ব্যক্তিগত পাঠ : ইশরাত তানিয়ার মদ এক স্বর্ণাভ শিশির

একজন জিজ্ঞেস করলেন : গল্পটি কেমন, প্রথম গল্পটি? প্রশ্নকারীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিনি গল্পটি পড়েছেন। তবু জানতে চান। মনে হলো দুই শব্দের উত্তর চান— ভালো কি মন্দ, হ্যাঁ অথবা না। এমন কবন্ধ উত্তর গল্পের ক্ষেত্রে দেয়া কবিরা গুনার সামিল। আর কিছু না হোক তাতে লেখকের শ্রমকে অস্বীকার করা হয়। 
প্রশ্নকারীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এবার মনে হলো তিনি দীর্ঘ আলাপে নিমগ্ন হতে চান। তা হলেই ভালো।
কবিরা গুনাহ বলাতে তিনি আমার দিকে অন্য রকম করে তাকালেন। ধর্ম থেকে ঋণ নিয়ে কথা বলছি। ঠিক আছে, মনে থাকলে হয়, জবাব দেবো। 
বাকি রইলো মাঝামাঝি বলে ঘষেমেজে নিজের কৃপণতার আড়ালে নিরপেক্ষ থাকা আর খুব বেশি বলে খুশি করা। ঠিক তখনি নিজের ভেতরে ‘ঘেউ’ শব্দটি শুনতে পেলাম। নিজেকে বললাম, আরে বাপ, তোর ভেতরের কুকুর, গন্ধপ্রবণ জ্যান্ত কুকুর বেশ বহাল তবিয়তে আছে। ইশরাত তানিয়া তাঁর গল্পে সারমেয়-র অনেক বিষয়ের অবতারণা করেছেন কিন্তু এই প্রাণী দুই কিলোমিটার দূর থেকে গন্ধ টের পায় তা উল্লেখ করেননি। তা না হলে এরা কালো প্রিমিওর হর্ন শুনেও নির্বিকার থাকে কী করে। একটু হেলদোল করে না। নিশ্চয় গাড়িতে কে আছে বহু পূর্বেই জানে। কুকুরের বিশেষ শক্তি হলো গন্ধ টের পাওয়া।
কুকুর সম্পর্কে মোল্লা মাওলানা থেকে শুরু করে নিরেট ভদ্রলোক পর্যন্ত প্রত্যেকে নিজেদের অভিজ্ঞান কমবেশ জাহির করেছেন এ গল্পে। বিজ্ঞান, হাদিস, ঋতু বা সময় কোন কিছু বাদ যায়নি। কুকুর বিষয়ক জ্ঞান এবং বিশেষ জ্ঞান একবিন্দু বাকি নেই যেন। 
প্রশ্নকারীর মুখের দিকে চেয়ে দেখলাম তিনি আমার ওপর অসন্তুষ্ট। অন্যের মনে কষ্ট দেয়া পাপের সামিল। আমি যা বলেছি তিনি তার সবটা জানেন। আমাকে নতুন কিছু বলতে হবে।
বললাম : ‘উত্তর কমলাপুরের একটা মধ্যবিত্ত গলি ভাতঘুম শেষে জেগে উঠেছে।’ বুঝতে পারছেন আস্ত একটা গলির প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে গল্পটি শুরু হয়েছে। 
তিনি বললেন : দেখেছি, এই বাক্যের জন্যই গল্পটি পড়তে শুরু করেছি। 
বুঝতে পারলাম অন্য নতুন কথা বলতে হবে। বললাম, কুকুরগুলো কুকুর নয়। এরা কালের অন্ধকার। প্রথমে দুটির সাক্ষাৎ পাই আমরা, শেষে শত শত অন্ধকার। অন্ধকার কুরুক্ষেত্র। বিশেষ থেকে সামান্যের দিকে যাত্রা।
তিনি আমাকে থামিয়ে বললেন : এমনিতে কুকুর রূপক, তার ওপরে আপনি আবার রূপক নিতে গেলেন কেন! কিছুক্ষণ পরে বলবেন, এ হলো অ্যালিগরি। সোস্যাল ডিজঅর্ডারকে চেতনার ভেতর থেকে উপস্থাপন করতে হলে রূপক লাগবে। কিন্তু আমার প্রত্যাশা ঢেকে না ফেলে খুলে দিন, উদোম করুন, গল্পের অস্থি মজ্জা দেখি। 
লোকটার ধৈর্য শক্তি কম। বললাম : রূপক বা আবরণ তো এখানে অলঙ্কার। কবিতা হলে তাই বলতেন। কিন্তু এ অলঙ্কার বিষয়কে ঢেকে ফেলেনি বরং গল্পকে সমুজ্জ্বল করেছে। গল্পের খেলাটা তো এখানে। অ্যালিগরি আছে বলে ইহা গল্প। আবার গল্পটা গল্প কিন্তু এর অন্তঃস্থ অর্থ ভিন্ন। ভদ্রলোকেরা প্রতিরোধ করে না। কামড় খাচ্ছে। র্যাবিসে আক্রান্ত হচ্ছে। চুমকির হাত কেটে যাচ্ছে। আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। ‘জরুরি কাজ না হলে কেউ ঘর থেকে বেরোয় না।’ কামড় খায়নি কে? ‘কে নেই? টিভি মেকানিক, বাবুর্চি, শিশু, গৃহিণী, আমলা, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, চাওয়ালা, কাবাবওয়ালা... এমন কি খোদ মেয়র।’ 
