশ এবং উৎকর্ষ সাধিত হয়। তাঁরা হচ্ছেন আবুল হাসান ও ওস্তাদ মনসুর। অসামান্য প্রতিভার স্বীকৃতিস্বরূপ জাহাঙ্গীর আবুল হাসানকে ‘নাদির-উজ-জামান’ অর্থাৎ যুগের শ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করেন। ‘তুজুখ-ই-জাহাঙ্গীরী’র নামপত্র (Frontispiece) আবুল হাসান অঙ্কন করলে সম্রাট তাঁকে এরূপ মর্যাদা দান করেন। সম্রাট জাহাঙ্গীর তাঁর সম্বন্ধে মন্তব্য করেন: “তাঁর শিল্পকর্ম ছিল সর্বোৎকৃষ্ট এবং তাঁর চিত্র ছিল যুগের সর্বাপেক্ষা আকর্ষণীয়।” প্রতিকৃতি শিল্পী হিসেবে আবুল হাসান মুঘল চিত্রশালায় অসামান্য খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর অঙ্কিত জাহাঙ্গীরের আবক্ষ প্রতিকৃতি মুঘল চিত্রকলার একটি অনবদ্য সৃষ্টি। প্রোফাইলে অঙ্কিত বাদশাহ তাঁর পিতা আকবরের একটি প্রতিকৃতি হস্তে ধারণ করে আছেন এবং আকবর তদীয় পুত্রকে একটি ভূগোলক উপহার দিচ্ছেন। এর অর্থ- আকবর আশা করছেন যে, জাহাঙ্গীর সমগ্র বিশ্বের অধিপতি হবেন। বর্ণাঢ্য ও সূক্ষ্ম চিত্রাঙ্কন ব্যতীত প্রতিকৃতিদ্বয়ের রাজকীয় অভিব্যক্তি ও পরিশীলিত অলঙ্করণ পদ্ধতি এ চিত্রে মূর্ত হয়ে রয়েছে।
মনসুরের শিল্পকর্মের উদ্ভাবনশক্তি দেখে মুগ্ধ হয়ে জাহাঙ্গীর তাঁকে ‘নাদির-উল-আসর’ অর্থাৎ ‘যুগের বিস্ময়’ উপাধিতে ভূষিত করেন। প্রাণীজগতের চিত্রাবলী অঙ্কনের মাধ্যমে ওস্তাদ মনসুর বিশেষ মর্যাদা ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। বিশেষজ্ঞদের মতে মনসুর অঙ্কিত পাখির প্রতিকৃতিগুলোর মধ্যে ময়ূর ও তুর্কী মোরগ সর্বোৎকৃষ্ট। তাঁর চিত্রের মনোহর বাজপাখি, শৃঙ্খলবদ্ধ মেষ, সাদা বক, জেব্রা, মোরগ, নীল গলা বিশিষ্ট হিমালয়ের পাখি, লাল ঝুঁটি বিশিষ্ট জলচর পাখি প্রভৃতি প্রাণী অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও নিখুঁতভাবে প্রতিভাত হয়, যা খুবই হৃদয়স্পর্শী। প্রাণীজগতের প্রতি একাত্মতা এবং গভীর মমত্ববোধও মনসুরের চিত্রে বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। ভারতীয় মুসলিম চিত্রকরদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন দাওলাত। আকবরের হিন্দু চিত্রকরদের মতো জাহাঙ্গীরের চিত্রশালায় রাজপুত-রীতিতে দক্ষ অসংখ্য শিল্পী নিযুক্ত হয়েছিলেন, এঁদের মধ্যে বিশেষভাবে প্রতিভাশালী ছিলেন বিসনদাস, তারা চাঁদ, জগন্নাথ, মনোহর ও গোবর্ধন।
শিল্পানুরাগী জাহাঙ্গীরের রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মুঘল চিত্রকলা পূর্ণাঙ্গ এবং প্রস্ফুটিতরূপ ধারণ করে। আকবরের যুগের অসামঞ্জস্য, বৈষম্য, অনড় ভাবভঙ্গি, রুক্ষতা এবং উপাদানের সংঘাত মুঘল চিত্রশিল্পকে বাস্তবধর্মী এবং জাতীয় চিত্রশিল্পে পরিণত করতে পারেনি; কিন্তু জাহাঙ্গীরের বাইশ বছরের রাজত্বকালে মুঘল চিত্রকলা উৎকর্ষের চরম শিখরে উপনীতই হয়নি বরং এর বিকাশ ঘটে চারুকলার বিভিন্ন ক্ষেত্রে। বস্তুত মুঘল চিত্রকলার রেনেসাঁ ও প্রতিষ্ঠায় সম্রাট জাহাঙ্গীরের অবদান ও গুরুত্ব যেমন সর্বাধিক তেমনি চিরস্মরণীয়।