রাতের আলোতে দু’জন অন্ধকারের কথোপকথন

“হাসছেন? আমি জোনাকিকে পাখিই বলি। জোনাকপাখি। পাখি বলতে ভাল লাগে। ছোট ছোট আলোর পাখি। মিষ্টি আলোর পাখি। ছোট ছোট আলোর টুকরো। ছোট ছোট ঠান্ডা আগুনের টুকরো উড়ে বেড়াচ্ছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে সুরে সুরে, কাছে দূরে, ফুরফুরে মেজাজে। দল বাঁধা জোনাকি দেখে মনে হয় আলোর বৃষ্টি। আর এসবের মধ্যে আপনার হাসি, খুবই দারুণ ব্যাপার। আপনার হাসিরাশি কেমন বিলি কেটে চলে যাচ্ছে অন্ধকার নদীর জলে। আপনার হাসি গোপন জোনাকির মতো, ভেতরকে আলোকিত করে। আরে না, আমি কবি না। কথা শুনে কবি মনে হচ্ছে? হা হা হাসালেন। কী! আমারও হাসি সুন্দর? এই প্রথম কেউ আমাকে বলল। ধন্যবাদ আপনাকে। তবে সুন্দর করে কথা বলতে আমার ভালো লাগে। ভাষা আমার খুব ভালো লাগে। ভাষার বিচিত্র রূপ। বলতে গেলে একরকম, লিখতে গেলে আরেকরকম। একই শব্দের, গঠনের বাক্য একেকজনের কাছে একেকরকম মুখ নিয়ে দাঁড় হয়। ভাষার চাঁদ আর তার জোছনার রূপ অদ্ভুত। যখন প্রাথমিকে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হই তখন, বই দিয়েছিল তিনটা। বাংলা, ইংরেজি আর গণিত। আমি বাসায় এসে আমার দাদাকে বাংলা বই দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এটা কেন পড়ব? তিনি বলেছিলেন, ‘এটা আমাদের মাতৃভাষার বই। এ জন্যে এটা পড়তে হবে।’ আমি তাকে ইংরেজি বই দেখিয়ে বলেছিলাম, এটা কেন পড়তে হবে? তিনি বলেছিলেন, ‘এটা ইংল্যান্ডের ভাষা কিন্তু সারা দুনিয়াতে এ ভাষা বোঝে তাই এ ভাষা শিখতে হবে।’ তিনি আর ততক্ষণ বসেছিলেন না। আমি গণিত বই নিয়ে ভাবলাম, গণিতও হয়তো কোনো এক দেশের ভাষা বা কোনো দুই দেশের ভাষা বা অনেকগুলো দেশের ভাষা বা সমগ্র জগতের। এ ভাষাতে কোথাও কোথাও কথা বলা হয়। হাসছেন? সত্যি আমি তাই ভেবেছিলাম। আমার দাদাও অবশ্য হেসেছিলেন। পরে, বলেছিলেন এটা ভাষা বটে তবে তুই যেমন ভাবছিস তেমন ভাষা নয়। এ ভাষা জগতকে নিয়ন্ত্রণ করে একেবারে। যে গণিতের ভাষা জানে না, সে আসলে কবরেই বাস করে। যেমন আমি।’ উদাহরণ হিসেবে তিনি নিজে দাঁড়িয়ে গিয়ে কিছুটা বিষ হতেন। অদ্ভুত লাগত এসব। অবশ্য ওই দুটো ভাষার কোনোটায় শিখতে পারিনি আমি। পরীক্ষাতে পাশ করেছি শুধু। পরীক্ষার বাইরে ফেল করেছি। বিদ্যালয়গুলো কোনো বিদ্যা দিতে পারে না। বিদ্যা কেড়ে নেয়। বিদ্যাকে কেটে ছেঁটে ছোট করে প্রায় পাখাহীন পাখি করে খাঁচায় পুরে দেয়। স্বাভাবিকভাবে সাঁতার কাটা, দৌড়াতে পারা, খেলাধুলা করতে পারা, গাছে চড়তে পারা, রান্না করতে পারা, কাপড় ধুতে পারা, চাষ করতে পারা, লড়াই করতে পারা, গান বাজনা করতে পারা, পায়ের শক্তি, হাতের শক্তি বিদ্যালয় কেড়ে নেয়। বিদ্যালয়ে না গেলে অন্তত এগুলো করতে পারতাম। কী জানতে চাইলেন? বুঝতে পারিনি। আবার বলুন প্লিজ! ও আমি কী করি? বুঝছি। কী আর করব-বেকার-পড়াশোনা শেষ করে ঘুরে বেড়াচ্ছি। সে কথাই তো বলা শুরু করেছিলাম। আমার  এক বন্ধু ছিল, ও কি বলতো জানেন? ও বলত, ‘এতদিন পড়ালেখা করে কী লাভ হলো বল্তো, ২০ বছর ধরে পড়লাম বাপের গাঁট খসিয়ে। তারপরেও চাকরি হয় না ঘুষ দিতে পারি না বলে।’ ওর জীবন দুর্বিষহ হয়ে গেছিল। বাপটা অক্ষম ছিল প্রায়। ওর বাপ ভিখারি ছিল, ভিক্ষা করেই ওর পড়ালেখার খরচ চালাত। বন্ধুটা একটা ছোট চাকরির জন্যে কত ঘুরে বেড়িয়েছে, হয়নি। মরে গেছে দুবছর আগে, অসুখ বাধিয়ে। চিকিৎসাহীন। সে ভিখারিও হতে পারেনি, ভিখারি হতে পারাটাও একটা যোগ্যতার ব্যাপার। ওর একটা চমৎকার হিসাব ছিল, হিসাবটা এমন-দিনে তিনশ টাকা হিসেবে ২০ বছর প্রায় ২০-২২ লক্ষ টাকা কামাতাম যদি মাঠে কৃষক বা কোনো কারখানায় শ্রমিকের কাজ করতাম। পড়ালেখার জন্যও ৮-১০ লাখ টাকা খরচ না হয়ে বেঁচে যেত। এতদিনে প্রায় ৩০-৩২ লাখ টাকা জমা হত। তাছাড়া চাকরির পেছনে ঘুরতে গিয়ে যে পোস্টাল অর্ডার করতে হয়েছে, যাতায়াত করতে হয়েছে আর জুতার তলা ক্ষয় হয়েছে তাও কম নয় নেহাত। যদি ‘সম্মান বা পড়াশোনার আলাদা একটা গুরুত্ব আছে’ বলতাম তাকে, ও রেগে যেত ভীষণ-‘রাখ তোর সম্মান, মানুষ টাকা ছাড়া সম্মান করে না।’ সে আরো বলত-‘টাকা থাকলে জিহ্বার দাম, পায়ের দাম, হাতের দাম, শিশ্নের দাম, প্রশ্নের দাম,  উত্তরের দাম, সম্মানের দাম, যোনির মূল্য। এগুলোর আলাদা কোনো দাম নেই। টাকা থাকলে মানুষ কেনা যায়। টাকাওয়ালা মানুষের কাছে টাকাহীন মানুষ নিজে গিয়ে, দরদাম করে বিক্রি হয়।’ আমারও এখন তাই মনে হয়। তার হিসাবটাকে ঠিক মনে হয়। বাপের ভিক্ষালব্ধ টাকা আর নিজে প্রাইভেট টিউশনি করে বেচারা কোনোরকমে পড়াশোনা করেছিল। ওর হিসাবটা দারুণ না? অন্ধকারে অবশ্য দেখতে পাচ্ছি না আপনাকে। তবে আমার মনে হয় আপনি মিটিমিটি হাসছেন। চাঁদ উঠতে আর দেরি নাই। একটুর মধ্যেই চাঁদ উঠবে। প্রচুর জোছনা ছড়াবে। পাতলা জুসের মতো জোছনা ছড়িয়ে পড়বে। প্রকৃতির সবকিছুই প্রচুর। রোদ প্রচুর, শীত প্রচুর, জল প্রচুর, মাটি প্রচুর, বাতাস প্রচুর। প্রকৃতি বিরাট এক অপচয়কারী। শয়তানের ভাই। প্রকৃতির কোনো অভাব নেই। অথচ কতশত অভাব, কতশত ধরনের অভাব ছড়িয়ে রয়েছে চারদিকে প্রাণীদের জন্যে, মানুষের জন্যে। এসব শুনে হাসছেন বুঝছি। যাক, চাঁদ উঠুক তখন আপনার হাসি দেখতে পারব। বাহ্ দারুণ বাতাস দিচ্ছে, সুন্দর। শুধু শুধু হাসবেন না, কিছু একটা বলুন। আমার বন্ধুর হিসাবটা ভাল না? আমিও কত ঘুরে বেড়াচ্ছি একটা চাকরির জন্য। হচ্ছে না। অথচ আমার এক বন্ধু ছিল, মানে ক্লাসমেট, তাকে স্যার বলতেন, ‘এ্যাই, তুই তোর মায়ের পেট থেকে বের হয়ে আসার সময় বুদ্ধির থলেটা ভুলে রেখেই বের হয়ে গেছিলি না কী রে! তোর বুদ্ধি এত কম ক্যানে!’ ছেলেটা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকত স্যারের দিকে। তার চোখ মুখ দেখে বোঝা যেত, সে স্যারের ইয়ারকিকে সিরিয়াসলি নিচ্ছে। মায়ের গর্ভে বুদ্ধি ভুলে রেখে এসে জন্ম হতে পারে বলে সে ধরে নিয়েছে। তার বুদ্ধি নিয়ে যদি কেউ বলত, ‘তোর এত বুদ্ধি কম কেন রে?’ সে বলত, ‘আমি যখন মায়ের পেট থেকে বের হই তখন বুদ্ধির থলেটা মাথায় ভরে নিয়ে আসতে ভুলে গেছিলাম। আমার বুদ্ধির থলে মায়ের পেটেই থেকে গেছে।’ সে পড়া লেখাটা ভালো করে শেষ করতেই পারেনি। কিন্তু আপনি জানেন? সে এখন বড় নেতা। টাকার পাহাড় তার। সে আঙুল সোজা করলে সবকিছু সোজা থাকে, যা বাঁকা তাও। সে আঙুল বাঁকা করলে সবকিছু বাঁকা হয়ে যায়, যা সোজা তাও। যা হোক, আপনি শুনে থাকবেন হয়তো, চারদিকে একটা কথা চালু আছে -‘ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়।’ মাথার ঘাম পায়ে ফেলা-এটাতো সহজ, পায়ের ঘাম মাথাতে উঠিয়েও একটু সুখের মুক্ত বাতাস পেলাম কই। আমাদের জন্য সুখ তার মুখ বন্ধ করে বসে থাকে সবসময়। উপায়ের পায়ে পড়েও কোনো কাজ হয় না আমাদের। অথচ ‘ওদের’ উপায় হচ্ছে অনায়াসে। ‘ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়’ কথাটার ওপর আমার সন্দেহ আছে। দেখেছি-উপায় থাকলেই উপায় হয়, উপায়  থাকলে ইচ্ছে হয়। তখন সে ইচ্ছা দিয়ে আরো উপায় হয়। ‘ওদের’ মানে বুঝলেন না। ঠিক আছে বলছি, ট্রাফিক জ্যাম দেখেননি কখনো? দেখেছেন। বেশ তবে! বোঝানো সুবিধা হবে। ট্রাফিক জ্যামে কী দেখতে পান? দেখতে পান, যেন একটা বিশাল গাড়ির মিছিল হঠাৎ থেমে গেছে, অপর পাশ হতে আরও একটা গাড়ির মিছিলকে পার হতে দেবার জন্যে। তখন কী মনে হয় না?-এগুলোর দাম আর কত হবে, হলো পাঁচ টাকা বা ছয় টাকা। কিন্তু গাড়ির দোকানে গিয়ে দেখেন, মনে হবে, ছুঁলেই টাকা চেয়ে বসবে। এইসব যাদের তারাই ‘ওদের’। এই ওদেরদের হাতেই সমস্ত দেশ, সমস্ত চাকরি। রাজনীতি আর তার বান্ধবরা আরও জঘন্য। রাজনীতিকদের নোঙরা হাতের নোঙরে-কাঁচিতে সমস্ত মানুষের সমস্ত ভবিষ্যৎ বাঁধা। তারা যেটাকে বলে উপায়, সেটা উপায়। যাকে বলে, নিরুপায়, তা নিরুপায়। আমাদের আর কী করার আছে, ট্রেনের সমান, ট্রেনের গতির সমান দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া! হাসালেন আমাকে। কেন হাসছি, আবার প্রশ্নও করছেন? এই যে আপনি বললেন, ‘আমাদের চারপাশে প্রচুর সংখ্যক মই থাকে। ব্যক্তিভেদে মইগুলো বড় এবং ছোট। আপনার চারপাশে যে মইগুলো আছে তার সবই বড়। প্রচুর সংখ্যক মইয়ের মধ্যে সবগুলোই মিস চলে যায় মাত্র একটাতে উঠতে পারে মানুষ। একটা বড় মইয়ে আপনিও উঠবেন। আপনার মেধা ভালো।’ কেমন করে যে বলতে পারছেন-আমিও একটা মইয়ে উঠতে পারব তাও আবার বড় মইয়ে, সে আপনিই জানেন। তাই যেন হয়। কিন্তু কতদিন আর অপেক্ষা করব? অপেক্ষা আর প্রতীক্ষা আর পরীক্ষাতেই জীবন শেষ হয়ে গেল। একটা চাকুরি হলো না। যদিও জানি, চাকুরি মানে নিজেকে দরদাম করে বিক্রি করে দেওয়া। চাকুরি মানে অন্যকে নিজের গায়ে থুথু ফেলতে দেওয়া, মুততে দেওয়া, পায়খানা করতে দেওয়া। চাকুরি মানে অন্যেকে ঘাড়ে চড়িয়ে নিয়ে বাতাস খাওয়ে বেড়ানো। যাক এসব। ভারি ভারি কথা বলে অযথা ভারী হয়ে যাবার মানে হয় না। দেখুন, কেমন সুন্দর চাঁদ উঠেছে। চাঁদের মুখ থেকে জোছনার মধু ঝরছে। এসব আমার ভালো লাগে খুব। ভালো লাগা বলতে তো এগুলোই। যদিও এগুলো মানুষের জন্যে এক ধরনের ফাঁদ, ধরে রাখার ফাঁদ, বাঁচিয়ে রেখে যন্ত্রণা দেবার কায়দা। মানুষ আবাদ করার ফন্দি। প্রকৃতির এগুলো ফন্দিতে পড়ে মানুষ জন্মগ্রহণ করে আর প্রকৃতি চুষতে শুরু করে রস। চোষা শেষ হলে মানুষ মরে পড়ে থাকে রসহীন। মৃত্যুদশাই মানুষের প্রকৃত আর পার্মানেন্ট মুক্তি দশা। আবারও ভারি কথা শুরু হয়ে গেল। থাক এসব। দেখুন, পার্কের সমস্ত কিছু কেমন নীরব অথচ কতটা সরব। সরবভাবে নীরব রয়েছে চারদিক। সরবে তারা তাদের নীরবতা আর সৌন্দর্য বিলিয়ে দিচ্ছে। সবকিছু মাখছে জোছনার যাদু, চাঁদের মধু। কেমন নদীর মত মনে হচ্ছে না? জোছনা জলের নদী। আপনার কি গান গাইতে ইচ্ছে করছে? আমারতো খুব ইচ্ছে করছে। আসুন দুজন মিলে গান গাই-

তোর পাঁজরের তলে কেউ দেখবে না
তোর মনেরও দোসর কেউ হবে না
ও মনো রে ॥

একা একা গা রে পাখি
একা একা গা
ঝড় তুফানে ভাঙা তরী
একা একা বা
সঙ্গি সখা বাহির দেখা মনের দোসর না ॥

কাউকে তুই ভাবলি আপন
কাউকে ভাবলি পর
কোথাকে ভাবলি বাহির
কোথাকে ঘর
আনিফ রুবেদ বলে, ঘর পর ভ্রান্ত ভাবনা ॥

কই গাইছেন নাতো আমার সাথে! আমার সঙ্গে গলা মেলান, সুর মেলান, কথা মেলান, পারলে ভাবও মেলান। কী বললেন? আমি একাই গাইব? থাক তবে গান, কথা বলি। কিছু মনে করবেন না, একটা সিগারেট জ্বালাই আমি? ঠিক আছে তাই হবে, সেভ করব, ধোঁয়া ওদিকে যাবে না। না, খুব বেশি সিগারেট খাই না, দিনে কত আর হবে ১২-১৩ টা মতো। এটাই খুব বেশি? জেনে অবাক হবেন, নেপোলিয়ান ৫০-৫৫টা খেতেন প্রতিদিন। নেপোলিয়ানতো ইতিহাসের মানুষ, সে অন্য কোথার, অন্য কথার। অবশ্য, ইতিহাস একটা অন্য দেশ। জীবিতদের দেশ থেকেই ওখানে বাসা বেঁধেছে তারা। ওরা আমাদের মত পৃথিবীতেই, কোনো এক দেশেই, শহরেই, গ্রামেই বাস করত। যাহোক, আমাদের গ্রামেরই মণ্টু মামাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ‘রমজান মাসে, রোজার মধ্যে নিশ্চয় আপনার সিগারেট কম খাওয়া হচ্ছে?’ উত্তর করেছিল, ‘হ্যাঁ কমে গেছে, ২৫-২৬টির বেশি হয় না। অথচ তিনি সিগারেট খেতে পেতেন সন্ধ্যার পর থেকে ঘুম এবং সেহেরি খেতে ওঠার পর থেকে ফজরের আজান পর্যন্ত। আমরা হেসেছিলাম খুব। এক্ষেত্রে ১১-১২ টা সিগারেট খুব কম নয় কি? ও হ্যাঁ, ষোল সতের বছর থেকে খাই। মানুষের দুটো আবিষ্কার আমার ভালো লাগে, একটা হলো কনডম আর দ্বিতীয়টি হলো সিগারেট। এ দুটো চমৎকার কাঁচি। সিগারেটকাঁচিতে সুন্দর করে ধীরে ধীরে জীবন কাটে। সিগারেটকাঁচি যার জীবন কাটে সে আনন্দও পায়। সুখে সুখে জীবন কাটে সিগারেট। আর কনডমকাঁচি জন্মকে কেটে ফেলে। ফলে বহুজন বেঁচে যায় এই পৃথিবীতে আসা থেকে। না জন্মে বেঁচে যায় পৃথিবীর যন্ত্রণা যাঁতায় পেষণ হওয়া থেকে। জীবন-যন্ত্রণা থেকে মানুষ দুভাবে বাঁচে, না জন্মে বাঁচে আর মরে বাঁচে। হা হা হা... বাহ্! আপনিতো বেশ বুদ্ধিমতি এর মধ্যেই হিসাব করে ফেলেছেন, চার লাখ টাকার সিগারেট খেয়ে ফেলেছি। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, এখন বয়স ৩৩ ক্যালেন্ডার দুছক প্রায়। কী জিজ্ঞেস করলেন? জন্মদিন? হঠাৎ! জন্মদিন দিয়ে কী হবে? আমার জন্মদিন ২৯ জুন। হ্যাঁ, জন্মদিনের তারিখ সবাইকে বলি, সে দিনের দিনও সবাইকে বলি-আজ আমার জন্মদিন। কেন বলি? কারণতো নিশ্চয়ই  আছে। প্রতিটি জন্মদিন জানিয়ে দেয়-পৃথিবীর এত প্রতিকূল অবস্থাতেও আমরা  আর একটা নতুন ক্যালেন্ডারের দিকে এগুলাম। শ্বাস-প্রশ্বাসের বেঁচে থাকাটাই বিরাট ব্যাপার। প্রতিকূলতার প্রতি অনুসাড়া দিয়ে আমার সে বন্ধুতো মরেই গেল। জন্মদিনের আরও একটা স্বস্তি আছে, গড় আয়ুর দিকে আরও একটু এগিয়ে গেলাম শরীর আর মন নিয়ে। মৃত্যুটা আরও একটু কাছের দিকে এলো। বললামইতো, জন্মে যাওয়া মানুষের মৃত্যুদশাই মুক্তি দশা। যাহোক, এই যে দেখেন, বাতাস বইতে শুরু করেছে। বুকের কাছের কয়টা বোতাম খুলে দিলাম, প্লিজ, ডোন্ট মাইন্ড! গরম সহ্য করতে পারি না আমি। মাঝে মধ্যে রাতেতো পোশাকই রাখতাম না শরীরে। এখন আর সেটা করতে পারি না। মেসে একটা রুমে তিন চারজন থাকি, কী করে সম্ভব! বাড়িতে একটা রুমে আমি একাই থাকতাম। আরে না, পোশাক খুললে স্বাধীন স্বাধীন লাগবে কেন? মানুষ স্বাধীন কখনোই নয়। গর্ভের ভেতর গর্ভনাড়ির বাঁধন, বাইরেও সে নাড়ি যুক্ত থাকে। নাড়ি কেটে মুক্ত করা হয় বটে কিন্তু সাথে সাথেই চারপাশের অসংখ্য সমস্যাগর্ভের নাড়ি বেঁধে ফেলে মানুষকে। মানুষের স্বাধীন হবার যো নেই। মানুষ স্বাধীন থাকে যখন জন্মে না তখন আর যখন মরে যায় তখন। একমাত্র অজন্মিত মানুষ স্বাধীন। একমাত্র মৃত মানুষ স্বাধীন। আমাদের ভাগ্য, আমাদের স্বাধীনতা রাজনীতিকদের হাতে বাঁধা। মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস, হায়-হুতাশ, চলাচল, বলাবল, কলাকল সবই নিয়ন্ত্রণ করে তারা। মৃত্যুর পরেও ঝামেলা করে ধর্মওয়ালারা। পোড়াবে? নাকি কবরে দেবে? নাকি জলে ভাসাবে? তা নিয়ে শুরু হয় ধর্মক্রদ্ধ-মানুষের ধর্মযুদ্ধ। অবশ্য সেটা জীবিতদের ব্যাপার, ততক্ষণে মরা মানুষ স্বাধীন