পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুদ্র বই আর নৃশংস গণহত্যার স্মৃতিচিহ্নের খোঁজে গির্জায়


অর্ধ-জাহান ইস্ফাহানের নাকশে জাহান দেখে বিস্মিত মন নিয়ে বিকেলে আসলাম জায়ান্দে নদীর দক্ষিণ পাড়ে অবস্থিত শিয়ায়ি মুসলিম অধ্যুষিত ইস্ফাহান শহরের অভ্যন্তরে একখণ্ড আর্মেনীয় খ্রিস্টানদের বাসভূমি নু জুলফা বা নব জুলফা এলাকায়। সতেরো শতকের গোড়ার দিকে গোড়াপত্তন হওয়া এ এলাকাটি এখনো গোটা বিশ্বে অন্যতম বৃহৎ আর্মেনীয় কোয়ার্টার হিসেবে বিখ্যাত। জুলফা মূলত আজারবাইজানের ভেতরে আর্মেনীয়দের স্বশাসিত প্রজাতান্ত্রিক একটি ছিটমহল। যেটি ইরান ও তুরস্ক সীমান্তের নিকট অবস্থিত। সাফাভি আমলে শাহ আব্বাসের নির্দেশে সেই প্রাচীন জুলফা থেকে বেশ কিছু অধিবাসীকে এখানে স্থানান্তরিত করার মাধ্যমে এ এলাকাটি গড়ে তোলা হয়। শাহের ইচ্ছে ছিল জুলফাবাসীর সিল্ক বুনন ও ব্যবসার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসায়িক ফায়দা হাসিল করা। আর্মেনীয় বণিকদের তৎকালীন ইরানি অর্থনীতিতে এক অভূতপূর্ব অবদান ছিল। তারা ইউরোপিয়ানদের সঙ্গে বিশেষ করে ইংল্যান্ড, স্পেন আর রাশিয়াসহ অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে পারস্য সিল্ক, ঘড়ি, কাচ, চশমা আর পেইন্টিংসহ নানা দামি সামগ্রীর জমজমাট ব্যবসা গড়ে তুলেছিলেন। তাই সাফাভি আমলের এ খণ্ড জায়গাটির গুরুত্ব ইস্ফাহানসহ ইরানের জাতীয় ইতিহাসে অনেক গুরুত্ব রাখে। কিন্তু আঠারো শতকে নাদির শাহ তাদের ওপর মাত্রাতিরিক্ত কর ও শুল্ক আরোপ করলে তাদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়। কিন্তু ঔজ্জ্বল্য এখনো আছে। এখানকার অধিবাসীদের সঙ্গে নাগার্নো-কারাবাখের এবং জিও পলিটিক্সের এক দীর্ঘ সূত্র জড়িয়ে আছে। থাক সে কথা। আমরা সামনে এগিয়ে দেখি নব জুলফায় কী কী আছে। 

এ জায়গাটিকে বলা যেতে পারে ইরানের অভ্যন্তরে একখণ্ড স্বতন্ত্র খ্রিস্টান ভূমি। কেননা, একটি আর্মেনীয় খ্রিস্টান স্কুলসহ মোট ষোলোটি গির্জা আছে এখানে। ইরানের জাতীয় ইসলামি বিধান পর্দাই শুধু মেনে চলে এখানকার প্রায় বিশ হাজার অধিবাসী। কিন্তু নিজেদের ভিতরে আর্মেনীয় ভাষায় কথোপকথন, তাদের নিজেদের ঐতিহ্যের খাদ্যাভ্যাস, সত্তা আর সংস্কৃতি এখনো লালন করে চলছে। খ্রিস্টমাসের সময় ইউরোপীয় অন্যান্য শহরের মতো এখানেও সাজসজ্জা করা হয়। যা দেখে মনে হবে না তারা ইরানের পেটের ভেতর আছেন।

