একচোখে দেখা বারোটি গল্পের রূপ এবং রূপের গল্প
সংবাদপত্রকে যদি গল্পের সংকলন বলি খুব একটা আলাদা বিষয় বা চমকে যাওয়ার বিষয় মনে হবে না। একইভাবে গল্পের বইকেও সংবাদপত্র বলা যেতে পারে। সংবাদপত্রগুলো প্রতিদিনের গল্প সংকলন, গল্পগুলো কোনো একসময়ের সংবাদ। তবু সাংবাদিক গল্পকার নয় যদিও গল্পকার সাংবাদিকও। গল্পকার সংবাদ সংগ্রহ করার পর গল্প বলেন; গল্পকার গল্প সংগ্রহ করতে পারেন নিজ জীবন থেকে, চারপাশ থেকে এমনকি সংবাদপত্র থেকেও। সংবাদপত্রে ঘটনার সংবাদ থাকে মনের সংবাদ থাকে না কিন্তু গল্পে মনের সংবাদও থাকে। গল্পে ঘটনার সাথে সাথে ঘটনার নিজের, ঘটনার ভেতরে থাকা পাত্রপাত্রীর মনের ক্রিয়ার বর্ণনা থাকে। গল্পকার, এমনকি ঘটনার সময়ের আবহাওয়ার, মাটির, জলপাথরের মনোভাবও ব্যক্ত করেন। ফলে ঘটনা বিচারের জন্য, শুধু কি ঘটনা ঘটল তা আর নিয়ামক হয়ে থাকে না, এখানে এসে উপস্থিত হয় মনের ভেতরের কর্মকাণ্ডও, আবহাওয়া, জলপাথরমাটির বক্তব্যও। গল্পের পাত্রপাত্রীর মনের রসে আর পাঠকের মনের রসে অভূতপূর্ব এক রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে। এ বিক্রিয়ার কারণে, একটা গল্পের ভেতর থাকা একজন চোরের জন্যও চোখে পানি চলে আসে, একজন বেশ্যার জন্যেও বেহেশত কামনা করে প্রার্থনায় বসে যেতে হয়, গল্পের খুনির ফাঁসির সময়; ফাঁসিবিরোধী মন জেগে ওঠে। আবার কোনো সময় এমনও হয়, যে খুন হচ্ছে বা যে খুন হচ্ছে অথবা যে চুরি করছে বা যার চুরি যাচ্ছে তাদের কারো জন্যেই রাগ বা অনুরাগ জন্মে না, রাগ জন্মে যায় ব্যবস্থার প্রতি। এসবই গল্পের কাজ, গল্পকারের কাজ। সত্যের মতো যাদু, যাদুর মতো সত্য। গণিতের যুক্তির ওপর মানবিক যুক্তির জয়।
কথা হবার কথা কথাকার শাখাওয়াৎ নয়নের ‘ব্যাপ্টিস্ট চার্চ এবং একটি টিকটিকির গল্প’ গল্পের বই নিয়ে সেখানে উপরের প্যারাটা বাড়তি মনে হতে পারে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা বাড়তি নয় বরং আমাদের পাঠপদ্ধতি বলে নেওয়া এবং তার সাথে শাখাওয়াৎ নয়নের বারোটি গল্পের ভেতরের রস আর সর আর স্বর আর সার গ্রহণের প্রক্রিয়া। গল্পের ভেতর আমরা দেখতে চাই ঘটনা, শব্দ আর বাক্যের ব্যবহার; দেখতে চাই, গল্প বলার কৌশল আর পরিকল্পনা; চাই, দর্শন। স্পষ্ট স্পষ্টতার চেয়ে বেশি করে চাই ইঙ্গিতময় স্পষ্টতা।
‘ব্যাপ্টিস্ট চার্চ এবং একটি টিকটিকির গল্প’গল্পের বইটির প্রথম গল্প ‘ব্যাপ্টিস্ট চার্চ এবং একটি টিকটিকির গল্প’। এই গল্পের কাহিনি মুগ্ধকর, ঋদ্ধকর এবং বিদ্ধকর। হৃদয়ে মোচড় দেয় বর্ণিত ব্যথার বিবরণ। মানুষের জীবন নিয়েই একধরনের হাহাকার তৈরি হয় যখন দেখি, একজন কিশোর আবিষ্কার করছে তার বাবা তার দ্বিতীয় মায়ের কাছে তাকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে ভাতিজা হিসেবে, যখন কিশোর তার নিজের নাম হারিয়ে তার চাচাত ভাই কামালের নামে পরিচতি হয়, যখন একজন কিশোর বা যুবককে ‘অভিভাবক চাই’ বলে বিজ্ঞাপন দেবার পরেও সাড়া পায় না আর নিজেকে একেবারে পরিত্যক্ত মনে করে। এই গল্পের কিছু ইঙ্গিত এতোই শক্তিশালী যে, আমাদের অবাক হতে হয়। এখানে আজব এক টিকটিকির দেখা পাই, যে টিকটিকি নাই কিন্তু তার ক্রিয়ার দাগ আছে। কপালে বারবার টিকটিকি পড়ার ফলে যে কালো দাগ তৈরি হয় তাকে দীর্ঘদিন নামাজ পড়ার ফলে কপালে পড়া দাগের মতো মনে হয়। এই টিকটিকি কী? পাঠক বেশ জটিল অবস্থায় পড়ে, এ জটিল অবস্থা পাঠকের জন্য মধুর এবং উপভোগ্য। প্রচুর ভাবনার অবকাশ পায় পাঠক। টিকটিকিকে টিকটিকি বলা ছাড়াও আমরা গোপনে পিছু নেয়া মানুষকেও টিকটিকি বলি। এই গল্পে ব্যবহৃত অদৃশ্যপ্রায় টিকটিকিকে হয়তো আমাদেরই ভাগ্যের মতো মনে হতে পারে। এই ভাগ্য-টিকটিকি প্রতিটা মানুষকে তিক্ষ্ন চোখে দেখে থাকে, থেকে থেকে লাফিয়ে পড়ে বিপুল দুঃসহ বেদনার বস্তা চাপিয়ে দিতে। অপূর্ব এ গল্পের কাহিনি আর ইঙ্গিতময়তা আর রসের সঞ্চারণ। তবু গল্প বলার কৌশল আর পরিকল্পনায় কিছুটা দুর্বলতা চোখে পড়ে আমাদের অথবা দুর্বল নয় কিন্তু আমাদের মনে হয়েছে দুর্বল। গল্পকে গাঁথতে তো হয় মালার মতো করেই এক সিকোয়েন্স থেকে আরেক সিকোয়েন্সে যাওয়ার সময়। একেকটা সিকোয়েন্স একেকটা ফুলের মতো। যখন কারো গলায় ফুলের মালা থাকে তখন সে জানে এ মালাটা গাঁথা হয়েছে সূঁচ দিয়ে কিন্তু মালার মধ্যে যদি সুতার সাথে সূঁচটা রেখে দেওয়া হয় তবে যে খোঁচাটা গলা-গর্দানে লাগে সেটা সুখকর হয় না। এ গল্পের কৌশলের ক্ষেত্রে একটা খোঁচা লাগে। গল্পের সিকুয়েন্স পরিবর্তন করার জন্য বা গল্পকে এগিয়ে নেবার জন্য—তাই কিছুক্ষণ পরে আবার জিজ্ঞেস করলাম —
‘
‘ঐ টিকটিকির বিষয়টা একটু জানতে পারি?’ অথবা ‘ঘটনাটা খুলে বলবেন, প্লিজ’ বাক্যগুলো এক ঘটনা থেকে আরেক ঘটনাতে এগিয়ে যাবার সংযোজক-বাক্য হিসেবে ব্যবহার করেছেন গল্পকার। এ কৌশলগুলো কৌশল হিসেবে চোখে পড়ে যায় বেশ মোটাদাগে। কৌশল এমন হওয়ায় ভালো, যাকে কৌশল বলে মনে হবে না। যেমনভাবে পুষ্পমালা পরিহিত মানুষ জানে মালা গাঁথা হয়েছে সূঁচ দিয়ে কিন্তু সূঁচের খোঁচা পায় না, তেমনভাবে গল্পে কৌশল থাকে পাঠক জানে কিন্তু কৌশলের টিকিটিও চোখে পড়বে না।
শাখাওয়াৎ নয়নের গল্প নিয়ে মূল কথাগুলো কিন্তু বলা হয়ে গেল। অহেতুক গল্পের সংক্ষেপসার বলে লেখাটা বড়ো করে তুলব না আমরা। গল্পের সংক্ষেপসার পড়ার চেয়ে বরং গল্পের বইটি থেকে পুরো গল্প পড়ে নেওয়ায় ভালো। এখন আরো কিছু কথা হতে পারে তার গল্প নিয়ে, সেগুলো কি নিয়ে তা নিচের প্যারাগুলো পড়লে সহজেই বোঝা যাবে।