হয়ে গেছে। পোড়াক বা খালে পুঁতুক, শেয়ালে বা শকুনে চোখ-মাংস খুবলে খাক, মরা মানুষের এতে কিছুই যায় আসে না। আরে দেখুন, দেখুন, চাঁদটা মাঝ আকাশে থেকে নিচ দিকে পিট পিট করে তাকাচ্ছে শান্তভাবে, গিরগিটির চোখের মতো চাঁদ। আর দেখুন, পুকুরটার দিকে। খুব ছোট ছোট ধীর ঢেউ, যেন আলোর পুকুর। তরল আলোর ঢেউ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে কালো মাটির দিকে। আসুন কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকি। নাহ্ আর চুপ থাকতে ইচ্ছে করছে না। অথচ কয়েক মিনিটও যায়নি। থাকগে। যাকগে। মিনিট যাক আর আসুক, হাঁটুক আর বসুক, কাঁদুক আর হাসুক। ওটা মিনিটের ব্যাপার। আসুন, আমরা কথা বলি। ছাত্রজীবনের কথা শুনতে চাইছেন? সে তেমন কিছু না। ছাত্রজীবনটা অবহেলায় কাটিয়াছি, রেজাল্ট ভালো করা যায়নি কোনো পরীক্ষাতেই। আড্ডাতে বহু তত্ত্ব, তত্ত্ব্য, তথ্য, বহু তর্ক, মত-বেমত, বেমত-মত করেই সময় পার করে দিতাম। আমরা চাইতাম আড্ডার টেবিলে বসে সমস্ত কিছু নাড়িয়ে দিতে। কিন্তু... হা হা হা...। স্বাধীনতার আগে কী ছিল দেখিনি, শুনেছি বা পড়েছি মাত্র। যুদ্ধের বছর জন্ম বলে বাবা মা নাম রেখেছিল-সমর, সমর উদ্দীন। কিন্তু যুদ্ধ হবার পেছনে শোনা কারণগুলোর কাছে যুদ্ধটাকে অহেতুক মনে হয় অথবা মনে হয় আসলে যুদ্ধ হয়নি কোনোদিন। যুদ্ধের স্মৃতিগুলো, ছবিগুলো, কষ্টগুলো, আনন্দগুলো আসলে রূপকথা বা স্বপনকথা। সমগ্র মানুষ একসাথে স্বপন দেখছিল। স্বপনে শহিদ হয়েছে, স্বপনে ধর্ষিত হয়েছে, স্বপনে বেদনা পেয়েছে। যদি তাই না হবে তবে এমন থাকবে কেন? সে সমস্ত কারণতো এখনও অহরহ সর্বস্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তখনো শোষণ এখনো শোষণ, তখনো ধর্ষণ এখনো ধর্ষণ, তখনো দুর্নীতি এখনো দুর্নীতি। তখনো গোলাগোলি এখনো তাই। পার্থক্যটা বুঝি না। একটা মানুষের চাই বাঁচার অধিকার এবং মৃত্যুর অধিকার। অথচ, মানুষেরা বাঁচতে পারছে না, মরতে পারছে না। ওদের যতক্ষণ ইচ্ছে, যতক্ষণ প্রয়োজন, ততক্ষণ বাঁচিয়ে রাখছে, যখন ইচ্ছে মেরে ফেলছে। কী করে কিছু লোকের শোষণের মাত্রা, ধর্মের মাত্রা দশমিকের ডানে থাকতে থাকতে বামে চলে আসছে তা আর বুঝতে বাকি নাই। এরা কারা জানেন? এইতো, বেশ বুঝেছেন। হ্যাঁ, এরা মানুষকে মিথ্যা কথা বলে, হত্যা করে, বিচারালয়ে হাত খেলায়, জেলে পাঠায়, শোষণ করে, ধর্ষণ করে। এরা মানুষকে ভালোবাসে না। সার চাইলে গুলি করে, খাবার চাইলে গুলি করে। নিজেরা কাউকে ভালোবাসে না, কাউকে ভালোবাসতেও দেয় না। ভালোবাসা দিবসেও হরতাল করে। হরতালগুলোকে তো আমার হরতাল মনে হয় না, জোরতাল বলে মনে হয়। জোরাজুরি করে মানুষের প্রতি। আপনার কী মনে হয়? লোকদের কাছে শুনে, বইয়ে পড়ে রাজাকারদের ওপর এমন ঘৃণা জন্মেছিল যে, একজন