জায়গাটি সম্পূর্ণ ঘুরে দেখা না হলেও আমরা প্রধান দুটো স্থাপনা ঘুরলাম। যাতে তাদের সম্পর্কে মোটামুটি স্পষ্ট ধারণা লাভ করা যায়। প্রথমেই আমরা খয়েরি রঙের মধ্যমানের একট গম্বুজ ও স্বতন্ত্র দুটো মিনারওয়ালা একটি ভবনে প্রবেশ করলাম। যার নাম ফারসিতে কালিসেয়ে অমনা পারকিচ আর বাংলায় অমনা পারকিচ গির্জা। ইংরেজিতে নামকরণ করা হয়েছে হলি স্যাভিওর ক্যাথেড্রাল। যেটি ভাঙ্ক (সাধু-সন্ন্যাসী) চার্জ নামেও সুপরিচিত। ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ শুরু হওয়া গির্জাটি আর্চবিশপ ডেভিডের তত্ত্বাবধানে ১৬৬৪ খ্রিস্টাব্দে এসে শেষ হয়। এটির বাহির অবয়ব এমনভাবে তৈরি যে, প্রথম দেখাতেই ইরানি স্থাপত্যকলার মসজিদ মনে হবে। কিন্তু অভ্যন্তরে এটি অর্ধ-অষ্টবৃত্তাকার এপস দিয়ে এমনভাবে উত্থিত যা পশ্চিমাবিশ্বের গির্জাগুলোতে সাধারণত দেখা যায়। মসৃণভাবে তৈরি করা দেয়ালগুলো দেখলে মনে হবে আধুনিক রীতির ইটদিয়ে তা নির্মিত।

গির্জা এলাকায় প্রবেশ করেই দুটি কবর দেখলাম। এপিটাফে লেখা দেখে বুঝলাম যে উপরোক্ত আর্চবিশপ ডেভিড ও আরেকজন শায়িত আছেন এখানে। এপিটাফের ছবিতে ধর্মীয় পোশাক পরিহিত উজ্জ্বল চেহারা আর লিপিবদ্ধ আছে নাতিদীর্ঘ পরিচয়। এরপর দেখলাম বেল টাওয়ার। ঘণ্টা বাজিয়ে প্রার্থনার সময় জানান দেয়া হয় এখান থেকে। তার পাশেই সারিবদ্ধ আরও কয়েকটি সমাধি।

মূল গির্জার ভিতরে প্রবেশ করলেই পিতলের গায়ে নকশা আঁকা সংরক্ষিত একটি চেয়ার নজর কাড়ল। ওটাতে আর্চবিশপ বসতেন। ইস্ফাহানি সেই সুখ্যাত কার্পেট বিছানো চেয়ারটির সামনে। এ বাবা চোখ ধাধানো কত্ত কত্ত দেয়ালচিত্র! ঠিক যেন চেহেলসুতুন। তবে এখানকার বিষয়বস্তু ভিন্ন। তিল ধারণের ঠাঁই নেই। দেয়াল, ছাদ আর গম্বুজের গাত্রে সোনালি, নীল আর হলুদ রঙের প্রাধান্য দিয়ে বিশাল, ক্ষুদ্রাকৃতির অসংখ্য চিত্র বাঁকানো আর তক্তার মতো টাইলসের গায়ে জ্বলজ্বল করছে।

