এই আকালেও আমরা যদি স্বপ্ন দেখি

আমার কাছে পেছন ফিরে তাকালে জীবন এতই ছোট মনে হয় যে, আমি খুব সামান্যই এর অর্থ বুঝতে পারি-কাফকার ‘পরের গ্রাম’ ছোটগল্পের এই বাক্যটি পড়তে গিয়ে আমি থেমে গেলাম এবং আমার নিজের জীবনের পেছনে তাকালাম। স্কুল বয়স, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো এবং আরো অনেক অনেক টুকরো ঘটনা, বিচ্ছিন্ন ঘটনা যেগুলো মনে পড়ছে বিচ্ছিন্নভাবেই, যদিও ঘটনাগুলো পর পর সময় দিয়ে সংযুক্ত এবং আমারও মনে হল এতগুলো বছর যেন এই সেদিনের কথা।
যে পাতায় গল্পটি ছাপা হয়েছে তার পরের পাতায় আবিদ আজাদের ‘বুকের নিচে ঢালু হাওয়া ধরেছে তরবারি’ বাক্যটিদ্ভূত নিজের সঙ্গে মিলিয়ে নিলাম। আরো কিছু পরে শ্বেতা শতাব্দী এষকে জানলাম তাঁর কিছু কবিতা আর তার কবিতা নিয়ে আলোচনা পড়তে পড়তে।‘বসন্ত আসবে ভেবে হাওয়ার বাগানে/ প্রতিদিন সকালে বৃষ্টি দিতাম/ রক্তকরবীর শরীরে কেবলই/ পাতা ভরা অসুখের খাম!’ কি ভীষণ নস্টালজিক সুর তাঁর কবিতায় ।
এবার উল্টো দিকে হেঁটে আসি সাতান্ন পৃষ্ঠায় গল্পের পাতায়, ‘একটি টুথব্রাশ দিবস’ গল্পে সঞ্জীব পুরোহিত দাম্পত্য জীবনের ছবি এঁকেছেন সাদা কালো রঙের সাথে, আরো কিছু নীল-হলুদ-গোলাপী মিশিয়ে। ছোটগল্পের মতই তাঁর ছোটগল্প হঠাৎ শেষ হয়ে গেল। মনে হল, আরো কি কিছু বলা যেতো? হয়তো হ্যাঁ, হয়তো না, কী যায় আসে! কিন্তু আমার তো মুক্তি নেই। পাতা উল্টাতে উল্টাতে আটচল্লিশ পৃষ্ঠায় চোখে পড়ে মুজিব ইরমের শ্রীহট্টগীতিকা-‘ঘুরিয়া অনেক পথ পন্থহীন হই/ ধরিয়া অনেক ভান যেই-সেই রই’ যা স্বভাব আমার আকাশে নিজের সাথে সুর মেলানোর চেষ্টা। কিন্তু এবার শুধু আমার নিজের নয়, মনে পড়ে আরো অনেক স্বজনের কথা, যারা মধ্য বয়সে এসে ভাবে, এই পথহীনতার জন্য এতো পথা হাঁটা! কী করে মুজিব ইরম লুকানো দীর্ঘশ্বাস টেনে বের করে এক্কেবারে ছেপে ছিলেন?
