ছোটকাগজ আলোচনা
শালুক অখণ্ড বাংলার সাহিত্যমুখ
জীবনানন্দ দাশ যেন প্রতিশোধ নিচ্ছেন। জীবদ্দশায় তাঁর লেখা কেউ বুঝেনি কিংবা তাঁর লেখা বুঝতে দেয়া হয়নি। মৃত্যুর পর বাংলা ভাষার পাঠক এবং লেখককে জীবনানন্দের লেখা বোধের আস্তরে কি এক আলপনা। কোথায় যেন একটা সুর তুলে—পরাবাস্তবতার সেই জগৎকে, অবচেতনের খোঁজ দিয়েছেন এই ভাষাশিল্পী।
অধুনাবাদী চিন্তার লিটল ম্যাগাজিন শালুক-এর ২৫তম সংখ্যাটি দূরের কাছের জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে। উল্লেখ্য ২৪তম সংখ্যাটিও জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে ছিল। ৮৪০ পৃষ্ঠার এই সংখ্যাটি পাঠক এবং লেখকের জন্য এই করোনাকালে এক মহার্ঘ। শালুকের শুধু এই সংখ্যাটিই না এর আগের ২৪টি সংখ্যা বাংলা ভাষার পাঠক এবং লেখককে চিন্তা বিনির্মাণের ক্ষেত্র তৈরি করেছে। প্রচলিত বাজার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে শালুকের এই প্রথা বিরোধী আন্দোলন নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার।
১৯৬ জন কবি-সাহিত্যিকের লেখা নিয়ে বর্তমান সংখ্যাটি সাজানে হয়েছে। জীবনানন্দ বিষয়ক লেখা ছাড়াও দশক ভিত্তিক কবিতা, পাণ্ডুলিপি, গল্প, অনুবাদ শালুকের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ছিল।
মূল্যায়ন : পুনর্পাঠ, অনিবার্য পাঠ, পরিবারের সদস্যদের মূল্যায়ন এ দুটি পর্বে ৮টি প্রবন্ধ এবং স্মৃতিগদ্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জীবনানন্দের সময়ের অবিভক্ত বাংলায় তৎকালীন পূর্ববাংলার মানুষকে তাদের প্রাপ্যটা সব সময়ে আদায় করে নিয়ে হতো। শহর আর গ্রামের মধ্যকার বিরোধেরমতো তা এখনো বর্তমান। ভাবতে অবাক লাগে বিশাল সাগরে দ্বীপের জন্ম দেয় সেই সাগরকে শাসন করে দ্বীপ। যদিও ব্রিটিশ রাজধানী কলকাতা কিংবা সিরাজউদ্দৌলার রাজধানী মুর্শিদাবাদ এই পূর্ববঙ্গের শ্রমঘামের টাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বুদ্ধদেব বসু এই বাংলার সন্তান। তবে কোনো ধরনের স্বজনপ্রীতির প্রশ্রয়ে নয় কাব্যঐশ্বর্যের গুণে প্রগতিতে জীবনানন্দের কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। তার সূত্র ধরেই জীবনানন্দ এবং বুদ্ধদেব বসুর ত্রিশের দশক। নাক উঁচু ঘটিদের এই দুই বাঙাল আধুনিক বাংলা সাহিত্য নির্মাণে যেন মহাভারতের দুই পাণ্ডা।
লোকজ শব্দের ব্যবহার, সংস্কৃত শব্দ পরিহার সরল কাব্য ভাষায় জীবনানন্দ তার কাব্যের জগৎ নির্মাণ করেন। সরল হয়েও তা যেন জলের মতো। বুদ্ধদেবের কয়েকটি লাইন—‘…কবিতায় দেশজ ও বিদেশি শব্দের এমন স্বচ্ছন্দ, সংগত ও প্রচুর ব্যবহার জীবনানন্দের আগে অন্য কোনো বাঙালি কবি করেননি।’, নির্জনতম কবিতায় শেলি, কীটস্-এর প্রভাব সম্পর্কে লেখেন—‘শেলি, কীটস্, পূর্ব-ইয়েটস আর কোথাও কোথাও সুইনবার্নকে নেয় কেমন করে ব্যবহার করেছিলেন তা তুলনার দ্বারা দেখানো যেতে পারে; সহজেই প্রমাণ করা যায় যে ইয়েটস-এর `O curlew’-র তুলনায় তাঁর ‘হায়, চিল’ অনেক বেশি তৃপ্তিকর কবিতা, আর ‘The Scholars’-র সঙ্গে সমারূঢ়ের সম্পর্ক যেমন স্পষ্ট, তার স্বাতন্ত্র্যও তেমিন নির্ভুল। ‘ওড টু এ নাইটেঙ্গেল’-এর কোনো কোনো পংক্তি ‘অবসরের গান’—এ কেমন নতুন শস্য হয়ে ফলে উঠেছে, তাও সহজেই বোধগম্য।’ বুদ্ধদেব বসু তার ‘জীবনানন্দ দাশ-এর স্বরণে’ প্রবন্ধে সামগ্রিক জীবনানন্দকে তুলে ধরেছেন। শেষে এ কথাও বলতে ভুলেননি—‘বাংলা কাব্যের ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর আসনটি ঠিক কোথায় সে বিষয়ে এখনই মনোস্থির করা সম্ভব নয়।… এ কাজের দায়িত্ব আমরা তুলে দিতে পারি আমাদের ঈর্ষাভাজন সেই সব নাবালকদের হাতে,’
জীবনানন্দ সম্পর্কে তাঁর কাছের মানুষের কথা কবিকে এবং কবির সৃষ্টিজগৎ বুঝতে পাঠককে বেশ সহযোগিতা করবে বলে মনে হয়। কবির স্ত্রী লাবণ্য দাশ কবির পারিবারিক ঐতিহ্য, পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক কবির লেখার দুনিয়া সম্পর্কে এক চমৎকার সিম্ফনির সুর শুনিয়েছেন। লাবণ্য দাশের কবির মা-বাবার সঙ্গে সম্পর্ক, পারিবারিক আবাহ সম্পর্কে যতটুকু জানিয়েছেন—নিঃসন্দেহে অনুমান করা যায় বগুড়া রোডের সেই বাড়িটি আরেক ‘জোড়া সাঁকু’ ছিল। কবির বাবা জ্ঞানযোগ করতেন, মাও কবি, ‘আমাদের দেশে সেই ছেলে হবে কবে/ কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।’ কবির মা তাঁর কাব্য প্রতিভার বিস্তৃতি যেন জীবনানন্দের মাঝেই চেয়েছেন। কবি পুরোদস্তুর একজন আধুনিক মানুষ ছিলেন। নিজের কোনো সিদ্ধান্ত লাবণ্য দাশের ওপর চাপিয়ে দেননি। কবির আর্থিক অনটনের কথা ইথারে যতটা শুনা যায় লাবণ্য দাশের লেখায় সেরকমটা মনে হয়নি। শিক্ষাজীবন শেষ করার পর কবির বেকার জীবন ওই ৫ বছরই ছিল। তাছাড়া সবসময় তিনি কোনো না কোনো কর্মে ছিলেন। যদিও কোন এক মুদ্রা দোষে তাঁর চাকরির স্থায়িত্ব কোনো প্রতিষ্ঠানে বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। লাবণ্য দাশ লেখেন—‘লোকে জানে, কবি ছিলেন শান্ত, নিরীহ প্রকৃতির। অর্থাৎ এক কথায় বলে ভালো মানুষ। তাঁকে চালানো খুব সোজা। কিন্তু ছাইচাপা আগুনের মতো সেই নিরীহ ভাবের নিচেই চাপা থাকত তার অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। তবে অকারণ চিৎকারে সে ব্যক্তিত্বকে প্রকাশ করাটা তিনি কোনোদিন পছন্দ করতেন না। শান্তভাবে, কল্প কথার ভিতরেই ছিল তাঁর অভিব্যক্তি। তার এ পরিচয় আমি বহুবার বহুভাবে পেয়েছি।’
শালুকে জীবনানন্দকে নিয়ে যারা লিখেছেন—‘কবির বোন সুচরিতা দাশ-এর ‘কাছের জীবনানন্দ’ লেখাটি প্রাসাদগুণ সম্পন্ন একটি রচনা। কবির বোন পূর্ব পুরুষের সম্পর্কে বলেছেন—‘তাঁদের একজনকে নাকি পরীতে পেয়েছিল। জ্যোৎস্না রাতে ধান ক্ষেতের উপর দিয়ে তাঁকে উড়িয়ে নিয়ে যেত পরীরা, ভোরের আলোয় তাঁকে পাওয়া যেত শিশির-ঝলমল সোনার ধান ক্ষেতের পাশে। তাঁর বিছানায় থাকতো কাঁচা লবঙ্গ, এলাচ, দারচিনি। তারপর বহু যুগ পার হয়ে গেছে। এদেরই উত্তরপুরুষ জীবনানন্দ।’ সুচরিতা দাশ এক জায়গায় উল্লেখ করেন—‘মনের একান্ততায় হয়তো ভালো থাকতেন তিনি, যদি না জনৈকা প্রতিবেশিনীর অভদ্র দৌরাত্ম্যে সর্বক্ষণ বাড়ির হাওয়া পরিবেশ পঙ্কিল হয়ে থাকত।’
এই জনৈকা প্রতিবেশিটা কে?
