আগস্ট আবছায়া : ১৫ আগস্টের নতুন দিগন্ত

‘ঈর্ষাকাতর সাহিত্যিক-পলিটিশিয়ানদের কোনো কথায় সত্যের কোনো হেরফের হবে না। হবে, পাঠকরা যদি বলেন এটা ভালো হয়নি, কেবল তবেই। নয়ত নয়। এর বাদে যা কিছু চলছে তা এই পাশবিক মানুষ দিয়ে ভরা জঘন্য পৃথিবীর নির্দয় আচার। এ-ব্যাপারে আমার ভালো ব্যতীত খারাপ কিছুই বলার নেই, কারণ পৃথিবীর রীতিই এই। আমি শুধু তাকিয়ে দেখছি এবং মনে মনে নিজেকে আরও শক্ত করে নিচ্ছি এই জীবনে আরও আরও শক্ত লড়াইয়ের মোকাবিলার জন্য। একটা হরফও আমার এই লেখায় মিথ্যা নয়। আমি এমনই। আমি লড়াকু। লড়েই, বিনয়ের সঙ্গে লড়েই, জীবনে এতদূর এসেছি এবং এখন দেখা যাচ্ছে এই জঘন্য ও ‘একপেশে’লড়াইয়ের কারণে আরও জেদি আমি বাংলা সাহিত্যের দিগন্তরেখায় নতুন নতুন বই লিখে সূর্যের আলোর মতো উদ্ভাসিত হতে থাকব। এতগুলো শত্রুর বিরুদ্ধে একা লড়তে আমার প্রচণ্ড ভালো লাগছে। নিজের প্রতি এই প্রবল আত্মবিশ্বাস ও আমার প্রতি ঈর্ষাকাতর ‘শত্রু’কিন্তু আদতে ‘মানুষ’বন্ধুদের উদ্দেশ্যে এই প্রতিজ্ঞার কথাটুকু বলেই শেষ করছি। পাঠক শুধু ‘আগস্ট আবছায়া’ কিনুন এবং পড়ে নিজেই বলুন আমি কেমন লিখেছি, আপনার বেশ কয়েক রাতের ঘুম হারাম হলো কি-না, বাংলা সাহিত্যে একদম নতুন কিছু পড়লেন কিনা। এ-ই...’ 

উপরে উল্লিখিত অংশটুকু কবি ও কথাশিল্পী মাসরুর আরেফিনের। তার নিজের ফিনকি থেকে বের হওয়া রক্ত-অশ্রু। লেখককে এ রকম আরও অনেক অশ্রু ঝরাতে হয়। মাসরুর আরেফিনও ঝরিয়েছেন। ঝরিয়েছেন বলেই আমরা তার কাছ থেকে পেয়েছি, আমাদের সময়ের উত্তম পুরুষে লেখা নন্দিত উপন্যাস—মাস্টারপিস ‘আগস্ট আবছায়া’। আগস্ট আবছায়ায় আছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে নির্মম হত্যাকাণ্ডের নৃশংস ঘটনা। ১৫ আগস্ট, কালো রাতের বীভৎস কাহিনি। কেমন করে, কখন কীভাবে এ হত্যাকাণ্ডটি ঘটল তার বিশদ বিবরণ। অর্থাৎ অনেক চরিত্র ও ঘটনার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে উপন্যাসটি জীবন ও মৃত্যু সম্পর্কে অনেক প্রশ্নের সামনে পাঠককে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আমরা পাঠকের কাছে সেই ঘটনার কিছুটা তুলে ধরার চেষ্টা করছি—অবসরপ্রাপ্ত মেজর শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর নূর চৌধুরী, খন্দকার মোশতাকের পুরান ঢাকার বাসায় মোশতাককেই বললেন, ‘অস্ত্রাগার খোলা হবে, গোলাগুলি ডিস্টিবিউট করা হবে, বালুর মাঠে ঘোষণা করা হবে, মুজিবকে মারতে যাচ্ছি আমরা, ব্রিফিং হবে ভালো মতো যে চার-পাঁচ দল কে কোন দিকে যাবে, মানে ওই তিন বাসা (মিন্টো রোড়ের ২৭ নাম্বার বাসা, অবসরপ্রাপ্ত মেজর শাহরিয়ার রশিদ খানের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও মোশতাক আহমদের পুরান ঢাকার বাসা) ও রেডিও স্টেশন আর ফারুক নিজে ট্যাংক নিয়ে যাবে শেরে বাংলা নগর রক্ষা বাহিনীর ওইখানে—সব স্মুথলি হবে, কোনো বাধা দেবে না আমার বস শাফায়াত কিংবা তার ফোরটি  সিক্স ব্রিগেডের চার হাজার জওয়ানের কেউ। কোনো বাধা দেবে না খালেদ মোশাররফ, জেনারেল জিয়া, ব্রিগেডিয়ার রউফ। কোনো বাধা দেবে না কেউ’ —কথাটা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল রশিদ—নো ওয়ান ইজ গোয়িং টু স্টপ অ্যানিথিং। ক্লিয়ার স্যার?
     
‘ক্লিয়ার স্যার’প্রশ্নটা রশিদ এত জোরে করল, মোশতাক দুই ইঞ্চি সরিয়ে নিল তার মুখ এবং আমি ঘাবড়ে গেলাম একটু। রশিদের নাকে এসেছে মোশতাকের দীর্ঘ সময় না-খাওয়া মুখের দুর্গন্ধ। সে সরে এলো পেছনের দিকে, মেজর শাহরিয়ার ও মেজর নূরকে ইঙ্গিত দিল উঠে দাঁড়ানোর, তারপর মোশতাককে বলল, ‘অ্যাবসুলিউটলি বি শিওর অ্যাবাউট আওয়ার সাকসেস টুমরো আর্লি মনিং। ঘুমান স্যার, রাতে জেগে থাকবেন না। আমি সকালে আসব দেশের নতুন প্রেসিডেন্টকে স্যালুট করতে।’   

২.
শেখ কামাল নিচে নেমে এলেন। তখনো গেটের সামনের কালো ও খাকি আর্মিদের দল গেট পার হয়ে ভেতরে ঢোকেনি, ঢুকবে ঢুকবে করছে। কামাল চেঁচিয়ে রিসিপশন রুমের সামনে জড়ো হওয়া কুমিল্লার ওয়ান ফিল্ড আর্টিলারির ব্যাটালিয়নদের এবং পুলিশের ওই তিন-চারজনকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘আব্বা আর্মি চিফের সাথে কথা বলেছেন, কর্নেল জামিলের সাথে কথা বলেছেন। আর্মিরা চলে আসবে এক্ষুনি। এইটা জাসদের হামলা, জাসদ, সর্বহারা গ্রুপ মিলে হামলা। আর্মি এসে যাবে। ভয় পাবেন না আপনারা।’
এই কথা বলতে বলতে শেখ কামাল রিসিপশন রুম থেকে সামান্য সরে বাইরের দিকে পা রাখলেন এবং গেটে ওই আর্মিদের দেখে অনেক খুশি হয়ে বললেন, ‘আর্মি ভাইয়েরা কারা আসছেন, ভিতরে আসেন। কারা আসছেন, ভিতরে আসেন।’পুলিশের দুজন পাশ থেকে শেখ কামালের হাত ধরে ভেতরের দিকে টেনে রাখলেন, যেন তিনি বাইরে চলে না যান। শেখ কামাল বিভ্রান্ত। আমি তার থেকে সামান্য দূরে, আমার সামনে কুমিল্লার রেজিমেন্টের ভিড়। শেখ কামালের পেছনে পিএ মুহিতুল ইসলাম। হঠাৎ গেট ধাক্কা দিয়ে এদিকে এগোতে থাকল কালো পোশাক ও খাকি পোশাকের দশজনের মতো একটা দল। তারা আমাদের এখানে পৌঁছে গেল একমুহূর্তে, গাড়িবারান্দা ও গেটের দূরত্ব অতখানিই কম। তারা একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল ‘হ্যান্ডস আপ’, ‘হ্যান্ডস আপ’। বিভ্রান্ত কামাল ও পুলিশের তিনজন—নুরুল  ইসলাম, সিদ্দিকুর রহমান, খোরশেদ আলী—একসঙ্গে হাত উঁচু করলেন। শেখ কামালের চোখেমুখে বিস্ময়। তিনি হাত উঁচুতে তোলা অবস্থাতেই বললেন, ‘আমি শেখ কামাল। শেখ মুজিবের ছেলে কামাল।’ আরও দুবার দলটা বলে উঠল, ‘হ্যান্ডস আপ’, ‘হ্যান্ডস আপ’।... ক্যাপ্টেন হুদা এবার আবার গুলি করল তাকে, বুকে ও তলপেটে, শর্ট ব্রাশফায়ার। আমি কোন দিকে যাব? গুলি চলার সময় কী বিভীষিকাময় শব্দ, কিন্তু গুলি শেষে কী ভয়ানক নিস্তব্ধতা। তিন দিক থেকে তিনটা আওয়াজ পেলাম। দোতলায় এক মেয়ের কণ্ঠে—‘কা-মা-ল’; আমার মনে হলো সুলতানা কামালের চিৎকার ওটা। কা ও মা জোরে, আর ল বলতেই কে যেন ওই নারীকণ্ঠকে মুখে হাতচাপা দিয়ে থামিয়ে দিল ঠাং করে। একমুহূর্তের জন্য মনে হলো বেগম মুজিবের চিৎকারও হতে পারে ওটা। আমার বাঁয়ে রিসিপশন রুম থেকে শুনলাম কামালের কণ্ঠে তীব্র ব্যথার এক গোঁ গোঁ আওয়াজ, তার পা দেখলাম নড়ছে ফড়িংয়ের পাখার মতো, তার ডান হাত পেটের ওপরে চলে এসেছে, যেখান থেকে পিঠ ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে গুলি, হাতটা সামনে নিয়ে হাত কী পরিমাণ রক্তে ভেসে গেছে, তা দেখারও আর শক্তি নেই কামালের।...

৩.
এরপর মূল ঘটনা—কবি ও কথাশিল্পী মাসরুর আরেফিন লিখলেন তার রক্ত ঝরানো লেখা। বঙ্গবন্ধুর  নৃশংস আর বীভৎসময় হত্যার কথা লিখলেন তার উত্তম পুরুষে লেখা উপন্যাস আগস্ট আবছায়ায়। সাধারণের বাইরে, নতুন আঙ্গিকে একটি ভিন্ন ধরনের নতুন উপন্যাস। নতুন কিছু। যা এর আগে আমরা পড়িনি। তিনি লিখলেন—শুনলাম বঙ্গবন্ধু কাকে যেনো বললেন, ‘বেয়াদবি করছিস কেনো? আমি তোদের  জাতির পিতা। আমি এক ঝলকের জন্য দেখলাম নূর মাঝখানের ল্যাডিং থেকে হাত তুলে বুড়ো আঙুলে চুটকি বাজিয়ে হুদাকে একটা ইঙ্গিত দিল। একঝলক। হুদা ঝট করে বঙ্গবন্ধুকে টপকে নিচে নেমে গেল, নূরের পশে গিয়ে দাঁড়াল। বঙ্গবন্ধু কেমন সচকিত হয়ে উঠলেন। নূর চিৎকার দিয়ে উঠল ‘স্টপ’। তারপর আবার ‘স্টপ। দিজ বাস্টার্স হ্যাজ নো রাইট টু লিভ। স্টেপ অ্যাসাইড।’ বঙ্গবন্ধুর একেবারে পেছনে দাঁড়ানো মেজর মুহিউদ্দিন এবং ওই তিন সৈনিক মুহূর্তের মধ্যে তিনতলার ওঠার সিঁড়ির দিকটাতে সরে গেল। নূর চিৎকার করছে ‘স্টপ দেয়ার স্টপ।’নূর কনুই দিয়ে গুঁতো দিল হুদাকে। নূরের ও হুদার স্টেনগান বঙ্গবন্ধুর বুকের উপর সোজা হয়ে উঠল। নূর বলল ‘ফ্রিজ।’

তারপরই গুলি। ব্রাশফায়ার। মোসলেম ও সারওয়ার ফায়ার করল। তবে বঙ্গবন্ধুর দিকে নয়। অন্যদিকে, কোন দিকে তা তারাও জানে না, আমিও না। একঝাঁক গুলি। তারা নির্বিঘ্নে বিশ্বস্ত হুকুমবরদারের মতো গিয়ে বিঁধল বঙ্গবন্ধুর বুকের ডান দিকে, একটা বিশাল ছিদ্র করে বেরিয়ে গেল তার পিঠ দিয়ে। যেনো একদল পশু গুলি করল বাংলাদেশকে। আটষট্টি হাজার গ্রামকে। গুলির ধাক্কায় তিনি মুখ থুবড়ে—হুমড়ি খেয়ে পড়লেন সিঁড়ির উপরে, দু’তিন ধাপ নেমে স্থির হলো তার উপুড় হওয়া শরীর। তখনো তার একহাতে দেশলাই ও পাইপ। তার তলপেট ও বুক বুলেটে ঝাঝরা হয়ে গেছে। কিন্তু আমি তা দেখতে পাচ্ছি না। শুধু দেখছি তার পিঠের গর্তটাকে। পাশে চশমা, চশমার একটা কাচ ভেঙে। এতক্ষণে হাতের পাইপ সিঁড়িতে স্থান নিয়েছে। আমি ভালো করে তাকালাম তার কেঁপে কেঁপে স্থির হয়ে থাকা দেহটার দিকে। এখনো নড়ছে দেহটা। হাঁটু সামান্য কাঁপছে বিদ্যুতায়িত হলে যেমন শরীর কাঁপে, তেমনভাবে। দেখলাম তার ডান হাতের তর্জনীতে একটা বুলেট গেলেছে, আঙুলটা কোনোরকমে ঝুলে আছে হাতের সঙ্গে। এইবার শুরু হলো তার পাঞ্জাবির রক্তে ভিজে ওঠা। প্রথমে ধীরে, তারপর বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো... 

