প্রত্যাবর্তন
দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায়
রইল না, রইল না
হায়রে আমার নানা রঙের দিনগুলি...
—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বৃষ্টির রাতে পুলিশের গাড়ি গল্প লেখার জন্য খুব জম্পেশ উপকরণ। দু’তিনটে চরিত্র এনে কোনরকম একটু নাড়াচাড়া করতে পারলেই আস্ত একটা থ্রিলার গল্প বেরিয়ে আসে থলে থেকে। আমার গল্প লেখার কোনো ইচ্ছে ছিল না। আমি সামান্য কসমেটিক্সের ব্যবসায়ী। সারাদিন এসিরুমে থাকলেও রাতে লোকাল বাসে করে ফিরতে গিয়েই দম অর্ধেক বেরিয়ে গেছে। এখন আমার ইচ্ছে একটা শান্তিপূর্ণ ঘুমের। অন্তরীক্ষে কে যেন আমার মনোবাসনা টের পেয়েছিল। আকাশ ভেঙে বৃষ্টির ব্যবস্থাও করে দিয়েছিল। কিন্তু কোনো এক থ্রিলার গল্পের লেখকের মনোবাসনা পূর্ণ হতে গিয়ে এখন এক পুলিশের গাড়ি বাসার আশেপাশে কোথাও এসে গগণবিদারী চিৎকার শুরু করেছে।
কিছুক্ষণ চেষ্টা করেছিলাম কানে বালিশ চাপা দিয়ে অপ্রাপ্তবয়স্ক ঘুমটাকে পরিণতি দান করতে। কিন্তু শেষরক্ষা হলো না। অসহ্য হয়ে একপর্যায়ে চোখ মেলতে বাধ্য হলাম। রোডলাইটের আলো থাইগ্লাস ভেদ করে সমস্ত ঘর ভিজিয়ে দিয়েছে। ঘাড়টা আলতো কাত করে পাশে শুয়ে থাকা গিন্নীর দিকে তাকালাম। পুলিশের গাড়ির দানবীয় চিৎকার উপেক্ষা করে দিব্যি ঘুমোচ্ছে। গালটা ঈষৎ হা হয়ে আছে। গ্রীষ্মের রাতে পরে থাকা কিছু নামমাত্র পোশাকের অবস্থাও তথৈবচ। বেশ বিরক্ত লাগল দেখে। মশারি থেকে বেরিয়ে সোজা চলে এলাম বারান্দায়।
৫ তলার বারান্দা থেকে রাস্তার মানুষজনকে বেশ ছোট দেখায়। এখন অবশ্য এই মাঝরাতে লোকজনও তেমন কেউ নেই। শুধু এক পুলিশের গাড়ি আর তাকে ঘিরে জনাচারেক লোক। একজন পুলিশ গাড়ি থেকে খানিকটা দূরে ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে আছে। এত উপর থেকে মুখটা ঠিক দেখতে পেলাম না। তবে ছাতার আড়াল থেকে কয়েক সেকেন্ড পরপর ধোঁয়া বেরোতে দেখে লোকটার ভাবলেশহীন মুখটা কল্পনা করে নিতে কষ্ট হলো না। আরেকজন পুলিশ গাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। রেইনকোটটা বৃষ্টির জলে চকচক করছে। লোকটার সামনে কোনোপ্রকার ছাতা বা রেইনকোট ছাড়াই দুটো কমবয়সী ছেলেমেয়ে দাঁড়ানো।
সম্ভবত কোনো উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হচ্ছিল। একপর্যায়ে পুলিশ ছেলেটার কলার খামচে ধরল। এটা আমাদের পুলিশসমাজের খুব বড় একটা গুণ। এদের হিসেবে সবচে দাগী আসামী হলো রাস্তায় ঘুরতে বেরোনো হংসমিথুন। চুরি, বদমায়েশি, খুনের ব্যাপারে ছাড় চলবে, কিন্তু জনসম্মুখে প্রেমপ্রদর্শন চলবে না। দেশের সম্মানটা সবার আগে। সারারাত ধরে এরকম যুগলের কাছ থেকে যথেচ্ছ অর্থ সংগ্রহ করে সকালে খাসির মাংস কিনে বীরদর্পে বাড়ি ফেরে!