বাংলা কবিতার ইতিহাসে জীবনানন্দ ‘দাশের বনলতা সেন’ কবিতাটি জনপ্রিয়তার বিচারে শীর্ষস্থানীয়। এই কবিতায় জন্মভিটার প্রতি একটা টান কবি অনুভব করতেন। কবি শান্তির সময় বলতে—বারবার বরিশালে থাকার সময়টার কথা বলতেন। আকবর আলী খান বনলতাকে নিয়ে যে দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলেছেন। জীবনানন্দের বেলায় তা বেশ কয়েকবার ভাবতে হয়। যে লোক পছন্দের মানুষের নাম প্রতীকের সাহায্যে লিখেন। মানুষ দেখলেই নিজেকে আড়াল করতেন। তিনি কিনা বেশ্যাপল্লির কোন নারীর সঙ্গে সম্পর্কের গনিষ্ঠতায় কবিতা লিখেছেন। বরং বনওয়ালীলাল বগলা ও মোঃ আব্দুর রশীদ-এর বনলতা সেনকে নিয়ে কল্পকাহিনিটি যুক্তিসঙ্গত। একবার কবি দার্জিলিং যাচ্ছিলেন। নাটরের ওপর দিয়ে দার্জিলিং যেতে হয়। নাটোরের বনিদি পরিবারের ম্যানেজার ভুবন সেনের বিধবা বোন ছিল বনলতা সেন। এক কামরায় তারা তিনজন ছিল। বৃদ্ধ ভুবন ঘুমিয়ে গেলে কথা বলতে বলতে বনলতা সেন আর কবি অনেকটা সময় কাটান। এই গল্পকাহিনির অন্য আরেকটি সংস্করণ হচ্ছে, ট্রেনের কামরা নয় ঘটনাস্থল ছিল ভুবন সেনের বাড়ি। জীবনানন্দ একবার নাটোরের জামিদার বাড়িতে অতিথি হয়ে আসেন। ম্যানেজার ভুবন সেনের বাড়িতে নিমন্ত্রণে গেলে আপ্যায়নের দায়িত্ব পড়ে—তার বিধবা বোন বনলতা সেনের ওপর। অপরূপ রূপসীর শ্বেতশুভ্র বসন দেখে আতকে ওঠে কবি। তাদের মধ্যে হয়তো দু-চারটি কথা হয়। কল্পকাহিনি তিন : নাটোরের রাজবাড়িতে কবি বেড়ালে এলে কয়েকজন সুন্দরীকে কবির দেখভালের দায়িত্ব দেয়া হয়। এদের মধ্যে একজনকে নিয়ে জীবনানন্দ কবিতা লেখতে চাইলে ওই সুন্দরী রাজি হয়নি। পরে কবির পীড়াপীড়িতে অন্যকোনো একজনের নামে কবিতা লিখতে সুন্দরী কবিকে অনুরোধ করেন। সৃষ্টি করা কঠিন। তার চেয়ে কঠিন সেই সৃষ্টি কিংবদন্তি হয়ে ওঠা। শিল্পী নিজেও জানেন না তার কোন সৃষ্টি বিখ্যাত হবে? বিখ্যাত সব শিল্পকর্মের ধর্মই যেন গল্পকাহিনি তৈরি করা। হয়তো বনলতা সেনকে নিয়ে আরও অসংখ্য মিথ তৈরি হবে।
জীবনানন্দ নীরবে মহাকালের পাতায় তার স্বাক্ষরটুকু দিয়ে চলে গেলেন। তাঁর ৫৫ বছরের কবি জীবনে স্বীকৃতি যে একেবারে জুটেনি তা কিন্তু না। জীবনানন্দের সাহিত্যের জগতের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে বাঙালি পাঠকের একটু সময়ে লেগেছে। যদি কবি ৮০ বছর কিংবা তাঁর অধিক বাঁচতেন তাহলে খ্যাতি তিনি দেখে যেতে পারতেন। জীবনানন্দ কী খ্যাতি চেয়েছিলেন? বিপন্ন এক বোধ সব সময় তাকে আচ্ছন্ন করে রাখত। তা নাহলে গত একশো বছরের ইতিহাসে ট্রামে কাটা পড়ে কারো মৃত্যু হয়নি। হয়তো জীবনানন্দও আত্মহত্যা করতে জাননি! দুই হাতে ব্যাগ নিয়ে কেউ কি আত্মহত্যা করতে যায়? হসপিটালের শয্যায় ডাক্তারের হাত ধরে কবি বলেছিলেন, ‘ডাক্তারবাবু, আমি বাঁচবো তো?’ কবি অ্যাকসিডেন্টের আগের দিন হন্তদন্ত হয়ে ছোট ভাইয়ের বাড়িতে গিয়েছিল। কাউকে কিছু না বলে আবার ফিরে গেলেন। পরদিন সুচরিতা কবির সঙ্গে দেখা করে। কবি তখন বলে, ‘রাস্তায় আসতে আসতে কাদের যেন বলতে শুনলাম অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে, মনে হলো তোদের ওই বাড়িতে। তাই দেখতে গিয়েছিলাম তোরা সবাই ভালো আছিস কি না। তোরা সবাই ঠিক আছিস দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচলাম। কাল রেডিওতে আমার কবিতাপাঠ, তোদের কুশল না জেনে গেলে সেটা স্বস্তির সঙ্গে করা আমার পক্ষে সম্ভব হতো না।’ অ্যাকসিডেন্টটা সেই সন্ধ্যাতেই হয়েছে। কবির মৃত্যুটা যেন এক বিপন্ন বিস্ময়! বুদ্ধদেব বসুর ভাষায়—‘কেন মরলো লোকটা? কোন দুঃখে? কিসের ব্যর্থতায়? না—না কোনো দুঃখই ছিল না; স্ত্রী ছিল, সন্তান ছিল, প্রেম ছিল, দারিদ্রের গ্লানিও ছিল না। কিন্তু—
জানি—তবু জানি
নারীর হৃদয়—প্রেম—শিশু—গৃহ—নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তি নয়—সচ্ছলতা নয়—
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে,
ক্লান্ত—ক্লান্ত করে;
লাশকাটা ঘরে
সেই ক্লান্তি নেই;
তাই…
পশ্চিমবঙ্গের ছোটকাগজ
দগ্ধের পরই বিদগ্ধ : দাহপত্র
ভারতীয় উপমহাদেশে জ্ঞানযোগটা বাঙালিরাই বেছে নিয়েছে। মুর্শিদাবাদ পরবর্তীকালে কলকাতা শুধু বাংলার রাজধানী ছিল না। অখণ্ড ভারতবর্ষের রাজধানী ছিল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে লন্ডনের পর কলকাতার অন্য এক একটা মর্যাদা ছিল। ইমারতের পেছনে স্থাপত্য নকশাটা কিন্তু জ্ঞানের। উৎকর্ষমণ্ডিত মানুষগুলো কেন্দ্রেই বসবাস করে। এখনো সারা ভারতে পশ্চিমবঙ্গের পাঠক সংখ্যা শীর্ষস্থানীয়। ১৯১১ সালে রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তরিত হলেও পাখির পালকেরমতো কলকাতা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আজও ধরে রেখেছে। সেজন্য ৩৪ বছরের বাম শাসন একটা প্রভাবক হতে পারে। সার্কভুক্ত দেশগুলোর কথা যদি ধরি তাহলে বোধহয় সবচেয়ে বেশি লিটলম্যাগ পশ্চিমবঙ্গেই প্রকাশিত হয়। আশার কথা হচ্ছে এই চিন্তাচর্চা শুধুমাত্র কলকাতা শহরকে কেন্দ্র করে নয়। পশ্চিমবঙ্গে জেলায়, মহকুমায় লিটলম্যাগকে কেন্দ্র করে পাঠক লেখকদের যে একটা প্রাণের সম্মিলন—তা নিঃসন্দেহে প্রগতির। প্রাতিষ্ঠানিক মাফিয়াদের সিন্ডিকেটে