কোরপুল

(তিনটি ছোট উপন্যাস নিয়ে গ্রন্থ কোরপুল | আনোয়ারা আজাদ দীর্ঘদিন ধরে ছোটগল্প এবং উপন্যাস নিয়ে কাজ করছেন। বইটি ‘জয়তী’ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিতব্য।)

কোরপুল উপন্যাসের সামান্য অংশ 
তো কোরপুলের স্বামী ওকে মায়ের জিম্মায় রেখে দিয়ে ত্রিপুরার দিকে পা বাড়িয়েছিল কাজ খোঁজার বাহানা করে। কাজ না কচু, মরে যাই! বেটাছেলের আবার কাজের অভাব গা গ্রামে! হাত পা নাড়াতে জানলে কাজ ঠিকই জুটে যাওয়ার কথা। ত্রিপুরার দিকে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন হয় না। ত্রিপুরার লোকজন কি আকামের? কাম কাজ জানে না! হাত পা গুটায় তেঁতুল চুষে! আসলে যে সে বাঁজা বউয়ের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার কারণেই পালিয়ে গিয়েছিল সে কথা বুঝতে কারও বাকি ছিল না। গ্রামের মানুষকে এতোটা বেকুব মনে করারও কোনো কারণ নেই। সোজা সরল আছে খানিকটা কিন্তু বেকুব নয় গো! 

তো স্বামী পালিয়ে যাওয়ার পর ঘরের সব কাজ শেষে পা টা টিপে দেওয়ার পরও থেমে না থেকে শাশুড়ির ঘনঘন মুখ নাড়ানো চলছিলই, চপরচপর চপরচপর। উপায় না দেখে সহ্য করে নিচ্ছিল কোরপুল। শুধু তো পা টেপা টেপি নয় সাথে মোষের মতো খাটাখাটুনি; কিন্তু এতো কিছু করার পরও বাঁজা অপবাদে মনটা কুঁকড়ে যেতে শুরু করলে কোরপুল তার ভাবনার নদীটাকে একটু ঘোরাতে চেষ্টা করে। একটু দোলাতে চেষ্টা করে; দোল দোল দুলুনি। কারণ মন কুঁকড়ে যাওয়ার কথা বলতে পারলেও শরীরেরও যে নানা রকম কথা ছিল সে সব কাউকে বলা সম্ভব ছিলনা। কাকে বলবে, কিভাবে বলবে, এসব কথা কি বলা যায়? পাঁচ বছরের দাম্পত্য অভ্যাসে নিজেও যে অনেকটাই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল সেসব ঠেকাবে কেমন করে! খাওয়া পরার বাইরে, সন্তান কামনা চেষ্টার বাইরেও তো কথা থাকে। মেয়ে মানুষ বলে কি সব কিছু ঘুমায় থাকে? যদিও এই সমাজ মনে করে মেয়ে মানুষের বেশি কথা থাকতে নেই! বললেই হলো বেশি কথা থাকতে নাই! আরে বেকুব সমাজ কতটুকু জানে! ঘোড়ার ডিম জানে!

কি করবে এখন কোরপুল? খাবেই বা কী? শাশুড়ির পা টিপেটুপে চুলে বিলি কেটে একবেলা কোনো রকম খাওয়া জুটলেও বেশিদিন চলবে না এই ব্যবস্থা বোঝে সে। বিয়ের পর গরিব মেয়ে মানুষের বাপের বাড়িও যে আর থাকে না, সে কি তা জানে না? এই গ্রামের কোন জিনিসটা অজানা তার? বিয়ের পর বাপের বাড়ি যে ভাইয়ের বাড়ি হয়ে যায় খুব ভালো জানে সে।
সৎ মা নয়, যে মায়ের পেটে নয়মাস ছিল সে, সেই নিজের মাই তাকে বলেছিল, ফিইর‌্যা আসতে চাস, তর ভাই কি থাকতে দিব?
ভাই ক্যান, তুমার কথা বলো মা?
আরে পাগলী, তর বাপে নাই, ভাই-ই তো এখন মুরুব্বি। আমারেই কোনদিন খ্যাদায় দেয় তার ঠিক নাই।
মা, ও আমার ছোট ভাই, বড় ভাই না কিন্তু।
তায় কী? পুরুষ পোলা সেয়ানা হইলেই মুরুব্বি।

মায়ের সাথে এ নিয়ে আর বেশি কথা বলেনি কোরপুল। বয়স তো এক্কেরে কম হয় নাই, বাইশ তেইশ তো হবেই, কে অতো শত জানে! বেশিও হতে পারে কমও হতে পারে। এই বয়সেই সমাজের নিয়ম কানুন কম তো দেখলো না। এইটা করা যাইবো না ঐটা করা যাইবো না, কত কিছু যে করা যাইবো তার ঠিক নাই। সব যাইবো না শুধু মাইয়া মাইনসের জন্যই! এদিকে দাঁত কাঁমড়ে শ্বশুর বাড়িতেও যে বেশিদিন আর পরে থাকা যাবেনা তাও বুঝে গেলো সে। লাথি ঝাটা ছাড়াও আরও ম্যালা কিসিমের উপদ্রব শুরু হলো। বেড়া ছাড়া ক্ষেত দেইখ্যা ছাগল গরু হাঁস মুরগী সবারই ঘাস খাওনের জন্য মন উতলা হয়ে উঠলো। ডবকা ছোড়াগুলা তো ছিলই সাথে বুড়া বেটাগুলারও চোখ টেপা শুরু হলো। ফোকলা দাঁতওয়ালাও ছিল একজন। সাদা দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে ইশারা করা দেখলেই গা ঘিন ঘিন করতো কোরপুলের। 


আনোয়ারা আজাদ, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, ঢাকা।

menu
menu