'উল্টো গাছ' : বাঁকে বাঁকে সমাজসত্যের উঁকিঝুঁকি
উর্দু-হিন্দি সাহিত্যের প্রথিতযশা কথাকার কৃষণ চন্দর(১৯১৪-১৯৭৭)। বিশটি উপন্যাস আর প্রায় ত্রিশটি গল্পগ্রন্থের রচয়িতা তিনি।
"রূপক-প্রতীকের মাধ্যমে সামাজিক বৈষম্য, অর্থনৈতিক শোষণ এবং দরিদ্র মানুষের দুর্দশা বর্ণনায় কৃষণ চন্দর সিদ্ধহস্ত।
'উল্টো গাছ'(উল্টা দরখত) কৃষণ চন্দরের একটি জনপ্রিয় রচনা। এই গল্পে দুটো স্তর রয়েছে। উপরিতল একটি সাদাসিধে রূপকথা, শিশু-কিশোরদের দারুণ সুখপাঠ্য। এর গভীরতলে রয়েছে বড়দের আস্বাদনযোগ্য বিষয়। এই গ্রন্থের স্তবকে-স্তবকে ছড়ানো প্রতীকী ব্যঞ্জনা যা বুদ্ধিমান পাঠককে পৌঁছে দেয় সামাজিক সত্য আর মানবস্বভাবের গভীরতর বোধে।"
এই বক্তব্যটি 'উল্টো গাছ' এর অনুবাদক সফিকুন্নবী সামাদীর। তিনি মূল উর্দু থেকে 'উল্টো গাছ' বাংলায় তর্জমা করে আমাদের পাঠের সুযোগ করে দিয়েছেন। যেমনটা বলেছেন গল্পটা একটা রূপকথার রাজ্যের। এখানে বারো বছরের এক ছেলে ইউসুফ এর অ্যাডভেঞ্চারের গল্প রয়েছে। ইউসুফ এর বাবা মৃত্যুর সময় তাদের মা-ছেলের জন্য রেখে যায় একটা ঝুপড়ি, একটা গরু, একটা কুয়া আর একটা বাগান। ইউসুফ নিজের সারল্যের কারণে কুয়া আর বাগান হারায় বাদশাহর কাছে। আর মহাজনের কাছে গরু হারায়। অবশ্য সেখানে জাদুর শস্যদানা পায়। সেটা রোপণ করলে একটি উল্টো গাছ জন্মে। গল্প এখান থেকেই শুরু। এই উল্টো গাছ বেয়ে এর শেষ কোথায় দেখতে বেরিয়ে পড়ে সে। এই জার্নিতে সে বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করে। প্রথমে যায় আওয়াজের কবরস্থানে। তারপর কালো দৈত্যের শহরে। এভাবে মেশিনের শহরে যেখানে একমাত্র মানুষের দেখা পায়। দশ বছর বয়সি এক ছেলে যার নাম ছিল 'শূন্য শূন্য এক (০০১)'। অবশ্য ইউসুফ তাকে বন্ধু বানায় এবং নাম রাখে মোহন। তাকে নিয়ে জাদুর দুনিয়ায় যায়। সেখানে শাহজাদিকে পায় যে আসলে ডবলরুটিওয়ালার মেয়ে। এই শাহজাদি হাসলে ফুল ঝরে আর কাঁদলে মুক্তো ঝরে। জাদুকরদের নির্বাচন দেখে তারা পৌঁছে যায় সাপেদের শহরে। এখানে ইউসুফকে সাপ কামড়ে দেয়। সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। তাকে বাঁচাতে এক জাদুকর বৃদ্ধ এগিয়ে আসে। মোহনকে বলে দেয় কী করতে হবে। মোহন ঘুমন্তদের শহরে যায়। সেখানকার গীর্জার পাদ্রির গলায় ঝুলানো ক্রুশে লাল পাথর আছে। সেটা এনে ইউসুফের ক্ষততে ছোঁয়ালে সে সব বিষ টেনে নিয়ে ইউসুফকে জীবিত করে দেবে। কিন্তু মোহন সেটা নিতে গেলে পাদ্রি তাকে মুক্তোর শঙ্খ এনে দিতে বলে বিনিময় হিসেবে। শঙ্খ রয়েছে দৈত্যদের শহরে। সেটা আনতে গিয়ে বন্দি হয় মোহন। এবার শাহজাদি আসে। বৃদ্ধের জাদুর ছড়ি নিয়ে শাহজাদি সোনার দুর্গে যায়। সবকিছুই সেখানে সোনার। সেখানকার মানুষ শাহজাদির চেষ্টায় প্রাণ ফিরে পায় আর শাহজাদি তার কাজ উদ্ধার করতে পারে। এভাবে সে মোহনকে নিয়ে লাল পাথর নিয়ে এসে ইউসুফকে বাঁচায়। সাপেদের ধ্বংস করে মানুষদের বাঁচায়। সেই বৃদ্ধসহ তারা ইউসুফের ঝুপড়িতে ফিরে আসে। লোভী বাদশাহকে শাস্তি দেয়। তাদের অনুরোধ উপেক্ষা করে বৃদ্ধ ফিরে যায়। বলে,"আমার কাজ থেমে থাকা নয়, চলা। আমি চলতেই থাকি। সবসময় চলতে থাকি, কেননা আমার নাম ইতিহাস।" টানটান উত্তেজনায় পাঠক এই তিন বাচ্চাবয়সি ছেলে-মেয়ের সাথে এক বিপৎসংকুল পথে ভ্রমণ করতে থাকে। গল্পের এমন এক আকর্ষণ শক্তি আছে যে তা ছেলে-বুড়ো সকলকেই আনন্দ দিতে সক্ষম।