বলেছিল, রাজাকাররাই একদিন ক্ষমতায় যাবে-একথা শোনার সাথে সাথে তাকে এমন একটা ঘুষি মেরেছিলাম। ঘুষির চোটে চোয়ালের চামড়া কেটে রক্ত বেরিয়ে গেছিল। সেদিন বলেছিলাম-যেদিন তারা ক্ষমতায় যাবে সেদিন আমি  দেশ ছেড়ে দেব। হা হা হা... আপনি আমার দিকে তাকাচ্ছেন কেন! আমি যেহেতু কথা বলছি, সেহেতু বুঝতেই পারছেন আমি আছি, চোখ তুলে দেখার কোনো দরকার নেই। হ্যাঁ, দেশ ছেড়ে যেতে পারিনি। লজ্জিত হয়ে দেশেই বাস করছি। টিভি খুলেই দেখি মাননীয় কৃষিমন্ত্রি, মাননীয় শিল্পমন্ত্রি গেলেন স্মৃতিসৌধে, শহিদ মিনারে। রাজাকার থেকে তারা রাজা হয়েছে। অমানবিকেরা মানবিকতার ভান ধরে ধান ভেঙে খাচ্ছে। জনশোসক থেকে জনসেবীর খোলস পরেছে। তাদের মন্ত্রি, এম. পি হওয়া দেখে দারুণ বেদনা পাই। ওই লোকের কাছে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে নেব কখন গিয়ে। কী বললেন? বুঝলাম না। ও আড্ডার কথা? হঠাৎ হঠাৎ কোন্ প্রসঙ্গ থেকে কোন্ প্রসঙ্গে যে যাচ্ছেন। যাহোক, হ্যাঁ, এখনো আড্ডা দিই সব বেকারগুলো, সন্ধ্যা পার হলেই। সোহাগের চায়ের দোকানে রোজ আড্ডা জমে ওঠে। প্রতিদিন এক টেবিল করে গল্প করি, চা খাই গল্প গল্প। আগে কত কষ্ট পেতাম মানুষের আর্তনাদে, দুঃখে, কষ্টে। এখন আর তা হয় না। কষ্ট পাই না মানুষের কষ্টে। পথে ঘাটে পোস্টারে টুকরো করে কাটা মানুষের রক্ত-মাংস দেখে দেখে সময় পান করি, সিগারেটের ধোঁয়ার মতোই ভুলে যায় মানুষের আর্তনাদ। তাছাড়া মানুষকে দেখে কষ্ট পাবার সময় কই? সারাদিন হাঁটাহাঁটি করি। রাতে রুমে ফিরে মোজা শুঁকে দেখি কালকে আবার মোজাটা পরা যাবে কিনা। মজা মোজার গন্ধ আরও কতদূর সহ্য করা যাবে তা মেপে দেখি নাকের মাপে। জুতার তলাটা কতদূর আর আমাকে নিয়ে যেতে পারবে। ওহ! হ্যাঁ হ্যাঁ, রাততো প্রায় শেষ হয়ে এলো, বুঝতেই পারিনি। আপনাকে আমি চিনি না, নাম জানি না, আপনি কী করেন জানি না, আপনিও জানেন না আমার ব্যাপারে। তারপরেও কত কথা হয়ে গেল। তবু খুব ভালো লাগল। আমার নামতো আগেই জেনেছেন, দয়া করে আপনার নামটা বলবেন? ও দারুণ নামতো আপনার-জোনাকি! আমি আপনাকে কিন্তু জোনাকপাখি বলে ডাকব। আগেইতো বলেছি, আমি জোনাকিকে পাখি বলি, তখন কিন্তু জানতাম না আপনার নাম জোনাকি। আপনিতো জেনেছেন আমি কী কাজ করি, আপনি কী করেন বলবেন কি প্লিজ? আমি কেন এখানে রাত পার করে দিলাম সেটা জানার পর বলবেন? না না, তার আগে আপনি বলেন আমাকে, আপনি কেন এখানে সারারাত আমার সাথে গল্প করে পার করে দিলেন আর কেনই বা এসেছিলেন? কী!?!?!?! আশ্চর্য কাণ্ডতো, আপনি বেশ্যা! আমিতো বুঝতেই পারিনি। অন্য দশটা নারীর থেকে আপনাকেতো আমি আলাদা করতেই পারিনি, পারছি না। তাহলেতো আপনার আজকের সব কাজ আমি মাটি করে দিলাম। ভোরতো হয়ে এলো জোনাকি পাখি। দিকে দিকে মসজিদগুলো আজান দিতে শুরু করেছে