ছেলেমেয়েদুটো সম্ভবত এই পাড়ারই। নইলে এই রাতদুপুরে বাইরে থেকে কারও এই আবাসিক এলাকায় ঘুরতে আসার কথা নয়। মেয়েটা হয়তো আমার মেয়ের চেয়ে বছর চারেকের বড় হতে পারে। রাত্রিবেলায় হয়তো ঠিকঠাকই খেয়েদেয়ে ঘুমোতে গেছিল। পরে বেলকনির সঙ্গে লাগানো কন্সট্রাকশনের মই বেয়ে নেমে এসেছে। বাকি পথটা তো বন্ধনহীন গ্রন্থিই বেঁধে দিয়েছে। মেয়েটার বাবা হয়তো আমার মতোই নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। কোনো অঘটন না ঘটলে সকালে জেগে উঠেও দেখবে, কন্যা তার স্নান সেরে এসে ভিজে চুলেই পড়তে বসে গেছে।
কী এক দমকা হাওয়া যেন স্মৃতির ওপর থেকে একরাশ ধুলো সরিয়ে দিল। বেলার সঙ্গে তখন আমার নতুন বিয়ে হয়েছে। পরিবার থেকেই দেখেশুনে বিয়ে দিয়েছিল। অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ যে সবসময় খারাপ হবে এমন কোনো কথা নেই। এক অসাধারণ অ্যারেঞ্জ ম্যারেজের হাত ধরেই অপরূপা বেলা হাত রেখেছিল আমার হাতে। বিয়ে-বৌভাতের কোনো অনুষ্ঠানে গেলে অনেকগুলো মুগ্ধ দৃষ্টি বেলার ওপর ঘুরপাক খেত সেটা দিব্যি টের পেতাম। আমার বন্ধু-বান্ধবরা তো মাঝেমধ্যে ইয়ার্কি করে ওকে বেলা বোস বলেও ডাকত।
বিয়ের মাসদেড়েক পরে আমরা এই ফ্ল্যাটে এসে ওঠি। এই এলাকাটা শহর থেকে কিছুটা বাইরেই। তখন নতুন নতুন এখানে আবাসিক এলাকা গড়ে উঠতে শুরু করেছে। বড় সাইজের বিল্ডিং এ পাড়ায় তখন এই একটিই। বেলার খুব ইচ্ছে ছিল বারান্দায় দাঁড়িয়ে শহর দেখবে। আমারও আপত্তি ছিল না। এজন্য দুজনে এসে আস্তানা গেড়ে বসি এই ফ্ল্যাটে। পুরো একবছর ধরে পাই পাই করে জমানো সমস্ত টাকা এক করেও কুলোতে পারিনি। শেষমেশ সমস্তটা পরিশোধ করতে বাবার কাছ থেকেও কিছু টাকা ধার নিতে হয়েছিল।
আমি তখন নিউমার্কেটের সবচে বড় গ্রোসারি শপের ম্যানেজার। আয়-ইনকাম মোটামুটি ভালোই ছিল। আমার তখন জীবনে একটিই জগৎ। বেলা। সারাদিন চোয়াল শক্ত করে কাজ করে একছুটে বাড়ি ফিরে আসতাম। সারাদিনের ক্লান্তিকে পথেই ফেলে রেখে আসতাম। বেলাও যে ভেতরে ভেতরে বেশ আকুল হয়ে থাকত সেটা বেশ টের পেতাম। তবে আমাকে সে বুঝতে দিতে চাইত না। রাজ্যের গল্প করতে করতে দুজন লম্বা সময় ধরে ডিনার করতাম।
তবে, মূল ব্যাপারটা শুরু হত এর পরে। After dinner walk a mile কথাটাকে আদর্শ ধরে দুজনে বাসায় তালা মেরে নেমে পড়তাম রাস্তায়। আগেই বলেছি, এ এলাকায় তখন নতুন আবাস গড়ে উঠছে। রাত ৯টার পরেই তাই রাস্তা ফাঁকা হয়ে যেত। শুধু আমি আর বেলা। বেলা আর আমি। হাতে হাত রেখে নিশ্চুপে দুইজন পার করে দিতাম ক্রোশ রাস্তা। এক অসাধারণ নীরবতাকে সঙ্গী করে সহস্র বাক্যালাপ করতাম দুজনে ভেতরে ভেতরে। নেশাতুরের মতো ঘুরতে ঘুরতে দু’জনে ঠিক আবার এসে ফিরতাম নিজেদের নীড়ে।