৪.
মাসরুর আরেফিনের এই আগস্ট আবছায়া উপন্যাস পড়লে বঙ্গবন্ধু ও তার বাংলাদেশ না, দেশের তথা সংসারের হিসাব-নিকাশ না, প্রেম-ভালোবাসা, দ্বন্দ্ব-সংঘাত না—বিশ্ব সাহিত্যের অনেক কিছু পড়া হয়ে যায়। পড়া হয়ে যায় উত্তরাধুনিক গল্পের শত-সহস্র পাতা। দেশ ভাগ, বিদেশের জল ও আবহাওয়া—জানা যায় ফ্রানৎস কাফকার করুণ মৃত্যু থেকে শুরু করে হোর্হে লুইস বোর্হেস, ইভান তুর্গেনেভ, নিৎসে, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, রবার্ট ক্লপস্টক, আলেকজান্ডার পুশকিন, কিটসের যক্ষ্মারোগ অথবা ওড টু নাইটিঙ্গেল-জানা যায় চার্লস ডারউইন, মার্সেল প্রুস্তের ইন সার্চ লস টাইমের অজানা সব নিত্য-নতুন কাহিনি। মানুষের ক্লেদাক্ত রক্ত আর ভালোবাসা গল্প। আর মাসরুর আরেফিনের এ উপন্যাসের ভাষা-ভঙ্গি ও বিষয়ে রয়েছে লেখকের নিত্য-নতুন, নান্দনিক, অভিনব সব অভিজ্ঞতা। উপন্যাসের জগতে এক নতুন, মুগ্ধতায় ভরা একদম ভিন্ন কিছু পড়লেন আপনি। মাসরুর আরেফিনের ভাষা ঝরঝরে, নিখুঁত ও সাবলীল। ফারুক আবদুল্লার মতো আমিও বলব, চরিত্রের এই অবসেশন ১৫ আগস্ট নিয়ে না হয়ে কারবালা নিয়েও হতে পারত। তবে এ কথাও সত্য, এ উপন্যাস আপনাকে বাংলা ও বিশ্ব সাহিত্যের নতুন দোলায় উদ্বেলিত করবে—এ উপন্যাস আপনার সংগ্রহকে সমৃদ্ধ করবে। আমরা এর উত্তরোত্তর প্রচার, প্রসার ও সমৃদ্ধি কামনা করছি। আগস্ট আবছায়া নিয়ে লিখেছেন এ টি এম গোলাম কিবরিয়া। তার লেখাটাও মন্দ না। বেশ সুন্দর। কিবরিয়ার লেখার চুম্বক অংশ পাঠকের জন্য তুলে ধরলাম। তিনি বলেন, আমার ধারণা, তিনি মাই স্ট্রাগল পড়েছেন। কার্লের অবসেশন তার বাবাকে নিয়ে, মাসরুরের অবসেশন পনেরোই আগস্ট তথা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। ভাষা মোটামুটি বাংলা দ্বিতীয়পত্রের রচনার মতো, কিন্তু একটা সময়ের পরে মনে হয়েছে মাহমুদুল হকের মতো। অনুবাদের মতন ভাষা, অদ্ভুত। একোয়ার্ড টেস্ট, এই স্বাদ আপনাকে অর্জন করতে হয়, মনে হয়েছে আমার। কোথাও কোথাও বিশুদ্ধ কবিতা, যখন তিনি প্রগাঢ় মেহেরনাজকে প্রথম পরিচিত করছেন, সেই সময়টুকু। এই বইটা নিয়ে এত এত কথা! পরের মুখে ঝাল না খেয়ে আপনি এটা নিজে পড়ে দেখুন। এই লেখক আনকোরা নন, টাকার জোরে লেখক নন এবং এমন কিছু আপনার বাংলায় আগে পড়ার সম্ভাবনা কম। বইয়ের খারাপ দিক হলো লেখকের রাজনৈতিক অবস্থান, একদমই শিশুতোষ। তার রাজনৈতিক দুনিয়া সাদা-কালো, যদি ও তিনি পরম পারস্পেক্টিভিস্ট নিটশের ভক্ত। ডানপন্থি মানেই খারাপ এই ধরনের কথা বলার মতন ডাম্ব তাকে আমার মনে হয়নি। এত বড় বই, কোথাও ফারুক রশীদদের গ্রিভেন্সের কারণ বর্ণনা নেই। প্রচলিত ন্যারেটিভের মতন মোশতাক আছে ডেভিল ইনকারনেট হয়ে, ওই সেন্সিটিভ সময়টুকুর বর্ণনায় তার কোনো ক্রিয়েটিভিটি দেখিনি, তাকে সচেতন মনে হয়েছে খুব। খারাপ লেগেছে। আমি কয়েকমাস আগে ইয়োসার ‘দ্য ফিস্ট অফ গোট’পড়েছিলাম; ট্রুহিলোকে যারা মেরেছিল তাদের প্রত্যেকের জবানী ছিল ওই বইয়ে। আমি পড়ছিলাম আর তুলনা করছিলাম বারবার। এই অদ্ভুত ভালো বইটার জন্য মায়া লাগবে যদি দেখি এটাকে একটা সফিস্টিকেইটেড প্রোপাগান্ডা নভেল হিসেবে ট্রিট করা হচ্ছে। আর একটা কথা, মাসরুরের সঙ্গে পরিচয় থাকলে আমি তাকে বলতাম প্রচারণায় আরেকটু ওল্ডস্কুল হতে। আমি বইয়ের বিপণনের একশতভাগ পক্ষে, কিন্তু এই বইটি পোস্টার লাগিয়ে বিক্রি করার মতন না। এইটা টিপিক্যাল হাই আর্ট মেটেরিয়াল, এক্সক্লুসিভিটি, নিচুস্বরের স্বাভাবিক ভঙ্গিমা হওয়ার কথা। মাসরুর সাংসারিক জীবনে এতই সফল, এই কথাগুলো বলার মতন বন্ধু বোধহয় তার নেই। চারদিকে স্তাবক আর নিন্দুক, স্বাভাবিক মানুষ নেই। এনিওয়ে, বইটি পড়ুন, ভিন্ন অভিজ্ঞতা হবে।