মধুসুরে, আপনাকেতো এখন চলে যেতে হবে। আপনার কী ক্ষতিই না করলাম আমি। মাফ করবেন। আর হ্যাঁ, আমি এসেছিলাম একজন বেশ্যার কাছেই। মানুষ মানুষকে টাকা ভিক্ষা দেয়, কাপড় ভিক্ষা দেয়, পরামর্শ বা উপদেশ ভিক্ষা দেয়। আমার দরকার যৌনতার ভিক্ষা। কত যে আমার সঙ্গম করতে ইচ্ছে করে! চেপে রাখা কষ্টকর হয়ে ওঠে। মাঝে মাঝে মরে যেতে ইচ্ছে করে। রাতগুলো কাঁটা দিয়ে তৈরি মনে হয়। তরুণীদের দিকে তাকিয়ে বুকফাটা আর্তনাদ বেরিয়ে আসে। তাদেরকে খুব স্বার্থপর মনে হয়। অথচ তাদেরকেও দেখেছি, বেশি নম্বর নেবার জন্যে স্যারেদের সাথে বিছানায় থাকতে। আমিতো দেখেছি, বড়লোক ক্লাসমেটদের সাথে সেক্স করতে। অবশ্য তারা দামি গিফট পেত। অথচ তারা যে তারাকে বিয়ে করেছে এমন নয়। প্রতিদিন দেহ পুড়ে আমার, ক্ষুধা, ক্ষুধা, ক্ষুধা... আমি কোনো বেশ্যার কাছে যৌনতা ভিক্ষার জন্যে আজ রাতে বের হয়েছিলাম। কিন্তু আপনার সাথে কথা বলতে বলতে ভুলেই গেছিলাম। তাছাড়া আপনি বলার আগে বুঝতেই পারিনি আপনি বেশ্যা। এখনতো ভোর হয়ে এলো। এখন আপনার ফিরে যাবার সময়। আপনার কাছে যৌনতা ভিক্ষা এখন তো আর চাওয়া যাবে না। কী বললেন! আমাকে যৌনতা ভিক্ষা দিতেন না? কিন্তু কেন?!?! ও আচ্ছা, ঠিক আছে। মনে ব্যথা পেলাম ভিক্ষা পেলাম না বলে। ব্যথা পেতে আবার নিষেধ করছেন! আরও কিছু বলতে চান? আচ্ছা বলুন, আমি মন দিয়েই শুনছি। ও ও ও... ঠিক আছে। আমি আপনার কথা আমাকে বোঝাব আর মনে গেঁথে নেব যে-জোনাকি পাখি নামে এক দার্শনিক বেশ্যা আমাকে বলেছেন, ‘যৌনতা কেউ কাউকে ভিক্ষা দেয় না। যৌনতা কিনে নিতে হয় অর্থ দিয়ে বা শাসনিক বা প্রশাসনিক বা অন্যকোনো ক্ষমতা দিয়ে বা রূপ দিয়ে। বা ছলনা করে যৌনতা নিতে হয়। বা জোর করে যৌনতা নিতে হয়। যৌনতার ভিক্ষা হয় না।’ আপনার কথার পরে, আরও বুঝে গেলাম, খাদ্যের দুর্ভিক্ষ কিছুদিন থাকে কিন্তু যৌনতার দুর্ভিক্ষ চিরকাল চলমান আছে। খাদ্যের দুর্ভিক্ষ চোখে দেখা যায়, যৌনতার দুর্ভিক্ষ দেখা যায় না। খাদ্যের দুর্ভিক্ষের ক্ষেত্রে কেউ কেউ দয়ালু হতে পারে, যৌনতার দুর্ভিক্ষে কেউ দয়ালু নয়। কেউ এসে কখনো বলবে না, তুমিতো কখনো সঙ্গম করতে পাওনি এসো সঙ্গম কর। বলবে না, তুমিতো অনেকদিন সঙ্গম করতে পাওনি এসো সঙ্গম কর। এটাকে কেউ দুর্ভিক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করেনি। এটা কখনো দুর্ভিক্ষরূপে চিহ্নিত হবে না। হবে না কি? অথচ খাদ্য, অবস্থান স্থান আর যৌনতা ছাড়া আর কোনো মৌলিক চাহিদা নেই। আচ্ছা, ঠিক আছে যান, বিদায় জোনাকি পাখি। না, মন খারাপ করিনি। ঠিক আছে হাসতে বলছেন, হাসছি। এইতো হাসলাম। হয়েছে এবার! আসুন আমরা হাত মেলাই। ঠিক আছে, এবার যান। সাবধানে যান প্রিয় বেশ্যা, দিনের আলো আসার আগেই চলে যান। বিদায় জোনাকি পাখি।”
 

menu
menu