এতগুলো দেয়ালচিত্রের বর্ণনা দিতে গেলে সে এক অভিসন্দর্ভ হয়ে যাবে। তাই ওসবের মধ্যে যে দৃশ্যগুলো আমার ভালো লেগেছে আর তাড়িত করেছে তার কিছু কিছু লিখছি। নান্দনিক ঝাড়বাতির আলোয় একমাত্র গম্বুজের গায়ে মানুষ সৃষ্টি হতে আদম (আ.) ও হাওয়ার (আ.) পৃথিবীতে আগমন ক্রমান্বয়ে সজ্জিত। জান্নাত ও জাহান্নামের দৃশ্য সবিশেষ আকর্ষণীয়। জাহান্নাম হলো সবচেয়ে নিচে এখানে মেয়েদের শাস্তি দেয়া হচ্ছে। বড় কালো কালো দানব তাদেরকে বস্ত্রহীন অবস্থায় কামড় দিচ্ছে, হাতুড়ি দিয়ে প্রহার করছে। বিষাক্ত কালো সাপ ছোবল দিচ্ছে। তার উপরে জান্নাতের দৃশ্য। যাতে পুরুষরা বাগানে আছে। সুখ আর আনন্দের হিল্লোল বয়ে যাচ্ছে। তার উপরে দাঁড়িপাল্লা দিয়ে একজন পাপ-পূণ্যের ওজন করছে। মূসা (আ.) যেন জন্ম নিতে না পারেন সে জন্য মায়ের কোলে নিষ্পাপ হাজারে হাজারে ছেলে শিশুকে ফেরাউনের বাহিনি কর্তৃক হত্যার সেই নিষ্ঠুরতার চিত্র হৃদয়কে গামগিন করল। কিন্তু সে দৃশ্য আমাদের পতন যে অবশ্যম্ভাবির শিক্ষা দেয় তা বেমালুম হয়ে মচ্ছবে মাতি। পাশের চিত্রে মুসা (আ.) ও ফেরাউনের মধ্যে যখন তুমুল যুদ্ধ হয়েছিল তখন নীল নদের পানিকে দ্বিখণ্ডিত করা হয়েছিল তার দৃশ্য সুন্দরভাবে অঙ্কন করা হয়েছে।

তার ওপরে হযরত ঈসা (আ.) এবং তার উপরে জিবরাইল (আ.)। তবে ঈসা (আ.) বা যিশুকে আলোকিত সূর্যের মাঝখানে দেখা যাচ্ছে। অপর চিত্রে দেখা যাচ্ছে যে, তিনি মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করতেছেন। বিবি মরিয়মের (আ.) কাছে সন্তান আসার পয়গাম নিয়ে আসার যে চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তা দৃষ্টি-নন্দন। যিশুর জন্ম থেকে লালন-পালন, মরিয়মের সতীত্বের প্রমাণ ইত্যাদি অত্যন্ত সুনিপুণভাবে অঙ্কিত হয়েছে। অনেক বড় করে একটি দৃশ্যে যিশুর ১০ টি ফরমান হাতে নিয়ে লোকজনকে পাঠ করে শোনানো হচ্ছে। একটি ছবিতে মেয়ে মানুষকে শুয়ে দিয়ে তার পেট কেটে নাড়িভুঁড়ি বের করার এক বিভৎস দৃশ্য দেখে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। আরও ভীতি সঞ্চারিত হলো তার চোখ তুলে নেয়া দেখে। যিশু খ্রিস্টকে ক্রুশবিদ্ধকরণের যে চিত্র অঙ্কন করা হয়েছে তা অন্যান্য চিত্র থেকে পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মূলত উপরের অংশে ঈসা (আ.) ও খ্রিস্ট ধর্ম সম্পর্কিত চিত্র। নিম্নাংশে আর্মেনীয়দের ওপর গণহত্যা ও নির্যাতনের চিত্র। কিছু চিত্রে ইরানি মিনিয়েচার রীতি অনুসরণ করা হলেও বেশিরভাগ চিত্রেই আর্মেনীয় চিত্রকলার অনুসরণ করা হয়েছে।