বাঙালি মুসলমান লেখকদের তুলনায় আগস্ট আবছায়ার গল্প ও ভাষা নতুন। ভিন্নতায় ভরা। অনেক দূর পড়ার পর কেন জানি মনে হয়েছিল লেখাটা একটা মেসমেরাইজিং। দীর্ঘ বাক্য নিয়ে আমার মনে হয়েছে—লেখক একটা স্ট্রেস টেস্টিং করছেন। দেখছেন কতটুকু লিখলে শব্দেরা না ছিড়ে একসঙ্গে থাকে বাক্যের ভেতর। বাইরে। মাসরুর আরেফিনের আগস্ট আবছায়ার যে জায়গাটা আমাদের বেশি ভালো লেগেছে, তা হলো এর ইমেজারি, শক্তি ও সাহস। একটা বড় চক্রান্ত খাড়া করানোর সাহস যেটা চলনসই মাত্রার ডেলিভারি বা প্রদান। বড় লেখকদের নিজস্ব ভাষা থাকে, মাসরুর আরেফিনেরও তা আছে। তার ভাষাতে পাঠকের জিহ্বা অভ্যস্ত হয়ে উঠবে বলেই আমাদের ধারণা।
 
গণমানুষের কবি, কথা সাহিত্যিক মাসরুর আরেফিনের আগস্ট আবছায়ার ইতি টানছি রাশিয়ার বিখ্যাত কবি ও লেখক মিখাইল লেরমন্তভের একটি বিখ্যাত ও দীর্ঘ কবিতার সামান্য উদ্ধৃতি দিয়ে— 
যখন হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে দেখবে আমাকে,
ওটা ঘটবে দ্রুত... আজই...
তখন ওদের বোলো তারা যেন আমাকে সরিয়ে নেয় এইখান থেকে।


• ঢাকা

menu
menu