চাঁদ জানে


বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছনো থেকে বাসে উঠে বসা, টিকিট কাটা, এমন কী ঘণ্টা দেড়েকের যাত্রা, কিছুই টের পায়নি মধু। শুরু থেকেই একটা ঘোর লাগা দশায় ডুবে ছিল। শুধু এটুকুই নয়, গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়াটাও খেয়ালে পড়েনি। হয়তো তিনবাতি মোড়ের পরিবর্তে ধুমডাঙি পৌঁছে গিয়ে তারপর উল্টো বাস ধরে ফিরতে হতো যদি না কন্ডাক্টর কাছে এসে বলত, নামবা না মদুদা?  

ধড়মড়িয়ে উঠে বসে মধু। মুঠো পাকানো হাতটা খুলে দেখে তেলোয় থাকা খৈনিটা সারা শরীরে চুনের ছোপ নিয়ে ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়ে আছে, ব্যবহৃত না হওয়ার বিস্ময়টা মুছতে পারছে না। জানলা দিয়ে খৈনিটা ফেলে দিয়ে নেমে পড়ে বটে মধু কিন্তু তারপরও দশাটা কাটে না। স্ট্যান্ডে কোনো টোটো নেই দেখে অপেক্ষা করে না, হেঁটেই রওনা দেয়। মনেই পড়ে না এখান থেকে কাউয়াখালি পাক্কা দু’কিলোমিটার। বেলা গড়িয়ে এলেও ভরা ভাদ্রের সূর্য যেহেতু সহজে ডিউটি থেকে রেহাই নেয় না তাই বাতাসে এখনো আগুনের স্রোত বইছে। এই উত্তাপে দু’কিলোমিটার হাঁটাটা অত সহজ নয়। হয়তো এর থেকে অনেক চড়া রোদে, ঝড়ে, বৃষ্টিতে আরও অনেকটা পথ হেঁটেছে মধু কিন্তু সেদিন তো সুদূর অতীত। এখন মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। বরং খানিকক্ষণ অপেক্ষা করলে টোটো না হোক, পরিচিত কোনো বাইক আরোহীকে অবধারিত পাওয়া যেত।

মনে যা-ই থাকুক মধুকে না নিয়ে যাওয়ার সাধ্য কারও নেই। 
অথচ এমন বেভুল দশা হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। লাইনটা যে খারাপ সেটা সবার মতো মধুও জানতো! কিংবা সবার থেকে বেশিই জানতো। জানবেই বা না কেন, সব আলোচনা তো তার চায়ের দোকানেই বসেই হতো। সব আলোচনায় বারবার যে নামটা উচ্চারিত হতো সেটা ছিল গোখরো। গোখরো অর্থাৎ মহাদেব পাল। নামটা উচ্চারণ করাটাই যেহেতু অলক্ষুণে তাই এই নামকরণ।

নামটা যে যথার্থ সেটা মধুও স্বীকার করতে বাধ্য। মহাদেব পাল একবার কারও ভিটেয় ঢুকতে পারলে ছোবল দিয়ে তাকে নির্বংশ না করে ছাড়ে না। এখন না হয় মহাদেবের নিজস্ব অফিস হয়েছে কিন্তু শুরুটা তো মধুদের চায়ের দোকান থেকেই। চোখের জল, শাপমন্যির সাক্ষীই তো খোদ মধু। খারাপ লাগলেও কিছু বলার উপায় ছিল না। মহাদেব পালকে চটিয়ে হাটে চায়ের দোকান চালানো অত সোজা ছিল নাকি! তাছাড়া মহাদেবের সব লেনদেন তখন মধুর চায়ের দোকানে বসে হতো, ফলে বিক্রিবাট্টা মন্দ হতো না। মধু মন্ডলই হাটে একমাত্র চা দোকানি ছিল না। মহাদেব পালের যেকোনো দোকানে আপ্যায়ন পেতে অসুবিধে হতো না। সুতরাং সাধ করে কেউ নিজের পায়ে কুড়াল চালায় নাকি! 

কান দুটো খোলা রেখে নিজের কাজে ব্যস্ত থাকত মধু। কেন কে জানে! তখনো তো এই লাইনে আসার কথা ভাবেইনি। যদিও মহাদেব পাল প্রায়ই বলতো, তর বেরেনটা সাফ, আমার লগে কাম কর। তোরও দুইটা পয়সা হয়, আমারও খাটনি কমে।
ছাকনিতে চা পাতা ঢালতে ঢালতে মধু হাসত, কী যে কন কাকা, জমিজমার আমি কী বুঝি!