বন্ধুগণ ক্যামেরা হাতে খটাখট ছবি তুলছেন কিন্তু বাঁধ সাজলেন গির্জার মধ্যখানে দায়িত্বে থাকা সফেদ মতো সেই আর্মেনীয় মহাশয়। গাইডেন্সকে কড়াভাবে বলে দিলেন ফারসিতে কিছু একটা। আর সেটাই উনি ভারিক্কি গলায় এভাবে বলছেন, ‘লুতফান ফলাশ না ঝান! প্লিজ, দোন্ত ফ্ল্যাশ!’ কাচুমাচু করে ফ্ল্যাশলাইট বন্ধ করে নিজেদের ক্যামেরাবাজি চালাতে লাগল বন্ধু সকল। খসরু-শিরিনের দেয়ালচিত্রের নিচে একটি লাস্যময়ী ইরানি মেয়ের সঙ্গে উপচে পড়া আগ্রহ নিয়ে বাতচিত করছিল কামাল। আমি কাছে পৌঁছুতেই বিচ্ছেদ ঘটল। মেয়েটি হনহন করে লোকসংস্কৃতি গ্যালারির দিকে এগিয়ে গেল। ‘কী রে কামাল? খুব ফ্লার্ট করলি তাই না?’ ওর লজ্জা মিশ্রিত উত্তর ছিল, ‘নারে বন্ধু, ওই মেয়েটার নামও শিরিন। সে আসছে শিরাজ থেকে। এই যা দুয়েকটা কথা বলছিলাম আরকি।’ ‘ও বাবা, তার মানে তুইও কি খসরু সেজে শিরির সঙ্গে সাক্ষাৎ করছিলে রে এতক্ষণ?’ এবার গাম্ভীর্যের সঙ্গে উত্তর করল, ‘ওই, তুই যা কস না! ওই মেয়ে হলো ইরানি শিয়া। আর আমি সুন্নি বাঙালি। শুনলাম ওর নাকি বাগদান হয়ে গেছে এক ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে। আমি এখন প্রেমে পড়লে নির্ঘাত হতভাগ্য ফরহাদের মতো পাহাড়চূড়া থেকে লাফিয়ে প্রাণদান ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না।’ বন্ধুর এসব বিষাদময় কথা শুনে পা বাড়ালাম শিরিকে অনুসরণ করে লোকসংস্কৃতির বিশেষ গ্যালারির দিকে। 

এখানে আলাদা দুটো নারী মূর্তিকে ইরানি-আর্মেনীয় লোকসংস্কৃতির সবিশেষ গাঢ় রঙের ঝলমলে পোশাকে সজ্জিত দেখলাম। পাশেই বর-বধূকে কাচের বাক্সবন্দি দেখলাম। কি বৈচিত্র্য তাদের পোশাক আশাকে! জরি, মালা, চুমকি আরও কতকিছু! ভাবলাম, কামালও বোধহয় ওর মনো খাঁচায় এই শিরিকে নিয়ে ওরকম কল্পনাচিত্রের বর-বধূর সুখস্মৃতি এঁকে রাখল। যার ব্যাপ্তি এই কালিসে আর তার হৃদয়।

গির্জার উঠোন জুড়ে যেমন অনেক সমাধি। তেমনি একটি কোণে খানিক উঁচু করে ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে অটোমান তুর্কিদের দ্বারা আর্মেনীয়দের গণহত্যার স্মৃতিবিজড়িত গণকবর। যেখানে দেড় লক্ষ আর্মেনীয়কে একসঙ্গে হত্যা করা হয়েছিল। দেয়াল ঘেঁষে কয়েকটি লম্বাটে কম পাতাওয়ালা গাছ দাঁড়িয়ে গণকবরবাসীকে দিনেরবেলা সামান্য ছায়া আর রাতেরবেলা শোকসন্তপ্ত কান্নার অশ্রু হিসেবে শিশির দিয়ে সিক্ত করে দেয়। মেটো রঙের চারটি অনুচ্চ পিলারকে একমাথায় মিলিত করে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। যা নৃশংসতার সাক্ষী। এপিটাফে অনেকের নাম ও পরিচয় লিপিবদ্ধ করা আছে।