অতখানি হাঁটার পর আবার সিড়ি ভেঙে পাঁচতলায় ওঠা সহজ কথা না। হাঁসের মতো হাপাতে থাকতাম দুজনেই। কোনোরকমে ঘামে ভেজা কাপড় ছেড়ে ভাইবোনের মতো পাশ ফিরে শুয়ে পড়তাম দুজনে। এরপর তলিয়ে যেতাম অতল ঘুমের দেশে। উহু, এখানেই নটে গাছ মুড়োতো না। বরং আসল গল্পের শুরু এখানেই। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যেত আমার। ঘাড় আলতো বাঁকিয়ে বেলাকে দেখতাম। যথারীতি দেখতে পেতাম গালটা ঈষৎ হা করে ঘুমাচ্ছে। চাঁদের আলো চুরি করে ঘরে ঢুকে বেলার শরীর বেয়ে পিছলে পড়ত।
এরপরেও পাশে ধর্মরাজের মতো চুপ করে শুয়ে থাকা নির্ঘাত অধর্ম। আমিও থাকতাম না। দা ভিঞ্চির মতোই তুলি নিয়ে এগোতাম শূন্য ক্যানভাসের দিকে। পরম মমতায় আঁচড় কাটতাম আমার প্রিয় ক্যানভাসে। ঠোঁট ছুঁয়ে যেত শরীরের প্রতিটা স্পর্শকাতর খাঁজে। ঘুমের ভেতর এমন মধুর আক্রমণে শিউরে উঠত বেলা। পাগলপ্রায় হয়ে আঁকড়ে ধরত আমায়। খাঁচায় বন্দী সিংহীর মতো গম্ভীর গর্জন অণুরণিত হতো ঘরের কোণে কোণে। একপর্যায়ে শরীরকে শূন্যে তুলে দিয়ে বিছানা খামচে ধরে রাগমোচন ঘটাত সে।
মদনদেবের এমন প্রাণপণ উপাসনার পরে পঞ্চশর বিদ্ধ হতে সময় লাগেনি। বিয়ের দেড় বছরের মাথায় আমাদের কোলে আসে ঋতি। পুরোনো দিনলিপির পাতাগুলোকে ছিঁড়ে নতুন পাতা জুড়ে দেয়া হলো। আমার আর বেলার আলাদা একটা জগৎ গড়ে উঠল। ঋতি। রাতে ফিরে মেয়েকে কোলে তুলে নেয়াই হলো সারাদিনের মূল আকর্ষণ। ধীরে ধীরে এলাকায় রাত্রিবেলায়ও জনসমাগম বাড়তে থাকল। শুধু আমি আর বেলাই হারিয়ে গেলাম ওই রাতের রাস্তা থেকে।
গভীর রাতে আমার ঘুম ভাঙতে থাকল ঠিকই। আলতো করে ঘাড় বাঁকিয়ে চোখে পড়ত ঋতির নির্লিপ্ত মুখ। চিন্তিত ভঙ্গিতে মেয়ের ঘাড়ে গলায় হাত দিয়ে ঘামছে কি না দেখে নিতাম। মেয়েটা আসলেই প্রচুর ঘামত। ভীষণ দায়িত্বশীল পিতার মতো হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতাম ত্রস্তভঙ্গিতে। সে বাতাস কিছুটা হয়ত ঋতিকে ছাপিয়ে ঋতির মায়ের মুখে গিয়েও পড়ত। পাখার ঠান্ডা বাতাসে মেয়ে আমার পরম সুখে হারিয়ে যেত ঘুমরাজ্যের আড়ালে। কিছুদিন পর ঘরে এসি লাগানোয় হাতপাখার প্রয়োজনও ফুরাল। প্রয়োজন ফুরাল আমারও রাতে জেগে ওঠার। বিছানার অপরপ্রান্তে শুয়ে থাকা আমার প্রেয়সী দিনে দিনে হয়ে উঠতে থাকল ভীষণ অচেনা কেউ।
পুরনো অভ্যাস খুব সহজে ছাড়া যায় না। প্রথমদিকে ঋতিকে টপকে গিয়ে বেলার সঙ্গে মিলিত হতাম। সপ্তাহে দুয়েকবার। ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম এই ক্যানভাস আমার চেনা ক্যানভাস নয়। আমার ভেতরের দা ভিঞ্চিও মরে যেতে থাকল সময়ের পরিক্রমায়। সপ্তাহ গিয়ে ঠেকল মাসে। মাস গিয়ে বছরে। সর্বশেষ কবে বেলার বুকে হাত রেখেছি এখন তো আর সেটাও মনে পড়ে না। মেয়ে বড় হলে তাকে আলাদা ঘর দিয়ে দেয়া হলো বটে, কিন্তু আমার আর বেলার মাঝের সেই পারাবার পার করার মতো ক্ষমতা বা সাহস আর অবশিষ্ট রইল না একটুও।