গ্লাসের তলায় জমে থাকা চিনি আঙুল দিয়ে তুলে খেতে খেতে মহাদেব নিরুত্তাপ স্বরে বলত, ভালো কথাই কইলি রে, চাষার ব্যাটা হয়্যা মাটি চেনোস না। 
কথাটা গায়ে মাখত না মধু। মাখার কথাও নয়। জন্মইস্তক বাপকে যে শুধু পরের জমিতে জনমজুর খাটতে দেখেছে, নিজের জমি এক ছটাকও নেই, সে কিভাবে চাষির ছেলে হয়! অন্যর দোকানে ফাইফরমাশ খাটতে খাটতে নেহাত মধু দোকানটা খুলতে পেরেছিল নাহলে কবে বসতভিটা মহাদেব পালকে সঁপে দিয়ে সপরিবারে পথে বসতে হতো।

হাল ছাড়েনি মহাদেব, মাঝেমধ্যেই উসকাতো, নাইমা পড় মদু। তরে আমি শিখায়া পড়ায়া নিবো। এই সুযোগ কিন্তু পাবি না কইয়া দিলাম। 
এটা যে সত্যিই একটা সুযোগ সেটা মধু কখনো অস্বীকার করেনি। করবেই বা কীভাবে! এই ব্যবসায় কাঁচা পয়সার কী রকম ছড়াছড়ি সেটা তো চোখের সামনেই রোজ দেখছিল। তবে পাশাপাশি এটাও তো দেখছিল যে মানুষ বিপদে পড়ে জমি বিক্রি করে বটে কিন্তু চোখের জল ফেলে শাপশাপান্ত করে মহাদেবকে। এত ঘৃণা সহ্য করে বেঁচে থাকা যায়? 

কথাটা বলবে না ভেবেও একদিন বলে ফেলেছিল মধু, তবে সরাসরি নয়, ঘুরিয়ে, ভদ্রতার পোঁচ দিয়ে।
—মুই শিল্পী মানুষ কাকা, মোক দিয়া এই কাম হবা নহে। 
যথারীতি ফোঁস করে উঠেছিল গোখরো সাপ, কীসের শিল্পীরে তুই? দোত্রায় টুংটুাং করলেই শিল্পী হওয়া যায়! 

মহাদেবের কথায় খুব দুঃখ পেয়েছিল সেদিন মধু। তার পাশে দাঁড়ানোর মতো গিদাল কাউয়াখালিতে তো দূরের কথা, আশেপাশের পাঁচ-সাতটা গ্রামের ভেতরে কারও নেই। এসব কথা জানে না মহাদেব পাল? দেখেনি পঞ্চায়েত অফিসের আলমারিতে থাকা মেডেলগুলো? জানে না ওগুলোর প্রকৃত মালিক কে?
জানে, সবই জানে মহাদেব; সুতরাং কথা শেষ করেছে এভাবে, বসতভিটাটা ধইরে যেইদিন টান দিমু সেইদিন পথে বইসা দোত্রায় টুংটাং করিস।

প্রখর রোদে মধুর দশা এখন ক্যালেন্ডারের শিবঠাকুরের মতো, বাবড়ি চুলে যেন গঙ্গা ধরেছে, ঝরঝরিয়ে নামছে স্রোতধারা। পরনের গেঞ্জি, পাঞ্জাবি একেবারে ভিজে সপসপে। মধু যদি স্ববশে থাকত তাহলে হয়তো পকেট থেকে বাহারি রুমালটা বের করে ঘনঘন মুখ মুছত। তবে সেটা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। কে জানে, হয়তো মধু চাইত আরও ঘাম নামুক, ধুয়ে সাফ করে দিক মুখসহ গোটা শরীরটা। যদিও তখনই কোর্ট চত্বরের চা দোকান থেকে জল নিয়ে গোটা মুখটা ধুয়ে নিয়েছিল তবুও থুতুটা যেন গালে ময়দার আঠার মতো লেপ্টে আছে। শালা মানুষ, নাকি গুইয়া সাপ! 

মহাদেব পাল আজ কোর্টে যায়নি অথচ অন্যদিনগুলোতে মধু সামলে দিলেও রায় ঘোষণার দিন মহাদেব স্বয়ং উপস্থিত থাকে। এ নিয়ে মধু বহুবার অনুযোগ করেছে, মোক বিশ্বাস যান না কাকা?  
মহাদেব পাল সস্নেহে মধুর পিঠ চাপড়ে বলেছে, এইটা কোনো কথা হইলো। আমি নিজেরেও ততটা বিশ্বাস করি না যতটা তোকে করি। 
মহাদেব এরপর খুলে বলেছে উপস্থিত থাকার কারণ। 
—কোটের লোকগুলান একেকটা মহা বেইমান। বচ্ছরভর পয়সা খাওয়াই তবু বেইমানগুলারে বিশ্বাস নাই। যহন তহন পাল্টি মাইরবার পারে। এই দিনটায় আমি হাজির থাকলে ভয়ে উল্টাপাল্টা কিছু করার সাহস পাবে না। 

কথাটা মিথ্যে নয় বটে কিন্তু আজ কেন কোর্টে আসেনি মহাদেব! শরীর খারাপের অজুহাত দিলেও সেটা যে নিছকই অজুহাত সেটা বুঝতে মধুর অসুবিধে হয়নি অথচ সন্দেহ করার পরিবর্তে আহ্লাদে গলে গিয়ে বলেছে, তমা র‌্যাস্ট নেন কাকা, মুই সোব সামলাইয়া নিমো। 
হায় রে সামলানো! বরং মহাদেব এলে অপমানটা ভাগাভাগি করে নেওয়া যেত। সবটুকুই কেন মধুর একার পাওনা হবে?  অবশ্য মহাদেব পাল উপস্থিত থাকলে সনাতন এতটা বাড়াবাড়ি করার সাহস পেত না। যদি বা হঠকারিতা করত তাহলে টুঁটিছেঁড়া কুকুরের মতো মরতে হতো। থানা, পুলিশ কিচ্ছু করতে পারত না। বডি পাওয়া গেলে তো ঝামেলা করবে? বেহাত হয়ে যাওয়া জমিরই সাতহাত নিচে শুয়ে থেকে থেকে পচতে হতো সনাতন সিংহকে, মুখে আগুনটুকুও পেত না। 

সত্যি বলতে কী, সনাতন যে এতটা বাড়াবাড়ি করবে সেটা কল্পনাও করতে পারেনি মধু। বিয়ে করলে হয়তো সন্তান অতটা বয়সী হতো না তবু সন্তানবৎ তো বটেই। ইচ্ছে ছিল মহাদেব পালকে বলেকয়ে কিছু বাড়তি টাকা পাইয়ে দেবে ছোকরাকে কিন্তু সেই ভাগ্য কি আছে? মেয়েদের মতো থুতু ছিটিয়ে বলে কিনা, মোনৎ রাখিস, বাপেরও বাপ আছে। কিস্যু ভোগ করিবার পারিবু না, দেখিয়া নিস কাউচ্যা হইয়া মাটিৎ মুখ ঢুকাইয়া মরা নাগিবে। 

হুমকি নাকি অভিশাপ, কোনটা দিয়েছে সনাতন? যদিও দুটোর কোনোটাতেই ডরায় না মধু বর্মন। এরকম কত হুমকি, কত অভিশাপ দু’পায়ে দলে এগিয়ে চলেছে মহাদেব পাল, সুদেব মাস্টার, তাহের শেখরা। গায়ে হাত দেওয়া তো দূরের কথা ওদের ছায়াটুকু স্পর্শ করার সাহস কারো হয়নি। 
তবে কেউ নিশ্চয়ই উসকেছে সনাতনকে নাহলে এতটা সাহস হওয়ার কথা নয়। তেমন লোকের তো অভাবও নেই। শুধু কাউয়াখালি নয়, ধুমডাঙি, কাদাপাড়া, ভেটাগুড়ি, চারদিকে শত্রু গিজগিজ করছে। সবাই মধুর বাড়বাড়ন্ত দেখে ঈর্ষায় জ্বলছে। কেঁচো নামটা তো ওদেরই দেওয়া। সবার মনে একটাই সন্দেহ কেঁচোর মতো পুরো বসুমতীটাকেই গিলে নেবে নাকি মধু! 

নেয় যদি নেবে, অত জ্বলনের কী আছে! সম্ভব হলে রুখে দেখা। তাছাড়া ক’ বিঘে জমি করেছে মধু? সবই তো হয় মহাদেব পাল নাহলে সুদেব মাস্টার, তাহের শেখের গর্ভে গিয়ে ঢুকছে। যা, মুরোদ থাকলে এসব কথা বল দেখি ওদের! মহাদেব পাল, তাহের শেখ তো তবু এতোদঞ্চলের মানুষ, যা গিয়ে সুদেব মাস্টারকে জিজ্ঞেস কর, ব্যাঙকান্দির লোক হয়ে সে কীভাবে সাহস পায় কাউয়াখালির জমি গ্রাস করার? 
সনাতন বলে কিনা, শালা কাউচ্যা, তুই নিজের গুরুক ঠকালু! 

কথাটা মিথ্যে নয়। মধুর দোতরার হাতেখড়ি হয়েছিল উপেন সিংহর কাছেই। কথাটা মাথায় ছিল জন্যই তাহের শেখকে ভিড়তে না দিয়ে প্রথম থেকে কেসটা দেখভাল করেছে মধু নিজে। যেটুকু টাকা পেয়েছে সনাতন সবটাই মধুর দৌলতে কিন্তু সে কথা ছোকরার মাথায় ঢুকলে তো! এখন খুব যে শিল্পী বাপের জন্য শোক দেখাচ্ছে বাপ বেঁচে থাকতে সেই দরদ ছিল কোথায়! বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে তো ডেরা বেঁধেছে টাউনে। দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের বন্দোবস্ত করতে বাপের যে কতটা হাঁড়ির হাল নুড়ির ঝাঁটা হতে হচ্ছে সে খবর রাখার প্রয়োজন বোধ করেছে কখনো? বরং মধু যখন পেরেছে উপেনের হাতে দু-দশটাকা গুঁজে দিয়েছে। গ্রামে যেবার ছানি কাটানোর শিবির চালু হয়েছিল, নিজে হাত ধরে নিয়ে গিয়েছিল গুরুদেবকে। তখন কোথায় ছিল বাপের সুপুত্র? যদি এতকিছু না করত মধু তাহলেই বা কার কী বলার ছিল! গান-বাজনার লাইন তো কবেই ছেড়ে দিয়েছে সে! 