এই প্রগতি কতদিন স্থায়ী থাকে সেটাও ভাববার বিষয়। যদিও টেলিকমিনিকেশনের যুগে গতিশীল মিডিয়া ডিমের খোসার মতো সব কিছু তছনথ করে দিচ্ছে। হিন্দি এবং ইংরেজির আধিপত্যে প্রাদেশিক ভাষা বাংলাকে লড়তে হচ্ছে বেঁচে থাকার সংগ্রামে। অর্থ উপার্জনের প্রতিযোগিতায় দিন দিন নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। ফেইসবুকের দিকে তাকালে এত বেশি কৃত্রিমতা—যে নিজের চেহারাকে না ছুঁয়ে স্ক্রিনের এডিট করা মুখসত্য আমাদেরকে পথ দেখায়। সহজেই অনুমান করা যায় আমাদের ভবিতব্য?
দহন প্রক্রিয়ার পত্ররূপ দাহপত্র নিয়ে। কমলকুমার দত্ত সম্পাদিত হুগলি থেকে প্রকাশিত লিটলম্যাগটি এখন পর্যন্ত প্রকাশ করেছে ৩৬টি সংখ্যা। ২৬ বছরে তারা বেশ কিছু কাজ করেছে। ২০০২ সালে দীপক মজুমদার বিশেষ সংখ্যা, ২০১৩-তে অরুণেশ ঘোষ সংখ্যা, ২০১৯-এ অমিতাভ মৈত্র সংখ্যা। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার কবিদের কবিতা, কবি-শিল্পীদের সাক্ষাৎকার, ডায়েরি, যেমন—ভ্যান গগের চিঠি, দালির ডায়েরি ও তাঁকে নিয়ে গদ্য, পাবলো নেরুদা, টম গান, অক্তাভিও পাস-এর সাক্ষাৎকার, কবিতা, জীবনপঞ্জি, লোরকা, হোলুব, শিম্বোর্স্কার কবিতাগুচ্ছ, জর্জ সেফেরিস-এর জার্নাল, র্যাঁবোকে নিয়ে হেনরি মিলারের বইয়ের ভাষ্য ও ভাষান্তর। আফ্রো-আমেরিকান কবিতা, অ্যাড্রিয়েনে রিচ-এর কবিতা, শার্ল পিয়ের বোদলের-এর জার্নাল, সিজার ভ্যালেহো, প্যাট্রিক লেন, স্যামুয়েল ওয়াগন ওয়াটসন, আঁরি মিশো, ফ্রাঁসিস পঁঝ, কার্ল স্যান্ডবার্গ, কাহলিল জিব্রান, এ. ডি. হোক-এর কবিতা, সঙ্গে সঙ্গে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের কবিতার অনুবাদ।
দাহপত্র-র সর্বশেষ সংখ্যাটি ছিল নিত্যব্রত দাস সংখ্যা। ১৯৫৬ সালে কুচবিহারে জন্ম নেয়া নিত্যব্রত দাস একেবারেই প্রকাশ্যে আসতে চান না। তিনি শুধুমাত্র দাহপত্র-র কবি। অন্য কোথাও তার কবিতা দেখা যায় না। ২০১৫ সালে ৫৯ বছর বয়সে প্রথম কাব্য অশুভ মোমবাতি প্রকাশিত হয়। সম্পূর্ণ নতুন এক কাব্য ভাষায় তার কবিতার জগৎ উন্মোচন করেছেন—যা আবহমান বাংলা কবিতার অভিজ্ঞতা নিয়ে মেলানো যায় না। পুঞ্জিভূত বোধ স্তূপ থেকে যেন নিজেকে একটু একটু উন্মোচন করেন। এখন পর্যন্ত ৬টি কাব্য প্রকাশিত হয়েছে। নিত্যব্রত দাসের কয়েকটি কবিতা পাঠ করা যাক—
কাহাদের জীবন
কেউ যেন চিৎকার করে বলল, কেউ ভাসিয়ে নিচ্ছে তাকে,
করুণ মিনতিতে।
বলছে, কেউ যেন ফিরিয়ে আনে
উড়ন্ত ঘোড়ার পিঠে, না হয় পালতোলা জাহাজে, পাখিদের ঠোঁটে।
সত্যিই উড়ে যাচ্ছে, গাছপালা ছাড়িয়ে মেঘের ওপরে?
সত্যিই ভেসে আসছে আর্ত চিৎকার?
অশুভ মোমবাতি
৮
কাচের বাটির আধারে ফুলের রেণুমাখা মধু
দিঘল মৌমাছি, কাচের মতো সাবলীল তোমার চোখ
আমার মধুও ভেঙে চৌচির হয়ে গেছে বলে
আধারের আকার আঁকড়ে থাকে গড় অন্ধকার
ঈশ্বর আসেন শূন্যে
এরকম কবিতায় ভরা নিত্যব্রত দাসের কবিতার খাতা। হাকডাক দিয়ে মানুষকে জড়ো করে তিনি মুন্সিয়ানা দেখাতে চান না। তার কবিতা কেউ পাঠ না করলেও কিছু আসে যায় না। যেন কাফকার বংশের। অবচেতনের ভাষা দিয়ে বোধের নগরীতে স্থাপত্য নির্মাণ করে হারিয়ে গেছেন। প্রথম কবিতার বই অশুভ মোমবাতি প্রকাশের পর সবগুলো কপি তিনি গুম করে ফেলেন। যে কয়েকটা কপি পাঠকের কাছে সে কয়টা কপিও ফিরিয়ে আনতে গেছেন। বিজ্ঞাপিত এই সময়ে তাঁর এই পথ নির্মাণ শুধু যেন তার নিজের জন্য নয়। চারদিকে এত অতৃপ্তির মিছিল। পণ্য বিক্রির এত হিড়িক। শিল্পও বাদ যায় না। প্রার্থনাও বিক্রি হয়। নিত্যব্রত নিজে পুড়ে আগুনের ভিতর এক বিদগ্ধতার কথা বলেছেন। পথ দেখিয়েছেন। হয়তো তিনি কিছুই চাননি। গদ্যেও তিনি শক্তিশালী। পাঠ করা যাক—
মুখোশ না থাকলে মানুষকে দেখা যায় না, অন্যকে বলা যায় না তার কথা। মুখোশ নেই মানুষ শীর্ণ হয়, ঝরাপাতার মতো দেখতে। মানুষের ঠিকানা তার মুখোশের অংশ, তার নাম, শরীরের আকার। কান একটু বড়ো, পা দু-খানা লম্বা। প্রেমও প্রেমের মুখোশ। মানুষের হরতকীর নাম বেদনা। রাত হলে শুধু ব্যথা অবশিষ্ট থাকে। মুখোশ ব্যথায় ভর্তি হয়ে ঘুমোয়। তরীতকী শূন্যের বিরোধী, শূন্যের বিরোধী।
(এইসব লুপ্ত ঘোড়ার দোকান)
দাহপত্র-র এবারের সংখ্যাটি শুধু নিত্যব্রত দাসময়। কবির সাক্ষাৎকার এক অবচেতনের সঙ্গে কথা বলা। এরকম বিমূর্ত উত্তর আগে চোখে পড়েনি। কবির কাব্যগুলোর নির্বাচিত কবিতা। অপ্রকাশিত কবিতা। তাঁর গদ্য পুকুরের সোনালি মাছ পাঠককে সাঁতায় শেখায়। ডুবতে শিখায়। মাছেদের সঙ্গে উড়ে উড়ে পৃথিবীকে ছুটি দিয়ে কোথায় যেন নিয়ে যায়। এক অনির্বচনীয় পার্থিব ও অপার্থিবের দেশে বাউলের পেছনে হাঁটা। হারিয়ে যাবার ভয় নেই। কবির কবিতার পাঠপ্রতিক্রিয়া লিখেখেন শতানীক রায়। গদ্য নিয়ে লিখতে গিয়ে অমিতাভ মৈত্র লিখেছেন, ডুবুরির পোশাক না থাকলে নিত্যব্রতর গদ্য পড়বেন না।