এখন দেখার বিষয় এর ভেতরের গল্পটা। যেখানে বাঁকে বাঁকে ছড়িয়ে সমাজসত্যের কঠিন বাস্তব সব বিষয়। যেমন : বারো বছরের ইউসুফ বলে বাদশাহর ফৌজে আমাকে দরকার বাদশাহ আমার কাছে আসবে আমি কেন তার কাছে যাবো। আর যখন জানতে পারে সৈন্যদের পাশের রাজ্যে লুটপাট করতে হবে তখন সে একাজ করতে অস্বীকৃতি জানায়। মানুষ হয়ে মানুষকে লুট করার কাজ যে ঘৃণার এটা বাদশাহ না জানলেও ইউসুফ জানে। আওয়াজের শহরে গিয়ে শোনে কবি, রাজনীতিবিদ যারা বাদশাহর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিল তাদের হত্যা করে তাদের আওয়াজকে বন্দি করে রেখেছে বাদশাহ। আমরা একটা মেসেজ পেয়ে যাই। দৈত্যদের শহরে সাদা-কালোর লড়াই দেখে সে অবাক হয়। এবং বুঝাতে সক্ষম হয় যে রক্তের রং সবার এক। তাই বিভেদ নয়। এভাবে মনুষ্যত্বের জয়গান গায় ইউসুফ। মেশিনের শহরে এসে মুনাফাখোর শহরের মালিকের কার্যক্রম তাকে আবারও অবাক করে। যেখানে মানুষকে সংখ্যা দিয়ে শনাক্ত করা হয়। মেশিন চালানোর জন্য বাটন প্রেস করতে বৃদ্ধাঙ্গুলির শুধু প্রয়োজন তাই বাকি আঙুলগুলো কেটে ফেলা হয়। ইউসুফ ভাবে মজুর আর মেশিনের সমন্বয় করা তো অনেক সহজ হিসেব সেটা লোভী মালিকের মাথায় ঢোকেনি। আর এই কারণে শহরটি মৃতদের শহরে পরিণত হয়েছে। জাদুকরদের নির্বাচনী প্রচারণায় ফাঁকিগুলোও সে ধরে ফেলতে পারে। যা সাদা চোখে দেখা গেলেও জনতা দেখে না। অন্যদিকে সাপেদের শহরে গিয়ে দেখে আজব কাণ্ড। সাপের কামড়ে মৃত্যুকে জনতা সৌভাগ্য মনে করছে। এখানকার সরকার রাতের অন্ধকারে কাজ করতে পছন্দ করে। এবিষয়ে ইউসুফ বলে, "শুধু এই শহরে নয়, অনেক জায়গার সরকারই অন্ধকারে কাজ করে। শহরবাসীর চোখের আড়ালে তারা অনেককিছু ঠিক করে।" তখন ইউসুফ আর বারো বছরের বাচ্চা ছেলে থাকে না একজন পরিণত মানুষে রূপান্তরিত হয়ে যায় আর 'উল্টো গাছ' হয়ে উঠে বড়দের লেখা। সোনার উপত্যকায় মানুষের অন্তহীন লোভের ফল দেখা যায়। সবকিছু এমনকি মানুষও সোনা হয়ে যায়। যদিও অনুশোচনার জন্য তাদের আবার বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব হয়। ব্যক্তিমানুষের অজ্ঞানতা, অসচেতনতা, নির্বুদ্ধিতা, ক্ষমতাবানদের উচ্চাশা, লোভ, অমানবিকতা এসবের মিশেলে অদ্ভুত চমৎকারিত্বেভরা আখ্যান 'উল্টো গাছ' এর।
অনুবাদক সফিকুন্নবী সামাদী উর্দু-হিন্দি সাহিত্যের বিশেষজ্ঞ সমঝদার। আর তাঁর ভাষার প্রতি অসামান্য দখল এই অনুবাদকর্মটিকে পাঠকের মনের অন্দরে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। ঝরঝরে গদ্যের কারণে এই রূপকথার রাজ্যে সবধরনের পাঠকের স্বছন্দ বিচরণ সম্ভব। আর মূল লেখক কৃষণ চন্দরের সেন্স অব হিউমার বিষয়ে তো বলার অপেক্ষা রাখে না। সাথে তাঁর দূরদর্শী চিন্তার প্রকাশ (মেশিনসংক্রান্ত প্রসঙ্গে) আমাদের বিস্মিত করে।
সবমিলিয়ে বলা যায় 'উল্টো গাছ' রূপকথার অন্তরালে সমাজে নিরন্তর বয়ে চলা জীবনের নির্মম বাস্তবতার গল্প। যে সত্য উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। যার মধ্যে আমাদের প্রত্যহ বসবাস। আমরা যেন সবাই এক উল্টো গাছ বেয়ে পথ চলেছি…
নূর সালমা জুলি, সহকারী অধ্যাপক এবং প্রাবন্ধিক, রাজশাহী