ঋতিকে ক্যাডেট কলেজে পাঠানো হয়েছে তিনমাস হলো। বাসায় এখন আর কোনো তৃতীয় ব্যক্তি নেই। নিউমার্কেটের সবচে বড় গ্রোসারি শপটার মালিক এখন আমি। সারাদিন দোকানে বসে স্টার স্পোর্টসে পুরোনো ম্যাচের হাইলাইট দেখা ছাড়া বিশেষ কোনো কাজও নেই। ইচ্ছে করলে বিকেলেই ঘরে ফিরতে পারি। ফিরি না। ইচ্ছে করে না। রাতে খাওয়ার পর নিচে নামার কথা তো কল্পনাতেও আসে না। যদিও এখন বিল্ডিং এ লিফট আছে। খেয়েদেয়ে জি বাংলা দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ি। আর ঘুম ভাঙে না। এক্কেবারে সকালে বেলার খুন্তির আওয়াজে জেগে উঠি।
বারান্দায় দাঁড়িয়েই কল্পনায় একবার মনে করার চেষ্টা করলাম বেলার মুখটা। ঠিকঠাক মনেও করতে পারলাম না। কতদিন আবেগভরে ও মুখের পানে চাইনি তার ইয়ত্তা নেই। চৌদ্দ বছর আগের যৌবন আর নেই এটা ঠিকই। তবে মুখে বয়সের ছাপ পড়েনি। পড়েছে সংসারের সমস্ত ভার নিজের কাঁধে তুলে নেয়ার ছাপ। পড়েছে আমার চূড়ান্ত অবহেলার ছাপ। দীর্ঘদিনের দাম্পত্যকে নেহাতই একটা অভ্যেস বানিয়ে ফেলার ছাপ। এসব ছাপের আড়ালে ঠিকই সেই ২২ বছরের উদ্দমযৌবনা বেলা লুকিয়ে আছে।
বর্ষাতি পরা পুলিশটা বোধহয় খুব একটা স্বাস্থ্যবান ছিল না। বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে ছেলেটা পুলিশটাকে জোরে একটা ধাক্কা দিল। এমন আকস্মিক আক্রমণ সম্ভবত লোকটা আশা করেনি। হতবিহ্বল অবস্থা কাটিয়ে উঠতে উঠতে ছেলেমেয়ে দুটো পগারপার। এ পাড়ার বিল্ডিং এর মধ্যকার গলিঘুপচি নিশ্চয়ই এদের চাইতে পুলিশগুলো বেশি চেনে না। সেটা আন্দাজ করেই আর পেছনে তাড়া করল না। বেশ একটা জোর হাসি হেসে আমি ফিরে এলাম ঘরে।
রোডলাইটের আলো সগর্বে ঘরে প্রবেশ করে পিছলে পড়ছে বেলার গা বেয়ে। দীর্ঘদিনে জেলে কাটিয়ে মুক্তি পাওয়া আসামীর মতো সতেজ মস্তিষ্কে মশারি সরিয়ে বিছানায় গিয়ে উঠলাম। বেলার ঈষৎ হা করা মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলাম নির্নিমেষে। হারিয়ে যাওয়া ক্যানভাসকে আবারও দেখতে পেলাম উদ্ভাসিত আনন্দে। এরপরে গল্পের সমস্ত নটেগাছকে নিজের হাতেই মুচড়ে দিয়ে ঠোঁট ডোবালাম ১৩ বছর পরে ফিরে পাওয়া আমার রানির ঊরুসন্ধিতে।
পুলিশের গাড়ির পাশবিক চিৎকার কখন যে থমকে গেছে টেরই পাইনি!
সমর্পণ বিশ্বাস গল্পকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা। যন্ত্রকৌশল বিভাগে অধ্যয়নরত। তিনি ঢাকায় থাকেন।