সাইমন জাকায়িরার ‘পুঁথি’ প্রবন্ধটা গল্পের ঢঙে রেফারেন্স যেন। দীর্ঘশ্বাসের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ যেভাবে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে, সেভাবে আমিও ঢুকে পড়লাম কিছু তথ্য, কিছু প্রেক্ষাপট, কিছু সামাজিক-সাংস্কৃতিক দায় দায়িত্ব সংক্রান্ত চিন্তাসূত্রে। কিন্তু তথ্যস্ত বা রেফারেন্স পাঠ্যতালিকা লেখা শেষে পেলাম না বলে কেমন একটা অভাববোধ তৈরি হল। 
যখন কারো মুখোমুখি হই, বিশেষত সেই ব্যক্তি যদি চিন্তাশীল, মননশীল এবং জাগ্রত সাহিত্যিক হন তবে তার কাছে জানতে চাইবো তার চিন্তাকাঠামো, সাহিত্য সংক্রান্ত রসবোধ, নান্দনিকতা, তাঁর সাহিত্য বিশ্লেষণের সূ² সকল অনুভূতি এবং তাঁর সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতি বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্য। এটা আমার ব্যক্তিগত চাওয়া। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে করা প্রশ্নগুলো সেই চাওয়া প্রতিফলিত উত্তর খুঁজে আনার পক্ষে খুব উপযুক্ত নয় বলে মনে হল। তিনি কত বছর ধরে সাহিত্য রচনা করেন বা সারাদিনে কতক্ষণ লেখেন, এ-জাতীয় প্রশ্নের উত্তর আমার আগ্রহের বাইরে। কিন্তু দুর্দান্ত ভালো লেগে গেল ফরিদ কবিরের ‘জিন্দাবাহার লেন’ উছিলায় পুরান ঢাকার স্মৃতিচারণমূলক জলছায়া। যেন শৈশবের কাঠ আইসক্রিমের দিনগুলো ফিরে এলো এক সটকায়।
ডানে বাঁ’য়ে পাতা উল্টাতে উল্টাতে খুঁজছিলাম আরো কিছু। ‘আরো কিছু’টা পেয়ে গেলাম ত্রয়ী সাহিত্য আড্ডায়। রিমি মুৎসুদ্দি একই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন দুই বাংলার দুই সমসাময়িক কথাসাহিত্যিক মোজাফ্ফর হোসেন ও বোধিসত্ত¡ ভট্টাচার্যের সাথে আলাপচারিতায়। খুব প্রাণবন্ত সরস অনলাইন আড্ডার মধ্যে উঠে এসেছে অনেক নতুন কথা, নতুন চিন্তা। পুরনোকে নতুন আঘাত দিয়ে ভেঙেচুরে দেখার চেষ্টা ছিল আড্ডায়। দুই কথাসাহিত্যিকের লেখালেখির ভিত্তিমূল দিয়ে শুরু হয়েছে আড্ডা। দুজনের গল্প লেখা নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা, গল্পের বাস্তবতা, সাহিত্যমান পারস্পরিক মূল্যায়নটা বেশ দরকার ছিল। একজন গল্পকারের গল্পে গল্পকারের ব্যক্তি জীবনের প্রভাব, প্রতিষ্ঠানমুখিতা বা বিরোধিতা, সমসাময়িক গল্পের চরিত্র তৈরি ও তাদের ভাষা এমন অনেক জরুরি বিষয় নিয়ে আড্ডা হয়েছে। নবীন প্রবীন সকল গল্পকারের জন্য এই আড্ডা হবে আনন্দের এবং চিন্তা জাগানিয়া। ১৭৬ পৃষ্ঠা, সংখ্যা ৫, বর্ষ ৬, জানুয়ারি ২০১৮ এবং শংখচিল পত্রিকাটি হাতে  নিয়ে মনে হয়েছে, অনেক রসদ সমৃদ্ধ সাহিত্য পত্রিকা এটি।
যখন কর্পোরেট সংস্কৃতি নতুন প্রশ্নকে কেবলই ‘ইউজার’ এবং ‘কনজিউমার’ বানিয়ে ফেলতে উদগ্রীব, যখন নতুন প্রজন্ম অনলাইন মিডিয়ায় বিপ্লব-বিদ্রোহ থেকে শুরু করে শিল্প-সাহিত্য চর্চার সকল কর্মকাÐে অধিকতর ব্যস্ত, তখন প্রশ্ন আসতেই পারে, এই ২০১৮তে ১৭৬ পৃষ্ঠার ‘শঙ্খচিল’ কী করে আলোর মুখ দেখলো? এমন বিরাট কর্মযজ্ঞে নিবেদিত প্রাণ ও পরিশ্রমী হলেই শুধু চলে না, হতে হয় চিন্তাশীল এবং একাগ্র। সম্পাদক মাহফুজ পাঠক এবং ইকবাল মাহফুজকে ধন্যবাদ এবং অভিনন্দন। সেই সাথে অভিনন্দন পত্রিকাটির সাথে যুক্ত সকল নিবেদিত প্রাণকে। সুমনের সেই গানটা মনে পড়ছে, ‘কার তাকে কী / এই আকালেও আমরা যদি স্বপ্ন দেখি।‘
‘শঙ্খচিল’
সম্পাদক :  মাহফুজ পাঠক, ইকবাল মাহফুজ।
প্রচ্ছদ : সব্যসাচী হাজরা।
মূল্য : ১২০ টাকা।
প্রকাশ স্থান : ঢাকা।
 

menu
menu