গির্জার মুখোমুখি বা তার মধ্যম দৈর্ঘ্যের চত্ত্বরের মাঝেই খাচাতুর কেসারাতসি নামক একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বিখ্যাত জাদুঘর আছে। এটি শুধু জাদুঘর নয়, বরং প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের অন্যতম উৎস ঐতিহাসিক অনেক গ্রন্থের মূল পাণ্ডুলিপির সংরক্ষণাগার বনাম গ্রন্থাগার। কি কিম্ভূতকিমাকার নাম তাই না! কিন্তু যে নামটি দিয়ে এই জাদুঘর ও গ্রন্থাগারের নামকরণ করা হয়েছে তা একজন তুর্কি খ্রিস্টান ব্যক্তির নাম। তুরস্কের মধ্য আনাতোলিয়ার শিল্প এলাকা কায়জেরিতে ১৫৯০ খ্রিস্টাব্দে জন্ম নেয়া কেসারাসতি নব জুলফাতে ৫৫/৫৬ বছর বয়সে ১৬৬৪ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। আর্মেনীয় জাতিভুক্ত সাফাভি আমলে তিনি শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। পেশায় আর্চবিশপ ও প্রিন্টিংপ্রেসের মালিক এ ব্যক্তিই ইরানে ১৬৩৪/১৬৩৬ খ্রিস্টাব্দে প্রথম প্রিন্টিং প্রেস চালু করেন। আর তাঁর মাধ্যমেই ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে ইরানে প্রথম কোনো বই ছাপানো হয়। যেটি ছিল বাইবেল অন্তর্ভুক্ত প্রার্থনাসংগীতের গ্রন্থ। গ্রন্থাগারটির প্রধান ফটকের বাঁপাশে এ মহান ব্যক্তির আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করে সম্মান জানানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর ডানপাশে স্থাপিত হয়েছে আর্মেনীয় লিপির জনক মেজরপ মাশটটস এর আবক্ষ মূর্তি।

জাদুঘরের ভিতরে ঢুকলাম। সিসি ক্যামেরার আওতাভুক্ত জাদুঘরটির নিচতলার মেঝেতে কয়েকটি কাচবন্দি বাক্সে বিভিন্ন জিনিস ও তৈজসপত্রের ডিসপ্লে। তারপর দেয়ালগুলোতে সেই আর্মেনীয়দের হত্যাকাণ্ডের যে দগদগে ক্ষতের প্রতীক নানা ছবি, চিত্র, বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে তাতে চোখ ভিজে গেল আমার। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষীণ-শীর্ণ আর আহতাবস্থার সাদা-কালো মমতা জাগানো ছবিগুলো। তবে বেশকিছু ব্যক্তির রঙিন ছবি সাঁটানো, যাঁরা সেই গণহত্যা থেকে নিজেদেরকে বাঁচাতে পেরেছিলেন। কয়েকজনের রোমহর্ষক বর্ণনাও আছে।
জাদুঘর বা লাইব্রেরিটির সবথেকে আকর্ষণের বিষয় হচ্ছে এখানে সংরক্ষিত ৭০০টি হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি। হাতে লেখা সে বইগুলোতে নানা রঙের যে ছবি ও হাতের লেখা অক্ষত আছে তা দেখে এই কম্পিউটার যুগের আলস্যে ভোগা মানুষজনের ঔদাসিন্য আমাকে ভাবায়। কত পরিশ্রমী আর আন্তরিক হলে এধরনের সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম রসবোধের কাজ করা যায়! মানুষের সমাবেশের যে চিত্র অঙ্কন করেছেন তাতে চোখ-মুখ বা অন্যান্য প্রত্যঙ্গ বাস্তবভাবে ফুটে না উঠলেও মননের বিষয়গুলোর কোনো কমতি পরিলক্ষিত হয় না। চার সময়ের চারজন শাসকের শিরোপরিচ্ছদে সেসময়কার শিল্পীদের কলাকুশলী দেখে অবাক হতে হয়। খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীগণের আবেগের যে অনুষঙ্গ ও মিথ তা এগুলোতে থরে থরে প্রথিত। এমন কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ এখানে সংরক্ষিত যা দেখতে অণুবীক্ষণ যন্ত্রেরও ব্যবস্থা আছে।

অণুবীক্ষণযন্ত্র লাগবে না কেন? এত ক্ষুদ্র গ্রন্থ দেখতে তো তার ব্যবহার অত্যাবশ্যক। আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন যে, কত ছোট্ট গ্রন্থ গো ভাই? হ্যাঁ, বলছি। গ্রন্থটি এত ছোট্ট যে, যার ওজন মাত্র ০.৭ গ্রাম। তাহলে বুঝেন কত ক্ষুদ্র গ্রন্থ। পৃষ্ঠা সংখ্যা কত বা বিষয়বস্তু কী তা জানতে খুব আগ্রহী হয়ে উঠলেও জানা হয়নি। কোন ভাষায় রচিত, তাও উদ্ধার করতে সক্ষম হইনি। তবে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুদ্র সে গ্রন্থটির দাতার নামটি জানতে পেরেছি। সুহৃদ সে ব্যক্তিটি হচ্ছেন, জনাব খঝাক দার গ্রিগরিয়ান। লাইব্রেরিতে ভুক্তি নাম্বার ৪৬৪৭। 

