নগরে আগুন লাগলে
আমেরিকাকে স্থবির করে দিয়েছে মহামারী করোনা। ইতোমধ্যে আমেরিকায় সাড়ে তিনকোটি লোক চাকরি হারিয়েছে। সরকার যথাসম্ভব চাকরিহারাদের সহায়তা দিচ্ছে। আমার ওপারের দাদা রঘুপতির চাকরি যায়নি। তিনি বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছেন। ধর্মকর্ম ভালোই পালন করেন। সময় খুবই খারাপ। তাই প্রায় সবার সঙ্গেই অকারণ কথাবার্তা বন্ধ করে দিয়েছি। নিজেকে এবং পরিবারকে নিরাপদে রাখাই এখন প্রধান কাজ।
আমার দাদার কথারোগ আছে। ‘কেমন আছেন দাদা?’ এই প্রশ্নের জবাব তিনি পাঁচ মিনিটের আগে শেষ করতে পারেন না। ‘ভালো আছি’ অথবা ‘ভালো নেই’—একথা সরাসরি বলেন না।
যাই হোক। চাকরি হারিয়ে গৃহবন্দী হয়ে আছি। দাদা ফোন করেছেন। ধরব কি ধরব না করতে করতে ধরলাম।
‘খবর কিছু শুনেছেন রাজেশ বাবু? মক্কা শরীফ তো বন্ধ করে দিয়েছে।’ এ কথার জবাবে কী বলব ভেবে পাচ্ছি না। তিনি তো নামাজ পড়তে মক্কায় যাবেন না। করোনার কারণে সব কিছুই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। তো, মক্কা শরীফ বন্ধ করে দিলে তার ক্ষতি কী?
‘করোনায় নিউইয়র্কে চারজন বাংলাদেশি মারা গেছে।’ খবরগুলো দাদা বেশ খোশ মেজাজেই আমাকে পরিবেশন করছে বলে মনে হলো। বিষয়গুলো যে আমিও জানি বা জানা সম্ভব সে রকম কোনো পাত্তাই তিনি দিচ্ছেন। যেন আমাকে পরিবেশন করতে পারলেই একটা কৃতিত্ব নিতে পারবেন—
কোনো কথারই জবাব না দিয়ে চুপ করে আছি। দাদা বলেই যাচ্ছেন। যখন তার বলা শেষ হলো তখন ফোন রাখলেন।
আজ রোববার। দাদা প্রতি রোববার এখানকার ইস্কন মন্দিরে যান। আমার আজ জানতে ভীষণ ইচ্ছে করছে দাদা মন্দিরে গিয়েছেন কিনা। ফোন করব কি করব না এই নিয়ে অনেকক্ষণ দ্বিধায় থেকে শেষমেশ ফোন করলাম।
‘দাদা আজ ইস্কনে যাননি?’
আমার ওপারের দাদা রঘুপতি ভারী একটা নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। ফোনের ও প্রান্ত থেকে সে নিঃশ্বাসধ্বনি ফোনের এ প্রান্তে আমার কান অব্দি পৌঁছে গেল। বললেন—‘কী করে যাব? ইস্কন তো বন্ধ করে দিয়েছে!’
আমি এমন একটা ভাব করলাম যেন এইমাত্র ভিন গ্রহ থেকে নেমে এসেছি। এই মর্তলোকে কোথায় কী ঘটছে তার কোনো খবরই জানি না।
‘বলেন কী দাদা? ইস্কন বন্ধ করে দিয়েছে!’
বিস্ময় প্রকাশের অভিনয় করে শুধালাম, ‘আপনি কিছু বললেন না?’
মিনমিন করে দাদা জবাব দিলেন, ‘আমি কী বলব? করোনার জন্য বন্ধ করে দিয়েছে।’
করোনার গ্রাস দেখে আমি হতবাক। ইস্কনকেও গিলেছে!
যিনি মক্কা শরীফ বন্ধ করে দিয়েছে শুনে উৎফুল্ল তিনি ইস্কন বন্ধ করে দিয়েছে শুনে মনোক্ষুন্ন কেন?
বিষয়টি জানার জন্য সার্চ কমিটিতে প্রশ্ন করব কি না ভাবছি।
তপন দেবনাথ কথাসাহিত্যিক এবং সাংবাদিক। ২০০১ সালে থেকে তিনি সপরিবারে লস এঞ্জেলেসে প্রবাস জীবনযাপন করছেন। রাজনীতির মহাকবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার ২৭তম গ্রন্থ। বর্তমানে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ঠিকানা, বাংলাদেশ প্রতিদিন ও দৈনিক যুগান্তর-এর লস এঞ্জেলেস সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেন।