বোমা আর সেনাপতি : বাঁচার জন্য চাই পরিবেশ, শান্তি ও সহিষ্ণুতা
পাঁচ বছর আগে, অনার্সের ফলাফল পেয়ে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক নিয়ে লেখা একটা পোস্ট চোখে পড়ল ফেইসবুক স্মৃতির সহায়তায়। সেখানে লিখেছিলাম : ‘ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক' হলো পৃথিবীর সুন্দরতম সম্পর্কের একটি। ভুলে, দৈবক্রমে, বাহুবলে অথবা দল-লেহন করে যারা এ পেশায় আসেন, একমাত্র তাঁদেরই দ্বারা সম্ভব এ সম্পর্ককে কলুষিত করা।
শিক্ষক ছাত্রের মধ্যে সুপ্ত থাকা প্রতিভার খোঁজ নিবেন, সেই জায়গায় ফোকাস করবেন। ব্যক্তিগত হোক বা একাডেমিক হোক যেকোনো প্রকার সমস্যায় আগ বাড়িয়ে এগিয়ে এসে কখনো বাবা, কখনো বড় ভাই, কখনো বড় বোন, কিংবা মায়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন, এটা-ই শিক্ষকতা। শিক্ষক হবেন সেই ব্যক্তি, যার জন্য একটা আলাদা স্থান থাকবে ছাত্রের মনে। এই অবস্থান তৈরিতে শিক্ষকের ভূমিকা মূখ্য। একজন ছাত্রের কাছে 'স্যার' নামক শব্দটি খুবই পবিত্র। শিক্ষকের কাছে ছাত্ররা 'সাবেক ছাত্র' নামে তকমা পেলেও, একজন ছাত্রের কাছে তার শিক্ষক কখনো 'সাবেক স্যার' হন না।
আমার শিক্ষাজীবনে চার স্তরের শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়েছি। এদের মধ্যে প্রাইমারি স্কুলের হেড মিস্ট্রেস, হাইস্কুলের হেডমাস্টার আমার জীবনে সেরা পাওয়া। কলেজ জীবন খুবই সংক্ষিপ্ত এবং কলেজের পরিসর বড় হওয়ায় শিক্ষকদের কাছে যাওয়া সম্ভব হয়নি। ভার্সিটিতে এসে দুয়েকজনকে খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। জিএইচ হাবীব তাঁদের একজন। স্যারকে খলিল জিবরানের জ্যোতির্বিদ (শিক্ষক) মনে হয়। জিবরান বলেছেন, ‘একজন জ্যোতির্বিদ (শিক্ষক) তোমার সঙ্গে মহাকাশ সম্পর্কে তাঁর অর্জিত বিদ্যা নিয়ে কথা বলতে পারবেন, কিন্তু তোমাকে সেই বিদ্যা দান করতে পারবেন না।’
উপরোক্ত লেখাটা চোখে পড়ার পর শেল্ফ থেকে স্যারের সদ্য প্রকাশিত বোমা আর সেনাপতি বইটা খুঁজে নিলাম। বইটি প্রায় সপ্তাহ খানেক আগে হাতে আসলেও পড়া হয়নি পেশাগত ও পারিবারিক ব্যস্ততায়। আজকে পড়ে অনেকক্ষণ ভেবে কিছু লিখতে বসলাম। এর আগে স্যারের কোনো বই নিয়ে লেখার সাহস করিনি। একজন অপদার্থ ছাত্র হয়ে স্যারের বই নিয়ে লেখার মতো দুঃসাহস আমার কখনো ছিল না। জিএইচ হাবীব আমাদের কালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুবাদক। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের নিঃসঙ্গতার একশো বছর, আর্থার কোনান ডয়েলের দ্য সাইন অভ ফোর , তরে ইয়নসনের লাতিন ভাষার কথা, পরদেশী গল্প, গল্প-বৈদেশী, রলা বাত’র রচয়িতার মৃত্যু, পিটার মাইলের এলেম আমি কোথা থেকে, ওয়েন্ডি ফরেস্ট এর রোজা লুক্সেমবার্গের জীবন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের অনুবাদ উপহার দিয়েছেন।
উমবের্তো একো পাঠকের কাছে দ্য নেইম ইভ দ্য রোজ', জিএইচ হাবীব যেটার নাম দিয়েছেন গোলাপের নাম (গত বইমেলা প্রকাশিত) উপন্যাসের জন্য বিখ্যাত। তাছাড়া 'বইয়ের ভবিষ্যৎ' নামে একটা পুস্তিকা, যেটা রচিত হয়েছে প্রিন্ট মিডিয়ার যুগে ছাপানো বইয়ের ভবিষ্যৎ কী সেই তর্ক নিয়ে, এর জন্যও একো পাঠক পরিচিত।
বোমা আর সেনাপতি বইয়ের পাতা উল্টে পাঠকের প্রথমেই বিস্ময় জাগবে একোর মতো এত বড় দার্শনিক বাচ্চাদের জন্য একটা বই লিখেছেন? হ্যাঁ, মলাট দেখে আপনার মনে হবে এটা শুধু শিশুদের জন্য লেখা। তবে একবার চোখ বুলানো শেষে পাঠকের কাছে লেখকের বার্তাটা পরিষ্কার হবে। এটমিক যুগের শিশুদের কাছে বিজ্ঞানের অনিয়ন্ত্রিত ও অপব্যবহারের প্রভাব একো তুলে ধরেছেন গল্পের ছলে। বাঁচতে হলে পরিবেশের ক্ষতি না করা, শান্তি ও সহিষ্ণুতার যে কত প্রয়োজন সেই বার্তা পাবে পাঠক। বইটি আসলে পুরোপুরি শিশুতোষ নয়, অনেকটা জ্ঞানকোষ। জন মিল্টন তাঁর এরিওপেজিটিকা প্রবন্ধে বলেছেন, `Where there is much desire to learn, there of necessity will be much arguing, much writing, many opinions; for opinion in good men is but knowledge in the making.’ জ্ঞানের যেকোনো শাখার যথার্থ ব্যবহার নিশ্চিত করতে না পারলে তা আখেরে মানবজাতির জন্য সমূহ ক্ষতির কারণে হয়ে দাঁড়ায়।
অনুবাদক হিসেবে জিএইচ হাবীবের সার্থকতা হলো টেক্সট নির্বাচনের নৈপুণ্য। এই টেক্সটের গদ্য ঝরঝরে ও প্রাণবন্ত। কলেবরে ছোট হলেও বোমা আর সেনাপতি বাংলা সাহিত্যের একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে বিবেচিত হবে সময়ের স্রোতে। শিশুরা, আমাদের সামনের দিনের নেতারা, এই বই পড়ে জানতে পারবে বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে ভালোবাসার শক্তিমত্তার বিন্দুমাত্র কমতি হবে না। পাঠকনন্দিত অনুবাদক জিএইচ হাবীব ও পেন্ডুলাম প্রকাশনীকে ধন্যবাদ এই গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য।
আলমগীর মোহাম্মদ অনুবাদক ও গবেষক। বাংলাদেশ আর্মি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, কুমিল্লাতে পড়ান। প্রকাশিত কিতাবের সংখ্যা ছয়।