একটা জাল এবং এতে একটা মাত্র মাছ উঠে এমন জাল আছে কিনা জানি না। কিন্তু ছোটগল্পকে আমার এমন মনে হয়। একটা ছোটগল্প মানুষের একটা মাত্র এমন ঘটনা-মাছকে তুলে আনে যে মাছ দেখলেই ওই মানুষটাকে দেখা যায় একেবারে জন্ম থেকে বর্তমান পর্যন্ত এবং দেখা যায় তার ভবিষ্যতের দিনগুলোকেও। একজন শক্তিমান লেখক এভাবে কাজ করেন বলেই মনে হয়। অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করেছি শাখাওয়াৎ নয়নের কাজ; গল্পের ভেতরের কাজ, বিষয় নির্বাচনের কাজ। তিনি একেকটা ছোটজালে একেকটা ছোটমাছ তুলে এনেছেন।
এই বইয়ের গল্পগুলো ছোটগল্প-জগতের ছোটগল্পের মধ্যেও ছোট। তার মধ্যে আরো ছোট আছে। ছোটস্য ছোট গল্পের মধ্যে রয়েছে, ‘ডিয়ানি, ‘মায়াবতী’, ‘শুভ ব্রতের বিড়ম্বনা’, ‘জানালাময়ী’, ‘আশাবরী’, ‘জলে ভাসা পদ্ম’, ‘অন্তরাক্ষী’। এইসব গল্প আকারে ছোট কিন্তু সুচারু, ঝরঝরে, গভীর এবং প্রবহমান। যদিও কিছু বিষয় আছে যেগুলো ভালো হতে পারত আর একটু যতœ নিতে পারলে। সেগুলোও বলব।
‘ডিয়ানি’ গল্পে ডিয়ানি মূল চরিত্র। গল্পস্থান : হার্স্টভিল, অস্ট্রেলিয়া। ডিয়ানির মায়ের জীবনের বা বাবার জীবনের অকল্পনীয় একটা বাঁক (তার বাবার সাথে তার নানির পরকীয়া হয়েছিল; ফলে বাবা-মা আলাদা হয়ে গেছিল) এবং তার জীবনের একটা মারাত্মক ঘটনা (ডিয়ানি গ্যাংরেপের শিকার হয়েছিল) তার জীবনটাকে আর স্বাভাবিক জীবন করে রাখেনি, তার চেতনাকে স্বাভাবিক চেতনা করে রাখেনি, করে তুলেছে এমনকিছু যা দিয়ে সে আর পৃথিবীকেই বিশ্বাস করতে পারে না। ডিয়ানি পুরুষসমগ্রের ওপর প্রচুর ঘৃণা নিয়ে বেঁচে থাকে; যদিও সে হাসে, কথা বলে বেশ উচ্ছল-স্বচ্ছলভাবে। ‘মায়াবতী’ গল্পের শুভ্রাকেও দেখি ঘৃণা নিয়ে বেঁচে থাকতে দেখি, দেখি ঘৃণা নিয়ে ভালোবাসতে (ঘৃণা নিয়েই সে তার সাবেক স্বামীকে মমতা নিয়ে রোগশয্যায় দেখতে যায় সে)। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে ঘৃণা নিয়ে ভালোবাসা অসম্ভব; গল্পকার বুঝি জোর করে এমন চিত্র তৈরি করেছেন। কিন্তু না, তার এ গল্পে জোরের কোনো লক্ষণ নেই। ‘জানালাময়ী’ গল্পটা যেন সেই টর্চের মতো যে টর্চটা একবার মাত্র মুহূর্তের জন্য জ্বলেই নিভে গেছে। এই এক মুহূর্তের আলোতে যে দৃশ্য দেখা যায় সে দৃশ্যের ভেতর দেখা হাহাকার কোনোদিন ভোলার মতো নয়। আবার, ‘আশাবরী’ আর ‘জলে ভাসা পদ্ম’ গল্পের শরীর ‘জানালাময়ী’ গল্পের মতোই খুব ছোট হলেও টর্চের আলো জ্বলানেভার সময়টুকুর মতো নয় বরং টর্চটা জ্বলে থাকে সুদীর্ঘকাল ধরে। এই একই সমান স্পেস নিয়ে, একই সমান সময় নিয়ে, একই সমান শব্দবাক্য নিয়ে গল্প লেখা হলেও অনুভূতির মধ্যে বিরাট ফারাক গেঁথে যান গল্পকার। অন্যদিকে একই সমান প্রায় শব্দবাক্য নিয়ে ‘অন্তরাক্ষী’ গল্প তৈরি হয়েছে যে গল্পে