—সালাম মালিক।  
আচমকা এহেন সম্ভাষণে চমকে উঠে তাকায় মধু কিন্তু মাথা তুলতেই কপাল বেয়ে নামতে থাকা ঘামের স্রোত চোখে ঢুকে অন্ধ করে দেয।  
 বক্তা এগিয়ে এসে মধুর পায়ে হাত ছুঁইয়ে বলে, দোয়া করেন মালিক। 

চোখ কচলে নিয়ে তাকিয়ে দেখে মধু। অবশ্য তাকানোর প্রয়োজন ছিল না। এই তল্লাটে এভাবে সম্বোধন একজনই করতে পারে সে হলো এরফান। এবং কথাগুলো ইয়ার্কি নয়, শ্রদ্ধা থেকেই বলে সেটা জানা থাকায় মনটা বরাবরই ভালো হয়ে যায় মধুর, আজও ব্যতিক্রম হলো না। 
—কোটে যাছিস?  
আঙুল দিয়ে কপাল থেকে ঘাম চেঁছে নিতে নিতে এরফান বলে, বাদিয়াডাঙা।  
কথাটা শুনে বিস্মিত হয় মধু। বাদিয়াডাঙা না হোক দশ কিলোমিটার। যাতায়াত মিলিয়ে কুড়ি। এই রোদে এরফানের ফর্সা মুখটা পাকা আমের মতো টুকটুকে হয়ে উঠেছে। 
—সেইটা তো ম্যালা দূর রে! পইসার হাউসে অ্যালায় মরিবু নাকি!  
মধুর কথায় গজদন্তে ঝিলিক দিয়ে হাসে এরফান। 
—কী করিমো মালিক! ঘরত বসি থাকিলে কি কায়ও আসি মুখের আগত ভাতের থাল ধরিবে? সগায় কী আপনার মতন!  

এরফানের কথায় নিমেষে শরীরের সব জ্বালা-যন্ত্রণা জুড়িয়ে যায় মধুর। তাকায় চারপাশে, লোকজন কোথায়? এসে শুনে যাক কে মধু বর্মন, কেঁচো, নাকি মালিক!
অবশ্য এ তল্লাটে লোক কোথায়, সবই তো পোক। শুনলেও স্বীকার যেত না। বলত, যেহেতু ভ্যানটা মধুর কিনে দেওয়া তাই তেলমারা কথা বলছে এরফান। ওরা জানে না এরফান বারবার এসেছে কিস্তির টাকা নিয়ে। বলেছে, দুইটা পৈসা তো কামাই হবার ধইচ্চে, তমার টাকাটা ফাকি দিমো ক্যান!
নেয়নি মধু। বলেছে, যেইদিন নিজের মুরাদে আরেকটা ভ্যান কিনিবার পারিবু তার বাদে আসিয়া টাকা দিস, নিমো। 

অথচ এই ভ্যান কিনে দেওয়া নিয়েও কুলোকে কম কুকথা বলেনি! সবটাই নাকি মধুর শয়তানি। একদিকে মহাদেবকে দিয়ে জমিটা দখল করিয়েছে অন্যহাতে কয়েকটা টাকা ছুঁড়ে দিয়েছে। আহা, যেন কত টাকা ছুড়নেওলা সব! তাছাড়া জমি দিয়ে কী করত এরফান, ভাতের বদলে ঘাস খেত? কৃষিকাজ তো কিছুই শেখেনি। দিনরাত শুধু যাত্রাপালায় কৃষ্ণ সেজে বাঁশি বাজিয়ে বেড়াত। ওতে ভাত তো জুটতই না উল্টো স্বজাতিদের ক্রোধের শিকার হতে হলো, মুসলমানের পোলা হয়া হিন্দুর দ্যাবতার পার্ট করা! কোনদিন ভিটেয় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারত। 
—যা, অনেক দূর যাওয়া নাগিবে, সোমায় নষ্ট করিন না।  
কথাগুলো বলে এগোতে যায় মধু কিন্তু এরফানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বোঝে কোনো বক্তব্য আছে এরফানের।
—কিসু কবু?  
হাসে এরফান।
—তমাক এট্টু আউগায় দেই?  

এরফানের কথায় অবাক হয়ে যায় মধু, কৃতজ্ঞতার চাপে ছোকরার কি মাথা খারাপ হলো! দু কিলোমিটার ফের পিছিয়ে যাবে? তারপর, কখন পৌঁছবে বাদিয়াডাঙা?
—আংসাং কথা বাদ দিয়া আসোল কথাটা ক’। 
এরফানকে হাসতে দেখে মধু বুঝতে পারে আন্দাজটা সঠিক। জরুরি কোনো কথা আছে এরফানের। 
—টাকাপৈসা নাগিবে?  

