প্রিয়-প্রাণ অথবা বাক্সবন্দি অপ্রিয় ভ্রমর

পৃথিবীর ভূমিকে সেদিন খুব পুড়িয়েছিল দিবাকর, জ্বলজ্বল কিরণের তাপ তখনো পুরোপুরি কমজোর হয়ে যায়নি বাতাসের গায়ে, দিনের আলো ম্লান হওয়ার সমস্ত প্রস্তুতি সেরে নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা ধবধবে সাদা চাঁদ অর্পণের প্রয়াস নিয়ে সন্ধ্যার দিকে আগাচ্ছিল আকাশ, পাখিদের ক্লান্ত ডানা ছুঁয়ে আজানের ধ্বনি মিশে যাচ্ছিল উষ্ণ বাতাসে; ধীরে ধীরে সন্ধ্যার কোলে চোখ বুঝল দিন…

গাড়ির অর্ধেক নামানো জানালার কাচ দিয়ে দেখতে পাওয়া দূরগাঁয়ের দৃশ্য আমাকে ফেলে ছুটে যাচ্ছিল রেসের ঘোড়ার মতো আর ইঞ্জিনচালিত যানের গতি আমায় নিয়ে ছুটছিল গন্তব্যের দিকে, হঠাৎ হঠাৎ কানে বেজে উঠছিল মৃদু ডাক ‘আগুনের ফুলকি…’  

আমায় যেন ভাসিয়ে নিচ্ছিল সেই ডাক বানের জল হয়ে। ভাসতে ভাসতে গন্তব্যে পৌঁছে, দৃষ্টিগোচর হলে চিরশব্দহীন নিদ্রারত প্রিয়প্রাণ, উৎপীড়ন এমন হলো, যেন সাইক্লোনের একঝাপটায় উড়ে গিয়ে তলিয়ে গেলাম সমুদ্রের গহিনে। হাবুডুবু খেতে খেতে অতল জলে নিস্তব্ধ আমি ভাবছি; চারিদিকে এত আর্তনাদ তবুও বুঝি এভাবে ঘুমানো যায়! ঘুমোতে হয় মেঝেতে মাদুর পেতে! এভাবেও গভীর নিদ্রা যাওয়া যায় বুঝি, কই আগে তো তাঁর এমন দক্ষতা দেখিনি!  

অথৈ জলে তলিয়ে যাওয়া দুইচোখে ঝাপসা মনে হচ্ছিল চরাচরের সকল কিছু। অমন তন্দ্রাঘোরে থাকা মুখ কতই না শিশুসুলভ হয়। তবুও সর্বক্ষেত্রে পৃথিবীর সমূহসুন্দর দেখার ক্ষমতা মানুষের থাকে না। সেদিন আমারও ছিল না। আমিও পারিনি। পারতেও চাইনি। সেদিন চক্ষুদ্বয় দেখতে চায়নি এমন নিদ্রা যাওয়া নির্ভার তাঁকে—দেখেনি তাঁর নিরাভরণ মুখ আর। 

অতীত হওয়ার পরপরই রাতঘন হওয়ার আগে আগে পরম আদরে ঘুমন্তকে স্নান করানো হলো এবং জানা গেল, তাঁকে না-কি আর ঘরেই আনা হবে না। তাঁর জন্য এমন ঘর আর নয়। এখন তাঁর উড়ার জন্য মস্ত এক-আকাশ চাই। সুনিদ্রার জন্য মাটির একচালা ঘর চাই। ঠিক তা-ই করা হলো; অথচ আমি চেয়েছিলাম, সে তাঁর জীবন অতিবাহিত হওয়া ঘরে ঘুমাবে যতক্ষণ পর্যন্ত মাটির দেয়াল নির্মাণ করা শেষ না-হয়; আমার ইচ্ছে কেউ শুনেনি…!

রাখা হলো একটা নারকেল গাছের তলে, ঠিক মাথার উপরে চাঁদকে পাহারায় রেখে। সারারাত জ্যোৎস্না গলে গলে পড়েছে নিথর গায়ে, আর নারকেল গাছের চিরল চিরল পাতার ফাঁকে উঁকি দিয়ে পাতাদেরকে বলেছে চাঁদ—বাতাস দাও বাতাস দাও; নিন্দ্রা যেন ভেঙে না যায়, বাতাস দাও…। পাতারাও ঠিক করেছে তেমনটাই; একটু থেমে থেমে পাতার বাতাস আর হিমের সান্নিধ্যে কাটছিল অপ্রত্যাশিত রাত। 

মাঝরাতে চাঁদের আলো আর পাতার শীতলবায়ুতে, উঠানজুড়ে বসা পাহারায় থাকা স্বজনদের চোখের পাতা হয়েছে এক। ঘরে-বাইরে সবার চোখ মুদে গেছে ক্লান্তি আর ঘুমে। সেই ফাঁকে নির্ভয়ে কতবার আসা যাওয়া তাঁর কাছে। ধবলসাদা পিরান গায়ে ঘুমানো খাটিয়ার চারিপাশে গুঁজে দেয়া আগরবাতি; আতর সমেত লোবানের ঘ্রাণে রাত যেন আরও দীর্ঘ এবং ভারী।

এক ফাঁকে নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করেছিলাম, প্রথম দেখায় ‘অপ্সরা, আগুনের ফুলকি’ বলেছিলেন কেন? তৎক্ষণাৎ কেমন একটা ঠান্ডা হাওয়ার সঙ্গে কানে ভেসে এলো ‘বনলতা সেন…’ (শাড়ি পরিহিত অপ্সরাকে এই নামে ডেকেছিল সেই কবে…)।