কোনো আলোছায়ার কারবার নাই বরং মনে হবে সমান পরিমাণ আলো আর ছায়াকে মিশেল করে একটা পানীয় তৈরি করা হয়েছে; এ গল্প-শরবত পান করলে কোনো চুমুকে মিষ্টি, কোনো চুমুকে তিতা, কোনো চুমুকে ঝাল মনে হবে। খুব অল্প একটু জায়গাতে এমনসব ব্যাপার তুলে ধরা নিশ্চিত একজন দক্ষ গল্পকারের কাজ। এসব গল্পে গল্প বলার কৌশলগুলো খুবই চিত্তকর্ষক এবং ফলপ্রসু। পড়ে বেশ আরাম। কোনো জোরাজুরি নাই, গল্প বলার সময় কৌশল মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে না।
‘শুভ ব্রতের বিড়ম্বনা’ গল্পে সমাজের অন্তরের বা অন্দরের ঘা আর বাহিরের চাকচিক্য বা নীতিঘেরা অবস্থা খুব ভালোভাবে ফুটে উঠে এসেছে। তবু এ গল্প পড়তে গিয়ে কৌশলের ধাক্কা খেতে হয়। সঙ্গমের আনন্দের চেয়ে ঘাম ঝরার বেদনা আগে চোখে পড়ার মতো ব্যাপার। তবু এ গল্পের শেষটুকু খুব দক্ষ একজন গল্পকারের কাজ বলেই মনে হয়েছে। এখানে যে ইঙ্গিতময়তার প্রয়োগ করেছেন গল্পকার তা খুব সহজকাজ নয়। মসজিদে চুরি ব্যাপারটা বেশ বড়ো একটা ধাক্কা দেয় পুরো একটা সিস্টেমকে। এ ইঙ্গিতটা বড়ো। কিন্তু গল্প বলার ক্ষেত্রে এ ইঙ্গিত মোটেও বড়ো নয়; এর চেয়ে বড়ো ইঙ্গিত আছে গল্পকারের ক্যামেরা চালানোর মধ্যে। যখন দেখি, যে ফ্যান চুরি গেছে সে ফ্যানের নিচে থরে থরে সাজানো কোরান শরিফগুলো। লেখক কোনোকিছুই বলেন না, কোনোকিছুই দেখান না বরং বারবার ক্যামেরা ঘুরিয়ে নেন। এখানে ক্যামেরা ঘুরিয়ে নেয়াটাই লেখকের মুন্সিয়ানা। এই ক্যামেরা ঘুরিয়ে নেয়াটা পাঠককে খুব আকৃষ্ট করবে বলেই মনে হয়।
কোনো মানুষ যে অবস্থাতে রয়েছে তার একটা কারণ রয়েছে; খুব বেশি কারণ কিন্তু নয় একটা মাত্র কারণ, এই কারণের সাথে আরো কিছু উপ-কারণ যুক্ত হয়ে সেই অবস্থাকে প্রকট করে থাকে মাত্র। লেখক যদি এই কারণটা খুঁজে ফেরে মানুষে মানুষে, ঘাসে ঘাসে, জলে জলে, মাটিতে মাটিতে তাহলে সেই লেখকই হবে মানুষ এবং মানুষের চারপাশে থাকা সবচে ভালো কথক। এ জন্যই প্রথমে হতে হয় দেখক, তারপর লেখক। দেখকের কাজ গভীরভাবে দেখা, লেখকের কাজ দেখক অবস্থায় যা দেখেছে তা চেতনার রসে ভিজিয়ে লেখালেখির কাজ করা। শাখাওয়াৎ নয়নকে গল্পকার হিসেবে একজন ভালো দেখক এবং লেখক বলেই মনে হয়েছে শেষ পর্যন্ত। ‘দেখা’ গল্পে দেখি একজন তরুণীকে —একজন রেবু; সে মরতে বসেছে। তার অপরাধ ছিল তার গরিব কাজিনের সাথে তার প্রেম হয়েছিল, যে কাজিন তাদেরই বাড়িতে আশ্রিত ছিল। এই প্রেমের ফলে তার প্রেমিককে বাড়ি ছাড়া হতে হয়েছিল। এই একটা ঘটনা রেবুর জীবনকে এমনকিছু দান করে যে দান নিয়ে তার জীবন বেদনাবিদ্ধ আর রোগবিদ্ধ হয়ে যায়। এখন মরণবিদ্ধ হবার অপেক্ষায়। যদিও তার বিয়ে হয়েছিল খুবই ভালো। ঐ যে বলা যাচ্ছিল মানুষ যে অবস্থাতে আছে সে অবস্থার জন্য দায়ী একটা মাত্র কারণ। সেই কারণটি গল্পকার আবিষ্কার করেছেন এবং গল্পের ভেতর এনেছেন দক্ষভাবে।