একটু থেমে বললাম :  ইহা কি সমাজের বর্তমান অবস্থা নয়?
তিনি আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চেয়ে আছেন। তিনি নিশ্চয়ই আরও শুনতে চান। তাই আমি বলতে থাকলাম, এ হলো গল্পের হৃৎপিণ্ড। কিন্তু ইহা দু'প্রকোষ্ঠের গল্প। হৃৎপিণ্ডের অলিন্দ নিলয়ের মতো। এক ডিমের ভেতর দুটি কুসুম থাকার মতো। অলিন্দের খবর জানা গেলো। এবার নিলয়ের খবর।
নিলয়ের খবরের সঙ্গে ৭১ জড়িত। সেই সময়ের অন্ধকার থেকে মুক্তি পেতে অনেকের সঙ্গে জর্জ হ্যারিসনও যুদ্ধ করেছিলেন। বন্দুক দিয়ে নয়, যুদ্ধ করেছিলেন গিটার হাতে। আমাদের এই সময়ের হ্যারিসন হলেন নাইম। জানেন কেন ওর নাম নাইম? ও আসলে জান্নাতুন নাইম থেকে নাইম। তাঁর বন্ধুর নাম রামীম (দুর্জয় নামেও একজন আছে)।
তিনি বললেন : ধর্মের ঋণ শোধ করছেন। 
আমি বললাম : আমারও তাই মনে হয়েছে। আপনি নামসমূহ লক্ষ করুন। ব্যাংকার মশিউর, আরবি মশহুর থেকে মশিউর অর্থাৎ প্রসিদ্ধ। সালাম শান্তি। আলিমুল হক, এলেম থেকে আলিম, হক- সঠিক বা অধিকার, জ্ঞানের অধিকারী বা সঠিক জ্ঞানী, আলিমুল হক। গল্পে এই আলিম কিন্তু বিভ্রান্তিতে আছে এবং তাই সত্য। একমাত্র নাইম বিভ্রান্তিতে নেই। যদিও নাইম ঘুরছে। লেখক বলেন ‘যেন তাকে শেষ বিন্দুটির কাছে যেতে হবে...’ তার এগিয়ে যাওয়ার গতিটি লক্ষ্য করুন, ‘বুড়ো-জোয়ান নারী-নরের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে কখনো হাতে ঠেলে সরিয়ে নাইম এগিয়ে যায়।’
এই আলিম নাইমকে ফোন করছে। প্রশ্ন, ‘নাঈম ছাড়া কে এত ছোটোছুটি করবে?’ লেখক নিজে বলছেন ‘পাড়াশুদ্ধ লোকজন সবাই যেন ঢুকে পড়েছে কালো গহ্বরে। মৃত্যু গাছের একেকটি পাতা ঝরে আর একেকটি মানুষের প্রাণ নিভে যায়। ইয়া নাফসি চিৎকারের ধ্বনি প্রতিধ্বনিতে এ যেন হাশরের ময়দান।’ 
কুকুরের সম্মিলিত আক্রমণের বিরুদ্ধে নাইম গিটার হাতে তুলে নেয়। দূরে তখন হ্যারিসন গাইছে ... দ্যাট সাফারিং আই কান্ট নেগলেক্ট...
এই সাফারিং কিন্তু দুয়ের ভেতরে চারের খবর প্রদান করে। বাম অলিন্দ বাম নিলয় এবং ডান অলিন্দ ডান নিলয়। তখন আমরা বনাম পাকিস্তান। এখন আমরা বনাম আমরা। ইশরাত তানিয়াকে ছোট্ট করে একটা ধন্যবাদ দিতে পারেন।
তিনি বললেন : ধন্যবাদ আপনি পাঠাবেন, ওটা আপনার দায়িত্ব। ইশরাত তানিয়ার পক্ষে একটি কথা বলে চলে যাবো, আপনি বলেছেন, ইশরাত তাঁর গল্পে কুকুর গন্ধপ্রবণ, তথ্যটি দেননি। আপনি বলুন তো আটটি কুকুরকে ট্রেনে করে কমলাপুর থেকে ভৈরব ফেলে এলে ছয়টি কুকুর কী করে ফিরে আসে? 
কথা শেষ করে তিনি হনহন করে চলে গেলে আমি বোকার মতো ভাবতে থাকি কুকুর ফিরে আসার ক্ষেত্রে ঘ্রাণ শক্তি কাজে লাগিয়েছে নাকি স্মৃতি শক্তি। এই সংবাদ ইশরাত তানিয়াই ভালো জানেন। কিন্তু আমি যা জানি তাও তো বলা দরকার। আমি জানি ফিরে আসা কুকুরগুলো তো আসলে কুকুররূপী মানব বা মানবরূপী কুকুর। এরা ফাঁকতালে ব্যাগও লাপাত্তা করতে পারে। 
ইশরাত তানিয়াকে অসংখ্য ধন্যবাদ 'সারমেয় এবং জর্জ হ্যারিসন' গল্পের জন্য। 

গল্পগ্রন্থ : মদ এক স্বর্ণাভ শিশির
লেখক : ইশরাত তানিয়া
প্রকাশক : জলধি


 কাজী মোহাম্মদ আলমগীর, কথাসাহিত্যিক, কুমিল্লা।

menu
menu