জিভ কেটে মাথা নাড়ে এরফান। তাহলে? এই গরমে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী ন্যাকামো শুরু করলো ছোকরা! 
—কইলে ক’ নাহৈলে ফোট। মর ম্যাজাজ কিন্তু খারাপ আছে। 
মধুর মেজাজ খারাপের কথা শুনে ভ্যানের দিকে এগিয়ে যায় এরফান। অর্থাৎ কথাটা বলার মতো সাহস পাচ্ছে না। কী এমন কথা! তবে কি সনাতনের কাণ্ডটা গ্রাম অবধি চলে এসেছে? অসম্ভব কিছু নয়, অনেকেই তো নানা কাজে কোর্টে দৌড়ায়, নিশ্চয়ই তাদের কারও চোখে ঘটনাটা পড়েছে, ফিরে এসে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে সবাইকে জানিয়েছে।

 কিন্তু কতটা ফুলিয়েছে সেটা না জেনে মধু কীভাবে ছাড়তে পারে এরফানকে।
—যাছিস ক্যান? কী কবার চাছিলি কয়া যা।  
মধুর হুকুমে দাঁড়ায় বটে এরফান কিন্তু ভয়ে কাছে আসে না, দূরত্ব বজায় রেখেই বলে, মোক একটা গান লিখি দিবা মালিক? 
মধু কানে খাটো তেমন অপবাদ আজ অবধি কেউ দেয়নি অথচ এরফানের কথাগুলো ঠিকঠাক কানে ঢোকে না। কে জানে তীব্র গরমে শব্দগুলো বাষ্প হয়ে উড়ে গেল কিনা! তাই ফের জিজ্ঞেস করতেই হয়, কী কলু? 
মধুর মিয়োন কণ্ঠস্বরে সম্ভবত সাহস পায় এরফান। 
—কদমপুরে কিষ্ণলীলা হোবে। মোক ধরিছে কৃষ্ণের পাট করিবার। তমা একোটা গান নিখি দাও।  

এবার কথাটা কানে ঢোকে মধুর। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে পায়ের থেকে একপাটি স্যান্ডেল খুলে চিৎকার করে ওঠে, জুতায়া তর মুখ ছিড়ি ফ্যালামো। হারামজাদা, ধান্দা ছাড়িয়া ফির মাগিমাইনষের মতো কমড় ঢুলাইবার ধচ্চিস। মোর ভ্যান মোক ফিরাইয়া দিয়া আসিবু।
এহেন হুমকিতেও ভয় পায় না এরফান।  
—মুই পোথমে রাজি হও নাই। বহোত সাদাসাদি করিলো। সোগায় কইলো গেরামের প্যাস্টিজটা রাখিবার। কী করিয়া রাজি না হও?
মুখ থেকে একটা অশ্রাব্য খিস্তি প্রায় বেরিয়েই পড়েছিল, শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলায় মধু।
—এই পাট তো তুই করিছু। তর তো সোব গানই মুখস্তো।  
—অইসব শুনি শুনি সগায়ের কান পচি গিসে। তমা একটা নোতুন গান  নিখি দিলে ভাল্ হয়। 

এরফানের কথার উত্তর না দিয়ে হাত থেকে স্যান্ডেলটা ফেলে পায়ে গলিয়ে নেয় মধু তারপর বাড়ি ফেরার পথা ধরে। পেছন থেকে এরফান বলে, কালি তমার বাড়ি যামো মালিক, মোক একটা নোতুন গান নিখি দ্যাওয়াই নাগিবে। গেরামের প্যাস্টিজ তমার ওপারে। 
এরফানের কথাটা কানে ঢুকতে না দিয়ে এগিয়া যায় মধু। হাঁটতে হাঁটতে টের পায় মনের জ্বালাটা হাপিস হয়ে গিয়েছে। কীভাবে হলো! কে মুছে দিলো মুখে লেগে থাকা চটচটে অনুভূতিটা?

এতক্ষণের উত্তেজনাটা নিভে যেতেই শরীর জুড়ে ক্লান্তি নামে মধুর। তাকিয়ে দেখে ডানদিকের জমিটা ধানে ধানে সবুজ হয়ে আছে। এখান থেকেই মধুর জমির শুরু। চটি খুলে আলের ওপর বসে গাছগুলোর গায়ে পা বোলাতে থাকে মধু। পাতাগুলো আহ্লাদে গলে মধুর পায়ের পাতায় চুমু খেতে থাকে। এতক্ষণের ক্লান্তি জুড়িয়ে গিয়ে আরামে চোখ বুজে আসে মধুর। ধরিত্রী যে সত্যিই মেয়েমানুষ সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারে। এই ভালোবাসা একমাত্র মেয়েরাই দিতে পারে। নরম মাটিতে পা ডুবিয়ে দিয়ে মধুর ইচ্ছে হয় ধরিত্রীর বুকের ঢিবঢিবুনিটা অনুভব করার।

বসে থেকে মধু দেখে সূর্যটার রাজপাট গুটিয়ে ধীরে ধীরে বিদায় নেওয়া। দেখে, আলো মুছে দিয়ে অন্ধকারের থাবা বাড়ানো। সারাদিন কিছু পেটে পড়েনি অথচ কোনো খিদে অনুভব করে না সে। তাহলে কি লোকে যেটা বলে সেটাই ঠিক? মধু মানুষ নয়, কেঁচো! নাহলে মাটির ওপর এত লোভ কেন? কথাটা তো মিথ্যে বলেনি সনাতন। সত্যিই তো গুরুর ছেলেকে ঠকালো মধু। উপেন সিংহের ভিটের ওপর বহুদিন লোভ ছিল মধুর, সম্পত্তি বাড়ানোর লোভ নয়, মাটির লোভ। যে মাটিতে থেবড়ে বসে উপেন সিংহ গলা ছেড়ে গান ধরত সেই মাটি ভূদেব মাস্টারের ভোগে যাবে সেটা মেনে নিতে কষ্ট হয়েছিল জন্যই মহাদেব পালকে উসকে ছিল মধু। মহাদেব যখন বলেছিল, জমিটা তোকেই লিখা দিমু মধু, তখন সেই আনন্দ সামলানো কষ্টকর হয়েছিল। গান হয়তো আর গাওয়া হয়ে ওঠে না কিন্তু সেটা যে কত কষ্টের সেটা একমাত্র মধুই জানে। যদি উপেন সিংহের মতো ওই মাটিতে থেবড়ে বসে থাকতে পারে তাহলে সেটাই কি কিছু কম পাওয়া নাকি! এটুকুই তো চেয়েছিল সে। কিন্তু সে কথা বোঝার সাধ্য সনাতনের কিভাবে থাকতে পারে! 

দূরের বাঁশঝাড়ের মাথা আলোয় মাখামাখি হয়ে উঠতে দেখে মধু বোঝে চাঁদ ওঠার প্রস্তুতি চলছে। এত তাড়াতাড়ি কেন! সবে তো সন্ধ্যা নেমেছে। তবে কি আজ পূর্ণিমা? উপেন বলত, সুরুজ টুরুজ কিস্যু না, চান্দই হইল আসল। চান্দ আছে তাই সুরও আছে। এমন রাতগুলোয় উপেন সিংহর ভিটেতে এসে হাজির হোত মধু। দূর থেকেই শোনা যেত দোতরা বাজিয়ে সুর ধরেছে উপেন সিংহ, ওকি গাড়িয়াল ভাই, কত রব আমি পন্থের দিকে চাঞা রে।  
সুরের টানে চাঁদটা যেন মাটির কাছে নেমে আসত। যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। ফিনকি দিয়ে ওঠা জ্যোৎস্নায় ভেসে যেত মাঠঘাট। সেই স্রোতে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে যেত মধু। আহা, সেসব কবেকার কথা!

—নিরাদা, হেই নিরাদা, কোটে গেলু রে?  
যদিও ব্যবসার এই ভর-ভরন্ত সময়ে কোথাও যাওয়ার মতো বিলাসী নিরাপদ সাহা নয় তবু বাইরে থেকে এই ডাক দেওয়াটা জরুরি। আড়ালে আবডালে লোকজন যতই কুকথা বলুক  মধু বর্মণ এখন কাউয়াখালির একজন তালেবর মানুষ। সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার মতো মুরোদই যখনই নেই তখন মদের আড্ডায় তো সেই প্রশ্ন ওঠেই না। মধুও সেই প্রশ্রয় দেয় না। মদ খুব বিপজ্জনক বস্তু, ভিতুকেও উসকে দিয়ে সাহসী করে তুলতে পারে। নেশা কেটে গেলে যদিও বাঘ ফের ইঁদুর হয়ে যাবে কিন্তু অপমানটা তো রয়ে যাবে। সচরাচর এখানে আসে না মধু, হুকুম করলে নিরাপদ গিয়ে বোতল পৌঁছে দিয়ে আসে কিন্তু আজ সেই সময়টুকু ছিল না। জমিতে শুয়ে চাঁদ দেখতে দেখতে এমন তৃষ্ণা অনুভব করেছিল যে চলে না এসে উপায় ছিল না। 
একডাকেই শশব্যস্ত হয়ে ছুটে আসে নিরাপদ, তোমার মাল তো নাই মদুদা! 
—ক্যান, ইস্টকৎ রাখিন নাই ক্যান?  
—তুমি তো খবর দ্যাও নাই! র‌্যাড হইলে ঝামেলা হবি। লাল মালের আইন খোব কড়া। 
নিরাপদর কথায় চিন্তায় পড়ে যায় মধু। যদিও দিশি সহ্য করার অভিজ্ঞতা লিভারের রয়েছে কিন্তু সময় বদলালে মানুষই যখন বিলকুল বদলে যায় তখন লিভারও কি পুরোনো কথা মনে রাখে? তাহলে কি ফিরে যাবে মধু!