নিঝুম রাত। একটা কুকুরও জেগে নেই। নিস্তব্ধ ক্ষেত, দিঘি, পথঘাট। সারা উঠানে সবাই ঘুমে কাদা। তখন রাত প্রায় চারটা। আকাশের দিকে চেয়ে দেখি চাঁদ ঝিমিয়ে পড়েনি, পূর্ণশশী সমস্ত অর্পণ করে জেগে আছে পাহারায়; নিশ্চুপ ফিরে গেলাম ঘরে। 

পুবের আকাশ লালচে হয়েছে, আলোকরশ্মি খেলে উঠছে দিনের উঠোন জুড়ে। চোখে সুরমা সাদা জামায় আতর আর লোবানের ঘ্রাণে শবদেহ রওনা হয়েছে অন্তিম যাত্রায়। রীতি অনুযায়ী অন্তিম ঠিকানায় একটা পাকাপাকি বন্দবস্ত হলে, সবার বর্তমান নিয়ে ব্যস্ততা শুরু করা যায়।

বাড়ির পশ্চিম ভিটার শেষদিকে অর্ধভরা জল দিঘির পাশ ঘেঁষে দুপুর ঘন হচ্ছে, বাতাসের চেয়ে সূর্যের তাপ বেশি নিয়ে। বিরাম দিয়ে দিয়ে শান্তবেগের অল্প বাতাস, দিঘির জলকে মৃদু দোলে দোলানোর খেলা দেখা নির্জনে বসে একা। বক্ষদেশে শব্দ বইছে হুহু হুহু… হুহু হুহু…। পাশে মাচা দেয়া লেবুবাগান থেকে একটা টক ঘ্রাণ আসছিল থেমে থেমে, যা বুকের বাঁপাশে বিঁধ ছিল লেবুগাছের সূঁচালো কাঁটা হয়ে। 

হঠাৎ উড়ে আসা মাছরাঙার ছায়ায় যেন শীতল হয়ে গেল ঝিম মেরে থাকা শান-বাঁধানো ঘাট। আদতে মাছরাঙাটি বুকে বিঁধে থাকা লেবুকাঁটা আর হুহু ডাক ছিল তাঁর ঠোঁটে বয়ে আনা টেলিপ্যাথি।

মাছরাঙা আমার চোখে চোখ রেখে ঠোঁট ভিজিয়ে দিঘির জলে, শিকার না-করেই উড়ে গেল ধানক্ষেতে, আর সন্ধ্যা নামার আগে আগে হয়ে গেল কাকতাড়ুয়া। গোধূলিলগ্নে ধানক্ষেতের আলধরে আমি যখন হাঁটছি, সে আমায় দিয়েছে : আলতা লাল রঙা একটা ফুসফুস, উইলে বুনা সাদা ফিতার একজোড়া শিশু-জুতা, সোনাঝুরি বনের পাখি বলে মায়াময় ডাক, মিশমিশে কালো ঝুটির কাকাতুয়ার মুখদর্শন, আর বনানীর ঝরা পাতাদের গান। এইসবের সঙ্গে আরও দিয়েছে একটা হলুদখাম, যার ভেতর ছিল একটা স্কুইজ বক্স।

এইসব কিছুতে অঞ্জলি পূর্ণ হলে, সন্ধ্যানামার মুহূর্তকালে কাকতাড়ুয়া নিমিষেই হয়ে গেল দাঁড়কাক, উড়ে গেল দৃষ্টির সীমানা পেরিয়ে যতদূর যাওয়া যায়, আর আমার ভেতর বেজে উঠল তার দেয়া স্কুইজ বক্স। বেজেই চলল অবিশ্রান্ত। বাজতে বাজতে আকাশ পাতাল শূন্য করে দিলো, শূন্য হয়ে গেলাম আমি। সেই সুর শূন্য আমার অবয়ব পালটে দিয়ে গড়েছে আমায় ভ্রমর, আর দৃষ্টির থেকে দাঁড়কাক করেছে আমায় বাক্সবন্দি। 

ভ্রমরের অবয়ব নিয়ে পার করে এসে বিগত বর্ষা, শরতের পেঁজা তুলা মেঘকে মনে করে করে ভাবি : এভাবেই ক্রমান্বয়ে কাটাবো পৃথিবীর বাকি হেমন্ত, শীত এবং বসন্ত। আরও আরও বহুঋতু কাটাবো আঁটোসাঁটো তালাবদ্ধ বাক্সের ভেতর এবং মিলতে না-পারা দুডানার ব্যথায় দিগন্তের মেঘ লাল হতে হতে আকাশ কেঁদে দিলে—আমার যে-চিঠি কাব্য হয়ে যায় : 

অন্তরীক্ষের ডাকযোগে পাঠানো
বৃষ্টির ডানায় লেপ্টে দেয়া হু হু-হৃৎবায়ু 
একদিন ঠিকঠিক প্রাপকের ঠিকানায় পৌঁছে যাবে
বহুপ্রহর পেরিয়ে, অন্তহীন দরজার পাশ ঠেলে 
প্রবেশ অনুমোদিত হলেও
অন্ধকার গ্রাস করবে প্রত্যাশিত পথের গতিবিধি
ভেতর থেকে ডানা ঝাপটাবে
অন্তিমকালে হারিয়ে যাওয়া বাক্সবন্দি অপ্রিয় ভ্রমর!


তৃণলতা কুরচি কবি। জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ঢাকায়, অরিজিন বিক্রমপুর। পেশায় চাকরিজীবী। মূলত কবিতা লেখেন। এপার-ওপার দুই বাংলার লিটল ম্যাগ এবং ওয়েব ম্যাগ লেখালেখির ক্ষেত্র।

menu
menu