খসরু-শিরিনের সেই (যে ছবিটি চেহেলসুতুনে দেখেছিলাম) সাক্ষাৎ ও কথোপকথনের বিখ্যাত চিত্রটি এখানেও স্থান পেয়েছে। তবে চেহেলসুতুনের থেকে ভিন্নভাবে। এ চিত্রে নীল রঙের ব্যবহার বেশি। একটি সাদামাটা চিত্রে একজন আর্মেনীয় পাচক দুহাতে দুটো চামচ আর ছাঁকনি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তার দুপাশে হাঁড়ি, বাটি, ছুরি, ঘুটনি, খন্তা, পানপাত্র, সাঁড়াশি ইত্যাদির ছবি। মধ্যে আর্মেনীয় অক্ষরে বর্ণনা লেখা। নিচে আংটায় মাংস ঝুলানো। মাংস কাটার নানা অস্ত্র। তাদের ঐতিহ্যের চিরায়ত প্রতীক।

প্রথম শাহ আব্বাসের যে চিত্রটি ফ্রেম করে সাঁটানো, তাতে তাঁকে ক্ষীণকায় অবয়বের অধিকারী মনে হচ্ছে। তবে সাজপোশাকে নেই কোনো কমতি। ইয়া লম্বা গোঁফে ফিরোজা রঙের পাগড়ি মাথায় আর স্বর্ণালি গাউনে ছোপ ছোপ পাতা-ফুল। কোষবদ্ধ তলোয়ারে বাঁহাত রেখে সাজানো দস্তরখান থেকে খাবারের পদ তুলে নিচ্ছেন। পানপাত্রগুলো দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়।

এছাড়াও প্রখ্যাত অনেক ব্যক্তির ছবি ক্রমান্বয়ে সাজানো আছে সেখানে। যেমন—প্রথমে নাসিরুদ্দিন শাহ, এরপর হচ্ছে ইসান লেডি, জেনারেল সারকিম খান, পোরট্রান্ট অব সলোমন প্রমুখের ছবি। তিনতলা বিশিষ্ট জাদুঘরটির অন্যতম আকর্ষণ ইরানের প্রথম প্রিন্টারটি। আরও কিছু ছবি ও চিত্রে আর্মেনীয়দের গ্রামীণ ও শহুরে মানুষ, চাকরিজীবী, ধোপা, তাঁতি, জেলে, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বিবাহ অনুষ্ঠান, আসবাবপত্র, চেয়ার, আংটি, ব্যবহৃত ধাতব মুদ্রাসহ জামাকাপড় পর্যটকদের অজানাকে জানার পিপাসা মিটাচ্ছে। আমার সঙ্গে আগত ইউরেশীয় আর ল্যাটিন আমেরিকান খ্রিস্টান বন্ধুদের বিশেষ আকর্ষণ করেছিল যিশুখ্রিস্টের ক্রুশবিদ্ধকরণ ছবি। বেশকিছু বাদ্যযন্ত্র ইরানিদের সংগীত প্রেমের প্রমাণ বহন করছে। তৎকালীন গ্রামীণ ইরানের মনোরম দৃশ্য ফুটিয়ে তুলে যে চিত্র ও ছবিগুলো পাশাপাশি সাজানো হয়েছে তা দেখে মনে হচ্ছে, ‘আরে ইরান কি তবে কৃষি প্রধান গ্রাম্যজীবনের দেশ!’
বেশিরভাগ সহপাঠীর চোখ-মুখ উজ্জ্বলতায় ভাস্বর। এত রুচিশীল আর ঐতিহ্যের জগৎ হতে এবার আমাদের পুনযাত্রা নাকশে জাহান। উদ্দেশ্য কেনাকাটা।


মীম মিজান, অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক, বাংলাদেশ

menu
menu