আকাশের দিকে আড়চোখে তাকায় মধু, চাঁদটা বাঁশঝাড় পেরিয়ে অনেকটা উঠে এসেছে। নিরাপদর উঠোনে ছায়া পড়ছে মধুর। এই ছায়াকে সঙ্গে নিয়ে খালি পেটে একা একা বাড়ি ফেরা কঠিন হবে।
—আজি দেশিই খামো।  
মধুর প্রস্তাবে বিড়ম্বনায় পড়ে যায় নিরাপদ। কিন্তু মধুকে ফেরানোর মতো সাহস কোথায়! 
—তাইলে এইহানে একটু খাড়াও।  
অন্য কেউ এভাবে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখার দুঃসাহস দেখালে নির্ঘাত তার ভিটেমাটি জব্দ করার ফন্দি আঁটত মধু কিন্তু এক্ষেত্রে পরিস্থিতি ভিন্ন। নিরাপদর উঠোনে বসে যারা মদ খাচ্ছে তাদের সামলানোর জন্য যে এই অপেক্ষা সেটা জানে মধু। মৌতাতে বিঘ্ন ঘটানোর জন্য নিশ্চয়ই লোকগুলো গালাগালি করবে, তা করুক। মধুর কিছু যায় আসে না। আড়ালে তো নোকে রাজার মায়েক-ও ডাইনি কয়। 

বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে উদয় হয় নিরাপদ। মধু দেখে উঠোনের ওপর খাটিয়া পাতা, বোতল-গ্লাস সব প্রস্তুত।
—মুই ঘরোত বসিমো।  
মধুর এহেন আবদারে অবাক হয় নিরাপদ। 
—ঘরে গোরোম লাগবে। এইহানে বইসা খুলা হাওয়ায় ফাইন লাগবে।  
—তর ফাইনের গুষ্টি কিলাই। আজি ঘরোত বসি খামো। 
মধুর মেজাজ দেখেও ভয় পায় না নিরাপদ।
—ঘরে বসা যাবে না মদুদা। আমার মেয়ে আইছে, বাচ্চা হবে।  
এই কথার পর আবদারে বহাল থাকাটা মানায় না। ততটা অমানবিক মধু নয়। তবু নিরাপদ মিথ্যা বলছে কিনা যাচাই তো করে নিতেই হয়। চাঁদের ফটফটে আলোয় নিরাপদর মুখের প্রতিটা রেখা, বিশেষ করে চোখদুটো যখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

মধুকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বিব্রত হাসি হাসে নিরাপদ।
—চাদ দ্যাখবা আর মাল খাবা।   
যে বস্তুকে এড়াতে চাইছে মধু সেটার লোভই কিনা নিরাপদ দেখাতে চাইছে! বিরক্ত হয় মধু। 
—ঠিকাছে, তোকও কিন্তু আজি মোর সংগে খাওয়া নাগিবে? এবার বিরক্তি ফুটে ওঠে নিরাপদর চোখে মুখে, মাল না খেয়েই কেঁচোটা কী মাতলামো শুরু করলো! এই লোকটার জন্য আজ অনেক লোকসান হয়ে গেল। মৌতাতের মাঝখানে তুলে দেওয়ায় মানুষগুলো দাম দিয়ে যায়নি, বলেছে পরের দিন দেবে। আদৌ কি দেবে? মধু নিজের মদের দাম দিলেও নিরাপদরটা নিশ্চয়ই দেবে না। নিজের টাকায় খেতে হলে তো নিরাপদর পুঁজিই চৌপট!

মধুর অভিজ্ঞ চোখ এই বিরক্তি খুঁজে নিতে ব্যর্থ হয় না। শালা, সাউয়ের বাচ্চা! কিন্তু তমাক আজি ছাড়া যাইবে না। দিশির সংগে কী মিলাইবা সেইটা খায়া মরি আর কী! 
—ভাবিস না নিরাদা, তর পাইসা মুই-ই দিমো। লস হয়া থাকিলে পুষাইয়াও দিমো। আজি মনটা একা একা মদ খাবার চাছে না।  
প্রথম গ্লাসটা শেষ করতে গিয়ে বিষম খায় মধু, কী ব্যাপার! বাংলু কবে থিকে এত কড়া হইল! সত্যিই কি কিছু মিশিয়ে দিয়েছে নাকি নিরাপদ?  আড়চোখে তাকিয়ে নিরাপদর গ্লাসও খালি দেখে স্বস্তি পায় মধু, হয়তো খালি পেট জন্যই এত কড়া লাগছে?  