এবার বড়ো ক্যানভাসের ছোটগল্প ‘অপাঙতেয়’, ‘নেতা’, ‘সর্প রোগ’ নিয়ে একটা-দুটো বাক্য ব্যবহার করে এ লেখার শেষে চলে যাব।
আমাদের দেশে তো বটেই পৃথিবীর আরো বিভিন্ন দেশে চরম আকারে একটা মানবিক বিপর্যয় আছে। এ বিপর্যয় ভোগ করে কিছু মানুষ। এদেরকে আমরা দেখতে পাই ফুটপাথে, রেলস্টেশনে, বাস টার্মিনালগুলোতে এবং শহরের যেকোনো জায়গাতে এদের দেখা যায়। এদের আমরা ভালো করে খেয়ালই করি না। এদের খাদ্যগ্রহণ, বসবাস, যৌনতা সবই আছে কিন্তু তার সবই নদীর স্রোতে ভাসমান কচুরিপানার মতো; এই দুটো পানা একসাথে আছে এই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল অবস্থা। এই অবস্থা মারাত্মক হয় যখন দুটো কচুরিপানার যৌনতার ফল শিশুরাও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। মেয়েশিশু হলে সমস্যা আরো প্রকট। বিশ্বের বিশাল এই সমস্যাটাকে নিয়েই ‘অপাঙতেয়’ গল্প। গল্পকারের অনুপম বর্ণনা তাদের প্রতি সমবেদনায় সিক্ত করে তোলে পাঠকের মনকে। পুরো মানব এবং ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রশ্ন জেগে ওঠে। ‘নেতা’ গল্পের ক্ষেত্রেও সেই একই কথা, নেতারাই সবচে বড়ো ত্রাস হিসেবে, বিপর্যয়কারী হিসেবে, উপদ্রব হিসেবে রয়েছে পৃথিবীতে। তাদের মারাত্মক স্বার্থচিন্তা, শোষণ, চোষণ, ত্রাসন সাধারণ মানুষের জন্য কণ্টকময় করে ফেলেছে। বেশিরভাগ মানুষকে ফেলে দিয়েছে গভীর গর্তের গর্ভে; এসবই তারা করেছে তাদের আর তাদের তোষণকারী কিছু মানুষের সুখের জন্য। ‘সর্প রোগ’ গল্পের রোগীকে তবু একটু ভালো লাগে যে তার এই রোগ হয়েছে; এই সর্প রোগকে একটা অনুতাপ হিসেবে গ্রহণ করার সুযোগ আছে পাঠকের। লেখকের অভিপ্রায় আমরা জানি না, তবু মনে হয়, যে চেয়ারম্যান সারাজীবন সাধারণ মানুষকে বঞ্চনা করেছে, জ্বালিয়েছে সেসব স্মৃতি অনুতাপ হিসেবে রোগে রূপান্তর হয়েছে। অন্য নেতাদের ক্ষেত্রে তাও হচ্ছে না।
এবার এ লেখার লেজে এসে আবার বলে নিতে হচ্ছে, এখানে গল্পের সারসংক্ষেপ বলা ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেছি আমরা। আমাদের আগ্রহ ছিল লেখকের বিষয় নির্বাচনের দিকে, সংকেত বা ইঙ্গিতের প্রয়োগের দিকে, দর্শনের দিকে, ভাষার দিকে, রচনাশৈলীর দিকে। এই লেখার মধ্যে যথাসাধ্য চেষ্টা করা হয়েছে। হয়তো আরো অনেককিছুই বলার আছে, আবিষ্কার করার আছে; সেগুলো পরবর্তীকালে নিশ্চয়ই আবিষ্কৃত হবে আরো নিবীড় পাঠের মাধ্যমে। শাখাওয়াৎ নয়নের এটা প্রথম গল্পগ্রন্থ। তার হাত দিয়ে আরো প্রচুর গল্প বের হয়ে আসুক। তার গল্প পাঠ করে মানুষ আনন্দ পাক, ঋদ্ধ হোক।
আনিফ রুবেদ কবি, কথাসাহিত্যিক, চাঁপাইনবাবগঞ্জ