চাঁদ এখন মাথার ওপর। ঘাড় না হেলালে চোখে পড়ছে না। মধুর দায় পড়েছে দেখার। যে যার ডিউটি করুক। মধু মদ খেতে এসেছে, খাবে। চাঁদ আলো বিলিয়ে বিলিয়ে এক সময় ফুরিয়ে যাবে। তাকে আদর করে নিচে ডেকে আসন পেতে বসানোর মতো কেউ নেই। 
—চান্দের গায়া কালা কালা ওইগুলা কী মদুদা?  
নিরাপদর প্রশ্নে চমকে ওঠে মধু, নিরাপদ কি চাঁদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে নাকি! কোন সাহসে? জানে না চন্দ্রদোষ খুব খারাপ? যাকে ধরে তাকে একেবারে পথের ভিখিরি বানিয়ে ছাড়ে। 
—মাটি।  
—ওই মাটিতে চাষ করা যায়? 

প্রশ্নটা শুনে হো হো করে হেসে ওঠে মধু বর্মন। পায়ের কাছে বসে থাকা নিরাপদর পিঠে আলতো করে লাথি মেরে বলে, খালি লোভ, না? কী করিবু দাম জানিয়া, কিনিবু?  
মধুর মেজাজ খুশি করতে পেরে আহ্লাদে লুটিয়ে পড়ে নিরাপদ।
—আমি গরিব মানুষ, চান্দের মাটি কেনার টাকা কুনহানে পামু!
—টাকা-পৈসা নাগিবে না। মহাদ্যাবক কইয়া একোটা বেবস্থা করি দিমো। 
এহেন প্রস্তাব পেয়েও খুশি হয় না নিরাপদ।
—চান্দের মাটি পাওয়া গেলে মহাদ্যাব থোড়াই আমারে দিবে! নিজেরাই লুটপাট কইরে খাবে।  
নিরাপদর কথাটা আচমকা বুকে বেঁধে মধুর। ‘নিজেরা’ বলতে কাদের বোঝাতে চাইছে নিরাপদ? কার জমি লুটপাট করে খেয়েছে মধু। রীতিমত নগদ দিয়ে কিনেছে। হতে পারে কম টাকায় কিনেছে, তবু তো জমির মালিক টাকা হাতে পেয়েছে, অন্যরা তো একটা পয়সাও ছোঁয়াতো না। 

মধু টের পায় দুপুরের রাগটা ফের ফিরে আসতে চাইছে কিন্তু নিরাপদর ওপরে রাগ দেখিয়ে কী হবে! বরং মাথার ভেতরে মদটা যে টুং টাং বাজনা বাজাতে শুরু করেছে সেটা বন্ধ হয়ে যাবে। যে ক্লান্তিটাকে বহুকষ্টে রুখেছে মধু সেটা ফিরে আসবে। সারা রাত জ্বালিয়ে মারবে, ঘুমোতে দেবে না।
নিজেকে সামলাতে আকাশের দিকে তাকায় মধু, চোখ রাখে চাঁদের চোখে, নিজের অজান্তে গলা থেকে সুর বেরিয়ে আসে—সোনার চান্দ, চান্দ রে, তরে হারাইলাম নদীতে। নিমের নিচে বইসাছিলাম, নিমের চিরা পাতা, কায়োঁরে হরিয়া নিলো সোনা মুখের কথা…
গান থামিয়ে আকাশের দিকে তাকায় মধু, গানটা কি চাঁদ চিনতে পেরেছে? একতিল নেমেছে নিচে? নাকি উপেন সিংহ ছাড়া চাঁদটাকে নামানোর সাধ্য কারো নেই?

গান থেমে যেতেই নিরাপদ সাহা বিরক্ত স্বরে হুকুম করে, থামলি ক্যান? সুর ধর, কদ্দিন পর তোর গান শোনলাম!
  এহেন তুই-তোকারিতেও বিরক্ত হয় না মধু। নিরাপদকে হুকুম করে, তিন-চার বোতল মাল ধরি আন, তার বাদে হোবে।
একছুটে ঘরে গিয়ে বোতল নিয়ে আসে। দুটো বোতল বগলে গুঁজে মধু হুকুম করে, চল।
নিরাপদ অবাক হয়, কোথায়!
—গান শুনিবার চাছিস, আবার কইস কোটে? চল, আজি তোক দেখামো গান কাক কয়।

শেষ রাতে কি ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছিল? বৃষ্টিধারা কি সব পাপচিহ্ন মুছে দিতে পেরেছে? নাকি বৃষ্টির কারণে নয়, চাঁদের চোখের জলে মাটি ভিজেছে? সেই অশ্রুধারা কি মাটির সাতহাত নিচে অবধি পৌঁছতে পেরেছে? উপুর হয়ে শুয়ে থাকা মধু বর্মন কি জলের স্পর্শ পেয়েছে?
সব উত্তর চাঁদ জানে।   
 


অলোক গোস্বামী কথাসাহিত্যিক। তিনি উত্তরবঙ্গের ত্রিবৃত্ত পুরস্কারসহ বেশ কিছু পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি কলকাতায় বসবাস করেন।

menu
menu